গল্প পড়ার গল্প

সহজ করে কঠিন কথা বলেন প্রফুল্ল রায়

Looks like you've blocked notifications!

 

প্রফুল্ল রায় আমাদের কৈশোর থেকেই জনপ্রিয় এবং মান্য লেখক।  সেই কবে পড়েছি তাঁর পূব পাবর্তী, নাগাল্যান্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজন, তাদের জীবন নিয়ে উপন্যাস। পড়েছি দেশভাগ নিয়ে তাঁর দীর্ঘ উপন্যাস কেয়াপাতার নৌকা, আন্দামানে উদ্বাস্তু সেটেলমেন্ট  নিয়ে সিন্ধুপারের পাখি, বিহারের অচ্ছুত চামারদের নিয়ে রামচরিত্র। তিনি বাংলা গল্প ও উপন্যাসের পরিধি বাড়িয়েছেন। প্রফুল্ল রায়ের গল্প আমাকে বিন্দুর ভিতরে সিন্ধুর স্বাদ দেয়। মনে পড়ে যায় সেই মেয়েটির কথা যার সাধ ছিল কাশ্মীর যাওয়া( কাশ্মীর), মনে পড়ে যায় সেই শিশুটির জন্মের কথা, পাহাড়ি পথে যার জন্ম হয় (মানুষ), সেই যে বাংলাদেশ থেকে আসা একটি পরিবার যারা ১৯৪৭-এ পারটিশনে ছেড়ে যাওয়া বাড়িটি দেখতে এসেছেন। এক্সচেঞ্জ করে চলে যাওয়া হয়েছিল। নতুন প্রজন্মকে শিকড় চেনাতে এসে প্রবীন মানুষটির ব্যর্থ হওয়া( শিকড় )।

প্রফুল্ল রায় সহজ করে কঠিন কথা বলেন। চরাচর,  কুয়াশা, মাঝি, জননী কত গল্পের কথা মনে পড়ে। দেশভাগ তাঁর লেখার উপর গভীর ছায়া ফেলেছে। আমরা যারা ওপার থেকে এপারে এসেছি, আমাদের শিকড়ের কথা প্রফুল্ল রায় স্মরণ করিয়ে দেন। ফেলে আসা দেশ, নদী, গ্রাম, মানুষ, গাছগাছালির কথা তিনি আমাদের শোনান। এই কথা শুনতেই আমি প্রফুল্ল রায়ের লেখা পড়ি। যে গল্পটির কথা বলছি সেই গল্প তরুণ প্রফুল্ল রায় লেখেন ১৯৫৬-য়। ষাট বছর হয়ে গেল প্রায়, গল্পটি পড়লে যে জীবনের কথা চেনা যায়, সেই চেনা যেন ফুরোয় না। এ হল মেঘনা নদীর গল্প।

মেঘনা, পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, সেই সব অলীকপ্রায় নদীর যে গল্প প্রফুল্ল রায় আমাদের শোনান, তার কোনো তুলনা নেই। হ্যাঁ আমার কাছে অলীকই মনে হয় সেই সব নদী। আমি তো তার রুদ্ররূপ দেখি নি। এত নদী দিয়ে ঘেরা আমাদের সেই জন্মভূমি আমরা তো ফেলেই এসেছি। মেঘনার গল্প হলো মেঘনার বুকে লোক পারাপারের কেরায়া নৌকার এক মাঝি আইনুদ্দির গল্প।  শ্রাবণের আকাশে সোনামুখি মেঘে মেঘে সজল বর্ষার ছায়ালিপি। আকাশের নিচে মেঘমতী মেঘনা। ঢেউ-এ উথালপাথাল সেই গাঙের গর্ভকোষ চিরে কনকপদ্মের মতো বেরিয়েছে ছোট্ট চর, চর বেহুলা।  গিরিগঞ্জের ঘাট থেকে আইনুদ্দি শ্রাবণের এই দুপুরে চর বেহুলায় যাবে মেঘনায় ভেসে।

সন্ধের আগে চর বেহুলার নারকেল কুঞ্জে পৌঁছতে হবে। সেখানে তার অপেক্ষায় থাকবে জমিলা। তার স্বপ্নের কন্যা। তাকে নিয়ে মেঘনা, পদ্মা, আড়িয়ল খাঁ গাঙের পানি ফালা ফালা করে দিয়ে একেবারে সেই দক্ষিণ-শাহবাজপুর। ফুফুর ঘরে গিয়ে উঠবে। তারপরের কথা পরে হবে। এই রকম ভাবতে ভাবতে আইনুদ্দি মেঘনার জলে তার কেরায়া ভাসিয়েছে সবে, পাড় থেকে ডাক এল, এই মাঝি, কেরায়া যাইবা? ঘাড় ঘুরিয়ে আইনুদ্দি দেখল, দুই জন পুলিশ। তারাও যাবে চর-বেহুলা।

