শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ স্মরণে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার ফলেই প্রথাবিরোধী, বহুমাত্রিক লেখক ড. হুমায়ুন আজাদকে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য হয় আমার। সাংবাদিকতা, লেখালেখি সেই সঙ্গে বিভাগে কিছুটা ভালো ছাত্র হওয়ার সুবাদে হুমায়ুন আজাদের সান্নিধ্য লাভ করি। আজ স্যার নেই। ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। তার আগে একই বছরে শুরুর দিকে ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বই মেলা থেকে বের হয়ে বাসায় ফেরার পথে মৌলবাদী, একদল হায়েনার চাপাতির আঘাতে তাঁরই লেখা উপন্যাস ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদের’ মতো ক্ষত-বিক্ষত হন স্যার। শেষ পর্যন্ত সেই আঘাতে দুর্বল দেহে দেশ ছাড়ার পর জামার্নির মিউনিখ শহরে ঘুমন্ত অবস্থায় রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় তাঁর। দেখতে দেখতে প্রায় এক দশক অতিক্রান্ত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি অনেক আগেই, তবু এখনো তাঁর হিরন্ময় সান্নিধ্যের স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে অবিরত। তাঁর মতো স্পষ্টবাক, জ্ঞানী, বিজ্ঞান মনস্ক, প্রথাবিরোধী, বাকপটু, রসিক সর্বগুণে গুণান্নিত একজন শিক্ষক, আমার মতো হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করত সদাসর্বদা। কিন্তু হুমায়ুন আজাদের মতো প্রবল ব্যক্তিত্ববান একজন শিক্ষকের সান্নিধ্য পাওয়া ছিল বেশ দুষ্কর। নিভৃতচারী এ শিক্ষক মানুষের সঙ্গ একেবারেই পছন্দ করতেন না। একা একা থাকতেন সবসময়। তাঁর কবিতায় এ কথার প্রমাণ মিলে-‘সবকিছুই ভালো লাগে, শুধু মানুষের সঙ্গ ছাড়া’।
অনার্স প্রথম বর্ষে হুমায়ুন আজাদ স্যার আমাদের কোনো ক্লাস নিতেন না। অনার্স, মাস্টার্স মিলিয়ে তিনি শুধু দ্বিতীয় বর্ষেই পড়াতেন। দ্বিতীয় বর্ষে তিনি আমাদের বাংলা উপন্যাস ও সাহিত্য পড়াতেন। আমাদের নিচের ক্লাসের অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল বিভাগে। দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে আমাদের। আমাদের একধাপ নিচের ক্লাসে একদিন পড়াতে এসে স্যার বললেন, ‘আজ পড়াতে ইচ্ছা করছে না। আমি কিছুক্ষণ আগে ডাস্টবিন থেকে উঠে সরাসরি তোমাদের ক্লাসে পড়াতে এসেছি। এখনো গায়ে নোংরা লেগে আছে। নিজেকে অশুচি লাগছে।’ ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নের মুখে তিনি যা বললেন তার সারাংশ এই, ‘সকালে আমি বাসায় বসে বসে তোমাদের বড় ভাইদের কোর্স ফাইনালের খাতা দেখেছি। বানান ভুল, বাক্য ভুল, অশুদ্ধ বাক্য, ব্যাকরণ ভুল, যাচ্ছে তাই লেখা। জঘন্য, জঘন্য লেখায় ভরপুর উত্তরপত্র। এসব খাতা পড়ে পড়ে দেখে দেখে আমার বমি এসে গেছে। মনে হয়েছে আমি এতক্ষণ ডাস্টবিনে ছিলাম।’ স্যারের এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ রসবোধে ক্লাসে হাসির রোল পড়ল। অবশ্য তার প্রতিটি ক্লাসই এমন উপভোগ্য ছিল। জুনিয়রদের মুখে এমন কথা শুনে আমরা খুবই বিমর্ষ ছিলাম। হুমায়ুন আজাদের মতো পণ্ডিত শিক্ষক যখন পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করছেন, না জানি ভাগ্যে কী আছে! শেষ পর্যন্ত আমাদের কোর্স ফাইনালের রেজাল্ট বের হলো, দেখলাম আমি স্যারের উপন্যাসের কোর্সে সর্বোচ্চ ৫৮% নম্বর পেয়েছি। সাহিত্যে ৬০% অর্থাৎ ফার্স্ট ক্লাস নম্বর পাওয়া খুবই কঠিন। শ্লাগা অনুভব করলাম। লেকচার থিয়েটার বিল্ডিংয়ের চার তলায় স্যারের রুমে দেখা করলাম। জানালাম আমার সাফল্যের কথা। স্যার খুশি হলেন। আরো ভালোভাবে পড়াশোনা করার পরামর্শ দিলেন। সাংবাদিকতা করি শুনে আরো খুশি হলেন। সেই সঙ্গে শঙ্কাও প্রকাশ করলেন সাংবাদিকতা চালিয়ে গেলে রেজাল্টের বারোটা বাজার।
