সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
জুলেখায় তো অর দিগে বাড়াইন্না দুই হাতের ভিতরে নিজেরে সঁইপ্পা দেওনের লেইগা ঝাঁপ দিলো; সেই অথির দুই হাতে অদিগে বেদিশা রকমে অরে জাবড়াইয়াও তো নিলো!
কিন্তুক ঝাঁপ দেওনের পরে জুলেখার মোনে হইলো যে, উয়ে মিয়াভাইয়ের বুকে ঝাঁপাইয়া পড়ে নাই! আদতে উয়ে ঝাঁপাইয়া পড়ছে এক ধু-ধু শূন্যে !
জুলেখায় কোনো একটা জুয়ান মাইনষের বুকের শক্ত জমিনে খাড়া হওয়া নাই! আছে য্যান বাতাসে ভাসা অবস্থায়! ছুট দিয়া য্যান উয়ে আইয়া পড়ছে তপ্ত রইদ-মাখা ধীর এক বাতাসের সোরোতে! সেই সোরোত তারে ভাসাইয়া নেয়! কোন দূরে ভাসাইয়া নেয়! নেয় নেয়!
ভাসাইয়া নিতে নিতে সেই সোরোত জুলেখারে ডুবায়, উপরে তোলে; ডুবায়, আবার উপরে তোলে! উথাল-পাথাল কইরা দিতে থাকে জুলেখারে! একরত্তি থির থাকতে দেয় না!
মিয়াভাইয়ের দুই হাতের ভিতরে গিয়া এমুন লাগে ক্যান! এমুন বাতাসে ভাসা, বাতাসে ভাসা লাগে ক্যান! এতো ডর ডর লাগে ক্যান! আবার লগে লগে এতো খুশি খুশি লাগে ক্যামনে! ক্যান লাগে!
মিয়াভাইরে এমুন লাগে ক্যান! ক্যান মোনে অইতাছে যে, য্যান সেয় আছে ঠিক; জুলেখারে জাবড়ানি দিয়া ধইরা খাড়াইয়া আছে সেয় ঠিকই; কিন্তুক সেয় য্যান নাইও এইখানে! নাই!
এমুন লাগে ক্যান! এমুন আন্ধা-ধোন্ধা কথা মোনে অয় ক্যান জুলেখার!
এমুন আঁতকার মিদে এতো হুজ্জোতি ঘইট্টা গেছে দেইখ্যা, এমুন বেতালা বেতালা লাগতাছে সবকিছু? সম্ভব হেইটাই কারোন। আর কিছু না।
জুলেখায় নিজেই নিজেরে বুঝ দেয়। এই ত্তো-আলা-বাইত গিয়া এট্টু থির হইয়া বইলেই, সব ঠিক লাগতে থাকবো নে আবার!
জুলেখায় তাইলে অখন বাইত যাউক গা? জুলেখায় মিয়াভাইরে জিগায়। যাই?
তয়, মিয়াভাইয়ে য্যান আর কোনো প্রকারেই দেরি না করে! বাবায় কইলাম সম্বন্ধ পাক্কা করতে গেছে গা আউজকা! সেয় য্যান অখন তরাতরি আইয়া জুলেখার বাবারে আর মায়রে যা কওনের কইয়া যায়!
কিন্তু মিয়াভাইয়ে কি একেলা আইবো এমুন গুরুতর কথাখান কইতে! একলা আইলে কেমুন বেশরমা লাগবো না বিষয়খান? জেঠীরে লগে না লইয়া আইলে মায়-বাবায় গোস্বা অয় যুদি! না না! একেলা আইলে বাবা-মায় কইলাম অসম্মানি হইবো মিয়াভাই! আপনে একলা আইয়েন না কিন্তুক!
মিয়াভাইয়ের দুই হাতের জাবড়ানির ভিতরে থাইক্কাই, এই সেই সগল কথা কইয়া শেষ করে জুলেখায়। এইবার তবে আমি যাই? আমারে ছাড়েন আলা! মিয়াভাই!
জুলেখার মোখ এই কথা কয় ঠিক, কিন্তু অর অন্তর কইতে থাকে অন্য কথা! অন্তরে কইতে থাকে—আর এট্টু থাকি! আর এট্টু!
দেহো তো নিলাজ অন্তরের কিরতিটা! কী বেহায়া বাসোনা করে! কেমুন টনটনায়! ক্যামনে হায়া-পরদার মাথা খাইয়া কইতাছে, আট্টু থাকি! আট্টু থাকি! শরম শরম!
