গল্প
শেখ মুজিবের রক্ত
কফিলুদ্দিন নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে।
সকাল হয়েছে। পুকুরপাড়ে গিয়েছিল সুলতানা। সেখান থেকে দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে ধাক্কা দেয় কফিলুদ্দিনকে, আর কত ঘুবাইবেন। সব্বোনাশ অইয়া গেছে। তাড়াতাড়ি ওঠেন।’
কফিলুদ্দিনের ঘুম ভেঙে গেলেও ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে। সকালের এই ঘুমটা সে খুব পছন্দ করে। গত কয়েকদিনে, শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হালচাষ করেছে। আপতত জমিতে কাজ নেই। রাতেই ঘুমানোর সময় বলেছে সুলতানাকে, সকালে আমাকে ডাক দিবা না। অথচ দেখো মহিলার কাণ্ড!
সুলতানা আবার ধাক্কা দেয়, আপনে কী কাল ঘুম ঘুমাইছেন। ওঠেন, ঢাকায় সব্বোনাশ হয়েছে। লোকেরা বলাবলি করতেছে।
এক ঝটকায় উঠে বসে কফিলুদ্দিন, কী অইচে ঢাকায়?
শ্যাক সাবরে নাহি...কফিলের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কথা বলে না সুলতানা।
ঘুম ছুটে গেছে কফিলুদ্দিনের, শ্যাক সাবের কী অইচে বৌ?
উনারে মিলিটারিরা মাইরা ফালাইচে।
তোরে কেডায় কইল?
পুকুর পাড়ে লোকেরা কইতেছে। রেডিওতে ঘোষণা দিতাছে।
রেডিওতে ঘোষণা দিতাছে! শ্যাক সাবরে মাইরা ফালাইচে? বিছানার উপর রাখা গেনজিটা হাতে নিয়ে শরীরে ঢোকাতে ঢোকাতে বের হয়ে যায় কফিলুদ্দিন। এক দৌড়ে পুকুরপাড়ে যায় কফিল। পুকুরপাড়ে অনেক মানুষের জটলা। কফিল জটলার পাশে দাঁড়াতেই দেখে, মধ্যমণি কালাম সিকদার। দাঁত মাজছে দাঁতন দিয়ে। মুখে জেল্লা ফুটে উঠেছে।
এহন কী হবে? কালাম সিকদারকে প্রশ্ন করে তাঁর কামলা জামাল মিয়া।
দাঁত মাজতে মাজতে, থুতু ফেলতে ফেলতে জবাব দেয় সিকদার, কী আর হবে? যে দেশে শেখ মুজিব নাই সে দেশ কি চলে না? আল্লায় যা করে মানুষের ভালোর লাইগাই করে। যা ঘটছে তার ইশারায় ঘটছে। বেশি কথা না কইয়া বাড়ি যাও। বলতে বলতে চোখ পড়ে কফিলুদ্দিনের দিকে, আমি কী আর বলব? বলার লোক তো আইসা পড়ছে।
কালাম সিকদারের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই তাকায় কফিলুদ্দিনের দিকে। কফিলুদ্দিন এবং উপস্থিত সবাই জানে, কালাম সিকদারের জানের শত্রু কফিলুদ্দিন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কফিলুদ্দিন নিজের হাতে হত্যা করেছে কালাম সিকদারের আপন চাচা নওয়াব আলি সিকদারকে। ঘটনাটা এলাকার সবাই জানে। কিন্তু কফিলুদ্দিনকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। কারণ, কফিলুদ্দিন এলাকার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খুবই পরিচিত। যুদ্ধের শেষে, দেশে ফিরে শেখ মুজিব যখন অস্ত্র জমা দিতে বললেন, তখন অনেকের সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় এসে তাঁর হাতে অস্ত্র জমা দিয়েছে। শেখ মুজিবের হাতে অস্ত্র জমা দেওয়ার ছবি পত্রিকায় উঠেছে।
কথায় কথায় গর্বের সঙ্গে বলে কফিলুদ্দিন, আমি যহন আমার স্টেন শেখের হাতে দিলাম, উনি আমারে জিগাইলো কয়ডা পাকিস্তানি সৈন্য মারছো?
