রম্যগল্প
গর্দভ সমাচার
দিন কয়েক আগে একটি পত্রিকায় পুরনো এক গল্পের নব রূপায়ন পড়লাম। গল্পটি আগেও শুনেছি। তবু আবার পড়তে গিয়ে নতুন করেই ভালো লাগল। গল্পটি অনেকটা এরকম-
প্রাচীনকালে এক সামন্ত রাজকুমারের সাথে পাঠশালায় পণ্ডিত মশায়ের কাছে সেই রাজ্যের রজকের পুত্রও পড়াশোনা করত। সেই সুবাদে রাজকুমার ও রজকপুত্রের ভেতর এক ধরনের হৃদ্যতাও গড়ে উঠেছিল। যা কি না তৎকালীন সামান্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একে বারেই অকল্পনীয় ব্যাপার। ওই রজকপুত্রের বাবা রাজবাড়ীর কাপড় চোপড় ধোয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। যতই একই পাঠশালায় একই শ্রেণীতে এবং একই পণ্ডিতের কাছে বিদ্যাভ্যাস করুক না কেন শ্রেণি চরিত্রের ব্যবধান না মেনে চলা অসম্ভব! তবুও ধোপার পুত্র কৃষ্ণদাস ও রাজকুমার গোবিন্দ দেবের ভেতরে কিছুটা হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল রাজকুমারের ঔদার্যের কারণে। কালের ব্যবধানে রাজার পরলোকগমনের পরে স্বভাবতই রাজকুমার গোবিন্দ দেব রাজপদে অভিষিক্ত হলেন। পাঠশালার সহপাঠী ধোপার ছেলে কৃষ্ণদাসের কথা হয়তো আর মনেই থাকল না।
এদিকে বৃদ্ধ রজকও একদিন মারা গেলেন। গরিবরা মারাই যায়, তারা পরলোকগমনও করেন না। ইন্তেকালও ফরমায় না। রজকের মৃত্যুর পর যথারীতি কৃষ্ণদাস রাজবাড়ীর ধোপা হিসেবে নিয়োজিত হয়। কৃষ্ণদাস খুব ভোরবেলায় গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে রাজবাড়ীতে যখন পৌঁছে তখনো রাজপুত্রদের কারোই সুখনিদ্রা ভাঙে না। দাস-দাসীরা, রাজা, রাণি ও অন্যান্য রাজকীয় ব্যক্তির পূর্বদিনের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় বুঝিয়ে দেয় এবং আগের দিনের ধোপদুরস্ত কাপড়-চোপড় বুঝে নেয়। অতিপ্রত্যুষে রাজবাড়ীর পিছনের খিড়কি পথে কৃষ্ণদাস ধোপাকে গর্দভ নিয়ে পৌঁছুতে হয় এজন্য যে- পাছে রাজা বা কোনো রাজপুরুষের ঘুম ভেঙেই ধোপার মুখদর্শন করে অযাত্রা না হয়। সেকালে মানুষ অযাত্রা-কুযাত্রা প্রভৃতি নানা সংস্কারে ভুগত। অবশ্য আজও আমাদের সমাজ জীবনে এসব নানা ধরনের কুসংস্কারের অন্ত নেই। যাই হোক, নতুন রাজার রাজত্বে সবাই ভালোই ছিল। সুখেই ছিল। দীর্ঘ একযুগেও রাজা গোবিন্দ দেবের সামনে পড়ার চেষ্টা করেনি ধোপা কৃষ্ণদাস।
রাজা গোবিন্দ দেব সজ্জন, সচ্চরিত্র ও ধার্মিক ছিল। প্রজাপালক রাজা বলতে যা বোঝায় তাই ছিল সে। কোনো প্রকার নেশা ভাং অথবা রংমহলে রাত্রি যাপনের বদ অভ্যাস ছিল না যা সেকালের এবং একালের অনেক রাজা রাজরাদেরই থাকে। একালে অবশ্য আমাদের এতদাঞ্চলের বহুদেশেই সামন্ত রাজা বা রাজতন্ত্র নেই। তার পরিবর্তে নানা বিবর্তনের ভেতর দিয়ে গণতন্ত্র চালু হয়ে গেছে। এখন রাজার পরিবর্তে সব রাজকীয় ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান।