জুলেখায় নিজ নিলাজ অন্তররে ধিক দিতে থাকে। ধিকের উপরে ধিক দিতে থাকে। কিন্তু অন্তরের তামশা দেখো! উয়ে শরমায় তো নাইই, উল্টা কইতে থাকে যে; এই মানুষটার বুকের মিদে মাথা থুইয়া বোলে সেয় জুড়াইয়া ঠান্ডা হইলো। চির জনমের লাহান ঠান্ডা হইলো! অহন বোলে অর মইরা গেলেও আর কষ্ট হইবো না! কোনো কষ্ট হইবো না!
জুলেখার অন্তরে তো অই কথা কয়, অদিগে দেহো শইল্লে কোন কথা কয়!
শইল্লে তো ঠান্ডা-শীতল কিছুই বোঝে না!
সেয় কয়, না না না! কারে কস তুই শীতল হওয়া জুলেখা! কিয়ের শীতল! এই যে আমি পুইড়া শেষ হইয়া যাইতাছি! এই যে আমি খোনে খোনে চৈত মাইস্যা দুপুইরা বেইলের লাহান তপ্ত, গনগনা হইয়া যাইতাছি! এরে নি কয় শীতল হওয়া! না না! আমি মইরা যামু! আমি মইরা যামু গা!
এমনে এমনে শীতল শীতল থাকতে থাকতে, এমনে এমনে এট্টু এট্টু পুড়তে পুড়তে এই একটু ভালা লাগতে থাকে জুলেখার! এই অকারোনে তুফান ডর লাগতে থাকে। আবার এই সেয় লাজে খানেখান হইয়া যাইতে থাকে।
এমুন হরেক জ্বালার তুফান তুফান তো জীবনে কোনোকালে লাগে নাই জুলেখার! আউজকা এইটা অর কী হইলো!
আর এই মিয়াভাইরে য্যান জুলেখার লাগতাছে অন্য একজোন অচিন মানুষ! এইটা য্যান অন্য কোন এক মিয়াভাইয়ে! জুলেখায় য্যান তারে চিনে নাই জীবনেও!
সেয় যে দুইহাতে জুলেখারে জাবড়ানি দিয়া খাড়া হইয়া আছে, তো আছেই! সেয় এট্টু লড়ে না। এট্টু কোনো আওয়াজ করে না! য্যান গহিন নিশি রাইতে গভীর ঘুমে সেয়! জাগনা নাই তার। য্যান তার চেতন নাই! জুলেখারে জাবড়াইয়া লইয়া য্যান সেয় গহন-ঘুমে ঢইল্লা গেছে!
দেহো দেহি! কোন পাগলামি জোড়াইছে অরা দোনোজোনে!
হইছে তো! আর না! জুলেখায় জোর কইরা য্যান নিজেরে হুঁশে নিয়া আসে।
এমনে নি এমুন বেতালা অইয়া খাড়াইয়া থাকোনটা ভালা কাম হইতাছে! কেউ যুদি আঁতকার মিদে আইয়া পড়ে এইনে, অগো দোনোজোনরে দেইখ্যা তাইলে কী মোনে করবো!
কলঙ্কী কইবো না জুলেখারে?
আবার, মায় যুদি অরে বিছরাইতে এইনে আইয়া পড়ে! আইয়া যুদি এই অবস্থায় দেইখ্যা ফালায়! আল্লা! কী শরমের হইবো তাইলে বিষয়খান!
মায় না জুলেখারে ঠাইট মাইরা ফালাইবো এই অবস্থায় দেখলে! মিয়াভাই! ছাইড়া দেন আলা!
কিন্তুক মিয়াভাইয়ের হাতের বন্ধন এট্টুও ঢিলা হয় না! সেয় আরো ঘন রকমে জুলেখারে জাবড়ানি দিয়া কয়, ‘না! এই জন্মে তোমারে আমি আর ছাড়মু না! এই জিন্দিগীতে না!’
‘আইচ্ছা! থাকমু। এমনেই থাকমু! কিন্তুক অহন বাইত যাই! বাবা-মায়রে কইবেন না সম্বন্ধের কতাখান? জেঠীরে কইবেন না?’