আমি কইলাম, এগারোটারে মারছি।
আমার পিঠে থাপ্পড় দিয়া কইল, সাব্বাস বাঙালি। বলতে বলতে শরীর বাঁকা করে দেখায় কফিলুদ্দিন, আমার এই পিঠে শ্যাক সাব হাত দিছে। বলেছে, যুদ্ধ কইরা দ্যাশ স্বাধীন করছো। এখন দেশ গড়ো।
গোটা এলাকায় শত শত মানুষের কাছে কফিলুদ্দিন এই ঘটনা বলেছে অনেকবার, অসংখ্যবার। আমার এই পিঠে শ্যাক সাব হাত দিছে, বলতে কখনো ক্লান্ত হয় না। ঘরের মধ্যে শেখ মুজিবের ছবি টাঙ্গানো। সেই কফিলুদ্দিনকে কী বলবে কালাম সিকদার? কতদিন গ্রামের হাটে দেখা হয়েছে, মন্টু ঘোষের চা দোকানে মুখোমুখি বসে চা খেয়েছে কালাম সিকদার আর কফিলুদ্দিন। কিন্তু কখনো কথা হয়নি। কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলতেও যায়নি। গোটা এলাকায় সিকদারবাড়ি রাজাকারদের বাড়ি হিসেবে পরিচিত। ধারেকাছে বসে না বললেও দূরে গেলেই লোকজন বলে, ওই দ্যাক হালার রাজাকার যায়।
ছেলেমেয়েরা স্কুলে গেলেও ওই একই পরিচিতি, ও তোমরা রাজাকার বাড়ির পোলা?
ছেলেমেয়েরা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি আসে। রাগে ক্ষোভে বেদনায় কালাম সিকদারের মগজ ফুটতে থাকে কিন্তু কিচ্ছু করার থাকে না। হ্যাঁ তার চাচা নওয়াব আলি সিকদার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল। ছোটবেলায় বাবা মারা গেলে এই ছোট চাচা নওয়াব আলিই আদর দিয়ে দিয়ে মানুষ করেছে। লেখাপড়া শিখিয়েছে। পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল নওয়াব আলি সিকদার। মিছিল করেছে। জেলও খেটেছে। পাকিস্তান হওয়ার পর নওয়াব আলি মুসলিম লীগের সমর্থক হিসেবে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিল।
শেখ মুজিব ছয় দফা ঘোষণা করেই পাকিস্তানের বারোটা বাজিয়ে দিলো, মনে আছে কালাম সিকদারের, কথাটা বলেছিল চাচা নওয়াব আলি সিকদার বৈঠকখানায় বসে।
ছয় দফায় কী আছে ভাই? জিজ্ঞেস করেছিল পাণ্ডা ইরফান গাজী।
ছয় দফার পাঁচ দফাই বাদ দাও, হুকায় টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জবাব দেয় নওয়াব-একটা দেশের কী দুই রকম টাকা হয়? শুনছো তোমরা? শেখ মুজির পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আলাদা আলাদা টাকা চালু করার কথা বলেছে, ছয় দফার এক দফার মধ্যে। এই প্রস্তাব কি মানা যায়? মানলে দেশ থাকে? আসলে সবই হচ্ছে ইন্ডিয়ার চাল। তারা আমাদের দুই ডানা ভাঙতে চায়। ইসলামরে খতম করতে চায়। কিন্তু যত ষড়যন্ত্রই করুক, কিচ্ছু করতে পারবে না, কিচ্ছু করতে পারবে না- নিজের মনে উপসংহার টেনে আবার হুকায় টান দেয় নওয়াব।
বড় সাহস নিয়ে প্রশ্ন করে পাশের বাড়ির হুকুম আলি, ক্যান কিছু করতে পারবে না মিয়া ভাই?
