দিব্যেন্দু পালিতের গল্প
অন্য রূপকথা
বিকেলের দিকে কোনো সময়ে এসেছিল চিঠিটা-সোহিনী তখন বাড়ি ছিল না। কে এনেছিল বা কীভাবে এলো সেটা জানা প্রাসঙ্গিক নয়। চিঠির কথা সে নিজেও জেনেছে পরে। ঘটনা এই যে সেদিন তার বাড়িতে থাকা ও না থাকার মাঝখানে বাড়ির মানসিকতা এমনভাবে বদলে যাবে তা সে কল্পনা করতে পারেনি।
সকালে যখন চাকরিতে বেরুবার জন্য তৈরি হচ্ছে, মা বলেছিল, ‘মাঝখানে আর কটা দিন। এখন আর অফিসে যাওয়ার কী দরকার! বাবার কথামতো রেজিগনেশন দিয়ে বাড়িতে থাকলেই পারতিস!’
সোহিনী বলেছিল, ‘এখনো অনেক দেরি আছে। আঠাশ দিন। এখনই তাড়া দিচ্ছ কেন?’ মা বলল, ‘বিয়ের চিঠি ছাপা হয়ে গেল, কাল-পরশু থেকে নেমন্তন্ন করতে বেরুতে হবে। আত্মীয়স্বজনদের জানানো হয়ে গেছে। বাজারহাট অনেক বাকি। তুইও তো যাবি সঙ্গে, নাকি? এই ৯টায় বেরুনো, ৭টায় ফেরা-এর মধ্যে এতসব হবে কখন!’
‘হবে রে বাবা, হবে! এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন!’ এক মুহূর্ত নিজের মতো করে ভাববার সময় নিয়ে সোহিনী বলল, ‘রেজিগনেশন দিতে হবে কেন! ছুটি নেব।’ দরকারে উইদাউট পে ছুটি নেব।’ ‘ছেলের বাবা পরিষ্কার বলে দিয়েছে, চাকরি করা চলবে না। তখন তো মাথা নাড়লি!’
মায়ের কথা শুনে হাসিই পেয়েছিল সোহিনীর। হাসিটা জিইয়ে রেখে বলল, ‘শিখিয়ে-পড়িয়ে পাঠিয়েছিলে। সব কথাতেই মাথা নাড়তে বলেছিলে। সে জন্যই মাথা নেড়েছিলাম। কী করব না করব সেটা বিয়ের পর বুঝব।’ কথাগুলো বলে অফিসে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল সোহিনী। বেরুবার আগে বলল, ‘কেনাকাটা যা করার তোমরাই কোরো। আমার কোনো পছন্দ-অপছন্দ নেই। তেমন দরকার হলে অ্যাডভান্স নোটিশ দিও। এক-দুদিন ক্যাজুয়াল লিভ নেব।’
২০১৩ সালের কোনো এক বিবাহের মাসে এই কলকাতার ২৬-২৭ বছরের একটি শিক্ষিতা যুবতী যখন নিজের বিয়ের ব্যাপারে তার মায়ের সঙ্গে এই ধরনের কথাবার্তা বলে এবং সংলাপে ধরা পড়ে, তখন তার মানসিকতা নিয়ে সন্দেহ করার সুযোগ থাকে। প্রশ্ন ওঠে, শেখানো-পড়ানো হয়ে সে কেন পুত্রবধূ হিসেবে মনোনীত হওয়ার জন্য গিয়ে দাঁড়াল, মাসান্তে প্রায় আড়াই হাজার টাকার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথায় মাথা নাড়ল ইত্যাদি। বিশেষত, সোহিনী নিজেই যখন বোঝে সে হেলাফেলার যোগ্য কোনো মেয়ে নয়- কলেজে পড়ার সময় ‘উইমেন্স লিব’ বিষয়ে বিতর্কে যোগ দিয়ে প্রাইজ পেয়েছে, নিজেকে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী চালানোর কথাও ভাবে এবং জানে, অন্তত বয়স, রূপ শিক্ষা এবং বাঁধা রোজগারের যোগ্যতায় ইচ্ছে করলেই স্বামী হিসেবে কাজ-চালানোর মতো একটা পুরুষ সে যখন তখন পেয়ে যেতে পারে। আগের কথা চুলোয় যাক, সাড়ে তিন বছরের চাকরিতে এটুকু বুঝেছে, এই অফিসেরই বিবাহিত, অবিবাহিত সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই পছন্দ করে তাকে, কেউ কেউ একটু বেশিই করে। এর কারণ বিভিন্ন এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অ্যাপ্রোচ, কথা বলা কি তাকানোর ধরন থেকেই সে বুঝে নিতে পারে কে সান্নিধ্য চায়, কে শরীর। এদের মধ্য থেকে বিবাহিতদের বাদ দিলে অন্য যারা থাকে, মাথা নাড়লে তাদের কেউ কেউ যে বিয়েতেও রাজি হয়ে যাবে- এটা বুঝতে অসুবিধে হবে কেন! সোহিনীর মগজে ও শরীরে অনেকগুলো চোখ ও জিব আছে, সব সময়েই সক্রিয় এই ইন্দ্রিয়গুলো কাজ করে কম্পিউটারের মতো। আজ মিনিবাসে উঠে, জায়গা পেয়ে, বসে অফিসে যেতে যেতে সোহিনী আরো একবার নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করল, এই বিয়েটার ব্যাপারে এ পর্যন্ত সে যা যা করেছে সেগুলো তার মতো একটি মেয়ের পক্ষে ঠিক কি না, যা যা করেছে সেসব না করে অন্য কিছু করতে পারত কি না। এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, এ ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারত! আঠারো থেকে ছাব্বিশ, এই আট-নয় বছরে ভালোবাসা-টাসার অভিজ্ঞতা তো কম হয়নি!
