অপরূপ শহীদুল জহির
বাংলা সাহিত্যের আকাশে এমন অনেক লেখক আছেন, যাঁদের এক-একটি বই প্রথম প্রকাশেই বিক্রি হয় হাজার হাজার, মুদ্রণ-পুনর্মুদ্রণ হয়; অগণিত তাঁদের পাঠক, অফুরন্ত তাঁদের শুভার্থী-স্তুতিকারক, কিন্তু তাঁদের লেখা পাঠের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফুরিয়ে যায়, ভাবনাহীন সুস্থ-স্বাভাবিক থাকা যায়; আবার এমন দু-একজন লেখক আছেন, যাঁদের বই প্রথম বৈ দ্বিতীয় প্রকাশ হয় না, সারা জীবনেও হয়তো সহস্র পাঠক জোটে না, কিন্তু তাঁদের লেখা শেষ করবার পর ভাবনার সাগরে তলিয়ে যাওয়া যায়, হারিয়ে যাওয়া যায়, কখনো আবার হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। শহীদুল জহির বোধ করি দ্বিতীয় পর্যায়ের লেখক। জীবদ্দশায় কমল কুমার মজুমদারের নাকি এগারোজন পাঠক ছিলেন, আর জীবনানন্দ দাশের কবিতাবিশ্বের প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর মৃত্যুরই পরে। যদিও মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে পাঠকের কাছে পৌঁছে গেছেন জীবনানন্দ, পেয়েছেনও বিপুল সমাদর-সম্মান, সেই তুলনায় কমল কুমারের পাঠকপ্রিয়তা নেই বললেই চলে, তথাপি একটি বিষয়ে এই দুজনই প্রায় অভিন্ন, দুজনই বাংলা সাহিত্যের বিরলপ্রসূত হিরের টুকরো।
কমল কুমারের কংক্রিটপ্রতিম ভাষাস্থাপত্যের পর ভিন্ন প্রেক্ষিতে হলেও বাংলা কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশ শতকের আশির দশকে আবির্ভূত শহীদুল জহির একটি অনন্য ভাষাশৈলীর প্রবেশক। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’-এই জহির পূর্ণ, যথার্থ লেখকের ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এরপর বের হয়েছে দুটি গল্পের বই, ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৯৫) এবং ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ (২০০৪)। ১৯৮৫-তে ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নামে বিস্ময়কর এক উপন্যাসের ১০ বছর পর প্রকাশিত হয় আরেক অ™ভূত ঘোর লাগা বিবৃত কাহিনি, ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ (১৯৯৫)। অন্য দুটি উপন্যাস হলো, ‘মুখের দিকে দেখি’ (২০০৬) এবং ‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু’ (২০০৯)। এ ছাড়া ‘কার্তিকের হিমে’, ‘জ্যোৎস্নায়’, ‘অদ্বৈত’, ‘তিন বান্দা’, ‘বিদ্ধ ক্রীতদাস’ নামে পাঁচটি মৌলিক গল্প, এবং ‘ফেরা’, History of cottage Industry, ‘মুক্তি’সহ কয়েকটি অনুবাদ গল্প, ‘মেহেরনি’ নামে একটি অপ্রকাশিত উপন্যাস এবং শহীদুল জহিরের কবিতা নিয়ে পাঠক সমাবেশ কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে শহীদুল জহির রচনাসমগ্র। গ্রন্থাকারে ‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু’ শেষ উপন্যাস হলেও এটি ১৯৯১ সালের রচনা। সে হিসেবে ‘মুখের দিকে দেখি’ই শহীদুল জহিরের সর্বশেষ ভাষাপ্রতিমা। এ উপন্যাসের দিকে তাকালে অনুমান করা যায়, নিজেকেই ভেঙে-গড়ে নতুন একটি নির্মাণদিগন্তের দিকে ধাবিত হতে চেয়েছিলেন শহীদুল জহির। কিন্তু মাত্র মধ্যপঞ্চাশেই বিদায় নিয়ে সে দিগন্তের নতুন কোনো মূর্তিমানতা থেকে আমাদের বঞ্চিত করে গেলেন। তবু এই সামান্য পরিসরেই যে অসামান্য শিল্পসম্পদ আমাদের জন্য রেখে গেলেন, তাঁর পঠন-পাঠনে আমরা অনুমান করতে পারি, প্রথাগত ও প্রতিষ্ঠিত ভাষাভঙ্গিমার বাইরে নতুন কিছুই করতে চেয়েছিলেন এই শিল্পী।
কী করতে চেয়েছিলেন শহীদুল জহির? তিনি কী করতে চেয়েছিলেন তার একটা রূপরেখা তিনি নিজেই দিয়েছিলেন কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সাথে এক দীর্ঘ কথোপকথনে। সেখান থেকে জহিরেরই কয়েকটি কথাকে পাথেয় করে আমরা চেষ্টা করব তাঁর সাধ ও সাধ্যের রেখাকে আত্মস্থ করতে।
ভাষা শুধু ব্যবহার নয়, ভাষায় অংশগ্রহণের অধিকার আমার আছে...
একটি সমৃদ্ধ ভাষায় অগণিত মানুষ লেখেন, মননশীল-সৃজনশীল...; কিন্তু ভাষায় অংশগ্রহণ করেন কজন? তার আগে আমাদের বুঝতে হবে, অংশগ্রহণ বলতে জহির কী বোঝাতে চেয়েছেন। অংশগ্রহণ বলতে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠিত ও প্রধান রেখায় আগের থেকে যা আছে, যেভাবে আছে; তাকে, সেই একই প্রকারে বা অবিকল্পরূপে অনুকরণ করা নয়, নিজের মতো করে তাকে সাজিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা আসলে প্রয়োজনভিত্তিক। এবং বাস্তবতাপ্রসূত। লেখক যে মানুষদের নিয়ে গল্প লিখতে চান সেই মানুষ ও তার বাস্তবজীবনের অনুকূলে যায় যে ভাষা, ভাব-ভঙ্গি ও সমাজ-ব্যবস্থাপনা, তাকেই অনুসরণ করবার উপযোগি ভাষাকেই গল্পের পাথেয় করবার আকাঙ্ক্ষা এবং তা পূরণের প্রচেষ্টাকেই জহির বলেছেন ভাষায় অংশগ্রহণের অধিকার। এই অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি বাংলা গল্পোপন্যাসের বহুব্যবহৃত প্রমিত রীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছেন। অধিকাংশ লেখক বিনাবাক্যে যে মান বাংলাকে তাঁদের লেখায় গ্রহণ করেছেন, সেই মান বাংলাভাষার বাইরে ভিন্ন এক ভাষাপ্রবাহ তৈরি করবার নিজস্ব প্রয়াসটিকেই বলেছেন ভাষায় অংশগ্রহণের অধিকার।
ভাষার অপরিবর্তনশীলতার তত্ত্বে আমার আস্থা নাই...