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দুনিয়ার সেরা বাহিনী। ইন্ডিয়ার পাঁচজন সৈন্যর সমান একজন পাকিস্তানি সৈন্য বুঝলা। একবার যদি ইন্ডিয়া আক্রমণ করে পাকিস্তান মজা হাড়ে হাড়ে বুঝাইয়া দেবে।
ছয় দফা, আগরতলার মামলা, ঊনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তুরের নির্বাচন পার হয়ে এলো একাত্তর। মার্চের এক রাতে নেমে এলো আগুন মাখা কেয়ামত বাংলায়। কেয়ামতের আগে শেখ মুজিব নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমি যদি হুকম দিতে নাও পারি, তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
সেই যুদ্ধের এক যোদ্ধা নেত্রকোনার কফিলুদ্দিন।
ঘটনা কী? কফিলুদ্দিনের বাড়িতে রেডিও নেই। দৌড়ায় বাজারে। মন্টু ঘোষের দোকান বন্ধ। অবাক কফিলুদ্দিন। মন্টু ঘোষের দোকান তো বন্ধ থাকে না। কালা মিয়ার দোকানে অনেক মানুষ জমেছে। রেডিওর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
দ্রুত যায় কফিলুদ্দিন। বসার জায়গা না পেয়ে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কান খাড়া প্রত্যেকের। সুরা পাঠ করা হচ্ছে। হঠাৎ ভেসে এলো একটি কণ্ঠ, আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাত করেছি। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। জয় বাংলার জায়গায় জিন্দাবাদ- কফিলুদ্দিনের কানে আগুন লাগে।
সবার চোখেমুখে চাপা উত্তেজনা। কী হচ্ছে, ঘটনা কি সত্যি? রেডিও থেকে যখন বলা হচ্ছে, তখন বিশ্বাস না করে উপায় নেই। কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে কেন? কফিলুদ্দিন বাজার থেকে বের হয়ে যায় চেয়ারম্যান হামেজ মিয়ার বাড়ি। বাড়িতে কেউ নেই। দীর্ঘদিনের পরিচিত বাড়ি কফিলের। পেছনে ঢুকে ডাকে- ও হামেজ চাচা? হামেজ চাচা বাড়িতে আছেন?
পেছনের ঘর থেকে বের হয়ে আসে হামেজ বিমর্ষ মুখে। দুজনে দেখছে দুজনকে। হামেজ যুদ্ধের সময়ে অনেক সাহায্য করেছে। টাকা দিয়েছে। চাল দিয়েছে। থাকার জায়গা দিয়েছে। সরাসরি যুদ্ধে না গেলেও এলাকায় থেকে শত্রুদের সঙ্গে মিশে অনেক তথ্য এনে দিয়েছে। স্বাধীনতার পর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে।
খবর কি সত্য? প্রশ্ন করে কফিলুদ্দিন।
চোখের পানি ছেড়ে দেয় হামেজ। হাত ধরে কফিলের, কফিলরে ঘটনা সত্য।
আপনার বাড়ির সামনের দিকটা বন্ধ কেন?
কী করব? কোনো দিশা পাইতেছি না। আমাদের বিপক্ষের শত্রু তো কম না। তারা যদি... থেমে যায় হামেজ মিয়া। আমার বাড়িতে ছেলের বৌ, নাতি নাতনি আছে। তোমার চাচি অসুস্থ। আমি কী করতে পারি?
তাই বইলা কোনো প্রতিবাদ হবে না?
কে করবে? দেশের অবস্থা ভালো না। মানুষের পেটে অভাব। কে নামব প্রতিবাদ করতে?
একাত্তরে এই চেয়ে বেশি অভাবের মধ্যে আমরা যুদ্ধ করছি না চাচা?