কলেজে পড়বার সময় প্রথম যার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, চিঠি চালাচালি, এখানে-ওখানে যাওয়া, ছোঁয়াছুঁয়ি, এমনকি এক-দেড়বার চুমু-টুমুও হয়- অর্থাৎ প্রায় সময়েই প্রেম যা যা করিয়ে নেয় সেসব হওয়ার পর সমবয়সী ও সহপাঠী সেই প্রেমিকটি ছিটকে যায়। আরো পরে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে নবীন কিন্তু পরিণত মনের যে অধ্যাপক আকর্ষণ করেছিল তাকে, ভালোবাসায় ভরে রাখার প্রক্রিয়ায় সে তাকে অক্ষত রাখেনি, কিন্তু বিয়ের নামে সরে পড়ে। দু-দুটো অভিজ্ঞতার পরে সোহিনী বুঝে নিয়েছিল নিজেকে দিয়ে হবে না, কারণ বাস্তব ও কল্পনার মধ্যবর্তী দূরত্ব কমতে কমতে যে জায়গায় এসে দানা বাঁধে, সেখানে পৌঁছানোর আগেই সে ছিঁড়ে যাচ্ছে। অথচ কাউকে পুরোপুরি পাওয়ার ইচ্ছেটা মরছে না। এই অবস্থায় চাকরি পাওয়ার পর ক্রমশ নিজেকে ছেড়ে দেয় ভাগ্য ও অভিভাবকদের ওপর। এরপর যা-যা করার অভিভাবকরা তা-ই করল। খবরের কাগজে ‘পাত্র চাই’ কলামে বিজ্ঞাপন দিল। ‘পাত্রী চাই’ কলাম দেখে একই বয়ানে চিঠি ছাড়ল অনেকগুলো। আত্মীয়স্বজন-পরিচিতদেরও বলা হলো এবং এমন পরিস্থিতিতে আরো যা হয়, দুলতে লাগল প্রায় পছন্দ ও অপছন্দের দোটানায়। বিজ্ঞাপনের উত্তরে খোঁজ পাওয়া সুমন নামে নিউ আলিপুরের এক পাত্রের নির্বাচন যখন প্রায় পাকা- বস্তুত এ ক্ষেত্রে পাত্রপক্ষের আগ্রহই ছিল বেশি, ঠিক সেই সময়ে সোহিনীর ছোট মাসির দেওরের বিয়েতে ঘটনাচক্রে পাওয়া গেল শুভঙ্করকে, আঠাশ দিন পরে যার সঙ্গে সোহিনীর বিয়ে হবে। শুভঙ্কর সোহিনীকে দেখল এবং সোহিনী শুভঙ্করকে-যাকে বলে শুধু চোখের দেখা, গভীর আলাপ কিংবা নেপথ্যে তবলা বেজে ওঠার মতো কোনো নাটকীয় ঘটনা না ঘটলেও ছোটমাসির তৎপরতায় পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটল সিনেমার ধরনের। কাউকে রিজেক্ট করতে খারাপ লাগে বলে সুমনের পরিবারকে জানিয়ে দেওয়া হলো, সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে ইত্যাদি। যদিও হওয়া না-হওয়ার মাঝখানে একদিন আহ্লাদিত সুমন টেলিফোনে কথা বলেছিল সোহিনীর সঙ্গে। বাইরে কোথাও আলাপ করতে চেয়েছিল, তখনো অনিশ্চিয়তার কারণজনিত দ্বিধায় এড়িয়ে যায় সোহিনী। সে একজন স্বামী চায়, এটাই বাস্তব, সোহিনী ভেবেছিল, এখনো তো বিয়ের কথা পাকা হয়নি, সে খামোখা দেখা করবে কেন! বাইরে-টাইরে থেকেও শুরু হয় যত গোলমাল; সে তৃতীয়বার ঠকতে চায়নি।
বলতে কি, শুভঙ্করের সঙ্গে বিয়ের কথা পাকা হয়ে যাওয়ার পর ভাবী স্বামীর সঙ্গে একটু আলাপ করে নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল সোহিনীর নিজেরই। যার সঙ্গে কাটাতে হবে জীবনের বাকি অংশ সেই মানুষটাকে একটা বিয়েবাড়ির ভিড়ে একবারই দেখল, দু-চারটে কথা বলল, তারপর আর যোগাযোগই হলো না, এমনকি সেও সোহিনীকে একটু-আধটু জানার আগ্রহ দেখাল না- সমস্ত ব্যাপারটা ছেড়ে দিল তার বাবা-মায়ের ওপর, এটাই বা কেমন কথা! এমন কী হতে পারে যে তার যেমন তেমনি শুভঙ্করের জীবনেও ঘটে গেছে দু-একটা ব্যর্থতার ঘটনা এবং সেই জন্যেই শুভঙ্করও ঠিক করে নিয়েছে, পাত্রীকে চোখে দেখার পর সম্বন্ধ পাকা করে ব্যাপারটা বাবা-মায়ের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। এটা সম্ভব হতে পারে। তা না হলে একজন শিক্ষিত ও রীতিমতো উপার্জনশীল আধুনিক যুবক এমন নির্লিপ্ত হবে কেন!
