হুমায়ুন আজাদের নতুন জন্ম
শারীরিকভাবে হুমায়ুন আজাদের (জন্ম ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭, মৃত্যু ১২ অগাস্ট ২০০৪) অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পর জীবিত আমরা উপেক্ষা করতে পারি না তাঁর নতুন জন্মের সম্ভাবনা। সামাজিকভাবে আমরা যেমন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি, সাহিত্যিক বিচারেও রয়েছি এক ধরনের স্থবিরতার ভেতরে। বিগত দিনের সাহিত্যিক অর্জনকে যদি অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব না হয় পরবর্তী সময়ে, তবে তা এক ধরনের স্থবিরতা বৈকি। সাহিত্যিক অর্জন সময়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে না, তার ধারাবাহিক নবায়ন ঘটান সাধক-সাহিত্যিকেরা। ব্যক্তি হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে নিশ্চয়ই উচ্চারিত হয়েছে কিছু সঙ্গত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতা জীবদ্দশায় বিস্মিত করেছে পাঠকশ্রেণীকে; ভবিষ্যতে আরো বেশি তিনি সমাদৃত হবেন- তারও ইশারা মিলেছে।
শিল্পস্রষ্টার প্রয়াণের পরে তাঁর ব্যক্তিকেন্দ্রীক বিচিত্র বৈশিষ্ট্য বিবেচনার আর কোনো অবকাশই থাকে না; সেই অবসরে তাঁর সমগ্র অর্জনের নির্মোহ মূল্যায়ণের একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। যত সময় যাবে ততই এটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, তাঁর নিজের কালে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক, যিনি ঈর্ষণীয় সৃজনশীলতা ও মননশীলতা দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে রচনা করে গেছেন মূল্যবান সব গ্রন্থ।
হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আমার নতুন জন্ম’ অবধারিতভাবে তাঁর জীবনের শেষ বই। আগামী প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত অনধিক ১০০ পৃষ্ঠার এই বইটি তাঁর নিয়মিত পাঠকদের নস্টালজিক করে তোলে। স্বাভাবিক আয়ু পেয়ে স্বাভাবিকভাবে বিদায় নেয়া একজন লেখকের অনুরাগী পাঠকবৃন্দের জন্যেও শেষতম গ্রন্থটি গ্রহণ করা বেদনার। আর হুমায়ুন আজাদ তো অকালে চলে গেলেন, বলা যায় তাঁকে সরিয়েই দেয়া হলো। বর্বরতার বিরুদ্ধে যিনি ছিলেন তীব্র উচ্চকণ্ঠ, তাঁকে চলে যেতে হলো বর্বরোচিত ঘটনারই ধারাবাহিকতায়।
‘আমার নতুন জন্ম’ বইটি ধারণ করে আছে একজন বহুমাত্রিক লেখকের অন্তরঙ্গ কণ্ঠস্বর; সেই স্বরে কখনো ফুটে উঠেছে সামাজিক হতাশা, কখনো প্রকাশিত হয়েছে বেঁচে থাকার বাসনা, ব্যক্তিগত আর্তি, অসহায়তা, বেদনা ও দীর্ঘশ্বাস; সেই সঙ্গে রয়েছে তীব্রতীক্ষ্ণ আহ্বান এবং সুন্দর ও কল্যাণের প্রতি পক্ষপাত, আর মৌলবাদ বিরোধিতা। দশটি রচনার এই সংগ্রহে ব্যক্তি হুমায়ুন আজাদ নানাভাবে প্রকাশিত। বিবিধ ব্যক্তিগত বিষয় এত খোলামেলা, সরল, আন্তরিকভাবে, এবং এত ব্যাপকভাবেও আর কোনো গ্রন্থে আসেনি। তবে এর সব ক’টি রচনাই যে তাঁর ওপর নৃশংস আক্রমণের পরে সৃষ্ট এমন নয়। রয়েছে তার এক যুগ, এমনকি আড়াই দশক আগে প্রকাশিত রচনাও। রয়েছে নিজের প্রথম গ্রন্থ (কাব্যগ্রন্থ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’) প্রকাশের স্মৃতিচারণ, দেশে কবিদের দলাদলি নিয়ে নিবন্ধ; এমনকি নিউইয়র্ক জর্নাল। তবে গ্রন্থের প্রধান সুর ব্যক্তি ও লেখক হুমায়ুন আজাদ স্বয়ং। একটি লেখার শিরোনামও ‘আমি’। দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হ্রস্ব এই লেখাটিতে দেখছি তিনি চল্লিশ বছর বাঁচার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বলছেন, ‘যদি পচন ধরে আমার হৃৎপিন্ড, তাহলেও বেঁচে থাকতে চাই আমি। অন্তত আরো চলিল্লশ বছর।’ একই আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হতে দেখবো মৃত্যুর কিছু কাল আগে লেখা (আসলে এটি লেখা নয়, কথা; ব্যাংককের হাসপাতালে ভিডিওতে ধারণকৃত বক্তব্য) ‘আমার নতুন জন্ম’-তেও। বলছেন, ‘আমি এই জীবনে ৫৬ বছর বয়সে থেমে যেতে চাই নি। মরে যেতে চাই নি। আমি অন্তত আশি বছর বেঁচে থাকতে চাই; কিন্তু ঘাতকেরা চায় না যে আমি বেঁচে থাকি।’
‘আমার নতুন জন্ম’ শীর্ষক আত্মজৈবনিক রচনাটি পড়তে পড়তে আমাদের চোখ ভিজে আসে। এটি এই বইয়ের প্রথম এবং দীর্ঘতম লেখা। বিদেশের হাসপাতালে বসে হুমায়ুন আজাদের হৃদয় তাঁর পরিবার এবং মাতৃভূমির জন্যে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল বলে তিনি তিরিশের দশকে তার নানার খুন হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটির উল্লেখ করেন। তিনিও নানার মতো খুন হয়ে যেতে পারতেন সেই ফেব্রুয়ারিতেই। কবি তিনি, তাই নিভৃত আরোগ্যশালায় তাঁর ভেতরে কবিত্ব পতাকা তোলে; বিদেশের দালানকোঠাকে তঁর মনে হয় গাছ, আর সেবিকাদের গাঙচিল; দ্রষ্টা তিনি, তাই উচ্চারণ করেন: ‘বাংলাদেশকেও তারা (হিংস্র ঘাতক মৌলবাদীরা) আমার মতোই বিকৃত, আমার থেকেও বিকৃত, এবং আমার থেকেও রুগ্ণ, এবং মৃত দেখতে চায়। সেই কাজটি তারা করে চলেছে।’ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, যে-হুমায়ুন আজাদ স্বদেশ ছেড়ে যেতে চাননি সেই তিনিই জার্মানিতে যান, প্রধানত আত্মরক্ষার জন্যেই। মাতৃভূমিতে তিনি কতখানি বিপন্ন হয়ে উঠেছিলেন তার খোলামেলা প্রকাশ ঘটিয়েছেন গ্রন্থের পরবর্তী রচনায়। কিন্তু ‘আমার নতুন জন্ম’-তে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন ‘আমার দেশকে আমি ভালোবাসি। আমার ভাষাকে আমি ভালোবাসি। আমি উদ্বাস্তু হয়ে দেশে দেশে ঘুরতে চাই না। আমি চাই না দেশ ছেড়ে চলে যাবো, এবং বিদেশে একজন অত্যন্ত পুরস্কৃত সম্মানিত উদ্বাস্তু লেখক হিসেবে বাঁচতে চাই না। আমি বাঁচবো আমার নিজের দেশে, এবং বাংলাদেশে, এবং এমন একটি বাংলাদেশ আমি চাই যে-বাংলাদেশ আলবদরমুক্ত রাজাকারমুক্ত মৌলবাদমুক্ত।’
ফেব্রুয়ারির ওই নারকীয় আক্রমণের পর, মৃত্যু থেকে প্রত্যাবর্তনের পরপর বিদেশের হাসপাতালে বসে তিনি যে কথাগুলো উচ্চারণ করেন, সেই কথায় যে-ক্ষুব্ধতার স্বর ছিল, তা যেন মাত্র তিন মাসের ভেতর অসহায়তার আর্তিতে রূপান্তরিত হয়। একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত ‘প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও দেশবাসীর কাছে খোলা চিঠি’ শীর্ষক লেখাটি ‘আমার নতুন জন্ম’ গ্রন্থের দ্বিতীয় লেখা। সম্ভবত কোনোকালেই হুমায়ুন আজাদের হৃদয় থেকে ‘আবেদন’ শব্দটি উচ্চারিত হয়নি; অথচ এই লেখায় তিনি প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও দেশবাসীর কাছে রীতিমতো আবেদন জানিয়ে বলছেন : ‘এখন আপনাদের নিষ্ক্রিয় থাকার সময় নয়, আপনাদের দেখা দরকার কারা আমাদের যন্ত্রণার মধ্যে রেখেছে;...এ সঙ্কট মুহূর্তে, বিপন্নতার সময়ে আমার পরিবারের ও আমার জীবন আমি আপনাদের হাতে সমর্পণ করলাম... সময় বেশি নেই, এখনই আপনাদের কর্তব্য স্থির করার জন্যে আবেদন জানাই।’ তাঁর কণ্ঠ হাহাকরের মতো শোনায় যখন তিনি বলেন, আমার মৃত্যুর সময় আপনারা যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তা কি আপনারা পালন করবেন না আমার জীবনের সময়?
