জহির রায়হানের উপন্যাস
নাগরিক মধ্যবিত্তের আটপৌরে জীবনালেখ্য
সাবলীল বাক্যচয়ন, সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনেক কথা বলার নির্মোহ শক্তি যাঁর লেখনীর বৈশিষ্ট্য, তিনি জহির রায়হান। বহতা নদীর মতো চলতে থাকা জীবনে নানা ঘটনার ঘনঘটায় তৈরি হয় যায় এক একটি জীবনালেখ্য; যার প্রকৃত আশ্রয় লক্ষ করা গিয়েছে জহির রায়হানের অনুপম লিখনশৈলীতে। শিল্পীর ক্যানভাস যেমন ফুটিয়ে তোলে জীবনের এক চিত্রিত রূপকল্প, তেমনি জহিরের অনেকগুলো গল্প। সঙ্গে উপন্যাস, চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং আরো কত কী? শিল্পীর ক্যানভাসের সীমারেখা আছে, সাহিত্যিকের নেই। আর তাই জহির রায়হানের সাহিত্য ক্যানভাস হয়ে গেছে পুরো ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশটিই। আবহমান বাংলাকে গল্প-উপন্যাসে তুলে ধরার ক্ষেত্রে জহির রায়হানের তুলনা তিনি নিজেই। সহজ-সরল বোধগম্য ভাষায় তিনি আর কিছু পারেন আর নাই পারেন, তৎকালীন বাংলা উপন্যাসধারাকে এগিয়ে নিয়েছিলেন অনেক দূর। বর্ণনায় গ্রামীণ পটভূমি, শ্রেণিসংগ্রাম, ধনীদের উচ্চাভিলাষ, নগরের আটপৌরে জীবন, মধ্যবিত্তের ভ্রষ্টাচার, প্রেম ও অনুরাগ, দ্রোহ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তির সংগ্রাম সবাই ছিল তাঁর রচনায়। বলতে গেলে বিরুদ্ধ বর্ণনাঙ্গিকে তিনি তুলে ধরেছেন সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তান তথা আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির নানা ক্ষেত্র।
জহির রায়হানের উপন্যাসে কোনো কৃত্রিমতা নেই, নেই আবেগে উদ্বেল ফানুস ওড়ানো বর্ণিল বর্ণনা। তারপরও একটি বিশেষ কাহিনীর পরিণতি, ঘটনা এগিয়ে নেওয়া থেকে চরিত্রের উপস্থাপনায় জহির ছিলেন নিজেই তাঁর তুলনা। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট, বিষয় নির্বাচন, চরিত্রসৃষ্টি আর ভাষার সহজবোধ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও আমার মনে হচ্ছে জহির মূলত নাগরিক লেখক। একমাত্র ‘হাজার বছর ধরে’ বাদ দিলে তাঁর সিংহভাগ লেখাই নগরকেন্দ্রিক ঘটনার বহুমুখী উপস্থাপন মাত্র। পাশাপাশি সেখানে ছিল দ্রোহ, আন্দোলন, বিচারবুদ্ধির স্ফুরণ আর নির্ভেজাল বিশুদ্ধ প্রেমালাপ। সব মিলিয়ে জহিরের উপন্যাসকে আমার হিসেবে তিনটি ধারায় বর্ণনা করা চলে। যদি ভাষা আন্দোলনের দিক থেকে বিচার করা যায় তবে প্রথম শ্রেণিটি হবে দ্রোহের উপন্যাস, তারপর ‘হাজার বছর ধরে’ গ্রামীণ প্রেক্ষাপট কিংবা ‘বরফ গলা নদী’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ আর ‘কয়েকটি মৃত্যু’ পুরো জীবনধর্মী বর্ণনা। তাই তাঁর প্রথম কয়েকটি উপন্যাস থেকে আলোকপাত করলে খুব স্পষ্টভাবে বোঝা সম্ভব, তিনি কীভাবে দেখতে চেয়েছেন নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনকে।