সাতপাঁচ ভেবে নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখেছিল সোহিনী। এতদিনে শুভঙ্করের বাড়ি, অফিসের ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার মুখস্থ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এই যে নিজেকে নিরস্ত করে রাখা- অফিসে যেতে যেতে আজও ভাবল সোহিনী: এটাই উচিত; এই ধৈর্য, আত্মবোধ ও সংযম অভ্যাসে থাকলে আগের দুটো ঘটনায় সে নিশ্চয়ই ঠকে যেত না। এসব ভাবতে ভাবতেই সোহিনী চলে এলো অন্য ভাবনায়: বিয়ের পর শুভঙ্কর কি কোনোদিন জানতে পারবে তার পতিব্রতা স্ত্রী বিয়ের আগের জীবনে নিষ্পাপ এবং অক্ষত ছিল না? এমন হওয়া কি সম্ভব যে, যাকে ভালোবেসে সে ভুল করেছিল, সেই অধ্যাপক ও শুভঙ্করের পরিচয় আছে, বা পরিচয় না থাকলেও একদিন হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে দুজনের এবং তার স্ত্রী সোহিনী সম্পর্কে সবকিছু জানতে পারবে শুভঙ্কর? তখন কী হবে! সোহিনীর কি উচিত ছিল বিয়ের আগেই শুভঙ্করকে নিজের অতীত সম্পর্কে সবকিছু জানিয়ে দেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে কোনো ঝামেলা না পাকায়?
এটা এমনই একটা ভাবনা যা এগোতে চাইলেও এগোয় না, হঠাৎ ফেঁসে যাওয়া গাড়ির হর্নের শব্দের মতো লকেট হয়ে ঘুরতে থাকে মাথায়। সোহিনীরও তা-ই হলো। শেষ পর্যন্ত সে ভাবল, নিজেকে এত কচলিয়ে লাভ কী, সেই কলেজে পড়ার সময় থেকেই আশপাশে তাকিয়ে সে কি দেখেনি অনেকেই গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসীপাতা নয়! শুভঙ্করকে সে চেনে না- সে কেমন, তাই বা জানবে কেমন করে! আগ বাড়িয়ে এসব নিয়ে আলোচনা করে মাঝখান থেকে বিয়েটাই ভেস্তে যাক আর কি! বরং চুপচাপ থাকাই ভালো; যেমন চলছে চলুক। আর তো মাত্র আঠাশ দিন। না হয় বিয়ের পর থেকেই শুরু হবে তাদের চেনাশোনা! অতীত আবার কি পুরোনো ঘটনাগুলো আবছাভাবে মনে পড়লেও সেসব নিয়ে আর তো জ্বালা অনুভব করে না সে! তাহলে এত ভাবছে কেন!
সেদিন অফিসে পৌঁছে এবং তারপরে সন্ধেয় বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত বেশ খোশমেজাজে থাকল সোহিনী। এতটা সময়ের মধ্যে একবারও ভাবতে পারেনি সে একটা বিপর্যয়ের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছে।
বাড়ি ফিরে সোহিনী দেখল, সকালের দেখার সঙ্গে কিছুই মিলছে না। ছোট বোন রোহিনী দরজা খুলে দিয়েই সরে পড়েছিল। দেখল – মা : মঞ্জু, বাবা : বিকাশ, দাদা : দেবাশিস জটলা করছে শোওয়ার ঘরে বসে। সবারই মুখচোখ অন্যরকম। তাকে দেখে মঞ্জু উঠে এল তাড়াতাড়ি- তার চোখ দুটো ঈষৎ লাল, মুখ থেকে সকালের হাসি ও প্রশ্রয় মুছে গিয়ে ফুটে উঠেছে বিষণ্ণতা। সোহিনীকে তার নিজের ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘হাতমুখ ধুয়ে নে। চা করা আছে, দিচ্ছি-’
অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সোহিনী জিগ্যেস করল, ‘কী হয়েছে, বল তো?’