ভাষা একটি বিবর্তনশীল বিষয়। বিভিন্ন ভাষার ইতিহাসের দিকে তাকালে অনুধাবন করা যায় কতশত বছর ধরে, কত পথ পাড়ি দিয়ে, কতটা বিবর্তন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তো কথাটি আরও বড় সত্য। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসম্প্রদায়ের একটি শাখা থেকে কত শাখা-প্রশাখার জন্ম হয়েছে, তা আবার কতগুলো ধাপ পেরিয়ে, কীভাবে, কত বছর ধরে বাংলা নামক ভাষার জন্ম দিয়েছে, সে কথা তো ভাষার ইতিহাস বিশ্লেষক ও পাঠকেরা মোটামুটি অবগত। তা ছাড়া আজ যাকে আমরা শুদ্ধ বা প্রমিত বাংলা বলছি, সেই বাংলাটাও বাংলা ভাষারই বহু বছরের বিবর্তনের ফল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের লিখিত আদি নিদর্শন চর্যাপদের বাংলা আর আজকের বাংলার বিস্তর ব্যবধানই তো বিবর্তন তথা পরিবর্তনশীলতার অনিবার্যতাকে প্রমাণ করে। উনিশ শতকের শুরুতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতবৃন্দ বাংলা গদ্যের যে প্রাথমিক রূপ দাঁড় করালেন, রাজা রামমোহন রায় যে গদ্য লিখলেন, বিদ্যাসাগর যে গদ্যকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেলেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে যে গদ্য ঐশ্বর্যমণ্ডিত হলো, রবীন্দ্রনাথ যে গদ্যকে অলকৃত করলেন, সেই গদ্যের সঙ্গে আজকের গদ্যের যে ব্যবধান সেথানে যেমন ক্রমপরিবর্তনেরই ছোঁয়া আছে, তেমনি আছে তার বাক্যগঠন ও শব্দপ্রয়োগে একধরনের অভিন্নতাও বর্তমান। এই যে ক্রমপরিবর্তনের দিক এটাকেই শহীদুল জহির তীব্র ও ব্যাপকভাবে গ্রহণ করতে চেয়েছেন, আর অভিন্নতার দিক, অপরিবর্তনতার দিকটিকে যথাসম্ভব বর্জন করতে চেয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভাষা তথাকথিত আসমানি কোনো ব্যাপার নয়, কিংবা বাংলা ভাষা মোগল হারেমে খোজাদের প্রহরাধীন কোনো নারী নয়। ‘ভাষা গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে টিকে থাকে, প্রয়োজনে বদলায়। কারো কথা অনুযায়ী না। প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়।’ শহীদুল জহির তাঁর নিজের সাহিত্যভাষাকে এহেন প্রাকৃতিক নিয়মের প্রভাবক হিসেবে উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন। কীভাবে করেছেন, কতোটুকু করেছেন, করতে পেরেছেন সে বিষয়টাও সময়ান্তরে যাচাইযোগ্য ব্যাপার।
আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভাষাটা রক্তাল্পতায় আক্রান্ত এবং জীর্ণ...
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ভাষা বলতে বাংলা গদ্যের আবির্ভাবের পর উনিশ শতকের মধ্যেই যে সবর্জনগ্রাহ্য একটা রূপ দাঁড়িয়ে গেছে তাকেই বুঝিয়েছেন। বিশ শতকের শুরুতে প্রমথ চৌধুরী নদীয়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের মধ্যে প্রচলিত যে ভাষাটাকে মান বাংলা রূপে গ্রহণ করেছিলেন, গ্রহণ করবার জন্য অন্য সকলকে আহ্বান করেছিলেন এবং যে ভাষাটাকে প্রায় সকলেই মান বাংলা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে যে ভাষাটাকে ব্যবহার করে আসছিলেন সেই ভাষাটা বহু ব্যবহারের ফলে জীর্ণ হয়ে গেছে এবং রক্তাল্পতায় ভোগা রোগীর মতো প্রাণহীন হয়ে গেছে বলে জহির মনে করেছেন। এই মনে করার পেছনে অবশ্য পাকিস্তানবাদী কোনো কারণ নেই। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, পাকিস্তানি হাওয়ায় উদ্দাম কতিপয় শিক্ষিত লেখক যে বাংলা ভাষার ইসলামীকরণের নামে তার ভেতরে ব্যাপক আরবি-ফারসি শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, বাংলা ভাষাটাকে বলেছিলেন নালায়েক ভাষা; তাদের সেই মতকেও সমর্থন করেননি শহীদুল জহির। তিনি বলেছেন, ‘ভাষাটা (বাংলা) পটের বিবির মতো, রক্ত নাই, মাংস নাই, ঘাম এবং বীর্যের গন্ধ নাই, কথায় এবং সৃষ্টিতে নেচে ওটার মতো ভাষা এইটা না।’ অর্থাৎ প্রথাগত শিল্পসৌন্দর্যের ধারণা থেকে বের হয়ে ভাষাটাতে প্রাণ সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন; রক্ত-মাংসে, ঘামে-বীর্যে ভরপুর শ্রমজীবী মানুষের ব্যবহৃত ও জীবন্ত ভাষাটিকেই গল্পোপন্যাসে ঠাঁই দিতে চেয়েছিলন। এবং এই জীবন্ত ভাষা প্রকাশের মাধ্যমে সৃষ্টির আনন্দে নেচে উঠতে চেয়েছেন।
নদী নদীই থাকে, কিন্তু নদীকে বহমান থাকতে হলে অনেক পানি জোগাড় করতে হবে...