‘চলো! চলো! বাইত যাই গা! আর দেরি ক্যান করতাছি আমি!’ মিয়াভাইয়ে হঠাতই বেচইন হইয়া পড়ে! হইয়া, তরাতরি জুলেখারে জাবড়ানির তেনে ছাড়ান দিয়া অর ডাইন হাতখান ধরে। ধইরা কয়, ‘চলো! মেলা দেই। অক্ষণ মেলা দেই! কতো পোথ যে যাওন লাগবো!’
ওমা! দেওভোগ বোলে দূরের পোথ! কী যে কয় না মিয়াভাইয়ে!
অখন, গেরামে কী তারা দোনোজোনে একলগে গিয়া ওঠবো নি! মিয়াভাইয়ের যে কী বুঝ! মাইনষে দেখলে কী কইবো! একলগে কোনো প্রকারেই যাইবো না জুলেখায়! ঠাকুরবাড়ির ঘাটলার তেনে আগে যাউক গা মিয়াভাইয়ে। তার এট্টু বাদে দুই-তিনটা ডুব দিয়া, রয়-সয় কইরা যাইবো নে জুলেখায়!
‘আর যে বাপ-মায়ের ভিটিতে পাও দেওনের কোনো উপায় নাই তোমার, কইন্না!’ মিয়াভাইয়ে নরম গলায় মিন্নতির স্বরে কইতে থাকে জুলেখারে, ‘আমি যে ছুঁইছি তোমারে! আমার ছোঁয়াই তোমার কাল হইয়া গেছে! এরে তুমি তোমার জিন্দিগীর সুখ কইলে সুখ! শনি কইলে শনি! কাল কইলে কাল! এরে তো আর শোধরানি দেওনের কোনো উপায় নাই!’
কী কয় এটি মিয়াভাইয়ে! কিয়ের কাল কিয়ের শনি! এতো তেছরা কইরা কইরা কথা কইলে কইলাম জুলেখায় বেজার হইবো! অনেক বেজার হইবো!
জুলেখায় যারে জান-পরান দিয়া বাসোনা করে, তারে এট্টু ধরলে, এট্টু ছুঁইলে—শনির দিষ্টি নাইম্মা আইবো কোন হিসাবে! কোন কারোনে আইবো! মিয়াভাইয়ের কথার দেহো কোনো আগা-মাথা নি থাকতাছে আউজকা!
‘না! না জুলেখা! কোনো কথারেই আর তুমি হালকা কইরা ধইরো না! এইটা কিছু খামখা কথা না! আমি কোনো বেফজুল কথা কইতাছি না! আমি কোনো আউলা কথা কওয়ার অবস্থায় নাই গো মানুষের ঝি!’ কইতে কইতে মিয়াভাইয়ে দপদপাইয়া কান্দোন ধরে।
কান্দতে কান্দতে সেয় কইতে থাকে, “আমি আসমান-জমিন আর চান-সুরুজরে সাক্ষী কইরা কইতাছি! সত্য কইতাছি! তোমার উপরে আমার আছর পইড়া গেছে। যুগ-জীবনের লেইগা আছর পইড়া গেছে কইন্না! মাইনষের গৃহে আর তোমার তিষ্টানের পোথ নাই! কোনো উপায় নাই! আমার জিন্দিগী আর তোমার জীবন এক এক্কাকার হইয়া গেছে!”
কী কয় এইটা মিয়াভাইয়ে! কিরা-কসম কাইট্টা এইটা কী কথা কয় সেয়! জুলেখায় যে হের কথা কিছুই ধরতে পারতাছে না! মিয়াভাই!
‘শোনো গো মানুষের ঝি! আমার নয়ানের তেজ, আমার পরানের স্বপন! জুলেখা! আমার জিন্দিগীর পিদিম! আমি তোমারে জীবন-মরণ দিয়া চাই! বহুত বহুত দিন ধইরা চাই! পইল্লা যেদিন এক ঝলকের লেইগা দেখছি তোমারে—এই নিজ্জুম নিরলের ঘাটলায়; আমি সেইদিন থেইক্কা আমার দীন-দুনিয়া সগলই ভুলছি! আমি চলতে ভুইল্লা গেছি! নড়তে ভুইল্লা গেছি! দেশ ভুলছি, খেস ভুলছি! স্মরণে আছে খালি এই ভাঙ্গা ঘাটের কথাখান! এই ঘাটলাই অখন আমার জীওন-মরণ! এইই আমার একমাত্র তীর্থ-থান!’