একাত্তরের যুদ্ধ আর আজকের মধ্যে অনেক ফারাক কফিলুদ্দিন।
ফারাক! ফারাক আপনি দেখতে পারেন কিন্তু আমি কোনো ফারাক দেখি না। আমার কাছে একাত্তরের চেয়ে আজকের অবস্থা আরো জটিল মনে হয়। আমি যাই।
হামেজের বাড়ি থেকে দ্রুত বের হয়ে আসে কফিলুদ্দিন। মাথাটা একদম খালি লাগছে। হায়, হায় এটা কী হলো? যে দেশের জন্য মানুষটা এত লড়াই করল, জেল খাটল বছরের পর বছর, এনে দিল স্বাধীনতা সেই মানুষটাকে মেরে ফেলল নিজের দেশের মানুষরা? পাকিস্তানিরা বন্দি করে রেখেছে কিন্তু হত্যা করতে সাহস করে নাই, সেই মানুষটাকে শেষে... । মাথাটা ঝিম ঝিম করছে কফিলের। মাঠ ঘাঠ পার হয়ে দৌড়াতে থাকে সিরাজের বাড়ির দিকে। সিরাজ গৌরিপুর থানার মুক্তযোদ্ধা কমান্ডার। খুব সাহসী মানুষ। যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছে। কোনো আক্রমণে পেছনে থাকেনি। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে শত্রুর একটা গুলি লেগেছিল ডান কাঁধে। ফিল্ড হাসপাতালে যেদিন অপারেশন করে গুলি বের করেছে, তার পরের রাতে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। সরকার তাকে বীরপ্রতীক উপাধি দিয়েছে।
কফিলুদ্দিনের বাড়ি থেকে প্রায় দুই-আড়াই মাইল দূরে সিরাজ বীরপ্রতীকের বাড়ি। শ্রাবণের মেঘের আকাশ যদিও, কিন্তু বাতাস নেই। চারদিকে গুমোট পরিস্থিতি। ঘেমে গেছে কফিল। সিরাজের বাড়ির সামনে আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখে সাহস বাড়ে কফিলের। দৌড় শুরু করে একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায় ওদের। সিরাজ বীরপ্রতীক মলিন মুখে হাত ধরে কফিলের, বাড়ি থেকে এসেছো?
হ্যাঁ।
পথের অবস্থা কি?
পথের অবস্থা তো দেখলাম স্বাভাবিক। কয়েকজন কৃষক হাল চাষ করতেছে। তাদের কাছে ঘটনা জানতে চাইলাম, উৎসাহ দেখলাম না। কিন্তু আমরা কী করব? বসে বসে সব মেনে নেব?
আমাদের কী করার আছে? পাল্টা প্রশ্ন করে সিরাজ বীরপ্রতীক।
কাশি দিয়ে কথা বলতে শুরু করে সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা আমীর হোসেন, ‘আমি বাহাত্তর সালেই বলেছিলাম মুক্তিযোদ্ধাদের হাতের অস্ত্র, হাতেই থাক। এই রকম পরিস্থিতি হলে যেন আমরা মোকাবেলা করতে পারি। আজ আমার কথা তো সত্য হলো।’
আমীর ভাই এইটা কোনো কথা হলো? অস্ত্র জমা দিয়েছি বঙ্গবন্ধুর ডাকে, বলতে থাকে কফিলুদ্দিন। যুদ্ধ শেষ, দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের তিনি দেশ গড়তে বলেছেন। মানুষ হত্যা করতে তো বলেন নাই।
তুমি কী বলতে চাও?
আমি কী বলব? আমি মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার? কমান্ডার তো আপনি। যা বলার আপনি বলবেন। সে জন্যই তো এত দূর দৌড়াইয়া আসলাম, জবাব দেয় কফিলুদ্দিন।
অস্ত্রশস্ত্র থাকলে একটা কিছু করা যাইত- জিহ্বা কামড়ায় সিরাজ বীরপ্রতীক।
ঘাড় সোজা করে উত্তর দেয় কফিলুদ্দিন, অস্ত্র না হয় জমা দিয়েছি কিন্তু ট্রেনিং তো জমা দিই নাই। চলেন, নামেন। অস্ত্রের অভাব হবে না।
কফিল, কাঁধে হাত রাখে সিরাজ বীরপ্রতীক, পুরো একটা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা কী করতে পারি? সেনাবাহিনীর মধ্যে আমাদের লোক আছে। ঘটনা তো ঘটে গেছে। এখন পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি জানতাম বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করা হয়েছে, আমরা লাখ রাখ মুক্তিযোদ্ধা ছুটে যেতাম। তাকে মুক্ত করে আনতাম। কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে যা কিছু করব, ভেবেচিন্তে করতে হবে। বাড়ি যাও, দু-একটা দিন যেতে দাও। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থ নেব। তা ছাড়া- থেমে যায় সিরাজ বীরপ্রতীক।
তা ছাড়া কী?