এখানে ‘পানি’ হচ্ছে জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত শব্দ ও শব্দপ্রয়োগ ভঙ্গি। লেখক নিজে যে সমাজে বসবাস করেন, সেই সমাজ ও তার চারপাশের চেনা মানুষের জীবনাভিজ্ঞতা, জীবন-যাপনের প্রক্রিয়া, তাদের কাজকর্ম, আচার-আচরণ, ক্রোধ-অক্রোধ, হাসি-কান্না, সংস্কার-কুসংস্কার, বুলি-গালি, যেভাবে, যে ভাষায় প্রকাশিত হয়, যে শব্দে তা প্রাণ পায়; সেই আপাত অবহেলিত শব্দ ও ভাষাভঙ্গিকে যতটা সম্ভব অবিকৃত অবস্থায় সাহিত্যশরীরে সংযুক্ত করবার প্রক্রিয়াটাই জহিরের মতে ভাষার নদীতে নতুন পানির জোগান। এই যোগান দেওয়ার কাজটাই তিনি করতে চেয়েছেন তাঁর সমগ্র সৃষ্টিজুড়ে।
আমার সাহিত্যকর্ম এই ভাষাটার আশ্রয়ে করতে চাই...
‘এই ভাষা’ বলতে প্রধানত পুরান ঢাকার মানুষের মুখের ভাষাটাকেই বুঝিয়েছেন জহির। পুরান ঢাকার ভূতের গলি এবং দক্ষিণ মৈশুণ্ডি বা এর আশে-পাশের লোকেরা মান বাংলার সাথে উর্দু-ফারসি শব্দের মিশ্রণে এবং আঞ্চলিক অভ্যাসে একধরণের স্বতন্ত্র ভাষা ব্যবহার করে থাকে, একে ঢাকাইয়া ভাষাও বলেন কেউ কেউ। এই ভাষার ব্যাপক ব্যবহার মূলত পাকিস্তান আমল থেকেই শুরু হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। এই ভাষাটিকেই শহীদুল জহির তাঁর গল্পের নিজস্ব ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এই ভাষা ছাড়াও তাঁর নিজের নাড়িমাটি সিরাজগঞ্জ এলাকার সুহাসিনী গ্রামের ভাষাটাও তার গল্পে এসেছে নান্দনিক রূপে। এমনকি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার আঞ্চলিক ভাষাটাও যে কী সুন্দরভাবে তিনি আয়ত্ত করেছিলেন তার প্রমাণ মেলে ‘মুখের দিকে দেখি’ উপন্যাসে। তবে জহিরের এই আঞ্চলিক কথ্যভাষার ব্যবহারের ঐশ্বর্য তাঁর চরিত্রের মুখে প্রকাশিত সংলাপের মাধ্যমেই অধিকতর প্রষ্ফূটিত হয়েছে। সেই ঔশ্বর্যমণ্ডিত সংলাপরাজ্যের চুম্বক স্পর্শ বর্তমান পাঠকবৃন্দের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা যায়।
বস্তিবাসী রিক্শাওয়ালা-শ্রমজীবী দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের রূঢ়বাস্তবতানির্ভর জীবনে পিতা-পুত্রের সংলাপও মাঝে মাঝে এ রকম হয়ে যায় :
বেঈমান হারামির গুষ্টি! বিড়বিড় করে তোরাব তারপর চিৎকার করে ওঠে, বাইর হয়া যা ব্যাকতে। এই বাইতে আমি থাকলে তরা থাকবার পারবি না, তরা থাকলে আমি থাকুম না।
জমির চেচায় না। বলে তুমার পছন্দ না লাগলে তুমি যাও গা।
আমি যামু কিয়ের লাইগা? এই ঘর আমার নামে এলুট। আমি থাকুম। আমি কইতাছি জমির্যা, তুই তর বউরে লয়া বাইর হয়া যা। মনে লইলে বুড়িরেও লয়া যা।
কই যাইবার কও আমাগো?
যেহানে ইচ্ছা। তগো লাহান মাইনষের আবার জায়গার অভাব আছেনি। না হয় তগো বড়লোক জামাইয়ের বাইত যায়া থাক।
( তোরাব সেখ/ পারপার)
শহীদুল জহিরের অসাধারণ ও অবাকপ্রকৃতির গল্পগুলির মধ্যে ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ অন্যতম। এই গল্পে একই সঙ্গে সিরাজগঞ্জ শহরের ছ-মাইল দূরের গ্রাম বৈকুণ্ঠপুর এবং ঢাকার রেললাইনসংলগ্ন বস্তির মানুষের ভাষা ব্যবহার করেছেন। তাঁর একাধিক গল্পের চরিত্র আকালু আর তার বৌয়ের অস্বাভাবিক জীবনবাস্তবতার ভেতর দিয়ে এদেশের শ্রমদাসদের চরম হতাশাদীর্ণ অসহায়ত্ব আর বিড়ম্বনাকে ধারণ করতে গিয়ে চমৎকার কথ্যভাষা ব্যবহার করেছেন। মগবাজার এলাকার মানুষের সাথে আকালুর কথোপকথন :
আমি দেই নাই, আকালু বলে, আমার বৌ দিছে।
তুমার বৌরে ডাকো।
ও রান্দে।
তুমরা কাউয়ার আণ্ডা খাও ক্যান?
ভাল নাগে তাই খাই, আপনেরা খাইবেন?
