গল্প পড়ার গল্প
নতুন সাহিত্য ভাষার নির্মাতা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
হ্যাঁ, সন্দীপন পড়তেই হয়। না পড়লে শেখা হবে না, তা জেনেছিলাম। যেখানে না লিখলে লেখক হওয়া যায় না, সন্দীপন সেখানে না লিখেই লেখক। আমি সন্দীপন পড়েছি, সেই ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’র গল্পগুলো থেকে সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য, আরো সব গল্পগ্রন্থ, আরো সব সাহিত্যপত্রে। খুব তাড়াতাড়ি সেই এক অন্ধ স্কুলে বাজল ছুটির ঘণ্টা। ‘হিরোসিমা মাই লাভ’ কিংবা ‘স্বর্গের নির্জন উপকূলে’ আমার দুই প্রিয় উপন্যাস। এই দুই উপন্যাসেও তিনি ছুঁয়েছেন জীবনের অনিবাযর্তা, নিঃশব্দ হনন, নিঃশব্দ মৃত্যুকে। যেমন ছুঁয়েছিলেন ‘বিজনের রক্তমাংস’, ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’, ‘মীরাবাঈ’ থেকে ‘ভারতবর্ষ’, ‘সোনালি ঈগল’ কত গল্পে।
মৃত্যুকেই আঁকতে আঁকতে তিনি জীবনের স্তব্ধতার দিকে পৌঁছে গেছেন কালান্তক অসুখে। টের পেয়েছিলেন ঘণ্টা বেজে গেছে, এবার ঘুমন্ত বিড়ালের লেজে পা দেবে অন্ধ শিশুরা। তাতেই বিড়াল খ্যাঁক করে উঠে কামড়ে দেবে তার হাঁ-এর ভেতরে ঢোকা ইঁদুরের মাথা। সন্দীপন তাঁর কালান্তক অসুখের বর্ষপূর্তি পালন করেছিলেন। চিয়ার্স হয়েছিল। এই আশ্চর্য ঘটনা এই কলকাতা শহরেই ঘটেছিল। সন্দীপনদা তাঁর সদর দরজা খুলে দিয়েছিলেন আর কান পেতে ছিলেন মৃত্যু তার বুটপরা পা নিয়ে মশমশিয়ে ঢুকে পড়বে তাঁর ফ্ল্যাটের ভেতর। যে বই নিয়ে তাঁর প্রবেশ আমাদের সাহিত্যে, সেই ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’ গ্রন্থের দ্বিতীয় গল্প, ১৯৬২-তে লেখা ‘আট বছর আগে একদিন’, সেই গল্পেও তো শেষে প্রায় মৃত্যুর ভয়ে আতঙ্কিত জলের বূহ্যবন্দি পিঁপড়েটির আর্তচিৎকার শুনতে পায় বিজন। কী হয়েছিল তার?
এক হৃদয়বিদারক প্রত্যাখ্যানের ঘটনা পাঁচ বছর বাদে জানতে পারে বিজন। বিয়ের কনে দেখতে গিয়েছিল দিদি আর মেজদাকে নিয়ে উত্তরপাড়া। সেই মেয়েটির দিকে ফিরে তাকিয়েছে কি তাকায়নি বিজন। তাকে রীতিমতো যাচাই করে নিয়েছিল দিদি। দাঁড় করিয়ে চুল খুলিয়ে হাঁটিয়ে। বিজনের কিছু জিজ্ঞাসা ছিল না। কী-ই বা জিজ্ঞেস করতে পারত সে? পরম উদাসীনতায় সে দিদিকে বলেছিল, ওঁকে এখন যেতে বল। সে চলে যাওয়ার পর দিদি ভেতরে গিয়েছিল। বিজন দেখেছিল জানালার বাইরে পত্রপুষ্পহীন একটি গাছ। কী গাছ? মনে হয়েছিল, সে জিজ্ঞেস করতে পারত কী গাছ ঐটি? ভেতর থেকে দিদি বেরিয়ে এসে বলেছিল, ঘরে সেতার হারমোনিয়াম, বলল, ও গান জানে না, ওর ছোট বোন জানে, সে শেখে, সে নাচও শেখে। সেতারও ওই ছোট বোনই শেখে। তারপর বহুদিন বাদে দেখা হওয়া বন্ধু দুলালের বাড়ি গিয়ে দ্যাখে ঘরে সেতার।