ছাত্রজীবনে হুমায়ুন আজাদ অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। অনার্স, মাস্টার্স দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলেন। স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন। স্কুল ফাইনালে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ১৪তম স্থান দখল করলেন। ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র। মাতৃভাষার প্রেমে পড়ে বাংলা সাহিত্যকে বেছে নিলেন অনার্সে। স্যারের নানা সাক্ষাৎকারে এবং ব্যক্তিগতভাবে ক্লাসেও নানাভাবে জেনেছি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকতেন তিনি। কলা ভবনের মূল ক্যাম্পাস থেকে দূরে নিরিবিলি পরিবেশের হলে থাকায় প্রচুর পড়াশোনা করতেন। রাজনীতি একদম অপছন্দ করতেন। তাঁর পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মধুর ক্যানটিনে মাত্র তিন-চার বার চা খেতে এসেছিলেন। এতটাই সংযমী ছাত্র ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। পারিবারিকভাবে মোটামুটি স্বচ্ছল থাকায় টিউশনি করতেন না। শুধু পড়াশোনাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। পারিবারিকভাবে আমি স্বচ্ছল থাকার পরও পড়াশোনা বাদ দিয়ে কেন ছাত্র অবস্থায় সাংবাদিকতা করছি, এটা জেনে খুবই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। আমি তাঁকে আমার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যার কথা বলতে পারিনি।
আমি যখন মাস্টার্সের ছাত্র, তখন হুমায়ুন আজাদ স্যার মারা যান। এটা ২০০৪ সালের ঘটনা। তার আগে আমার অনার্সের রেজাল্ট একবারেই সাদামাটা হয়ে যায় সাংবাদিকতা পেশার চাপে। মাস্টার্সের রেজাল্টও একই রকম হয়। ক্লাসে আমার চেয়ে পেছনে থাকা অনেক ছাত্রছাত্রী এখন বিসিএস ক্যাডার, ম্যাজিস্ট্রেট, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অনেক সরকারি-বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। এখন বীতশ্রদ্ধ হয়ে সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে দিয়েছি একেবারেই।
এখন নানা রকম বিকল্প পেশায় জীবন-জীবিকার তাগিদে আমাকে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে অবিরত। হুমায়ুন আজাদ স্যারের পরামর্শে সাংবাদিকা পেশা বাদ দিয়ে প্রথম বর্ষ থেকেই যদি শুধু পড়াশোনাই করতাম, তাহলে নিঃসন্দেহে রেজাল্ট ভালো হতো। এত দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপকের পাশাপাশি হয়ে যেতাম ছোটখাটো বুদ্ধিজীবী। টিভির টকশোতে প্রতি রাতে দালালি করে তেলেঝোলে বেশ ভালোই থাকতাম! হুমায়ুন আজাদ স্যারের আরেকটা পরিচয় হলো, তিনি ছিলেন একজন কবি। কবিরা হচ্ছেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। আমার ভবিষ্যৎ পরিণতি অনেক আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন তিনি। আমাকে সতর্কও করেছিলেন। শুনিনি। তাই মাসুল দিচ্ছি এখন।
অনার্স ও মাস্টার্সে এত ভালো রেজাল্ট করার পরও হুমায়ুন আজাদ স্যারকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি পেতে অনেক সমস্যা হয়েছিল। তৎকালীন পণ্ডিত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এনামুল হকের পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ ‘মঞ্জু ও মনীষা’-যার জন্য ড. এনামুল হক গর্ব করতেন সদা সর্বদা, সেই পাণ্ডিত্যপূর্ণ বইয়ের ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন তরুণ হুমায়ুন আজাদ পাতায় পাতায় বাংলা একাডেমির এক সেমিনারে। স্যারের ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’ উপন্যাসে এ ঘটনার বর্ণনা আছে। আগ্রহী পাঠকরা পড়ে দেখতে পারেন। হুমায়ুন আজাদের প্রতি বোর্ড চেয়ারম্যান ড. এনামুল হক এবং তাঁর শিষ্যদের উষ্মাটা ছিল এখানেই। কিন্তু বিভাগের আরেক স্বনামধণ্য শিক্ষক ড. আহমদ শরীফের প্রবল সমর্থনে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন আজাদ বাংলা বিভাগের শিক্ষকের চাকরি পান। এতেই প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে দলাদলির সংস্কৃতি ছিল। এখনো আছে। ক্লাসে পড়াতে গিয়ে স্যার এ রকম অসংখ্য ঘটনার কথা আমাদের তুলে ধরেছিলেন।