না কাউয়ার আণ্ডা আমরা চাই না, ঝাড়–দারণীরে যা দিছ আমাগো তা-ই দিবা।
আচ্ছা দিমু, আকালু বলে, এহন নাই, পরে আবার পাইলে দিমু, এহন আপনেরা যান।
(কাঠুরে ও দাঁড়কাক/ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প)
জহিরের একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’। তুলনামূলক বৃহত্তর ক্যানভাসে রচিত এই উপন্যাসের কাহিনিতে আছে বৃহত্তর সিরাজগঞ্জ এলাকার ভাষা । গল্পের প্রধান চরিত্র মফিজুদ্দিন অস্বাভাবিকভাবে বেঁচে ফেরার পর তার জীবনের জন্য যার অবদানই ছিলো অতুলনীয় সেই নয়নতারার প্রতি পরম কৃতজ্ঞতাবশত গ্রামের নবপ্রতিষ্ঠিত হাটের নাম রাখতে চায় নয়নতারার হাট।
সেদিন সে (মফিজুদ্দিন) বলে, এই রহম ম্যায়া মানুষ আর দেখি নাই, আর দেখমুও না; সে এমন এক ম্যায়ামানুষ আছিল যে মায়ের নাহাল, বৌ আর বিটির নাহাল এই হাটের নাম হবি নয়নতারার হাট, এরপর মফিজুদ্দিন তার গলার স্বর নামিয়ে নেয় অথবা আবেগের তাড়নায় তা নিজে নিজেই নেমে আসে এবং সে বলে নয়নতারার নাহাল ম্যায়ামানুষ জীবনে দেহি নাই, নয়নতারা আমার মুর্শিদের নাম; সে হিন্দু আছিল, না মুসলমান আছিল, আমি জানি না, কিন্তু সে আমাক কইছিল, ভয় পায়ো না ভগমানের নাম নেও; সে আমাক কইছিল ভয় পায়ো না আল্লা নবির নাম নেও।; (সে রাতে পূর্ণিমা ছিল)
গ্রামের দরিদ্র কৃষকপরিবারের সংলাপে একই সঙ্গে আছে চরম বাস্তবতার চিহ্ন ও হাস্যরসের উপাদান :
তাদের কথা আকালু হয়তো শোনে না, কারণ সে চুপ করে হুঁকো টানে। কিন্তু গ্রামের কৃষক এবং ভূমিহীন ক্ষেতমজুরেরা তাকে ছাড়ে না, তারা তার পিছনে লেগে থাকে।
- ক্যারে, নিজে নিজে বিয়া কইরলি, আমাগোরে দাওয়াত দিলি ন্যা!
- দাওয়াতের কাম নাই!
- ক্যা, আমরা দাওয়াত খাওয়া জানি ন্যা!
- দাওয়াত খাওয়া লাগবি না।
- ঠিক আছে, দাওয়াত না খাওয়াইস বৌ দেখা, এমন একখান বৌ পাইলি, সঙ্গে একখান গাইও পাইলি, আমাগোরে দেখা, আমরা কি তর বৌয়েক খায়া ফালায়া দিমুনি!
- বৌ কি এই বালের ক্ষেতের মইদ্দে আইন্যা তোমাগোরে দেখাইন নাইগব! বৌ দেখা নাগে, বাড়িত যাইয়া দেইখো। (আমাদের বকুল/ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প)
শহীদুল জহিরকে কেউ যদি রাজাকারবিরোধি লেখক বলেন, সত্য কথাই বলেন। তাঁর চাইতে বড়ো কথা তিনি মুক্তযুদ্ধের চেতনার সাথে শতভাগ সহাবস্থানকারী লেখক, এদেশের প্রথাগত রাজনৈতিক দল ও তাদের ভণ্ডামিগুলোকে কঠরভাবে চিত্রিতকারী শিল্পী। তিনটি উপন্যাসের ভেতরেই আছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিচিন্তা। সেখানে রাজাকার বিরোধিতা যেমন ব্যাপক, তেমনি আছে মুক্তিযুদ্ধ করে আবার মুক্তিযুদ্ধেরই বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া আমাদের রাজনীতিকদের চরিত্র রূপায়ণের চেষ্টা। ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতাহীনদের পারস্পরিক সম্পর্কের সূত্র ধরে নির্মিত এরকম একটি গল্প ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’।
রাজাকাররা একটু চুপ করে থাকে, তারপর আবদুল গনি পুনরায় বলে, আপনেরে আর একটা কথা জিগাই?
- জিগান।
- এই মহল্লায় আপনেরা ভোট দেন নাই?
- দিছি।
- আপনেরা কারে দিছেন?
- এই মহল্লার সব মুসলিম লীগ।
- তবু আওয়ামী লীগ জিতলো?
এবার আবদুল করিম চুপ করে থাকে।
- মহল্লায় বাড়ি কয়টা?
- অইবো চল্লিশ, পঞ্চাইশটা।
- লোক কত?
- অইবো পাঁচশ, একহাজার।
- সব আওয়ামী লীগ?
আবদুল চুপ করে থাকে।
- মহল্লায় হিন্দু নাই?
- আছিল, অখনেতো দেখি না।
- কয় ঘর হিন্দু আছিল?
- অইবো, আছে তিন/চাইর ঘর।
- অরা গেছে কই?
- কি জিনি, ঠিক কয়া পারুম না।
- হালারা ইন্ডিয়া ভাগছে?
আবদুল করিম আবার চুপ থাকে।
(ইন্দুর-বিলাই খেলা/ ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প)
কথ্যভাষার চমৎকার নিদর্শন ‘মুখের দিকে দেখি’ উপন্যাসখানি; সেখান থেকে দু’একটি কথোপকথন তুলে না ধরলেই নয়।
ফকরুল আলম লেদু ব্যাপারটা খুবই আন্দাজ করতে পারে, কারণ তাকে যত বোকা মনে হয় তত বোকা সে মোটেও না, সে মামুনকে বলে, টিচারের বাইতে ঘন ঘন যাস?
: গেলে, তর কি?
: জুলি ফ্লোরেন্সের দিকে নজর দেছ? কিস দিছস?
: পারি নাইকা অখনো, ইচ্ছা আছে।
: আমারও ইচ্ছা আছে।
: মান্দারপোলা, মাইরা ফালামু তরে, ভদ্র একটা মেয়েরে নিয়া তুমি বদমাইশি চিন্তা করো!
: তুমি কি করো হারামযাদা বান্দর? তুই যদি আবার টিচারের বাইতে যাবি আমি টিচাররে কমু,
তুই বদমাইশি করনের লাইগা ঘুরতাছচ!
(মুখের দিকে দেখি)
কেবল পুরান ঢাকার আঞ্চলিকতা নয়, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ভাষাতেও আশ্চর্যরকমের দক্ষতা দেখিয়েছেন শহীদুল জহির। ভূতের গলির মামুনকে কাঠের গুঁড়োর বস্তায় বরে অবিশ্বাস্যভাবে সাতকানিয়ার একটি চোরাকারবারি পরিবার ও সেই পরিবার সংশ্লিষ্ট ঘটনার সহাবস্থানে উপস্থাপন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগরোপকূলবর্তী ওই স্থানের লোকদের ভাষাটাকে আমাদের সামনে হাজির করেছেন। মামুনকে যখন খরকোস (খরগোশ!) বানিয়ে খাঁচার ভেতর বন্দি রাখে আবদুল ওদুদ চৌধুরী ও ডলি আক্তারের খেয়ালি এবং জেদি মেয়ে আসমানতারা হুরে জান্নাত, তারই এক পর্যায়ে পাগলপ্রায় মামুনের উপর মসজিদের ইমাম এক বালতি পানি ছুড়ে দিলে মামুন বলে,
আঁই খাঁচার ভিতরে ন থাইক্কম, আঁতথে গম ন লার, আঁরে বাইর গরন।
পুরান ঢাকার মামুন সাতকানিয়ায় গ্যালো বলে তার কণ্ঠেও ক্যানো সাতকানিয়ার ভাষা ব্যবহৃত হবে? এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। মামুনের বীর্যের সোঁদা ঘ্রান সকলের নাকে এলে মসজিদের ইমাম বলে, ‘ফোয়া ইবা হইয়েদ্যে, আলহামদু লিল্লাহ, ইবা ছাড়ি দঅন!’ তখন অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য আসমানতারার অনুমতি চাওয়া হলে সে জানায়, ‘আম্মা খরকোস দেখিয়েরে আঁই ডরাইয়্যি!’
সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, শহীদুল জহিরের সংলাপের ভাষা পুরোটাই কথ্যরীতিনির্ভর এবং নান্দনিক। মানবাংলার কৃত্রিমতাকে বর্জন করে প্রকৃতপক্ষেই চরিত্রের স্ট্যাটাস ও মুখনিসৃত বাণীকে ধারণ করেছেন তিনি।
শুধু সংলাপে না, টেক্সটের ক্ষেত্রেও নতুন বাক্যবিন্যাস এবং ভাষা প্রয়োগ করতে চাচ্ছি...
বাংলা উপন্যাসে এবং গল্পে অনেক দিন ধরেই চরিত্রের মুখের কথায় বা সংলাপে আঞ্চলিক বা কথ্য ভাষার প্রয়োগ চলে আসছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) মতো দিক্পাল গদ্য লেখকেরা বর্ণনার ভাষা তো বটেই, সংলাপের ভাষাতেও সাধুরীতির প্রয়োগ দেখিয়েছেন এক সময়। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের ব্যবহারিক ও শৈল্পিক কাঠামোর নির্মাতা, বঙ্কিমচন্দ্র গদ্যকে প্রথম সৃজনশীলতার প্রধান বাহন করেছেন, রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে সাধুগদ্যে লিখলেও বিশশতকের দ্বিতীয় দশক থেকে চলিতগদ্যের দিকে যাত্রা করেছেন। তবে দু’একজন লেখক প্রায় প্রথম থেকেই বাংলা গদ্যকে কথ্যরীতিতে ব্যবহারের চেষ্টা করেন নি, তা নয়। বাংলা গদ্যের আবির্ভাবের পর উনিশ শতকেই যাঁরা গদ্যকে ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত আন্তরিকতা ও সৃজনশীলতার সাথে, তাঁদের মধ্যে পূর্বোল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩) এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০)-র নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’, যা কিনা বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস বলে স্বীকৃত, সেখানে সংলাপে রয়েছে আটপৌরে কথ্যরীতি, আর টেক্সট তথা বর্ণনার ভাষার সাধুতার ভেতরেও উঁকি দ্যায় কথ্যরীতির সরলতা। আর কালী প্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’র ভাষা তো কথ্যরীতির এক দুঃসাহসী দলিল। একটু উদাহরণ দেওয়ার লোভ সংবরণ না করাই এখানে উপযুক্ত বলে মনে হয় :
তোপ পড়ে গিয়েচে, পূর্বদিকে ফরসা হয়েচে, ফুরফুরে হাওয়া উঠেছে-- ধোপাপুকুরের দলেরা আসর নিয়ে খেঁউড় ধল্লেন, গোঁড়াদের ‘শাবাশ’! ‘বাহবা’ ‘শোভান্তরী’! ‘জিতা রও’! দিতে দিতে গলা চিরে গেল; এরই তামাশা দেখতে যেন সূর্যদেব তাড়াতাড়ি উদয় হলেন! ... ধোপাপুকুরওয়ালারা দেড় ঘণ্টা প্রাণপণে চেঁচিয়ে খেঁউড়টি গেয়ে থাম্লে চকের দলেরা আসরে নাব্লেন, সাজ বাজতে লাগল, ওদিকে আখ্ড়াঘরে খেঁউড়ের উতোর প্রস্তুত হচ্চে, আদ ঘণ্টার মধ্যে উতোরের চোতা মজলিশে দেখা দিলেন- চকের দলেরা তেজের সহিত উতোর গাইলেন! গোঁড়ারা গরম হয়ে ‘আমাদের জিত’! ‘আমাদের জিত’! করে চেঁচামেচি কত্তে লাগ্লেন- (হাতাহাতিও বাকি রইল না) এদিকে মধ্যস্থরাও চকের দলের জিত সাব্যস্ত কল্লেন।
(হুতোম প্যাঁচার নকশা)
সবুজপত্রের যুগে, প্রমথ চৌধুরীর (১৮৬৮-১৯৪৬) আহ্বানে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ প্রথমে সংলাপের ভাষা, এবং পরে বর্ণনার ভাষাতেও চলিতরীতির প্রয়োগ করেছেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ যে অতুলনীয় চলিতগদ্যের প্রসার ঘটিয়েছেন তা মানুষের মুখের ভাষা তো নয়ই, সৌন্দর্যগুণে তা যে কোনো লেখকেরও অনতিক্রম্য। এমনকি তাঁর গল্পোপন্যাসের ভাষাটা যে ক্রমশ জটিলতর হয়ে উঠেছে সচেতন পাঠকের চোখে ধরা পড়ে নিংসন্দেহে। ‘ঘাটের কথা’ কিংবা ‘দেনাপাওনা’ গল্পের ভাষা অপেক্ষা ‘রবিবার’ কিংবা ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের ভাষা জটিল, অন্যদিকে ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ সাধুগদ্যে লেখা হলেও চলিতগদ্যের ‘শেষের কবিতা’র ভাষা তার থেকে অনেক অলঙ্কৃত ও জটিলবদ্ধ। এই বিষয়টা লক্ষ্য করে কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক যথার্থই বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গদ্য, এমনকি তাঁর গল্প-উপন্যাসের গদ্যও ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে, হীরের মতো স্বচ্ছ ও কঠিন দানা বেঁধেছে, বক্তব্যসূত্র দৃঢ়বদ্ধ হয়ে গেছে এবং অন্যান্য আরো নানা লক্ষণ দেখা দিয়েছে’ (মুখের কথা : লেখার ভাষা)।
প্রমথ চৌধুরী নিজে যদিও মুখের ভাষাকেই কলমের ভাষা তথা লেখার ভাষা করবার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তথাপি তিনিও যে ভাষায় গদ্য লিখতেন তা চলিতরীতির হলেও অত্যন্ত মার্জিত, সুবিন্যস্ত এবং অসাধারণ শিল্পসৌন্দর্যনন্দিত ভাষা, মুখের ভাষা তা কখনই নয়। তাঁদের সমসাময়িক জনপ্রিয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) বরং সংলাপের ভাষায় কখনো কখনো কথ্যরীতির দু-একটা শব্দ ও ধ্বনির প্রয়োগ দেখিয়েছেন। পরবর্তীতে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬), এবং আরও কিছু পরে সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ (১৯২২-১৯৭১), শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮), আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩), শহীদুল্লা কায়সার (১৯২৭-১৯৭১), শওকত আলী (১৯৩৬), এবং আরও পরে আকতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) প্রমুখের রচনায় কম-বেশি কথ্যরীতির প্রয়োগ দেখা যায়। কিন্তু এগুলোর প্রায় সবটাই সংলাপে; বর্ণনার ভাষায় তাঁরা মান বাংলাকেই আশ্রয় করে নিয়েছিলেন। শহীদুল জহির জানালেন, কেবল সংলাপে নয়, গল্পের বর্ণনাতেও কথ্যরীতির প্রয়োগ ঘটাবেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই জহির তা কতটুকু ঘটিয়েছেন?