একাধিক অপ্রকাশিত লেখা রয়েছে বইয়ে; তার একটি ‘আহমদীয়া মুসলিম জামায়েতের প্রকাশনা নিষিদ্ধকরণ : বাংলাদেশ কি তালেবানি আফগানিস্তান হয়ে উঠেছে?’ যার প্রথম পঙক্তিতেই বলছেন, ‘আমি কোনো ধর্মে বিশ্বাস করি না’। এই উক্তি অসত্য নয়, তবে লেখক নিজের বক্তব্যকে তীব্র করে তোলার জন্যে কবর আজাবের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন গ্রন্থের প্রথম লেখায়। যে-উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ করছি তা পড়লেই পাঠক বুঝবেন সেই চেনা হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে বাক্যগুলো ঠিক যায় না। তিনি লিখেছেন, ‘আমার তো ধারণা যখন সাঈদী নিজামী গোলাম আজম কবরের মধ্যে ঘোর আজাবে থাকবে, যখন বিভিন্ন রকম অজগর তাদের জড়িয়ে ধরে পেষণ করবে, যখন তাদের কবরের ভেতর আগুন জ্বলবে তখন আমার নাম বাংলাদেশ স্মরণে রাখবে।’
বইটির শেষ রচনা তাঁর কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতা ‘মানবাধিকার ও লেখকের স্বাধীনতা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’। নিজের লেখা সর্বশেষ উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’-–এর চরিত্রগুলো সমকালীন বাংলাদেশে বাস্তবরূপ ধারণ করেছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন এ-লেখায়।
গ্রন্থের একমাত্র সাহিত্যরসসিক্ত রচনা ‘আমার প্রথম বই’ তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের স্মৃতিকথা; মনে পড়ছে নব্বইয়ের শুরুতে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘মাটি’ পত্রিকার জন্যে এই রচনাটি তিনি সাগ্রহে তৈরি করেছিলেন অল্প সময়ের ভেতর। তিনি খুব স্পষ্ট করেই এতে বলেছিলেন যে তাঁর নিজের লেখা কোনো বইয়ের জন্যেই মোহ নেই, কিন্তু তাঁর প্রথম গ্রন্থের নামে যে শিহরণ বোধ করেন, তা আর কোনো বইয়ের নামে করেন না। সত্য উচ্চারণ এবং প্রতিবাদ এ দুটি বৈশিষ্ট্যের জন্য কমবেশি তিনি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু হত্যা প্রচেষ্টার পর তাৎক্ষণিকভাবে তিনি পরিণত হন প্রতীকে। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে সমগ্র বাংলাদেশ। তাঁর বেঁচে ওঠা ছিল এক ধরনের পুনর্জন্মই। আমাদের দুর্ভাগ্য এরপর অর্ধেক বছরও গেল না, তিনি প্রস্থান করলেন। মৃত্যুর এক সেকেন্ড দূর থেকে তিনি ফিরে এসেছিলেন জীবনে এবং লেখক হিসেবে তাঁর নতুন জন্মের বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। বিদেশে প্রথম পর্যায়ের চিকিৎসা শেষে স্বদেশে তাঁর প্রত্যাবর্তনের পর প্রদত্ত বক্তব্য থেকে বোঝা গিয়েছিল শারীরিকভাবে তিনি কাহিল হয়ে পড়লেও আদি ও অকৃত্রিম সেই হুমায়ুন আজাদই তিনি রয়ে গেছেন। ‘আমার নতুন জন্ম’ রচনাটি পড়ে আমাদের হাহাকার আরো বেড়ে যায়; আমরা বুঝতে পারি নিজের নতুন জন্মগ্রহণকে তিনি কী বিপুলভাবেই না তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলার পরিকল্পনা করছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁর সেই নতুন জন্মের ফসল আমরা পেলাম না। এর জন্যে তাঁকে বা নিয়তিকে দুষে লাভ নেই। এক নতুন হুমায়ুন আজাদকে আমরা পাই নি বটে, কিন্তু একদিন না একদিন তাঁর সমগ্র সৃজনসম্ভার নতুনভাবে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসবে; এক অর্থে সেদিন তাঁর নতুন জন্মই ঘটবে এমনটাই বিশ্বাস করি আমি।