দুলাল বলল, মণিমালার সেতার, ও এখন আর বাজায় না, ছেড়ে দিয়েছে গানও। সে ছিল বসন্তকাল। ঘরে শিমুল ফুল। সেই ফুল দুলাল তার শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে আসে প্রতিবার এই সময়। মণিমালা বিজনকে চিনতে পারেনি। বিজন পেরেছিল। বিজনের মনে পড়ে প্রত্যাখ্যানের দিনটিকে। তাকে মনে ধরেনি, তাই সেতার আর গানের কথা তার দিদির কাছে লুকিয়েছিল মণিমালা। গায়িকা হয়ে এক যুবকের কাছে তা লুকিয়েছিল মণিমালা। দুলালের বাড়ি থেকে ফিরে মণিমালার জন্য নয়, গানের জন্য মূক হয়ে গিয়েছিল বিজন। গান তার প্রাণাধিক প্রিয়। অথচ মণিমালা তা গোপন করেছিল, যদি তাকে পছন্দ হয়ে যায় পাত্রপক্ষের! বিজনের? দিদির কাছে পাওয়া অপমানের শোধ নিয়েছিল মণিমালা এইভাবে। সেদিন কত রাত অবধি সে বসে থাকে খাওয়ার টেবিলে। দেখেছিল, একটি কালো পিঁপড়ে বিশৃঙ্খলভাবে পার হয়ে যাচ্ছে টেবিল।
গ্লাসের জলে আঙুল ডুবিয়ে সে তার চতুর্দিকে একটি শূন্য এঁকে দিল। পিঁপড়ে সেই শূন্যের ধারে ধারে ঘুরতে লাগল তীর বেগে। কী ছটফটানি তার। মাঝেমধ্যে থেমে পড়ে, শুঁড় দিয়ে জল শোঁকে, আবার ঘুরতে থাকে বোঁ বোঁ করে। একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শূন্যের মাঝখানটিতে অপেক্ষা করে। বিজনকে কী ক্ষমাহীন প্রত্যাখ্যান না করেছিল মণিমালা সেই এক প্রাচীন সন্ধ্যায়। প্রত্যাখ্যান করেছিল সে অসত্য বলে। নিজেকে লুকিয়ে। এতকাল পরে বিজন তা জানল। অথচ এখন বিজন বুঝতে পারছে, কী হারিয়েছে সে সেই সন্ধ্যায়। গোপনে কী অপমান না করেছিল সেই মেয়ে, মণিমালা। প্রতিশোধের ইচ্ছা জাগে বিজনের ভেতর। জল শুকিয়ে গেলে বিজন হত্যা করে পিঁপড়েটিকে ধীরে ধীরে। পা ছিড়ল বিজন তার। ছেড়ে দিল টেবিলে। লেংচাতে লেংচাতে পিঁপড়েটি কোনাকুনি পার হয়ে যাচ্ছে টেবিল। আহত পিপীলিকা। যতদিন যাবে পিঁপড়েটির প্রতিরোধ স্পৃহা বাড়বে। হিংসা বাড়বে। বাড়বে অবর্ণনীয় বেদনাবোধ। বিজন মনে মনে বলে, বাড়ুক। আত্মহনন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে ওর প্রতিহিংসা চরিতার্থ হবে না কোনোদিন। মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত ওর সবই মনে থাকবে।
সেই কিংবদন্তি হয়ে ওঠা প্রায় গল্পগ্রন্থ আমি পেয়েছিলাম ১৯৭১-এর শেষে বা বাহাত্তরের প্রথমে। তখন বয়স অল্প। ক্রীতদাস ক্রীতদাসীতে মজে আছি। পড়েছি আর এক তরুণ লেখক তাঁদের সহযাত্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা সেই অসামান্য উক্তি। বাংলা সাহিত্য যদি সত্যবাদী হয়, এই গ্রন্থটির কথা পঞ্চাশ বছর বাদেও উচ্চারিত হবে (স্মৃতি থেকে উদ্ধার যতটুকু