প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’ এর পাঁচটি গল্পে কোনো কথ্য বর্ণনার প্রয়োগ নেই, বর্ণনার ভাষাটি শতভাগ প্রমিতরীতি সমর্থিত; কেবল সংলাপেই আছে আঞ্চলিক কথ্যভাষার ব্যবহার। দ্বিতীয় গল্পের বই ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’তেও সংলাপ ভিন্ন কথ্যরীতির প্রয়োগ নেই; বর্ণনার ভাষা প্রথাগতই বলা যায়। তবে ‘পারাপার’ অপেক্ষা বর্ণনার ভাষা এখানে পরিবর্তিত, জটিলতার পথে চলতে শুরু করেছে বলা যায়। তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’তে বর্ণনার ভাষায় কোনো কোনো জায়গায় কথ্যরীতির প্রয়োগ থাকলেও প্রমিতরীতি বিবরণই এখানেও প্রধান। এই গ্রন্থের ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ এবং ‘প্রথম বয়ান’ গল্প দুটির বর্ণনার ভাষা কথ্যরীতির; এবং মান বাংলার সাথে কথ্যরীতির এক চমৎকার মিশ্রণ আছে সেখানে। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও বর্ণনার ভাষায় মানবাংলারই আধিপত্য দেখি। প্রথম উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ অসাধারণ উপন্যাস, পড়তে বসলে শেষ না করে ওঠা যায় না; একটা অপ্রকাশ্য ঘোরের ভেতর দিয়ে পাঠককে টেনে নিয়ে যান শহীদুল জহির। এ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যকেই অনেকটা অনুসরণ করে, প্রথাগত ক্রিয়াপদেরই উপস্তিতি বর্তমান, কিন্তু সংলাপ এ উপন্যাসে নেই বললেই চলে; যেটুকু আছে সেখানে নান্দনিক আঞ্চলিক কথ্যভাষার স্পর্শ প্রশংসনীয়। তুলনামূলক বড়ো পরিসরে নির্মিত ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসের বর্ণনার ভাষা জটিল হলেও শব্দ চয়ন ও কথনভঙ্গিমা মানবাংলারই; এ কাহিনিটির উপস্থাপন কৌশল নিয়েও আলোচনার ইচ্ছে রইলো। ‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু’ উপন্যাসের বর্ণনারীতিও মানবাংলারই নিকটস্থ। আগেই জানিয়েছি, মৃত্যুর পর প্রকাশিত হলেও ‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু’ নয়, রচনাকালের দিক থেকে ‘মুখের দিকে দেখি’ই জহিরের শেষ উপন্যাস।
এই উপন্যাসে এসে লেখক পূর্বের যে কোনো রচনার থেকে আলাদা, অন্তত ভাষার দিক থেকে অবশ্যই আগেরগুলোর থেকে অনেক বেশি নিরীক্ষাপ্রবণ। এখানে এসে প্রথমবারের মতো সংলাপের ভাষার সাথে সাথে বর্ণনার ভাষাতেও কথ্যরীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বস্তুত, এ উপন্যাসে লেখকের সামগ্রিক ভাষাবিন্যাসেরই বড়ো ধরণের পরিবর্তনের পূর্বাভাস পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এরীতির পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগের পূর্বেই, তিনি যে অকালপ্রয়াত, এটা বাংলা সাহিত্যের পাঠকের জন্য বেদনাকর বৈকি। প্রসঙ্গত, বর্ণনার ভাষার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
১.আবেদা হাতের কাজ সারে। দেখে তহুরা তাকিয়ে আছে, কুপির ম্লান আলো তহুরার চোখে নরম হয়ে জ্বলছে। আবেদা কাজ শেষে তহুরার কাছে সরে আসে। ফুঁ দিয়ে আলোটা নিভিয়ে দেয়। উবু হয়ে আসা আবেদার ঠোঁট তুহরার কপাল ছোঁয়। (ভালোবাসা/ পারাপার)
২.আবদুস সাত্তার বাসায় ফিরছিল; তালতলায় বাস থেকে নেমে বিকেলের নরম আলোয় পায়ে হেঁটে যখন তার কলোনির বাসার দিকে আসছিল তখন কেউ কেউ তাকে দেথেছিল, যদিও শীর্ণ এবয় কালো রঙের একজন মধ্যবয়স্ক কেরানির অফিস শেষে গৃহে প্রত্যাবর্তনের এই নিত্যদিনের ঘটনা তাকিয়ে দেখার মতো কিছু ছিল না। সে যখন কলোনির ভেতরের রাস্তায় প্রবেশ করে তখন, সেটা হয়তো বর্ষার মৌসুম ছিল বলে অথবা অদিনের কোনো বর্ষণের কারণে, সেই ইট বিছানো ভাঙাচোরা রাস্তার অসংখ্য গর্ত পানিতে পূর্ণ হয়ে ছিল এবং যেখানে গর্ত ছিল না সেখানে রাস্তা পিচ্ছিল এবং কর্দমাক্ত প্রতারক পিঠ উঁচু এবং বাঁকা করে রেখেছিল।
(আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই/ ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প)