এই ঘাটলায় জুলিরে পইল্লা—পরথম দেখছে মিয়াভাইয়ে! হেয় যে কী তামশার কথা কয়! মিয়াভাই!
“শোনো গো কন্যা! মানুষের ঝি! শোনো তুমি। আমি সত্য কইরা কই! আমারে দেখতে তোমার মিয়াভাইয়ের মতোন যে দেখতাছো, তার কারোন আমি তার রূপ ধইরা আছি! কিন্তুক, আমি অপর একজন! আমি সেয় না !”
কী কয় কী কয় এই লোকে! কোন আজাইরা, অবিশ্বাসের কথা কয়! মিয়াভাই! সগল সোম তামশা ভালা লাগে না কইলাম!
“নাম আমার সুরুত জামাল! আমি যেই বংশের পুত, সেই বংশের কেউ মাটির-গড়া আদমের বংশধর না! আমরা ভিন-জাত। আমরা নূরের-গড়া। আমরা অন্য! আমার বংশের সগলতের মতোন আমিও অপরের চিত্তির অতি ভিতরের কথাসগল জাইন্না নেওনের খ্যামতা রাখি। তোমার চিত্তির গইনে যে জাগে, তার রূপ ধরতে হইছে আমারে, তোমার সামোনে আইয়া খাড়া হওনের বাঞ্ছায়!”
‘না না! বিশ্বাস করি না! আমার লগে আপনে তামশা করতাছেন! আমি বুজছি! আমারে আপনে খামখা, হুদা কামে ডর দেহাইতাছে! মিয়াভাই! আমি কিন্তুক ডরাইতাছি !’ ডরে লাজে জুলেখার অন্তর ফাইট্টা চৌচির হইয়া যাইতে থাকে! সেই চৌচির অন্তর দেহো পলকে ক্যামনে জানি চক্ষের পানির রূপ ধইরা ফালায়। ধইরা, ঝরা শুরু করে! অজ্জোরে ঝরা শুরু করে।
না না! আর এইনে থাকোনের কোনো কাম নাই! অক্ষণ যাইবো গা জুলেখায়! অক্ষণ।
করুক মিয়াভাইয়ে—যতো হের মোনে লয়—তামশা করুক! জুলেখার কী!
অর কপালে যারে লেখে নাই বিধিয়ে, তারে উয়ে ক্যামনে জিন্দিগীতে পাইবো! পাইবো না। কোনো রকমেই পাইবো না! নাইলে, মিয়াভাইয়ে কী আগে একটা দিন মোখ ফুইট্টা জুলেখারে কইতে পারতো না হের অন্তরের কথাখান! কইছিলো কোনোদিন? কোনোসোম কয় নাই!
আবার অখন অন্তরের কথাখান কইয়াও—কেমুন উল্টা-সিধা নাই কথা জোড়াইছে! লাগবো না জুলেখার—হের সোহাগ লাগবো না! দর্দ- মোহব্বত কিচ্ছু লাগবো না! জুলেখার কিসমতে অটি লেখে নাই খোদায়!
একদিগে ধু-ধু পরান নিয়া কান্দতে থাকে মিয়াভাইয়ে, আরেক দিগে ভাঙা অন্তরের বেদনা নিয়া কাইন্দা জারেজার হইয়া যাইতে থাকে জুলেখায়! কান্দতে কান্দতে আবার জুলেখারে নিজের দুই হাতের ভিতরে ঢুকাইয়া নেয় মিয়াভাইয়ে।
কান্দতে কান্দতে মিয়াভাইয়ের হাতের ঘেরে বান্ধা পড়তে পড়তে জুলেখায় বোঝে, খোব পরিষ্কার কইরা বোঝে, এই হাতের ঘেরের ভিতরে এমুন কইরা থাইক্কাই উয়ে অর বাদবাকি জিন্দিগী পার করতে চায়! দুনিয়ার আগুন-পানি সব মোকাবিলা করতে চায় জুলেখায়—এমনে থাইক্কাই। বাঁচলে বাঁচবো, মরলে মরবো জুলেখায়—এই এমনে থাইক্কাই!
মিয়াভাইয়ে অরে রাখবো না?
“এই দেহে যতখোন রুহু থাকবো, ততোখোন তোমারে এমনে আগলানি দিয়া রাখবো আমি কন্যা!”
আমার নাম যে জুলেখা—হেইটা বুঝি অখন, সগল সোম আপনের স্মরণে থাকতাছে না?
(চলবে)