‘বলব পরে।’ মঞ্জু মায়ের মতোই হয়ে উঠল, ‘আগে জিরিয়ে নে একটু, চা-টা খা।’
আঠাশ দিন পরে যে মেয়ের বিয়ে, এ রকম পাল্টানো পরিস্থিতিতে তার যেমন প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত, তেমনই হলো। সোহিনী ধরেই নিল, ঘটনাটা তাকেই কেন্দ্র করে- কেউ মারা-টারা গেল নাকি! বরের বাড়ির কেউ? এসব চিন্তা করে অনিশ্চিত ধারণা থেকে সে বলল, ‘তা না হয় যাচ্ছি। ঘটনাটা কী, বলবে তো?’
মেয়ের প্রশ্নে মঞ্জু হঠাৎ দিশেহারা বোধ করল এবং নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে উপচানো গলায় বলল, ‘আমি আর কী বলব! যা জানার বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।’
এরই মধ্যে চা নিয়ে এসেছিল রোহিনী। কাপটা ওর হাত থেকে নিয়ে কিছু বলবার আগে দুটো চুমুক দিয়ে নিল সোহিনী। তারপর জিগ্যেস করল, ‘তুই বল তো, কী হয়েছে?’
‘কী আবার হবে!’ মা ও দিদিকে লক্ষ্য করতে করতে কী বলবে বুঝতে না পেরে রোহিনীও ঢুকে পড়ল রহস্যে, ‘একটা চিঠি এসেছে-
‘চিঠি! মানে!’
‘জানি না।’ বলেই সামলে নিল রোহিনী, ‘আমি সবটা শুনিনি-’
ঘটনা ছড়িয়ে পড়ল ঘটনায়। বাইরে মা ও দুই মেয়ের কথায় বিভ্রম আঁচ করে সোহিনীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঘরে নিয়ে গেল বিকাশ এবং একই ঘরে বাড়ির সবার সামনে দুর্ঘটনার কথাটা বলল তাকে- শুভঙ্কর বিকাশকে চিঠি লিখে জানিয়েছে তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। সে নাকি দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত, মা-বাবার চাপে পড়ে আগে বিয়েতে সম্মত হলেও, পরে ভেবে দেখেছে একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করার অধিকার তার নেই। সুতরাং তাকে যেন ক্ষমা করা হয়।
এরপর যা হয়, স্তব্ধতা নামল ঘরজুড়ে। আস্তে আস্তে সোহিনী অনুভব করল দিনগুলো হারিয়ে গেছে, আর কয়েক ঘণ্টা পরেই সে আঠাশ দিন থেকে পৌঁছে যেত সাতাশ দিনে, কিন্তু বিকাশ যা বলল- ঘোষণাই করল বলা যায়- তারপর কিছুই আর দাঁড়িয়ে নেই নির্দিষ্টতায়। এখন তার সামনে পড়ে থাকছে অনন্ত সময় আর সময়ের অন্তর্নিহিত শূন্যতা। মাথা নিচু করে থাকা, চুপ করে থাকা ছাড়া এখন আর কী করতে পারে সে! তার আচ্ছন্ন দৃষ্টির সামনে মাত্র গতকাল ছাপিয়ে আনা বিয়ের কার্ডের রঙিন ছবি ও অক্ষরগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে উড়তে থাকল হাওয়ায়।
সামগ্রিক স্তব্ধতা কাটিয়ে বেশ কিছুটা পরে কথায় ফিরল সোহিনীর বাবা বিকাশ, ‘এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। তবু ভালো, সত্যি কথাটা জানিয়ে দিয়েছে। বিয়ের পরে অসুখটা ধরা পড়লে মেয়েটার সর্বনাশ হতো।’
‘তুমি তখন থেকে সত্যি কথা, সত্যি কথা বলছ কেন!’ সোহিনীর দাদা দেবাশিস বলল, ‘সম্বন্ধ পাকা হওয়ার পর কেউ এমন করে না। হি ইজ এ ক্রিমিনাল। নিশ্চয়ই অন্য কোনো ধান্ধা আছে। চিঠিটা পুলিশে দেওয়া দরকার, তা হলেই স্কাউন্ড্রেলটার শিক্ষা হবে।’
অত চ্যাঁচাচ্ছিস কেন!’ এতক্ষণে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে সোহিনীর মা মঞ্জু বলল, ‘পুলিশ ডেকে তো আর এই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যাবে না।’ আরো কী বলতে গিয়ে থেমে গেল সে। তারপর আড়ে তাকিয়ে মেয়ের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে করতে বলল? ‘সোহিনীর যেটা জানা দরকার, সেটাই বলো না ওকে!’