হুমায়ুন আজাদ স্যারের মতো বটবৃক্ষতুল্য শিক্ষকের প্রতিটি মুহূর্তই একজন ছাত্রের কাছে আরাধ্য। তাই তাঁর সান্নিধ্যের প্রতিটি ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেও তৃপ্তি মিটে না। ১২ আগস্ট স্যারের একাদশ মৃত্যুবার্ষিকী। এনটিভি পরিবারের বিশেষত ভোরের কাগজের এক সময়ের সহকর্মী, অকৃত্রিম বন্ধু, মাহমুদুল হাসানের অনুরোধেই এ স্মৃতিচারণামূলক লেখা।
‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি লেখার কারণে মৌলবাদীদের কোপানলে পড়েন স্যার। ২০০৩ সালে ইত্তেফাকের ঈদ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয় এই উপন্যাস। ২০০৪ সালের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী থেকে বই আকারে বের হয় এই বিতর্কিত উপন্যাস। অথচ বইটি প্রকাশিত হওয়ার কথাই ছিল না। ২০০৩ সালে স্যার একটি মাত্র উপন্যাস লিখেন-‘একটি খুনের স্বপ্ন’ ‘সূর্যতরু’ নামের অখ্যাত ও স্বল্পায়ু সাহিত্য পত্রিকার জন্য। এ পত্রিকার অফিস ছিল খিলগাঁওয়ে। আমি থাকি এ এলাকাতেই। নিজেও সূর্যতরুতে লিখতাম, অনুবাদের কাজ করতাম। আড্ডা দিতাম এই অফিসে। আমার ওপর দায়িত্ব ছিল ‘একটি খুনের স্বপ্ন’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করার। এ উদ্দেশে হুমায়ুন আজাদ স্যারের ফুলার রোডের বাসায় বেশ কয়েকবার গিয়েছি। স্যার যথাসময়ের আগেই সব কাজ শেষ করেই আমার হাতে পাণ্ডুলিপি দিয়ে বললেন ‘আমি কম্পোজ করেছি। প্রুফ দেখেছি। তোমাদের আর কোনো ঝামেলা নেই। সরাসরি ছাপাতে পারবে।’ স্যারের বাসায় বসার ঘরে আরো অনেক বিষয়ে কথা হয়। স্যার বললেন ‘ তোমরা তো জানই আমি খুব বেশি লিখি না। জনপ্রিয় ব্যবসায়ী ঔপন্যাসিকের মতো প্রতি ঈদ সংখ্যায় চার-পাঁচটা ‘অপন্যাস’ আমি প্রসব করি না। এত প্রসব বেদনা আমার সহ্য হয় না। তাই এ বছর ‘একটি খুনের স্বপ্ন’ একটি মাত্র উপন্যাস লিখেছি। অনেক বিখ্যাত দৈনিক আমার কাছে তাদের ঈদ সংখ্যার জন্য লেখা চেয়েছিল। দেইনি। তোমাদের দিলাম। টাকাও অনেক কম নিয়েছি। তোমরা সবাই মিলে একটা সাহিত্য পত্রিকা দাঁড় করাচ্ছ, তোমাদের সাহায্য করতে চাই। তাই লেখা দিলাম।’ কথা পুরোপুরি সত্য। লেখা ছাপা হওয়ার পর যখন পারিশ্রমিকের টাকা নিয়ে স্যারের বাসায় গেলাম, টাকার অঙ্ক দেখে আমি নিজেই হতবাক। এত কম টাকায় তাঁর মতো বিখ্যাত-জনপ্রিয় লেখক কীভাবে এমন নামগোত্রহীন পত্রিকায় লেখা দিলেন? টাকা-পয়সা সারা জীবনেই তাঁর কাছে তুচ্ছ ছিল। কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক দলের দালালি করেননি। বাংলাদেশের দূষিত বুদ্ধিজীবীদের গোত্রে হুমায়ুন আজাদই একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। হংসের মাঝে বক।
কথা প্রসঙ্গে স্যার জানালেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ লেখার শানে নজুল- ‘মৌলবাদীদের নিয়ে বড় আকারের একটা গবেষণা গ্রন্থ লেখার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। এ জন্য নানা তথ্য সংগ্রহ করেছি। প্রচুর পড়াশোনাও করেছি। ঈদের মাস খানেকেরও কম সময়ের আগে ইত্তেফাক পত্রিকা থেকে দুজন সাংবাদিক এলো আমার বাসায়। বলল, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেব তাদের পাঠিয়েছেন। ইত্তেফাকের ঈদ সংখ্যার জন্য একটা উপন্যাস দিতে হবে। আমি না বললাম। এখন সময় নেই। সম্ভব নয়। তারা এতই নাছোরবান্দা যে বলল, স্যার আমরা যদি লেখা নিয়ে না যেতে পারি তাহলে মঞ্জু সাহেব বলে দিয়েছেন আমাদের চাকরি থাকবে না। প্রায় পায়ে ধরার উপক্রম। শেষ পর্যন্ত না করতে পারলাম না। মাত্র ৮-১০ দিনে অনেক ঘোরের মধ্যে লিখে ফেললাম ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ।’ লেখা শেষ করে পড়তে গিয়ে আমি নিজেই বিস্মিত হয়েছি। কী লিখেছি! ওদের এত গালাগালি করেছি!’ তারপর স্যার ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছেন। স্যারের প্রাণখোলা সেই হাসির শব্দ এখনো কানে বাজে! কে জানত, অফুরান প্রাণশক্তির এ প্রাণখোলা মানুষটিকেই এমন একটি উপন্যাস লেখার জন্য শেষ পর্যন্ত মৌলবাদীদের হাতে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে!
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক ছাত্র।