আমরা শুরুতেই যদি জহির রায়হানের প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’কে আলোচনার পাদপ্রদীপে ঠাঁই দিই তবে দেখব, সেখানে স্থান সংকুলান হয়েছে মধ্যবিত্তের নাগরিক জীবন। তাদের একেঘেঁয়ে আটপৌরে জীবন, তাদের ভ্রষ্টাচার, বাঁধভাঙা প্রেম আর বিকৃত সব চিন্তা মিলেমিশে একাকার বর্ণনায়। একজন কাসেদ, মা জাহানারা, শিউলি, নাহার, সালমা, বড় সাহেব, মকবুল সাহেব ও তাঁর তিন মেয়ের চরিত্র রূপায়ণ বিম্বিত হয়েছে মধ্যবিত্তের ভাবনালেখ্যে। এখানে জহিরের সাবলীল বর্ণনায় চরিত্রগুলোর একটিও শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের আলোয় অপরিচিত থাকেনি। জহির প্রেমের বর্ণনায় যখন দরকার চরিত্রগুলো কাছাকাছি এনেছেন, আবার দূরেও ঠেলে দিয়েছেন যখন প্রয়োজন।
শুরুটা ছিল বর্ণিল, শেষটা কেমন যেন পানসে। তাই জাহানারা-শিউলির স্বপ্নরঙিন সরব প্রেমের চেয়ে নাহারের হৃদয় গহিনে থাকা একচিলতে প্রেমের নীরবতা ঘটনার প্রান্তিকে তাকে পরিচয় করিয়েছে শেষ বিকেলের মেয়ে হিসেবে। বলতে গেলে পুরো ঘটনায় চুপ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তার ভালোবাসার রঙে কাসেদকে রাঙিয়ে দেওয়াটা এর অন্যতম দিক। এদিকে কাসেদের মনে নানা ধরনের দ্বিমুখী চিন্তা আর সিদ্ধান্তহীনতা তার মধ্যবিত্ত অক্ষম ক্রোধকে তুলে ধরেছে সুনিপুণভাবে। অদ্ভুত চিন্তায় সে জাহানারা-শিউলিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, তার ভাবনায় ঠাঁই নিতে দেখা যায় মকবুল সাহেবের মেয়েকেও। অবাক কাণ্ড হলেও কাসেদ যাকে নিয়ে কোনোদিন ভাবেনি, সেই নাহার হৃদয়ের গহিনে নীরবে ভালোবেসেছে কাসেদকে। তাকে জানতেও না দেওয়ায় তার বিয়ে ঠিক হয় অন্য কোথাও।
জীবনের আকাশে মেঘের ঘনঘটা, সে মেঘের অনেক রং। বর্ষাকাশে মেঘ যেমন কৃষ্ণ-কালো, শরতের মেঘে যেমন শুভ্রতা, তেমনি সন্ধ্যার আরক্তির আবিরের রাগ উদাস করে দিতে পারে যে কাউকে। আর জহির শেষ বিকেলের মেয়েকে চেনাতে দেখালেন ভাবনার আকাশে বেশ দূরে ঘুরছে একটা নিঃসঙ্গ চিল। শেষ বিকেলের আরক্তিম আভায় মসৃণ পাখাটা চিকচিক করছে তার। ঘটনা যখন বিয়োগাত্মক পরিণতি নিশ্চিত করে ফেলে এমন অবস্থা, ঠিক তখনই নাহার বিয়েবাড়ি থেকে দলছুট। অবাক কাণ্ডে তার ডেসটিনি তখন প্রিয়তম কাসেদ। জহির অবাক করেছেন পাঠককে। তিনি নাহারকে দিয়ে বলিয়েছেন অদ্ভুত এক ভালোবাসার কথা। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া কাসেদের প্রশ্নোত্তরে নাহারের সদুত্তর ‘আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে’। খ্যাপাটে ক্রোধে কাসেদের প্রশ্ন ‘কার সাথে?’। নাহার কোনো ব্যস্ত না হয়ে বলে, ‘আরে যার সাথে হয়েছে তার কাছেই তো এসেছি।’ আর এখানেই জহিরের সার্থকতা। তিনি বর্ণনা তো বটেই, ঘটনাকে হুট করে ভিন্ন খাতে পাঠিয়ে দেওয়ার দক্ষতায়ও একজন সফল ঔপন্যাসিক। আর পরবর্তীকালে যখন এসব কাহিনীকে ঠাঁই দিয়েছেন সেলুলয়েডে, সেখানেও তাঁর মুনশিয়ানা ছিল চোখে পড়ার মতো। আর তাই হয়তো প্রথম উপন্যাস হলেও বর্ণনার বাস্তবতা তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে একজন সফল ঔপন্যাসিক হিসেবে।
