সমাজসচেতন কবিতার অগ্রপথিক শামসুর রাহমান
‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’-স্বৈরাচারী শাসকের অত্যাচারী চিৎকার শুনে এমনই বাক্য ধ্বনিত হয়েছিল তাঁর প্রতিবাদী লেখায়, তাঁর কণ্ঠে। তাঁর চেতনায় ছিল বিশুদ্ধ নাগরিক চিত্ত আর হৃদয়ে ছিল দেশের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা। তিনিই আমাদের শামসুর রাহমান (১৯২৭-২০০৬)। সমাজসচেতন কবিতার অগ্রপথিক।
তিরিশ পেরিয়ে গেলেও রবীন্দ্র কাব্যধারা অতিক্রমণের প্রবণতা চল্লিশের দশকেও প্রবাহিত ছিল। নতুন বাঁক সৃষ্টির দায়বদ্ধতা তাঁদের মধ্যে ততটা প্রগাঢ় হয়ে ওঠেনি। পঞ্চাশের দশকে আত্মপ্রকাশ করেন কিছুটা স্বাতন্ত্র্য নিয়ে- আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে নিজের বিশেষত্বকে প্রকাশ করেন শামসুর রাহমান। আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতে, তিরিশের পরে শামসুর রাহমানই বাংলা কবিতার প্রধান কবি।
তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় কালের প্রভাবে পীড়িত, বিশ্বাসে চিড় ধরা, প্রতিবাদী ও সংগ্রামী এক কবি-মন। দেশের প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে তাঁর সরব প্রতিক্রিয়া, প্রতিটি সংগ্রামে তিনি কলম তুলে নিয়েছেন নিজের মতো করে। নাগরিক এই কবির কাব্য প্রকাশও ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত। তিনি মনে করতেন- কবিতা বড় গূঢ়াশ্রয়ী, বড় জটিল। আমি তো জীবনের স্তরে স্তরে প্রবেশ করতে চাই, কুড়িয়ে আনতে চাই পাতালের কালি, তার সকল রহস্যময়তা।
কবিতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন সমকালকে ধারণ করতে, করেছেন প্রতিবাদী চেতনা প্রকাশের দৃঢ় হাতিয়ার। তাঁর অসাধারণ কাব্যভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়েছে পাঠক। ব্রিটিশ শাসনকে সরাসরি উপলব্ধি করতে না পারলেও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন দেশভাগের ভয়াবহতা, অনুভব করেছেন নিজ বাসভূমিতে পরবাসী হওয়ার দুঃখ। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন মাতৃভূমির প্রতি গভীর টান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন তাঁর চিত্তকে তীব্রভাবে নাড়া দিয়েছিল। হৃদয়ের গভীর থেকে মাতৃভাষার প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতায়-
“তোমাকে উপরে নিলে বল তবে কি থাকে আমার?
উনিশশো বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলী বুকে নিয়ে
আছো সগৌরবে মহীয়সী।
সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে
কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে...
