প্রিয় শওকত আলী এ অভাজন আপনার স্তব গাহে

Looks like you've blocked notifications!

১.

শওকত আলী প্রয়াত হয়েছেন!

এই সত্য যতবার মনে আসছে, অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে ভেতর বাহির!

জানি তো, মৃত্যুই মনুষ্যজীবনের শেষ গন্তব্য! অমোঘ, অবধারিত! তবুও প্রাণ অসাড় হয়ে যেতে চাচ্ছে, থেকে থেকে!

এদিকে, আজকাল বেশ কদিন হয়, একটা কঠিন মতো কী-জানি জিনিস—আমার ভেতরে বসত নিয়ে, আমাকেই খুব রূঢ়ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছে! বেহিসাব, আবেগ-টলোমলো আমাকে বাস্তবতা শেখাচ্ছে নিত্য! সরল বা সঘন-যে কোনো আবেগের মুহূর্তে কড়া কণ্ঠে বলছে, হুঁশ রাখো!

তাই ওই প্রয়াণ সংবাদে মন যখন বিবশ হয়ে আসছে একটু পর পর; তখন, সেই বিবশ মনকে ক্ষণে ক্ষণে ধমকেও চলছে-আমার ভেতরের সেইজন!

যুক্তিমানা একজন! কোনো আবেগ-কম্পনের ধার ধারতে দেখি না তাকে কখনো! কেবল যুক্তি দেয়! কেবল কঠিন সব উচিতকথা শোনায়।

মোহমায়াকে তোয়াক্কা করে না যে, তাকে কোন নামে ডাকা যায়? যুক্তি-বুদ্ধি? নাকি ঔচিত্য বোধ? নাকি বৈরাগ্য ভাবনা? আমি নিশ্চিত নই।

কিন্তু এখন এই বেদনাদীর্ণতার কালেও আমি তার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। বিস্তর সব কড়া কড়া কথা বলতে শুনছি! 

সে বলছে, বলেই চলছে; ‘এইই ভালো হয়েছে! শওকত আলী স্যারের এই দেহাবসান! এইই ভালো হয়েছে, এই প্রয়াণ! এই মুক্তি!’

‘নয়তো রোগজীর্ণ অচল দেহ নিয়ে আর কতো থেবড়ে পড়ে থাকতেন তিনি! সর্ব অর্থে সচল ছিলেন যিনি, যিনি বিপুল নিবেদিত ছিলেন সংঘে ও সৃষ্টিশীলতায়; তিনি কত সইতেন ক্রমে, নিজ শরীরের, অচল হয়ে ওঠার বেদনা? কত সইতেন অপরের ওপর নির্ভর করতে থাকার অসহায় দশাটাকে? কত? কোন মানুষই বা সেটা সইতে পারে? এই যে- ওই অচল হয়ে দেহধারণের যাতনা? কেউই পারে না! তাই, এই যে তাঁর প্রয়াণ-এটা সেই অশক্ত দেহের জন্য পরম কল্যাণ বলে জেনো! খুব কল্যাণ!’

‘তাই, শোক কেন? স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকা কেন?’

‘বরং তিনি যা সৃজন করে গেছেন, তাতে মগ্ন হও!’

‘দ্যাখো,তাঁর ফলানো শস্যরাশি, কতটা অঢেল!আদতেই তা অঢেল, বিচিত্ররকম? নাকি কেবলই তা রটনা মাত্র? কেবলই প্রতিভাস?’

‘পিতৃপুরুষ তিনি, তোমার পূর্বসূরি!’

‘নেয়ার আছে তাঁর কাছ থেকে কিছু? আছে? নিজেকে কতটা সমৃদ্ধ করার আছে তোমার, তাঁর সৃষ্টির সান্নিধ্যে এসে? কতখানি?’

‘তাহলে তাঁর কাছ থেকে ঋণ করো, নিজের জন্য! যতটা পারো।’

‘তাঁর অভিজ্ঞতার ভুবন থেকে নাও! ঋণ করো তাঁর স্বপ্ন তাঁর দর্শন, তাঁর গল্পবুননের রীতিকৌশল থেকে! নিজেকে ঋদ্ধ করো। সার্থক হও।’

 ‘তাঁকে দেয়ার কি আছে কিছু, তোমার? দাও সেটা। যদি ভালোবাসা দেয়ার থাকে, তো দাও! যদি গহিনরকম কেঁপে উঠে থাকো, তার সৃষ্টিশীলতার সৌন্দর্যে; শব্দে শব্দে বাজিয়ে তোলো সেই মুগ্ধতা!’

‘আছে মুগ্ধতা?’ সে জিজ্ঞেস করে।

‘আছে!’ আমি বলি, ‘অনেক গভীর বিস্ময় আছে! অনেক অনেক মুগ্ধতা আছে! অনেক অনেক ভালোবাসা-মাখানো ঈর্ষা আছে!’

২.

আজ কতকাল হয়—কী বিপুল মুগ্ধ হয়ে আছি-তাঁর সেজানকে দিয়ে!

তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস-দক্ষিণায়নের দিন,কূলায় কালপুরুষ,পূর্বদিন পূর্বরাত্রি-এর খুব সক্রিয় চরিত্র যে, সে হচ্ছে সেজান!

ষাটের দশকে আমার স্বদেশ যখন কেঁপে কেঁপে উঠছে সংগ্রামে-স্লোগানে, বিবিধ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে; ক্রমে এগুচ্ছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের দিকে; সেইসময়ের দ্রোহী তরুণ সেজান।

বিপ্লবী, নিঃসঙ্গ, লড়াকু ,হৃদয়বান সেজান। তাকে কখনো কখনো মনে হতে থাকে—যেন সাহস আর অদম্যতারই মনুষ্যরূপ সে! আরো অসংখ্য লড়াকুর সাথে সে-ও নিজেকে সমর্পণ করেছে বিপ্লবে, শাসক-শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে।

আর তারা নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু শাসক গোষ্ঠীর বুলেট দিয়েই তারা আক্রান্ত হচ্ছে না; আক্রান্ত হচ্ছে মূঢ়তা দিয়ে, নৈরাশ্য দিয়ে, সহবিপ্লবীদের অন্ধ-উপহাস দিয়ে।

কিন্তু তারা অদম্য। বুলেট তাদের প্রাণ হরণ করতে পারে, কিন্তু সংগ্রামের পথে তাদের অগ্রযাত্রা রুখতে পারে না!

ক্রমে সেজান কি আর শুধু একজন ব্যক্তি মাত্রই হয়ে থাকে? তা তো নয়। ক্রমে তার মধ্য দিয়ে আমরা মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি ষাটের দশকের পুরো সংগ্রামী দেশ-জনতাকে। সেজানের হৃদ-স্পন্দনে কেঁপে উঠতে শুনি দেশের সকল মানুষেরই ক্ষুব্ধ ও তেজি প্রাণ-স্পন্দনকে।

এমন নায়কের মুখোমুখি এসে অভিভূত না হয়ে কী পারা যায়! অভিভূত হতে হয়, প্রেমে পড়ে যেতে হয়, এবং তার মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে বোধ করতে হয় যে, আমি শুধু মৃত্যুগ্রস্ত হয়ে নেই। এমনকি আমি আর পাঠকের অবস্থানেও নেই! আমি হয়ে উঠেছি সেজানের অসম্পন্ন সংগ্রাম ও স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বের অংশ।

সেজান, তোমার কাছে বারবার ফিরে যাওয়াই দেখো আমার নিয়তি হয়ে উঠল শেষে!

রাখী এই উপন্যাস ত্রয়ীর গুরুত্বপূর্ণ নারী চরিত্র।

প্রথম পাঠের কালে রাখীর জন্য আমার বিশেষ কোনো ভালোবাসা জন্মায়নি। বরং বিরক্তিই জন্মেছিল। এতটা সংবেদনশীল যেই মেয়ে, এতটা শাণিত অন্তর্লোক যার, সে কেন হবে এমন লক্ষ্যহীন! তাকে বড্ড অকর্মণ্য বড় উদভ্রান্ত ও আত্মবিশ্বাসহীন মনে হয় তখন আমার। এবং আমি তার নিকট হতে পারি না কোনো মতেই তখন, সেই প্রথম পাঠের কালে। একটু বিরক্তি একটু অপছন্দ একটু বিতৃষ্ণা নিয়ে চেয়ে থাকি তার দিকে। তারপর ভুলে যাই।

তারপর দিন গড়ায়। অনেক দিনই যায়। নতুন করে একদিন যখন এই ত্রয়ী উপন্যাস পড়তে শুরু করি, তখন আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করি; আমি বিহ্বল হয়ে যাচ্ছি! তুমুল বিহ্বল! রাখীর নিস্পৃহতা, আমাকে উতলা করে তুলছে! রাখীকে আমার ভালো লাগছে! খুব খুব ভালো!

যেমন ভালো লেগেছে ইভান তুর্গেনিভের নায়ক রুডিনকে; যেমন ভালো লেগেছে অই রুডিনের আদলে গড়া বাঙালি রুডিনদের! তেমন উছলে-ওঠা ভালো লাগা জাগছে রাখীর জন্যেও!

বুদ্ধদেব বসু তাঁর “অকর্মন্য বা একটি বাঙালী রুডিন” উপন্যাসে বা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত  তাঁর “বেদে” উপন্যাসে তো সেই মেধাবী অথচ অকর্মন্য, স্বাপ্নিক অথচ নিষ্ক্রিয়, নিরুদ্যম নায়ককেই তুলে এনেছেন আর নতুন নামে ডেকেছেন!

আমি দেখতে পেতে থাকি এই ত্রয়ী উপন্যাসে সৃজন করা হয়েছে সেই স্বপ্নময়কেই! এইখানে নারী সে। এইখানে তার নাম রাখী! ভুল কালে জন্ম নেবার দণ্ডভোগ করে চলেছে এইজন। সকলের ভেতরে থেকেও চির একা।

নিরুদ্যম তো সে বটেই, কিন্তু কখনো কখনো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে যাবার সাহসও তো তার আছে!