ইন্ডিয়া কী চায় সেটাও আমাদের ভাবতে হবে।
ক্ষেপে ওঠে কফিল, আপনি কী যে বলেন বুঝি না। আমাদের নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিশোধ নেব আমরা, এখানে ইন্ডিয়ার কী করার আছে?
তুমি বিশ্ব রাজনীতি বোঝো না কফিল, সান্ত্বনার স্বরে বলে সিরাজ- বিশ্ব রাজনীতি বড় কঠিন। তুমি কি মনে করো বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে কেবল আমাদের সেনাবাহিনী জড়িত? আমি মনে করি না। আমার মনে হয়, পেছনে অনেক বড় শক্তি আছে। যারা-
থাকেন আপনি আপনার বিশ্বরাজনীতি লইয়া। আমি গেলাম- কফিলুদ্দিন ঝড়ের মতো ছোটে।
পাগল একটা, পেছনে থেকে বিদ্রূপের স্বরে বলে সিরাজ বীরপ্রতীক। মাথা ভরা আবেগ। বাস্তবতা বুঝতে চায় না। আরে তোর চেয়ে শেখ মুজিবকে আমি কম ভালোবাসি?
ছুটতে ছুটতে দুপুরের আগে বাড়ি আসে কফিলুদ্দিন। বসে পড়ে বারান্দায়। ক্রোধে-আক্রোশে চোখ রক্তবর্ণ। হায়, যে মানুষটার ছবি বুকে নিয়ে যুদ্ধ করেছি, যার নামে সাড়ে সাত কোটি মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল, সেই মানুষটির নির্মম মৃত্যুতে কেনো প্রতিবাদ হবে না? বাঙালি এতটা নেকমহারাম? আমরা এতটা প্রতারক? কফিলের ভাবনার মধ্যে ভাতের থালা নিয়ে সামনে দাঁড়ায় সুলতানা।
কোথায় ছিলেন? নেন, ভাত খান। বাড়িয়ে ধরে ভাতের থালা। এক ঝটকায় ভাতের থালা ফেলে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কফিলুদ্দিন হাউ মাউ শব্দে কাঁদতে শুরু করে। হঠাৎ বাবার কান্না শুনে এগারো বছরের মেয়ে পুষ্প দৌড়ে আসে বারান্দায়। তাকায় মায়ের দিকে- বাবা কাঁদছে কেন?
ধরা গলায় জবাব দেয় সুলতানা, বঙ্গবন্ধুর জন্য কান্দে।
পুষ্প বসে বাবার পাশে। হাত রাখে কফিলের বুকের ওপর, বাবা আমারও কান্না আসছে।
মেয়েকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে আরো বেদনায় কাঁদতে থাকে কফিলুদ্দিন, মারে আমার বুকটা ভাইঙ্গা যাইতেছে। এমন সোনার মানুষটারে মারল কোন নমরুদে? মারে...।
তিনদিন-তিন রাত কফিলুদ্দিন ঘরের ভেতর। কোথাও যায় না। পাশের ছোট ভগ্নিপতির বাড়ি থেকে রেডিও সেট এনেছে। শুনছে আকাশবাণী, বিবিসি আর ভোয়ার খবর। যত শোনে তত বেদনায়, হতাশায় নিজের ভেতরে ভেঙে পড়ে। সুলতানা, পুষ্প বসে থাকে পাশে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। সুলতানা অনেক অনুরোধ করেছে কফিলুদ্দিন বলেছে, নেতার হত্যার প্রতিবাদ না করে আমি কেমনে মুখে দানা দিই?
আপনে একলা কী করবেন?