যাই হোক, বলছিলাম রাজা গোবিন্দ দেবের কথা। গোবিন্দ দেব অসময়ে ঘুমাত না। নেশা ভাং করত না, সে কথা তো আগেই বলেছি। তবে রাজার একটি নেশা ছিল। সে নেশার নাম মৃগয়া। রাজা গভীর জঙ্গলে পশু শিকার করতে খুব পছন্দ করত। সেজন্য প্রায়ই শিকারে যেত। সেকালে রাজারা যেকোনো কর্মে যাওয়ার আগে রাজজ্যোতিষীর পরামর্শ নিত। শিকারে যাওয়ার আগে তো পরামর্শ নিতেই হতো। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দৈব দুর্ঘটনা প্রভৃতির তো কোনো মা-বাপ ছিল না। কখন যে কী হয় বলা তো যায় না। সেকালে আজকের মতো যন্ত্রদানবের অত্যাচার ছিল না। কোনো দুর্ঘটনা যদি নাও ঘটে তবু আদৌ ভালো শিকার মিলবে কি না প্রভৃতি জানার জন্যও রাজারা রাজজ্যোতিষীর পরামর্শ নিত। তা ছাড়া রাজ জ্যোতিষীরা ছিল সেকালে রাজার অন্যতম পরামর্শদাতা বা মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন।
রাজা গোবিন্দ দেব শিকারে যাব। যথারীতি যাওয়ার আগে রাজজ্যোতিষী গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানাদি, তিথি, লগ্ন প্রভৃতি সূচারুরূপে গণনা করল। শুভদিন ও যাত্রার শুভক্ষণ নির্ধারিত হলো। অন্যান্য উজির নাজির, পাত্র-মিত্রের সাথেও বিস্তর শলা-পরামর্শ হলো। সবার পরামর্শ অনুযায়ী হেমন্তের এক মেঘমুক্ত শিশিরস্নাত প্রভাতে লোক-লস্কর, হাতি ঘোড়া, পাইক-পেয়াদা, উজির নাজিরসহ রাজা গোবিন্দ দেব রওনা হল শিকারে।
এদিকে রাজবাড়ীর রজক কৃষ্ণদাস জানত না যে ওই দিন রাজা শিকারে যাব এবং ওই পথেই। রজক প্রভাতে যথারীতি রাজবাড়ীতে আসছিল প্রতিদিনের মতো গর্দভের পিঠে কাপড়ের বোঝা চাপিয়ে এবং নিজেও সওয়ার হয়ে। পড়বি তো পড় এক্কেবারে রাজকীয় শোভাযাত্রার সামনে! রাস্তার দুই পাশে ঝোপজঙ্গলও কিছু ছিল না যে, লুকিয়ে গর্দভসহ আত্মগোপন করবে। হস্তিপৃষ্ঠে আরোহী রাজা রজককে দেখল এবং বহুদিন পর হলেও বাল্যকালের সহপাঠীকে চিনল। অযাত্রার প্রতীক রজক ও গর্দভ দেখে উজির-নাজির, পাত্র-মিত্ররা বিব্রত বোধ করল এবং স্বভাবতই রুষ্ট হলো। কিন্তু রাজা আদৌ বিব্রত হলো না। বরং এতকাল পরে সহপাঠীকে দেখে হাতি থেকে নামল। তার কুশল বার্তাদিসহ হাল অবস্থা জানল। এত দিন রাজবাড়ীতে কাপড় ধোয়ার কাজের জন্য নিয়মিত যাতায়াত সত্বেও রাজার সাথে সাক্ষাৎ না হওয়ায় রাজ গোবিন্দ দেব বিস্ময়বোধ করল এবং উদারভাবে কৃষ্ণদাস কে দেখা-সাক্ষাৎ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখল।
রাজার এত উদারতা ও এত কথাবার্তার পরও ভীত সন্ত্রস্ত কৃষ্ণদাস রজক যদি রাজাকে কিছু না বলে এবং কুশলাদি জিজ্ঞেস না করে তা নিতান্তই খারাপ দেখায়। তা ছাড়া কথায় বলে ‘বড়র পিরিতি বালিয়া বাধ’, রাজড়াদের মেজাজ মর্জি এই ভালো, তো এই খারাপ। রাজা যদি রুষ্ট হয় তবে তো সমূহ বিপদ! একালে অবশ্য শুধু রাজারা নয়, রাজ পুরুষ বা ঊর্ধ্বতন রাজকর্মচারী, উজির-নাজির, কতোয়াল যে কেউ রূষ্ট হলেই বিপদ। সেকালে এত সব লিখিত আইনকানুন ছিল না। রাজার মুখের কথাই ছিল আইন। আজকাল শুনি, নানা অভিযোগ আসে, খবরের কাগজে বিবৃতি আসে, বড় বড় রাজ পুরুষেরা তো আছেই, এমনকি ছোটখাটো রাজকর্মচারীরা কারো ওপর রূষ্ট হলেই ওই সব কোনো না কোনো আইনে আটকে দিতে পারে।