‘আগে কথা হোক।’ প্রথমে ইতস্তত ভাব দেখিয়ে, হয়তো নিজের ইচ্ছেটাকেই জোরদার করার জন্য পরে বলল বিকাশ, ‘আমি নিউ আলিপুরে ফোন করেছিলাম। ওই যে ছেলেটা- সুমন। ভালো ছেলে। ওকেই তো আমরা আগে পছন্দ করেছিলাম। ওর বাবা কাল সকালে যেতে বলেছে।’
সোহিনীর বোন রোহিনী এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার হঠাৎ বলে ফেলল, ‘দিদি, আমার মন বলছে, সুমনের সঙ্গেই তোর বিয়ে হবে। বেশ স্মার্ট, নামটাও বেশ। শুভঙ্কর শুনলেই কেমন অঙ্ক-অঙ্ক...’
‘তুই থাম তো!’ রোহিনীর কথা কেড়ে নিল দেবাশিস, ‘ওখানে না হলে অন্য কোথাও হবেই। ওই তারিখেই। আমার বন্ধু চন্দ্রশেখর- ওর বরাবরই পছন্দ সোহিনীকে...’
‘থাক ওসব কথা’ ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে মঞ্জু বলল, ‘মেয়েটা এইমাত্র বাড়ি ফিরেছে।’
সবাই চুপ করে যেতে সোহিনী মুখ তুলল। বাবার দিকে তাকিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে জিগ্যেস করল, ‘চিঠিটা আমি দেখতে পারি?’ বিকাশ বিমূঢ়, একটু ইতস্ততও করল যেন। তারপর বালিশের তলা থেকে একটা খাম বের করে বাড়িয়ে দিল সোহিনীর দিকে।
সেদিন সন্ধে থেকে অনেক রাত পর্যন্ত নিজেকে একান্ত করে নিয়ে বেশ কয়েকবার শুভঙ্করের চিঠিটা পড়ল সোহিনী। অসংখ্য অক্ষরের সমষ্টি একটি অর্থ ছাড়া আর কিছুই ফিরিয়ে দিল না তাকে। দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত কথাটা ঠিক নয়। বিকাশকে লেখা চিঠিতে শুভঙ্কর জানিয়েছে, তার দাদা অন্ত্রের ক্যানসারে মারা যায়। দাদার মৃত্যুর চার বছর পরে- এখন থেকে আট-নয় বছর আগে, সে নিজেও একই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল কিন্তু যথাসময়ে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার হওয়ায় বেঁচে যায়, যদিও তার অন্ত্রের অনেকটাই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। ডাক্তার বলেছে, এসব ক্ষেত্রে আবার ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা ৫০-৫০। অর্থাৎ সে যে সম্পূর্ণভাবে রোগের সম্ভাবনামুক্ত এমন বলা যায় না। লিখেছে, ‘আমি প্রচণ্ড মানসিক অস্বস্তিতে ভুগছি, বিবেকের তাড়নাও অনুভব করছি। বাবা-মায়ের ইচ্ছায় এই বিয়েতে রাজি হয়ে আমি হঠকারিতা করেছি। অদূর ভবিষ্যতে যদি আমি আবার ক্যানসারে আক্রান্ত হই এবং পরিণতিতে কিছু হয়, তাহলে আপনার মেয়ে সোহিনী দুর্ভাগ্যের শিকার হবেন। আপনাকে অনুরোধ করছি, এই বিয়েতে আপনারা আর অগ্রসর হবেন না। কারণ, এই বিয়ে হলে শেষ পর্যন্ত তা আপনার মেয়ের পক্ষে অমঙ্গলসূচক হতে পারে।’
বিয়ে বাতিল করার অনুরোধ জানালেও এ চিঠির একটা অর্থ নিজের দিক থেকে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেছে শুভঙ্কর- চিঠিটা লিখে ফেলার পর সম্ভবত আর কোনো মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করছে না। ধরেই নিয়েছে সোহিনী এবার নিশ্চিত মঙ্গলের দিকে এগিয়ে যাবে। এটা সে ভাবল কী করে!
এসব ভাবতে ভাবতে সোহিনী ওই ৫০-৫০-এর সম্ভাবনাতেই আটকে গেল। এবং ভাবল, অমন কঠিন একটা রোগে অপারেশনের পর যে-লোক আট-নয় বছর স্বাভাবিকভাবে বেঁচে আছে, সে কী করে জানল এরই মধ্যে ৫০-৫০-এর অঙ্কটা বদলে যায়নি- সম্ভাবনার দিকে এগোচ্ছে না!