৩.ভূতের গলির লোকদের জীবন দীর্ঘদিন যাবৎ একটি সংকটের ভেতর দিয়ে পার হয় বলে জানা যায়; বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশির দশকে দ্বিতীয় সামরিক শাসনের কাল শুরু হয়, এই সময় ভূতের গলির পশ্চিম প্রান্তে রাস্তা যেখানে তিন ভাগ হয়ে জোড়পুল, পদ্মনিধি লেন এবং র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের দিকে গেছে, সেখানে আবদুল আলি যখন একদিন তার পুরনো চুল কাটার সেলুনঘর ভেঙে নূতন এবং আধুনিক করে তৈরি করে এর নাম দেয় ‘ইয়োর চয়েস সেলুন’, শাহসাহেব লেন এবং নারিন্দা থেকে লোকেরা আবদুল আলির নূতন সেলুনে চুল কাটতে আসে এবং তখন তারা ভূতের গলির লোকেদের এই সমস্যার কথা জানতে পারে। (কাঁটা/ ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প)
৪. সেদিন মিলিটারি চলে যাওয়ার পর মহল্লার লোকেরা সাতটি লাশ এবং নিজে নিহত না হওয়ার বিস্ময় নিয়ে যে সময়টায় চূড়ান্ত অবসাদে ডুবে ছিল, সেই সময়ও তারা তাদের নারীদের মুখে লাঞ্ছনার বিষণ্ণতা দেখেছিল। মহল্লার প্রতিটি বালক এবং বালিকার কাছে, পুরুষ এবং রমণীর কাছে যেন এই প্রথম উদঘাটিত হয়েছিল যে, জগৎ-সংসারে একটি ব্যাপার আছে, যাকে বলাৎকার বলে। তারা আজীবন যে দৃশ্য দেখে বোঝে নাই- যেখানে একটি মোরগ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মুরগিকে- মহল্লার মিলিটারি আসার পর তাদের মনে হয়েছিল যে, প্রাঙ্গনের মুরগির মতো তার মা এবং কিশোরি কন্যাটি, পরিচিত ভালোবাসার স্ত্রী, তাদের চোখের সামনে প্রাণভয়ে এবং অনভিপ্রেত সহবাস এড়ানোর জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে। ব্যাপারটি এমন মর্মান্তিকভাবে তাদের জানা থাকে যে, তাদের বিষণ্ণতা ছাড়া আর কোনো বোধ হয় না।
(জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা)
৫. গ্রামের লোকেরা তখন এই পূর্ণিমার কথা বলে। তারা বলে যে, দুলালির অস্থিসমূহ মোল্লা নাসিরউদ্দিনের কবরের পাশে নূতন এক কবরে দাফন করার পর তারা যখন যার যার বাড়িতে ফেরে, সেদিন রাতে তাদের ভিটার বাড়িঘর এবং গাছপালার ওপর অঝোর ধারায় জ্যোৎস্না ঝরে পড়ে। তারা বলে যে, তারা যখন তাদের হাত শোঁকে তখন তারা তাদের হাতে দুলালির কবরের মাটির সোঁদা গন্ধ পায় এবং দেখে যে, গ্রামের মাথার ওপর দিয়ে নরম এবং স্মিতমুখী এক বালিকার ভরা মুখের মতো এই চাঁদ গড়িয়ে যায়। ( সে রাতে পূর্ণিমা ছিল)
৬. সেদিন মাথা ধরা নিয়া শুয়ে থাকার পর তার বৌ ঝর্ণা বেগম মোটা ফরসা আঙ্গুল দিয়া তার কপালের দুই পাশে মলম লাগায়া টিপা দিলে সে তার ভূতের গলির ৩৬ নম্বর বাসা থেকে বের হয়, তখন হয়তো সকাল অথবা বিকাল, অথবা বিকাল গড়ায়া এই হৈচৈ-এ ভরা মহল্লায় একরকমের ধুলাধুলা নীরবতাসহ সন্ধ্যা আসি আসি করে; হয়তো হয়তো বড়ো রাস্তা থেকে মন্দিরের পাশ দিয়া যে গলি প্যাঁচ খায়া ভিতরে ঢুকে গেছে সেই রাস্তার কোনায়, সাদমন আলি কন্ট্রাক্টারের বাড়ির সামনের ইলেক্ট্রনিকের লোহার খাম্বার মাথার কাকের বাসার মতন জড়াইনা প্যাঁচাইনা তারের জটের নিচে ঝুলে থাকা ষাইট অথবা একশ ওয়াটের টিমটিমা একটা বাত্তি জ্বলে উঠেছে অথবা উঠব উঠব করছে।
(প্রথম বয়ান/ ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প)
৭. ভূতের গল্লির বান্দরগুলা চানমিয়ার দিকে নজর দিয়াই রাখে, ঢাকা শহরের এই বান্দরগুলার সংবেদনশীলতা হয়তো মানুষের মতো হয়া ওঠে, হয়তো ঠিক মানুষের মতো না- কারণ, মানুষের সংবেদনশীলতার বিষয়টাই হয়তো বুঝতে পারে যে, পোলাটার কেউ নাই, বাপ/ভাই নাই, মামা/চাচা নাই, নানা/নানি, দাদা/দাদি, কিচ্ছু নাই, ফলে ধূসর বান্দরনিটার বাচ্চার সঙ্গে সে খেলা করে বড় হয় - মানুষের একটা বাচ্চা, বান্দরের একটা বাচ্চার সঙ্গে খেলাধূলা করে বড় হয়া উঠতেই পারে। কিন্তু বান্দরের বাচ্চাতো বান্দরের বাচ্চাই, দ্রুত বড় হয়া যায়, সেটার হোলের বিচি মোটা হয়া পিছনের দুই ঠ্যাংয়ের ফাঁক দিয়া লটরপটর করে, তার হোগার উপরে সিন্দুরের মত লাল হয়া ওঠে, সে মহল্লার বাড়িঘরের দেওয়াল কিংবা ছাদের কার্নিশের উপর দিয়া তার কান্তিময় তেজি লেঙ্গুর উঁচা করে ধরে বাংলাদেশী পুরুষ র্যাম্প মডেলদের মত হেঁটে আসে, ভূতের গল্লি, দক্ষিণ মৈশুন্দি এবয় পদ্মনিধি লেনের অনেক কিশোরী ও যুবতী বান্দরনি তার ঔরসজাত চাইর/পাঁচটা বাচ্চা ঠ্যাংয়ের চিপায় বুকের সঙ্গে ঝুলায়া মহল্লার কোন বিল্ডিং কিংবা দেওয়ালের উপর এসে খাড়ায়;