কিন্তু সেকালে এসব ঝামেলা ছিল না। রাজরোষকে সবাবই ভয় পেতেন। রজকের মতো সাধারণ লোকের পক্ষে রাজরোষকে ভয় না করা- সে তো অসম্ভব ব্যাপার। যাই হোক, ভয়ে হোক, ভদ্রতাবোধের জন্য হোক, রজক কৃষ্ণদাসও সবিনয়ে রাজার কুশলাদি জিজ্ঞেস করল। রাজা এত প্রত্যুষে মৃগয়ায় চলেছে জানতে পেরে রজক কৃষ্ণদাস বলল- রাজা মশায়ের মৃগয়ার জন্য তো আজকের দিনটা ভালো না।
একজন সাধারণ রজকের মুখে এ ধরনের কথা শুনে রাজা বিস্মিত হলো। শুধাল, কেন ভালো না? রজক বিনীতভাবে জবাব দিল, ‘মহারাজ-আজ আকাশের অবস্থা ভালো না। ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে।’
রজকের মুখে ভবিষ্যদ্বাণী শুনে রাজজ্যোতিষী তো মহাখাপ্পা, অন্য রাজ পুরুষরাও ক্ষুব্ধ হলো। এমনিতেই যাত্রাকালে রজক ও গর্দভের মুখ দর্শন করায় যাত্রা নাস্তি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তদুপরি বেটা ধোপা বলে কি না ঝড়বৃষ্টি হবে। তিনি একেবারে মহা জ্যোতিষী হয়েছেন! যতই তারা ক্ষুব্ধ হোক না কেন- রাজা যেহেতু রজকের সাথে বয়স্য (বন্ধু) সুলভ ব্যবহার করছে সুতরাং কেউ আর রাজার সামনে কৃষ্ণদাসকে গালাগাল দেওয়ার সাহস করল না। রাজা কৃষ্ণদাসের কথায় তেমন একটা আমল দিল না। ছোট জাতের চপলতা ভেবে একটু মুচকি হেসে রাজা সামনে এগিয়ে গেল।
কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছাবার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেল। জোর বাতাস বইতে শুরু করল। এর কিছুক্ষণ পরই প্রবল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। জঙ্গলের গাছ ভেঙে পড়ে, হাতি, ঘোড়া, লোক-লস্কর মায় রাজজ্যোতিষী পর্যন্ত আহত হলো। কোনো ক্রমে সন্ধ্যায় ঝড় থামলে প্রাণে বেঁচে রাজা প্রাসাদে ফিরে এলো।
সঙ্গত কারণেই পরের দিন রাজদরবারে রজক কৃষ্ণদাসের ডাক পড়ল। কৃষ্ণদাস ভয়ে ভয়ে কম্পিত কলেবরে হাত জোড় করে রাজার সামনে এসে দাঁড়াল। ভাবখানা এই বুঝি গর্দান নেওয়ার হুকুম হবে।
কিন্তু না সে সব কিছুই হলো না। রাজা সমাদরে কৃষ্ণদাসকে কাছে ডেকে পারিষদদের মাঝখানে বসাল। তারপর জিজ্ঞেস করল- কৃষ্ণ তুমি জ্যোতিষ গণনা এত ভালো কোথায় শিখলে? বিস্ময়ে বিমূঢ় কৃষ্ণদাস বলল- মহারাজ আমি তো জ্যোতিষচর্চা করি না, এ বিষয়ে জানিও না কিছু।তবে? কাল এভাবে ঝড় বৃষ্টির পূর্বাভাস দিলে কেমন করে? এবার রজক একটু হেসে জবাব দিল, মহারাজ সেটাতো আমার গাধার কৃতিত্ব। আমি গত এক দশক পর্যন্ত লক্ষ করে আসছি। যখনি বড় ধরনের ঝড় বৃষ্টি হয়, তার আগে আমার গাধার লেজ শক্ত হয়ে যায়, আর গায়ের পশম খাড়া হয়ে যায়। গতকাল সকালেও তাই হয়েছে আর সে জন্যই আমি বলেছিলাম ঝড় বৃষ্টি হবে।
রজক কৃষ্ণদাসের কথা শুনে রাজা বিস্মিত ও বিমুগ্ধ হলো। তখুনি স্থির করল গুণী গদর্ভকে পুরস্কৃত করা দরকার। তাই সেদিনই গাধাকে রাজার মন্ত্রী নিযুক্ত করা হলো।
বলা বাহুল্য সেই থেকে মন্ত্রিসভায় দুয়েকটি গর্দভ নিয়োগ দেওয়ার রীতি চালু হয়ে যায়।