কেউ না করলে আমি করমু।
আপনেরে ওরা আস্তা রাখবে? সিকদারবাড়ির কালাম সিকদার দুইটা গরু কিনেছে। কাল এলাকার লোকদের খাওয়াবে নওয়াব আলীর নামে।
একাত্তরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নওয়াব আলি এলাকার যে যে ঘর থেকে মুক্তিযুদ্ধে গেছে, পাকিস্তানি মিলিটারি ডেকে এনে প্রত্যেকের ঘরে আগুন দিয়েছে। বিশেষ করে আজগর হোসেনের বাবা মার ঘরে আগুন দেওয়ার আগে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ বন্ধ করে পুড়িয়ে মেরেছে। কারণ, পারিবারিক বিরোধ ছিল আজগরদের সঙ্গে। আরো অপরাধ, আজগর মুক্তিযোদ্ধা। পাশাপাশি বাড়ি।
অনেক মেয়েকে উপস্থিত থেকে তুলে দিয়েছে পাকিস্তান আর্মির গাড়িতে। মেয়ে, বধূদের চিৎকারে নেত্রকোনার আকাশ বাতাস মাতম করেছে। ক্যাম্পে বসে সব খবরই পায় কফিলুদ্দিন। অক্টোবরের শেষ দিকে অপারেশন করতে এসে প্রথম সুযোগেই ধরে ফেলে নওয়াব আলিকে। কিন্তু নওয়াব আলি নির্বিকার।
গুলি করার জন্য তাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল কফিল, কেন সে নিজের দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে?
নির্বিকার লোকটি বলেছিল, আমি পাকিস্তানের মৃত্যু চাই না। পাকিস্তান না থাকলে দুনিয়ায় ইসলাম থাকবে না।
ঠাস করে থাপ্পড় মারে কমান্ডার, এই ব্যাটা পাকিস্তানের বয়স মাত্র ২৪ বছর। অথচ দুনিয়ায় ইসলাম আছে শত শত বছর ধরে। ইসলামের সঙ্গে পাকিস্তানের কী সম্পর্ক? পাকিস্তানিরা যে আমাদের হত্যা করছে, ভাষা কেড়ে নিতে চাইছে তার কোনো মূল্য নেই তোর কাছে? না, তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। ফায়ার!
সঙ্গে সঙ্গে কফিলুদ্দিনের রাইফেল গর্জে ওঠে। নওয়াবের বুকে একটা ধাক্কা লাগে। এবং লুটিয়ে পড়ে মাটির ওপর। লাশটা ফেলে রেখেছিল ছাড়াবাড়ির শকুনের ভাগাড়ের কাছে। যাতে শকুনেরা সকল অস্থিমজ্জা খেয়ে ওকে বাংলার মাটি থেকে চিরকালের জন্য উৎখাত করে। আজ, সেই নওয়াব আলির জন্য দুদুটো গরু জবাই হচ্ছে? অনেকেই যাবে সেই মাংস খেতে। বাঙালি, না যেয়ে পারে না। এরাই তো নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে গিয়ে ইংরেজ বেনিয়াদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। বাঙালি যাবেই...।
বৌ? ডাকে কফিলুদ্দিন।
দৌড়ে আসে সুলতানা, ভাত দিব?