অদ্ভুত এক বাস্তবতায় কাসেদ যেভাবে পেয়ে যায় তার নাহারকে, যে কিনা জহিরের বর্ণনায় শেষ বিকেলের মেয়ে তার অনেকটা ছাপ ছিল ‘বরফ গলা নদী’ উপন্যাসেও। মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগী জীবনের আলেখ্যে অভাব-অভিযোগ, নানা হতাশা, ক্লান্তি, উদ্বেগ আর টানাপড়েনের আলেখ্য হয়ে গেছে এটি। উপন্যাসের নায়ক মাহমুদকে ঘিরেই এগিয়েছে অন্য চরিত্র, আবর্তিত হয়েছে পুরো কাহিনী ঠিক তাকে নিয়েই। মাহমুদ, তার বাবা হাসমত আলী, মা সালেহা বিবি, বোন মরিয়ম, হাসিনা, দুলু, ছোট ভাই খোকন : এ নিয়ে তাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। হতশ্রী দশার একটি বাসায় গাদাগাদি থাকে তারা, যেখানে সব থেকে পরিচিত শব্দ হচ্ছে অভাব। নিত্যদিনের সঙ্গী এ যন্ত্রণাকে সাথী করে জীবন সংগ্রামে মাহমুদ করে সাংবাদিকতা। বেশির ভাগ দিন হয় না তেমন ঘুম, জীবনের প্রয়োজনেই কষ্ট করে রাত জাগে সে। এদিকে মরিয়ম ছাত্রী পড়ায়, পাশাপাশি খুব হিসাব করে চলে। আর তাদের মিলিত চেষ্টায় কোনোক্রমে চলে যায় মধ্যবিত্তের অভাবী দিন। বর্ণনার ধারাক্রমে জহির এখানে এনেছেন লিলি, মরিয়মের বান্ধবী, মনসুর, সেলিনা, তসলিমসহ আরো অনেককে। আর ঘটনার প্রয়োজন ফুরোতেই তারা হারিয়ে গেছেন কাহিনীর গহিনে, ঠিক যেখানে যাওয়াটা উচিত সেখানেই।
মধ্যবিত্তের নাই নাই, খাই খাই দিয়ে উপন্যাসটা আরো কিছুদূর এগুতে পারত, কিন্তু জহির মনে হয় বিরক্ত ছিলেন বর্ণনা দিতে গিয়ে। তাঁর চাপা ক্ষোভ পুরো পরিবারটিকেই বর্ণনার ছুতোয় মেরে ফেলল হুট করে। থামিয়ে দিল সব ধরনের মধ্যবিত্ত আবেগকে। ভঙ্গুর নড়বড়ে একটি বাড়ির মানুষ শুধু আর্থিক অনটনে পড়ে বাসাবদল করতে পারেনি। তারপর থেমে থাকেনি তাদের উচ্চাশারা; আর ঘটনার শেষটা অনেক মর্মস্পর্শী। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে হঠাৎ ধসে পড়ে বাড়িটা; এতে মারা যায় সবগুলো মানুষ যার জহিরের বর্ণনালেখ্যে অনেক কষ্টে হলেও বাঁচতে চেয়েছিল শুরু থেকে। কিন্তু তাদের মেরে ফেলে জহির দেখিয়েছেন পরাজিত মধ্যবিত্ত সত্তাকে যার তুলনা হতে পারে, কেবল সে নিজেই। তাই তো ঘটনা তুলে ধরতে গিয়ে মাহমুদের শেষ আশ্রয় লিলির কাছে। কী মনে করে কাঁদতে থাকে সে নিজেই। তারপর লিলির কান্নাতে মাহমুদই তাকে সান্তনা দিতে থাকে। প্রশ্ন তোলে জীবনটা কি কারো অপেক্ষায় থেমে থাকে? সবাইকেই একদিন মরতে হবে আর তখনো তো পৃথিবী চলবে আপন নিয়মে। যে অফুরান প্রাণশক্তি জীবনকে চালিয়ে নিয়েছে চলেছে তার কী কোনো শেষ আছে?' আর এমনি প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত জহির রায়হান বেশ আশাবাদী।