পরের দিন সকালে নিউ আলিপুরে সুমনের বাবার সঙ্গে দেখা করতে বিকাশ বেরিয়ে গেলে সোহিনী অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। মঞ্জু বলল! ‘আজকের দিনটা বাড়িতে থাকলেই পারতিস!’
মায়ের গলার বদলানো স্বরটা অনুসরণ করে সোহিনী জিগ্যেস করল, ‘কেন?’
সঙ্গে সঙ্গে কথা খুঁজে পেল না মঞ্জু। পরে বলল, ‘বাবা হয়তো পাকা খবর নিয়েই ফিরত।’
‘তারপর হয়তো সে-ছেলেও একটা চিঠি লিখত।’ সোহিনী হেসে বলল, ‘বিয়ে ভেঙে যাওয়া মানে বিধবা হওয়া নয়। শুধু শুধু অফিস কামাই করব কেন!’
মঞ্জু আর কিছু বলল না।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে অফিসে পৌঁছানোর আগে মুখস্থ হয়ে থাকা নম্বরের শুভঙ্করের অফিসে ফোন করল সোহিনী।
শুভঙ্কর অফিসেই ছিল। সোহিনীর ফোন পেয়ে বিস্মিত, কোনো রকমে বলল, ‘কিন্তু, আমি তো...’
‘চিঠি দিয়েছেন তো’, অকপটে বলল সোহিনী, ‘তা সত্ত্বেও আপনার সঙ্গে আমার দেখা করা খুব জরুরি। আজই।’
‘কেন বলুন তো!’
‘ভয় নেই। বিয়ে করতে বলব না।’ সোহিনী বলল, ‘আমার কিছু বলার আছে।’
একটু চুপ করে থেকে শুভঙ্কর বলল, ‘আজই?’
‘হ্যাঁ, আজই। যদি আপনার অসুবিধে থাকে বলুন, আমি আপনার অফিসেই আসব।’
‘না।’ শুভঙ্কর ভেবে বলল, ‘ঠিক আছে। কোথায়, কখন বলুন?’
যেখানে আসতে দুজনের কারো অসুবিধে হবে না। সন্ধ্যে ৬টা নাগাদ?’
‘ঠিক আছে। আমি গ্র্যান্ডের নিচের বাটার দোকানের সামনে দাঁড়াব। অসুবিধে হবে?’
‘না’, সোহিনী বলল, ‘আমিও ওই সময়ে ওই জায়গায় পৌঁছে যাব।’
ক্লান্ত ও অবিন্যস্ত বোধ করার কারণে বাস, মিনিবাসের জন্য অপেক্ষা না করে একটা ট্যাক্সিতেই উঠল সোহিনী। অফিসে পৌঁছাতে আজ একটু দেরি হবে, সেটা কিছু নয়, সে অফিসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে নিউ আলিপুর থেকে বিকাশও ফিরে আসবে হয়তো, সেটাও কিছু নয়। ব্যাগ থেকে শুভঙ্করের সঙ্গে তার বিয়ের চিঠিটা বের করে পড়তে পড়তে সোহিনী ভাবল, সাতাশ দিন পরে সে ও শুভঙ্কর স্বামী-স্ত্রী হতো। সাতাশ দিন পরে সে অন্য কারো স্ত্রী হবে, সে রকম কিছু সম্ভবও হয়, কাল সন্ধ্যে বেলায় বাড়িতে যেসব আলোচনা হয়েছে তার জেরে- যদি হয় তো সুমনের কিংবা দাদার বন্ধু চন্দ্রশেখরের সঙ্গে, তখন তার চিঠির বয়ানের আর কোনো মূল্য থাকবে না। কিন্তু শুভঙ্কর যেহেতু আর বিয়েই করবে না বলে স্থির করেছে, তার কাছে কি কোনো মূল্য থাকবে এই বয়ানের? হয়েও হতে না-পারার কোনো বঞ্চনা কি শুভঙ্কর বোধ করবে, যতদিন বাঁচবে? নাকি মানুষের বঞ্চনাবোধ একটা ধারণা মাত্র, ভুলতে যেটুকু সময় লাগে তারপর আর মনে থাকে না! ভাবতে ভাবতেই চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল সোহিনীর। অদ্ভুত আচ্ছন্নতার মধ্যে সে ক্রমশ ঢুকে পড়ল সময়ে।
সন্ধ্যেয় নির্দিষ্ট জায়গায় দেখা হতে ব্যাগ খুলে ওই চিঠিটাই শুভঙ্করের হাতে তুলে দিল সোহিনী।
শুভঙ্কর অপ্রস্তুত; বলল, ‘এই জন্যে ডেকেছিলেন?’