তাদের সঙ্গে গেরুয়া কাপড়ে মোড়া একটি নিথরপ্রায় দেহ। আইনুদ্দি একটু শঙ্কিত, দু‘টাকা ভাড়া চেয়ে বসে, তারা তাতেই রাজি। পুলিশের একজন বলল, চর বেহুলার ঘাটলায় নামিয়ে দিতে, দু‘দিন আগে একটি খুন হয়েছে মেঘনায়, তার কিনারা করতেই যাচ্ছে তারা। শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আইনুদ্দির। জমিলাকে নিয়ে সন্ধের আগে গাঙে ভাসবে, তার ভিতরে এই উপদ্রব।  কিন্তু উপায় কী? পুলিশ তো। কেরায়ার মাথায় বাদাম টাঙিয়ে দিল আইনুদ্দি। ছইয়ের ভিতরে দেহটাকে নিয়ে বসেছে দুই পুলিশ। নৌকো চলল। আর তখনই সেই গেরুয়া কাপড়ে মোড়া দেহটি আর্তনাদ করে উঠল, ‘‘আ আ আ, আমারে সড়কি দিয়া মাইরা ফেলাইল, আ আ আ…”।  তা শুনে জলপুলিশ প্রচণ্ড গর্জন করে উঠল, ‘এই চুপ, সুমুন্দির পুত।’ এই গল্প সেই জলযাত্রার। সেই আইনুদ্দির। তার প্রেম আর হিংসার।

যে পৃথিবীর কথা বলেছিলেন প্রফুল্ল রায়, সেই পৃথিবী আমাদের চেনা নয়। কিন্তু মানুষের প্রেম আর হিংস্রতা কিছুই তো অচেনা নয়। একই ঘটনা অন্য পরিবেশে ঘটে যায় সমস্ত কালে। মানুষের আদিমতা নিয়ে এই কাহিনি। আইনুদ্দির মিতা হাসেমের সঙ্গে মেঘনার বুকে এক গভীর অন্ধকারে দেখা হয়েছিল নাওয়ে নাওয়ে ধাক্কা লাগায়। কতদিন বাদে সেই দেখা। দুজনেই গাঙে গাঙে ঘুরে বেড়ায়। হাসেম তার বিবি দেখাতে আইনুদ্দিকে নিয়ে যায় চর বেহুলায়। আইনুদ্দি জারি গান করে। আইনুদ্দি ঢপ গায়। মস্ত বড় কবিদার আর গায়েন। তাকে দেখে হাসেমের শাজাদি, বিবি জমিলা মুগ্ধ। আর আইনুদ্দিও অভিভূত। তার বিয়ে হয় নি।  সে দেখল আলোকলতার মতো সরল দীঘল দেহ জমিলার। কামরাঙা শাড়ি তার দেহ পেঁচিয়ে সাপের রেখা টেনে উঠে গেছে।  জমিলার সারা দেহে মদির কুহক। রাতভোর হাসি ঠাট্টা চলে তিনজনায়। কিন্তু হাসেম তো চুপ। আইনুদ্দির মতো রসের কথা সে জানে না। পরদিন যখন তারা আবার ভেসে যাবে, জমিলা আইনুদ্দিকে বলেছিল আর একদিন থেকে যেতে। এ হল আইনুদ্দির প্রেমের গল্প। জমিলা আইনুদ্দিকে চাইলেও হাসেমকে ত্যাগ করতে চায় না। হাসেম যে তাকে বড় ভালবাসে। কিন্তু আইনুদ্দি ভালবাসার ভাগে বিশ্বাস করে না, হয় হাসেম না হয় সে, একজনকে বেছে নিক জমিলা। 

এ সেই আদিমতার গল্প যেখানে জমিলাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসেমকে বৈঠার ঘায়ে খুন করে মেঘনার জলে ডুবিয়ে দিয়ে নিষ্কন্টক হতে হয় আইনুদ্দিকে। জমিলা তা জানে না। জমিলা শুধু রাজি হয়েছে আইনুদ্দির সঙ্গে গাঙের পানিতে ভেসে যাবে। তার জন্যই শ্রাবণের দুপুরে তার চর বেহুলা যাত্রা। কিন্তু নৌকোর ছইয়ের ভিতরে শায়িত দেহটি যে মাঝে মাঝেই আর্তনাদ করে ওঠে, আমারে সড়কি দিয়া...।

আইনুদ্দির সুখ স্বপ্নে বারবার ঘা মেরে যায় ওই আহত পুরুষ। তাকে নিয়ে চর বেহুলায় যাচ্ছে পুলিশ। কে সে? মেঘনার গভীর জলে ডুবিয়ে দেওয়া হাসেম কি উঠে এল? মরেনি সে?  খুনি আইনুদ্দি ভয় পেয়ে আর আত্মধিক্কারে বৈঠা ফেলে নিজের পাপের কথা বলে ফেলে। সে ভেবেছিল ছইয়ের নিচে হাসেম কাতরাচ্ছে। নিজের পাপের কথা বলে ভিতরে তাকাতে দ্যাখে না সে নয়। অন্য মুখ। অন্য কেউ আর্তনাদ করছে। কিন্তু তখন তো আর উপায় নেই। পুলিশ তার দিকে হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে। গল্প এই। লেখার গুনে এই গল্প হয়ে উঠেছে আদিমজীবনের এক ছবি। এই আদিমতা, ধুসর বিন্দুর মতো অকুল অথৈ মেঘনায় ভেসে থাকা সেই চর, আমাকে সমান মুগ্ধ করে রাখে এত বছর বাদেও । তাঁর কাছে আমরা ঋণী হয়ে আছি।