নাম ‘কয়েকটি মৃত্যু’ হলেও আসলে সে উপন্যাসে নেই কোনো মৃত্যুর জটিলতা। বলতে গেলে সেখানে কারো মৃত্যু হয় না, কিন্তু মৃত্যুভয় পাথরের মতো চেপে বসে বুকে। সবাই ভাবতে থাকে মৃত্যুকে কীভাবে এড়ানো যায়। আর কখনো কখনো মৃত্যু এড়ানোর ভাবনা মানুষকে কীভাবে বেকুব বানিয়ে দেয় তার রূপায়ন উপন্যাসের বয়স্ক চরিত্র বাবা আহমদ আলী। এখানে তিনিও নগরকেন্দ্রিক উচ্চ মধ্যবিত্ত চরিত্রের এক সত্তা। শহরে তাঁর নিজস্ব বাড়ি, তিন ছেলে ও এক মেয়ে সবাই প্রতিষ্ঠিত। বলতে গেলে তাঁর কোনো অভাব-অনটন নেই। স্ত্রীও সাথে আছেন; আছে ছেলে, ছেলের বউ নাতি-নাতনিরা সবাই। হঠাৎ পরিবারের সবাইকে একঘরে ডেকে নিয়ে এসে বসান আহমদ আলী শেখ। তারপর চেয়ে চেয়ে তাদের দেখেন। তাঁর ভাবখানা একজন চাষি যেমন করে ফসলভরা ক্ষেতের দিকে যেভাবে চেয়ে থাকে, ঠিক সেভাবে। তিনি সবার দিকে তাকিয়ে দেখেন আর আল্লাহর কাছে মোনাজাত করে কৃতজ্ঞতা জানান।
একদিকে জীবন আর অন্যদিকে মৃত্যুভয়-দুইয়ের অভিব্যক্তি আহমদ আলী আর ছেলেদের সংলাপকে দিয়েছে অনন্যসাধারণ পরিণতি। মৃত্যুভয়ে ভীত আহমদ আলীর মনে যে পরিতৃপ্তি, তা উধাও হতে সময় লাগেনি। তিনি আবার সবাইকে ডাকেন, এবার আগের উল্টোচিত্র দৃশ্যমান হয় বুড়ো আহমদ সবার মুখের দিকে একবার করে তাকালেন। ছেলে, তাদের বউ, আমেনা আর পেঁচিকে দেখে চাইলেন স্ত্রীর দিকে। সবার মুখ পাংশুটে ভরা ফসলের ক্ষেতে হঠাৎ পোকার উপদ্রব হলে যেমনি হয়, তেমনি অসহায় আতঙ্ক নিয়ে একজন চাষির দৃষ্টি তাঁর চোখে। আর এভাবেই জহির রায়হান মানুষের জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণকে নিয়ে এসেছেন উপন্যাসের উপমায়। এখানে বর্ণনার প্রাণান্তকর প্রাণসঞ্জীবনী পরিণতি ঘটিয়েছে বাড়ির চাকর আবদুলের স্ত্রীর সদ্যোজাত শিশুর কান্নায়। বলতে গেলে এর মধ্য দিয়েই মৃত্যুভয় কেটে যায়। আর জহির দেখালেন বাচ্চাটি কীভাবে জীবনের স্পন্দন ফিরিয়ে আনল। আর তখনই ‘গিন্নি হেসে বললেন, দাঁড়ায়ে রইলে কেন, অজু করে এসো, তাড়াতাড়ি আজান দাও।’ আর জহির বর্ণনা করছেন এভাবে- ‘আহমদ সাহেবের এক নাতি তখনো পড়া মুখস্থ করছে, আল্লাহ তায়ালা বলিলেন- হে ফেরেশতা শ্রেষ্ঠ ইবলিশ, আমি তামাম জাহানের শ্রেষ্ঠ জীব ইনসানকে পয়দা করিয়াছি। ইহাকে সেজদা করো। ইবলিশ তবু রাজি হইল না। তবু সেজদা করিল না।’ আর সেখানেই সফল পরিণতি মৃত্যু আলেখ্যে অনন্যসাধারণ জীবনের জয়গানে শোভিত এ উপন্যাসটির।