‘না।’ সোহিনী বলল, ‘বাবাকে লেখা আপনার চিঠি পড়েছি। আমারও একটা অসুখ আছে, কিন্তু কোনো ডাক্তারের সার্টিফিকেট নেই। সে জন্য জবাব দেওয়ার সুযোগ পাব না, তাই এটাই দিলাম। ইচ্ছে করলে এখানেই ছিঁড়ে ফেলতে পারেন।’
শুভঙ্কর কিছু বুঝল হয়তো। দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলল, ‘আপনার আর কিছু বলার থাকলে আমরা কোথাও গিয়ে বসতে পারি।’
‘বেশ তো!’ একটুও অসতর্ক না হয়ে সোহিনী বলল, ‘এই রকম সম্পর্কে একটা রোমান্টিক সিচুয়েশনের দরকার হয়। হয় না?’
শুভঙ্কর জবাব দিল না।
এরপর কাছাকাছি রেস্তোরাঁ পর্যন্ত চুপচাপ হাঁটল দুজনে। রেস্তোরাঁয় ঢুকে নির্জনতা খুঁজল। মিনিট পনেরোর সেই একত্র অবস্থানের মধ্যে শুভঙ্করকে অপ্রতিভ করে সোহিনী আগেই ভেবে রাখা পুরোনো প্রশ্নটাই তুলল, ‘অপারেশনের পর আট-নয় বছর যে বেঁচে থাকে সে আর বেশি বছর বাঁচবে না, এ ধারণা আপনার হলো কেন! এমনও তো হতে পারত যে, আপনার আগে আমিই মরতাম!
‘আপনি মরবেন কেন! শুভঙ্কর কথাটা অন্যদিকে নিয়ে গেল, ‘আপনি আমাকে ভুল বুঝতে পারেন, কিন্তু আমি নিজের কাছে সৎ থাকতে চেয়েছি।’
সোহিনী বলল, ‘এই ভয়ংকর সততার কোনো দাম আছে?’
শুভঙ্কর অবাক হয়ে বলল, ‘ভয়ংকর বলছেন কেন!
‘ভয়ংকর নয়! আমি যে এতদিন সৎভাবে একজনকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম, তার কী হবে!
সোহিনীর নত ও অন্যমনস্ক মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল শুভঙ্কর। তারপর বলল, আপনি আপসেট হয়েছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি যা করেছি আপনার কথা ভেবেই করেছি। আপনার ভবিষ্যৎ আছে, মানে...।’
শুভঙ্করকে থামিয়ে দিয়ে উঠতে উঠতে সোহিনী বলল, ‘যার বর্তমানই নেই, তার ভবিষ্যৎ থাকবে কী করে!’
‘তার মানে!’
‘সেটা আপনি বুঝবেন না। ইনটেসটাইনের অনেকটাই শুধু বাদ যায়নি, ক্যানসারে আপনার হার্টেরও অনেকটা বাদ গেছে। বিবেকের শরীর থাকে না, না হলে ওটাকেও ওই লিস্টে যোগ করতাম।’ দ্রুত কথাগুলো বলে ম্লান হাসল সোহিনী। বলল, ‘যাকগে, সৎ হওয়ার জন্য ধন্যবাদ, চায়ের দাম দেওয়ার জন্যও।’
এবং একাই বেরিয়ে গেল।
বিমর্ষ ভঙ্গিতে বাড়ি ফিরে সোহিনী আবার গতকাল সন্ধ্যের দৃশ্যের সম্মুখীন হলো। আজ মঞ্জুকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছে, নিজেই মেয়েকে ঘরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আর মন খারাপ করে থাকিস না তো! বাবা কী বলছে শোন!’
সোহিনী বললে, ‘মন খারাপ করব কেন!’
‘দিদি, আমার কথাটাই ফলে গেল।’
বিকাশ কিছু বলবার আগেই রোহিনী বলল, ‘সুমনের সঙ্গেই তোর বিয়ে হবে।’
‘সত্যি, এটা যে হবে ভাবিনি।’
বিকাশ বলল, ‘তারিখটাও মেনে নিলেন ওঁরা। সবই ভাগ্য!’
সেই সময় দেবাশিস ঘরে ঢোকায় বলার কথাটা চেপে গেল সোহিনী। দাদার বিজয়ী মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আর তো সাতাশ দিনও নেই। আবার কার্ড ছাপার কী হবে?
সোহিনীর প্রশ্নের সঙ্গে তার কণ্ঠস্বরের, কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মুখের ভাবে মিল খুঁজে না পেয়ে প্রায় সকলেই হকচকিয়ে গেল। একমুহূর্তে বোনকে লক্ষ করে দেবাশিস বলল, ‘কার্ড ছাপতে আর কতক্ষণ লাগবে। সবই তো এক- শুধু পাত্রের নাম, পরিচয়টাই বদলে যাবে।’
‘হ্যাঁ, তাই তো।’ সোহিনী বলল।
‘আমি তাহলে যাই?