যে নারী সামান্য জীবন দিয়ে বেষ্টিত সর্বক্ষণ, অথচ সামান্যতা তাকে স্পর্শ করে সামান্য। উচ্চকণ্ঠ বিদ্রোহী সে নয় মোটেও, অথচ সে প্রথা ভাঙে। নতুন আদর্শ গড়ে। নিঃশব্দে গড়ে চলতে থাকে! এই নারী যেন একই সাথে বাস্তব আর অবাস্তবের মিশেল! এই তাকে মনে হতে থাকে—এ আমাদেরই কন্যা, গৃহবাসী। নিত্য তাকে দেখি, কথা বলি, ভাব হয় আবার বিবাদও! আবার একটু পরেই তাকে ঘোর অচেনা লাগে! তার জীবন, তার বাসনা, তার মৌন স্পর্ধা-আমাদের কাঁপিয়ে-নাড়িয়ে-টলিয়ে ছন্নভন্ন করে দেয়!

কী বিস্ময়!

এই তো রাখীকে আমি নতুন করে চিনে উঠছি! বুঝতে পারছি, এমন অভিনব তরুণ নারীর উপস্থিতি বাংলা উপন্যাসে খুব বেশী নেই!রাখীর জন্য মমতায় ভরে উঠতে থাকে আমাদের প্রাণ!

৩.

সেজান এবং রাখী—এই ত্রয়ী উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, একথা ঠিক। কিন্তু এই তাদের কেউই এ-উপন্যাসের নায়ক নয়।

এ-উপন্যাসে নায়ক অন্য একজন।

এমনটা লক্ষ্য করা যায় “প্রদোষে প্রাকৃতজন” উপন্যাসেও। সেখানেও, শ্যামাঙ্গ বা লীলাবতী, পাত্রপাত্রী মাত্র, নায়ক সেখানেও অন্য একজন।

কে সেই নায়ক? কার গাথা রচনা করেন শওকত আলী?

কার কথা বলেন তিনি নিস্তেজ, নিরুত্তাপ বাক্যে? মহাকালের মতন নিরুত্তাপ স্বরে? কার কথা?

কাহিনীর সাথে একটু লগ্ন হওয়া মাত্রই আমরা বুঝে উঠতে পারি, কার স্তব ছড়িয়ে আছে তাঁর উপন্যাসে! জেনে যাই, কে তাঁর আখ্যানের প্রকৃত নায়ক!

তাঁর আখ্যানের নায়ক তাঁর স্বদেশ! তাঁর জন্মভূমি!

তবে শুধু সবুজে-শ্যামলে ছাওয়া স্বদেশের গল্প বলেই কৃতার্থ বোধ করেন না তিনি। তিনি তুলে ধরেন দূর ইতিহাসের সত্য। তুলে ধরেন তাঁর সমকালের রাজনীতিক বাস্তবতার আদ্যোপান্ত পরিচয়!

তাঁর আখ্যান আমাদের কখনো বিস্মৃত হতে দেয় না যে, আমাদের জীবন আসলে রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিধি-বন্দোবস্ত দিয়ে জটিল রকমে ঘেরাও হয়ে আছে।

তাঁর আখ্যান বরাবর আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, এই  যে ভূখণ্ড—এই বঙ্গদেশ—সেটি অদম্য এক জনগোষ্ঠীর মাতৃভূমি!

এই দেশের লোকসাধারণের অন্তর, চিরদিন, তীব্রভাবে যাঞ্চা করেছে শান্তি ও স্বস্তি। কিন্তু চিরকালই সেই শান্তিকে তাদের অর্জন করতে হয়েছে দুস্তর সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে! আক্রান্ত হয়েছে তারা বারবার, কিন্তু হাল ছাড়েনি। লড়াই বন্ধ করেনি কদাপি। তারপর জয় এসেছে সত্য, কিন্তু নবরূপে আবার শুরু হয়েছে তাদের অন্য লড়াই!

তিনি তাঁর জন্মভূমির গল্প বলেন, গল্প বলেন সেই জনগোষ্ঠীর—যাদের জীবনে প্রতিরোধ, সংগ্রাম, আর প্রণয়—চিরদিন সমান্তরালভাবে অবস্থান করে গেছে!

৪.

এ কথা তো জানা আছে, খুব জানা আছে যে; সব রাঙা কামনার শেষে আমরা আমাদের শিয়রে দাঁড়ানো দেখতে পাই যাকে, তার নাম মৃত্যু। এইই শেষ কথা।

সব জেনে, তাও, চোখ ভেসে যেতে থাকে! চোখের জলে কেন ভেসে যায় চরাচর! এমন ভেসে যায়! দিন ও রাত ভেসে যায়। আশা ভেসে যায়।

প্রিয় শওকত আলী, এই অশ্রু আপনাকে স্মরণ করে!

এই অশ্রু শুধু আপনার বিয়োগ-ব্যথায় নয়, আপনার সৃজন করা শিল্পসুষমার প্রতি ভালোবাসা জ্ঞাপন করেও আমাদের চোখ ভিজে যাচ্ছে! ভিজে যাবে চিরকাল!