হয়)। বাংলা সাহিত্য কেন পৃথিবীর ইতিহাসে সাহিত্যের পাঠক চিরকাল সত্য উচ্চারণ করেছে, না হলে ৫০ বছর বাদে ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’র কথা আবার কেন? সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আমাদের জন্য নতুন সাহিত্য ভাষা নির্মাণ করেছিলেন। সাহিত্য প্রস্তাবে অস্বীকার করেছিলেন সাহিত্যের পুরোনো ভাষা আর নির্মাণকে। গেল গেল রব উঠেছিল সাহিত্যের অভিভাবকদের ভেতর। তাঁর গল্পের ভেতরে তৈরি হতো নতুন নতুন পাঠ। কাহিনী কথনের পরম্পরা ছেড়ে নিয়েছেন নতুন গল্পভাষা। কিন্তু যদি বলি শুধুই গল্পের ভাষা, তা তো নয়। মনে করুন সেই গল্প, ‘ভারতবর্ষ’।
সেই যে ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বরের দুপুর। সেই দুপুরের কথা শোনাচ্ছে রাখি তার স্বামী হেমাঙ্গকে। কিছু নদী থাকে, জোয়ার-ভাটা খেলে না, হেমাঙ্গ তেমনি। তার মনের ছায়া মুখে পড়ে না। যেদিন বাবরি ভাঙা হয়, সেইদিন দুপুরে তাদের বন্ধু, আর্টিস্ট সঈদুল তার স্টুডিওর নিচে, নিজের বেড রুমে মিলিত হতে হতে ধর্ষণই করেছে রাখিকে। রাখি জানত না, কিন্তু সঈদুল নিশ্চয় জানত দুপুরে কী ঘটে গেছে। গম্বুজের মাথা তখনই ভেঙে পড়েছিল। বিবিসি দেখেছিল সঈদুল। পরস্পরে মিলিত হওয়া আর সমস্তটা হিন্দু-মুসলমানের মতো হয়ে যাওয়া এক নয়। ফেরার সময়, ট্যাক্সিতে তুলে দেওয়ার সময়ও ক্ষমা চায়নি সঈদুল। রাখিকে বেডরুমে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সে আত্মরক্ষার কারণে ট্রেঞ্চে ঢোকার মতো করে। তার দুই চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল আগুন ঝরানো বুলেট। তাকেও সে ভেঙেছিল যেন শাবল গাঁইতি দিয়ে, যেভাবে ভাঙা হয়েছিল গম্বুজ। শোধ নিয়েছিল সঈদুল। সে তখন আহত মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। আসলে সেই দুপুরে সঈদুলের বেডরুমেও একটি দাঙ্গা হয়ে গিয়েছিল। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কী ভয়ানক এক মরণের কথা লিখেছিলেন সন্দীপন এই গল্পে। তাঁর দেখার চোখ ছিল আলাদা। একজন আধুনিক মানবিক লেখকের মুখ আমি ওই গল্পে দেখতে পাই। সেই দুপুরের পরে আর কী ঘটেছিল? ভারতবর্ষজুড়ে তখন দাঙ্গা বিস্তৃত হচ্ছিল। নিরীহ মানুষ মরছিল। কিন্তু রাখির ভেতরে সঞ্চারিত হচ্ছিল নতুন প্রাণ। সেই ৬ ডিসেম্বর রাখির কোনো প্রটেকশন ছিল না। পিরিয়ড বন্ধ। সন্তান আসছে। সে সমস্তটা খুলে বলছে হেমাঙ্গকে। ভাবলেশহীন মুখে হেমাঙ্গ শুনে যাচ্ছিল ছয় ডিসেম্বরের দুপুরের কথা। সন্দীপনই এই লেখা লিখতে পারতেন। সন্দীপনদা, সেই ৬ ডিসেম্বরের ভারতবর্ষের জন্য আর একবার মাথা নুয়ে থাকি। আপনাকে না পড়ে এই ভারতবর্ষকে চেনা যায় না।