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।”
তাঁর ‘ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বধীনতা’, ‘স্বাধীনতা তুমি’ ইত্যাদি কবিতায় পাওয়া যায় তাঁর স্বাধীনতার প্রতি টান ও দেশের প্রতি মমত্ব। স্বাধীনতার জন্য তাঁর মন হয়েছে আকুল। স্বাধীনতা অর্জনের ভয়াবহতা তিনি চিত্রিত করেছেন কবিতায়। একজন কবির দৃষ্টিতেই শুধু নয় যেন এক বিদগ্ধ নাগরিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। সংগ্রামী সত্তার উজ্জ্বল নিদর্শন। প্রশ্নবাণে তিনি জর্জরিত করেছেন প্রতি বাঙালির হৃদয়। তাঁর দৃপ্ত উচ্চারণ-
‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্য
আর কতকাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতকাল দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
আবার অপরদিকে স্বাধীনতার কোমল স্পর্শে তিনি শীতল হয়েছেন। নিজ মাতৃভূমির করস্পর্শে কবিতার প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। নিজের বিপন্ন অস্তিত্বের পুনরুদ্ধার তিনি করতে পেরেছিলেন কবিতার ঝংকারে। স্বাধীনতা তাই তাঁর কাছে-
‘স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।’
একদিকে যেমন তিনি স্বধীনতার পুষ্প সৌরভকে অনুভব করেছেন, তেমনি অপরদিকে শাসকের অত্যাচারকে করেছেন প্রত্যক্ষ। উপলব্ধি করেছেন তাঁর প্রাণের বাংলায় শোষকের রাজত্ব। শাসকের বুটের পদতলে দেখেছেন শ্যামল বাংলাকে। তাঁর মনে হয়েছে-
‘পথপার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক;
নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।’
তবুও তিনি কখনো হতাশায় নিমজ্জিত হননি বরং সময়ের প্রতীক্ষায় থেকেছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর চেতনায় কোনো আশার চিহ্ন দেখেননি, তাঁর কাছে মনে হয়েছিল হয়তো ঈশ্বর নেই, আর শামসুর রাহমান চিন্তা করেছিলেন তাঁর বিপরীত পথে। গেরিলার আগমনের আশায় তিনি থেকেছেন উদগ্রীব। এখানেই শামসুর রাহমানের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য। চন্দন চৌধুরী যথার্থই মন্তব্য করেছিলেন, ‘শামসুর রাহমানের কবিতা বহিরাশ্রয়ী, সংগ্রামী, সময়-সচেতন, সমকাল উৎসাহী।’ সমকালের কবি বলেই বিশুদ্ধতার প্রতি তাঁর ছিল তীব্র অনাস্থা। তিনি ছিলেন সংকল্পবদ্ধ নতুন দিনের সৈনিক। তাঁর কবিতার আর্ত হাহাকার কাব্যগ্রন্থের শিরোনামগুলোই বুঝিয়ে দেয়। অন্যান্য কবিদের মতো শামসুর রাহমানের নায়কেরা চির অন্ধকারের বাসিন্দা নয়। যেখানে আলো প্রবেশ করতে পারে না সেখানেও তিনি খোঁজেন মুক্তির পথ। নতুনের মাঝে দেখেন ভবিষ্যতের আলোকিত পৃথিবী -
‘সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ তাড়ানিয়া,
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।’
শামসুর রাহমান যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এ যুগ স্বভাব কবির নয়, স্বাভাবিক কবির। জীবনানন্দ পেয়েছিলেন সরল প্রকৃতি থেকে ইন্দ্রিয়ঘন প্রকৃতির রং-রূপের সন্ধান, সুধীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন ঈশ্বরহীন পৃথিবী, বুদ্ধদেব বসু পেয়েছিলেন প্রেম ও আঁধারকে, শামসুর রাহমান পেলেন নগরজীবনকে। হয়ে উঠলেন প্রকৃত অর্থেই ‘নাগরিক কবি’। সংগ্রামী চেতনায় ধারণ করলেন শহরের প্রতিচ্ছবি।
বিরূপ বিশ্বের নাগরিক হিসেবেও তিনি সচেতন। তাঁর কবিতায় ধ্বনিত হয় সমকালীন বর্বরতা ও হিংস্ররতার চিৎকার। প্রেমিকার সঙ্গে মিলন মুহূর্তেও তাঁর মনে হয় ভিয়েতনামে বোমাবর্ষণের কথা। সভ্যতার এই কুৎসিত অহংকারের যুগে বেঁচে থাকার চেয়ে তাঁর কাছে সহজ ক্রুশে বিদ্ধ হওয়া। এই অসাধারণ চেতনায় আচ্ছন্ন ছিলেন বলেই তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন অদ্ভুত সব কবিতা যা কেবল সমকালের প্রতিধ্বনি হিসেবেই আন্দোলিত হয়নি রয়ে গেছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়েও। আর শামসুর রাহমান আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে গেছেন সমাজসচেতন কবি হিসেবে।