নায়ক শওকত, খ্রিস্টান মার্থা গ্রাহাম, নাচের মেয়ে সেলিনা, মাতাল বউ-মারা কেরানি কিংবা আরো অনেক বাঁচার আশা নিয়ে রকে বসে থাকা এক কুষ্ঠ রোগী সবার মধ্যেই এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে আর সেটা নিয়েই জহিরের উপন্যাস ‘তৃষ্ণা’। তিনি চেষ্টা করেছেন, এক আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিতে। শহরের অনেক বড় এক ভাড়াটে বাড়ি, যে বাড়িতে শওকত থাকত। এখানে বিচিত্র ধরনের, বিচিত্র পেশার মানুষের বাস। তারা সমাজের বিভিন্ন ধাঁচের মানুষ। এদিকে খুপরির মতো একেকটা ঘর, একা মানুষ থেকে বিরাট সংসার নিয়ে বাস করছে কেউ। জহিরের বর্ণনায় সেখানে বাঙালি ছাড়াও অন্য অনেক ভাষাভাষী বাস করে এখানে। বুড়ো আহমদ হোসেন কী করে কেউ জানে না, কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলে সে অনেকটাই ত্রিকালদর্শী। এদিকে শওকত চাকরিহীন, মার্থা গ্রাহামের সঙ্গে তার পরিচয় অনেক দিনের হলেও মার্থা স্বামী পরিত্যক্তা। অবশেষে মার্থা শওকতকে আশ্রয় দিলে সে বাঁচার রসদ খুঁজে পায় তার কাছে। মার্থার কাজ ওষুধের দোকানে। সমাজধর্মের বিপরীতে গিয়ে তারা দুজনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। আলাদাভাবে নিজেদের বাসা ভাড়া নেওয়ার কথা ভাবে, এমনকি ওষুধের দোকানটা কিনে নেওয়ার চিন্তায় বাড়তি টাকা রোজগারে মন লাগায়। একদিন দোকান থেকে ওষুধ চুরি করে বাজারে বিক্রি করার অপরাধে পুলিশ এসে মার্থাকে ধরে নিয়ে গেলে শওকতের স্বপ্ন খান খান হয়ে যায়।
শওকতের ভাবনা, সুন্দর জীবন সাজানোর জন্যই মার্থা এ কাজ করেছে অথচ পৃথিবীর কোন মানুষকে বোঝায় সাধ্য কার। এখানে অনেক বড় সামাজিক অপরাধ করে মানুষ দিব্যি বেঁচে যায়, কেউ স্পর্শ করতে পারে না তাদের কেশাগ্র। আর তাই এ অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ত্রাহিচিৎকার করে ওঠে শওকত। তার সব ক্রোধ নতুন করে ভাষা পায় এক ঝড়বৃষ্টির রাতে। মাতাল বউ-মারা কেরানিটাকে শায়েস্তা করতে তার সব ক্ষোভ আর আক্রোশ ফেটে পড়ে। প্রচণ্ড ক্ষোভে সে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে, পাশে রাখা একটি দা দিয়ে কল্লা ফেলে দেয় অসভ্য বউ পেটানো জন্তুটার। হঠাৎ একচিলতে ভিন্ন ভাবনা তার, যখন নাচের মেয়ে সেলিনাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তার লোলুপ চোখ যায় মেয়েটির ব্লাউজ-বক্ষবেষ্টনীর নিচে লুকানো উদ্ধত যৌবনে। বহুবার হাতছানি দিয়ে ডেকে উঠলেও সে পারেনি, এবার পারতে চায়। অন্তত যন্ত্রণার জীবন থেকে ছুটি নিয়ে একটু দূরে কোথাও পালিয়ে বাঁচার তৃষ্ণায় শওকত বেরিয়ে পড়ে সেলিনার হাত ধরে। বৃষ্টি আর সেদিনের ঝড়-জল কিংবা কদাকার শহরকে পায়ে ঠেলে ফেলে ছুটে যায় তারা দূরে, বহু দূরে। এরপরের বর্ণনাটুকু দেখলে বোঝা যায়, লেখক আর কেউ নন, তিনি আমাদের জহির রায়হান। বর্ণনায় এসে ‘এক সুন্দর বৃষ্টিহীন রোদঝলমলে সকালে জঙ্গলের পাশে খড়ের গাদায় শওকতের বুকে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে সেলিনা, তখন চকিতে গাছের ডালের বুনো পাখির পাখা ঝাঁপটানোর শব্দ শোনা গেল। মটরশুটির ক্ষেত থেকে একটা সাদা খরগোশের বাচ্চা ছুটে পালিয়ে গেল কাছের বনের দিকে। খড়ের কোলে জেগে উঠল অনেক পায়ের ঐকতান। আঠার জোড়া আইনের পা ধীরে ধীরে চারপাশ থেকে বৃত্তাকারে ঘিরে দাঁড়াল ওদের। ওরা তখনো ঘুমুচ্ছে।’ আর ঘুমকে না ভাঙিয়ে জহির দেখালেন এক সংগ্রামী জীবনের ছবি, কিছু তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের নির্মোহ আকুতি, যাদের তৃষ্ণা শুধু বাঁচার নিমিত্তেই।
সমালোচকদের কেউ কেউ বলে থাকেন, ‘জহির রায়হান কথাসাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পাননি, তাঁর চারিত্রিক অস্থিরতা ও আবেগ তাঁকে এ বিষয়ে স্থিত হতে দেয়নি। কেননা তখন তাঁর অন্তরজুড়ে চলচ্চিত্রের বিশাল ক্যানভাস। উপন্যাস লেখা চলেছে চলচ্চিত্র নির্মাণের ফাঁকে ফাঁকে।’ মেনে নিতেই হবে তাঁর উপন্যাস লেখা আর চলচ্চিত্র নির্মাণের সময়কালটা একই; অর্থাৎ ১৯৬০ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রদোষকাল। তাই আমি মনে করি বর্ণনার ধারাক্রম, কাহিনীর সাবলীলতা আর চরিত্র রূপায়ণে কখনো ছেদ পড়েনি জহিরের। বরং এটুকু বলতে হবে জহির রায়হানের গল্প-উপন্যাস আমাদের কথাসাহিত্যকে দিয়েছে অন্যমাত্রা।
বিশেষ সময়ের চিত্রালেখ্য যাঁর বর্ণনার আরশিতে বিম্বিত হয় স্পষ্ট ও সাবলীল ভঙ্গিতে, তিনি জহির রায়হান। অন্তত তিনি যা-ই লিখেছেন, তাতে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না; বরং সাবলীলতা ছিল তাঁর একমাত্র বৈশিষ্ট্য। তাই জহির রায়হানের উপন্যাসে নগর ও মধ্যবিত্তের জীবনালেখ্য ঠাঁই পেয়েছে অনন্য এক বাস্তবতায়। বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের প্রদোষকালে মধ্যবিত্ত জীবন কেমন ছিল, তখনকার নাগরিক ভাবনাগুলো কোন দিশায় আবর্তিত হত এর এক বায়োস্কোপ বলা যায় জহিরের রচনাগুলোকে। বর্ণনায় জটিলতা বাদ দিয়ে সহজবোধ্যতা ও যুগের চাহিদাকে ঠাঁই দিলে তা লেখার মান সমুন্নত রেখেও কত দ্রুত জনপ্রিয়তার শীর্ষে যায় তার স্পষ্ট প্রমাণ জহির রায়হানের রচনা। অন্তত মধ্যবিত্তের বর্ণনা নিয়ে তার যে উপন্যাস সেগুলো চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার অনেক আগে থেকেই এক একটি সবাক চলচ্চিত্রের চেয়ে কম নয়। তাই জহিরের উপন্যাস পাঠ করলে সেটাকে নিছক কোনো উপন্যাস পাঠ না বলে বিশেষ সময়ের প্রামাণ্যচিত্র চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলার একটি চেষ্টাও বলা যেতে পারে। কারণ তিনি কাহিনীর আবর্তনে গুরুত্ব দিতেন সময়কেও। অর্থাৎ বাগাড়ম্বর কিংবা অপ্রয়োজীয় বাক্যালঙ্কারের বদলে তিনি আশ্রয় করেছেন সরলতা আর সাবলীল বর্ণনাকে। আর এদিক থেকে চিন্তা করলেও তাঁর লেখায় বিমূর্ত থেকে মূর্ত হয়েছে নাগরিক মধ্যবিত্তের আটপৌরে জীবনালেখ্য।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।