সোহিনী চলে গেল। পেছনে পেছনে রোহিনী।
মেয়েরা আড়ালে যেতে মঞ্জু বলল, ‘খুশি হলো না, নাকি?’
বিকাশ বলল, ‘কেন?’
‘কী জানি। কথাগুলো যেন কেমন!’
‘কেমন আবার কি!’ দেবাশিস বলল, ‘ব্যাপারটা বুঝতে সময় নেবে না!’ ক্রমশ পালটে গেল বাড়ির আবহাওয়া। চব্বিশ দিনের মাথায় নতুন বিয়ের কার্ড ছেপে এনে বোনের হাতে দিয়ে দেবাশিস বলল, ‘দ্যাখ, সবই একরকম, বলেছিলাম না! শুধু ছেলের পরিচয়টাই পাল্টানো। ভালো হয়নি?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে সোহিনী বলল, ‘এটাও রাখি?
‘রাখবি না কেন? তোরই তো ব্যাপার!’
দেবাশিস চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘শোন, আজ সুমনকে সুটের মাপ দিতে টেলারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। ও তোর সঙ্গে আলাদা আলাপ করতে চায়। আমি বলেছি, তোর সঙ্গেই ফোনে কথা বলে নিতে।’
‘কোথায়?
‘বাড়ি, অফিস- যেখানে হোক। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, এখন একটু আলাপ-টালাপ করতে দোষের কি?’
নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল সোহিনী।
সেদিন গভীর রাতে আধো ঘুম ও আধো জাগরণের মধ্যে প্রচণ্ড অস্বস্তি ও যন্ত্রণা বোধ করতে করতে সোহিনী তার সততা চিনল এবং অনুভব করল, বুকের কোথাও আটকে থাকা নিশ্বাসটাকে সে কিছুতেই নতুন ভালোবাসার বোধে রূপান্তর করতে পারছে না। ঘৃণা হচ্ছে নিজের ওপর। ঘৃণাই জল এনে দিল চোখে। বোধশূন্যতার মধ্যে অনেকটা সময় কাটিয়ে, বিছানা ছেড়ে উঠে আলো জ্বালল সে, টেবিলের ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখা দুটো বিয়ের কার্ডই বের করে পাশাপাশি রেখে একবার এটা এবং একবার অন্যটা পড়তে পড়তে দেখল, ঠিকই সে একাই শুধু বদলায়নি। কার্ড ছাপা না হলেও এই দুটোর আগে আরো যে দুটো ঘটেছিল, সেই কলেজের সহপাঠী ও নবীন অধ্যাপকের মধ্যে কমন ফ্যাক্টর ছিল সে-ই। এটা কেমন ব্যাপার! তারপর ভাবল, শুভঙ্কর সৎ হতে পারলে সে কেন পারবে না?
কেন আত্মগোপন করে থাকবে!
তখন, মধ্যরাতেই সে কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসল।
চার-পাঁচদিন পরে সন্ধেয় অফিস থেকে ফিরে সোহিনী দেখল বিষাদ ফিরে এসেছে বাড়িতে, আলো কম, স্তব্ধতা থিকথিক করছে চারদিকে। রোহিনী দরজা খুলে দিল। কী হয়েছে জিগ্যেস করায় অন্যরকম গলায় বলল, ‘এই বিয়েটাও ভেঙে গেল, দিদি!’
‘কেন!’
‘জানি না। বাবা সকালে নিউ আলিপুরে গিয়েছিল- সুমনের বাবা বলেছে কে নাকি চিঠি দিয়ে জানিয়েছে মেয়ের চরিত্র খারাপ, এর আগেও তিন-তিনবার...’
রোহিনী আর এগোলো না।
মুখে হাসি এনে সোহিনী বলল, ‘ও, এই ব্যাপার!
আজ আর তাকে ঘরে টেনে নিয়ে গেল না কেউ। সোহিনী নিজেই এগিয়ে গেল এবং দেখল, নিকট আত্মীয় বিয়োগের পরের মুখ নিয়ে বসে আছে তার তিন অভিভাবক। তাকে দেখে সামান্য চঞ্চল হলো শুধু। তারপর সোহিনী কিছু বলবার আগেই, ভাঙা, বিপর্যস্ত স্বরে বিকাশ বলল, ‘কে তোর সঙ্গে এত বড় শত্রুতা করল, মা?
সোহিনী জানে এর উত্তর কী। তবু নিজেকে আড়াল করে তিনজনকেই দেখতে দেখতে দেবাশিসের মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সে বলল, এতে ভেঙে পড়ার কী আছে! দাদা, তুমিই না বলেছিলে, তোমার কোন বন্ধু আছে- আমাকে খুব পছন্দ। তাকেই দ্যাখো না?’