না, ট্রাংক থেকে পতাকাটা দাও।
সুলতানা বুঝতে পারে না, এখন পতাকা দিয়ে কী করবে কফিল। প্রত্যেক বছরের ২৬ মার্চ আর ষোলোই ডিসেম্বর নিজের হাতে বাড়ির সামনে পতাকা ওড়ায় কফিল। সঙ্গে থাকে পুষ্প আশপাশের লোকজন। আজকে কী শেখ মুজিবের জন্য পতাকা ওড়াবে? পতাকা ওড়াতে গেলে কালাম সিকদাররা কি আস্ত রাখবে? কানাঘুষায় জেনে গেছে সুলতানা- কালাম সিকদাররা একজোট হচ্ছে।
দাঁড়াইয়া আছে কেন? তাড়াতাড়ি দাও। হাতে টাইম নাই।
সুলতানা ট্রাংক থেকে পতাকা এনে হাতে দেয়। পাশে বসা পুষ্পর হাত ধরে কফিল, চলো মা।
চলো।
দুজনে বের হয়ে যায়। হতবাক সুলতানা কিছুই বুঝতে পারে না, বাবা আর মেয়ে কোথায় যাচ্ছে? যাবার সময়ে টানানো শেখ মুজিবের ছবিটা নেয় কফিল। মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে সুলতানার।
বাড়ির পাশে, বড় রাস্তার কাছেই বাজার। পুষ্পর হাত ধরে কফিলুদ্দিন বাজারে একটা চক্কর দেয়। সব স্বাভাবিক। কেউ মরিচ বিক্রি করছে। কেউ মাছ কিনছে। কেউ ডাল কিনছে। কেউ মাছের দরদাম করছে। মন্টু ঘোষের দোকান আজও বন্ধ। বেশ কয়েকজন কফিলের দিকে অন্য চোখে তাকায়। কফিল পরোয়া করে না।
দাঁড়ায় বাজারের মাঝখানে। পুষ্পকে ইশারা করলে, পুষ্প পতাকা বের করে দুই হাতে মাথার ওপর মেলে ধরে। বুকের সঙ্গে উল্টো করে রাখা শেখ মুজিবের ছবিটা সোজা করে বুকের সঙ্গে চেপে কফিল আকাশ বাতাস মথিত করে স্লোগান দেয়, জয় বাংলা।
মনে হলো বাজারের মানুষের মধ্যে একটা নিঃশব্দ বোমা ফাটল। হতভম্ভ। হতচকিত। কেউ কেউ ভয়ার্ত চোখে তাকায় এদিক ওদিক। বোঝার চেষ্টা করছে, ঘটনা ঘটছে কী?
আবার স্লোগান, জয় বাংলা। প্রতি উত্তরে পুষ্পর নরম গলা : জয় বাংলা।
কফিলুদ্দিন বাজারে হাঁটতে শুরু করে, সঙ্গে পুষ্প। মুখে স্লোগান- শেখ মুজিবের রক্ত, পুষ্প জবাব দেয়, বৃথা যেতে দেব না। মাছবিক্রেতা কেরামত উঠে দাঁড়ায়, হাত তোলে। কণ্ঠ মেলায় কফিলের সঙ্গে- জয় বাংলা। কেরামতের দেখাদেখি সবজিবিক্রেতা মোমিন এসে হাত ধরে পুষ্পর, মুখে স্লোগান ধরে, বৃথা যেতে দেব না। উঠে আসে জলিল ঘরামি, শেখ মুজিবের রক্ত। মুদি দোকানের ঝাঁপ ফেলে যুক্ত হয় সালাম সিকদার, কালাম সিকদারের চাচাতো ভাই। স্লোগানের অগ্নিবাণে জমাটবাঁধা মানুষগুলোর ভেতরের বরফ উত্তপ্ত হতে শুরু করে। ধসে পড়া দেয়ালের মতো এক-একটি ইট খসে পড়তে থাকে। ফলে মিনিট খানেকের মধ্যে বিশ-পঁচিশজনের একটি দল জন্ম নেয়। সবাই মিলিত প্রবাহে স্লোগান ধরে- জয় বাংলা : জয় বাংলা। শেখ মুজিবের রক্ত : বৃথা যেতে দেব না। বাজার ঘুরে বড় রাস্তায় উঠতে উঠতে শ দুয়েক মানুষের মিছিলে রূপান্তরিত হয় কফিলুদ্দিন আর পুষ্পের শুরু করা মিছিল। যত সামনে এগুচ্ছে, স্লোগানের শব্দ শুনছে, তত মানুষ যুক্ত হচ্ছে। বড় রাস্তা ধরে মিছিল যত সামনে এগুচ্ছে, মিছিলের আয়তন তত বাড়ছে বন্যার মতো, ভূমিকম্পের মতো, বজ্রকণ্ঠের মতো, বিশাল বঙ্গোসাগরের মতো। মিছিল বাড়ছেই...। তাদের মিলিত স্লোগান, শেখ মুজিবের রক্ত : বৃথা যেতে দেব না। বৃথা যেতে দেব না :