(মুখের দিকে দেখি)
উপরের উদাহরণসমূহ পরখ করলে, অনুধাবন করলে বোঝা যায়, লেখক টেক্সটের (বর্ণনার ভাষা) ক্ষেত্রেও নতুন বাক্যবিন্যাস এবং ভাষা প্রয়োগ করতে চাইলেও শেষ দুটো নমুনা ছাড়া বাকি সবগুলোতেই তিনি মূলত মান বাংলা তথা প্রমিত বাংলাকেই প্রয়োগ করেছেন। তবে শেষ গল্প ‘প্রথম বয়ান’ কিংবা শেষ উপন্যাস ‘মুখের দিকে দেখি’তে যেভাবে তিনি কথ্যভাষাতেই উপস্থাপন করেছেন তাতে একথা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, অকালেই প্রয়াত না হলে তাঁর নিকট থেকে আরও অধিক ও অধিকতর অনুপম কথ্যভাষার বর্ণনা আমরা পেতাম। এবং তখনই তাঁর বক্তব্যটি পূর্ণতা পেতো। তবে প্রথাগত ভাষার ভেতরেই বাক্যবিন্যাসে যে জহির নতুনত্ব এনেছেন সে বিষয়টা আলোচনার দাবি রাখে।
গল্প বলার এই পদ্ধতি আমাদের মুখে গল্প বলার যে পদ্ধতি তার কাছাকাছি...
আমার মনে হয়, শহীদুল জহির কোন ভাষায় গল্প লিখেছেন, কোন রীতির সংলাপে তাঁর চরিত্রের মনোভাব প্রকাশ করিয়েছেন কিংবা বর্ণনার ভাষা হিসেবে কোনটাকে বেছে নিয়েছেন, তার চাইতে বড়ো কথা, তিনি কোন পদ্ধতিতে গল্প বলেছেন বা বলতে চেয়েছেন। তাঁর গল্প বলার পদ্ধতিই তাঁকে স্বতন্ত্র শিল্পীর মর্যাদা দিয়েছে। ক্যামন সেই পদ্ধতি? আমার পূর্বপ্রকাশিত একটি রচনার থেকে ধার নিয়েই বলি, ‘শহীদুল জহীরের গল্প ও উপন্যাস যে কারণে শিল্পিত পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু তা হলো, কাহিনী বয়ানের অপরূপ জটিলতা। যে জায়গা থেকে শুরু করেছেন সেখান থেকে স্মৃতি-বিস্মৃতির সাহায্য নিয়ে নিকট অতীত, দূরের অতীত সবই তন্ন তন্ন করে খোঁজেন, আবার ফেরেন শুরুর বর্তমানে, সেখানে কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে যান অতীতের বিচিত্র রকমের ঘটনাবহুলতায়, অতীতের বিচিত্রময় খাঁজে খাঁজে বর্তমানকে গুঁজে দেন; বর্তমানের রোমে রোমে অতীতের সুর তোলেন; আবার খানিক সময়ের জন্য অতীতের বিপুলতায় বিমুগ্ধ রাখেন পাঠককে; রাখতে রাখতেই সহসা ফিরে আসেন সাম্প্রতিকের তুলিতে; আবার যান; আবার আসেন— এভাবেই চলতে থাকে সময়ের আসা-যাওয়া। ফলে বার বার কাহিনীর ভেতর উপকাহিনী, উপকাহিনীর ভেতরে অন্য কাহিনী, অন্য কাহিনীর শরীরে অন্যান্য কাহিনী; একটার ভেতর আরেকটা, আরেকটার ভেতর অপর একটা ঘটনা-অনুঘটনা-প্রতিঘটনা প্রোথিত হয়ে যায়। কখনো কখনো পাঠককে প্রস্তুত হতে না দিয়েই একস্থান থেকে অন্যস্থানে যান, এক কাহিনী থেকে অন্য কাহিনীতে যান, এক কাল থেকে অন্যকালে যান; এক স্তবকের ভেতর ঢুকিয়ে দেন অনেক স্তবকের কথা। স্বভাবতই পাঠককের বিরক্তিবোধও অলক্ষ্য থাকে না অনেক সময়। এমনকি কোনো পাঠকের যদি এরকম মনে হয় যে, লেখকের বয়ানভঙ্গি কখনো কখনো অপ্রয়োজনীয়প্রকারের ঘোরানো-প্যাঁচানো হয়েছে, প্রয়োজনের চাইতে বেশি জটিল হয়ে গেছে; সেই মনে হওয়াও ফেলে দেওয়ার নয়।
আমরা জানি, আমাদের মন, আমাদের স্মৃতি, নিয়ত পরিক্রমণশীল, প্রতি মুহূর্তে সে এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনায়, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অবচেতন মনেই উড়ে বেড়ায়। সে হিসেবে স্মৃতি থেকে কোনো কাহিনী বর্ণনা করতে গেলে ধারাবাহিকতা না থাকারই কথা। একটা ঘটনার ভেতরে অপর ঘটনা, তার ভেতরে অন্য একটি ঘটনা, আসতেই পারে।’ (সে রাতে পূর্ণিমা ছিল : দুঃসাহসী বয়নকলা)। এই আসবার বিষয়টা তথা নির্মিতির এই ঘোরালো-প্যাঁচালো ভঙ্গিটা প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’এ বিশেষ দেখা যায় নি; সেখানে জহির প্রায় পুরোটাই প্রথাগত, মনোবাস্তবতায় নিবিষ্ট, এবং অনেকটাই পূর্বসূরিদের দ্বারা, বিশেষত সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ প্রমুখ বড়ো শিল্পীর দ্বারা প্রভাবিত। দ্বিতীয় গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’তেই জহিরের ভাষা নিজস্ব রূপে প্রতিষ্ঠিত। এই উপন্যাস পাঠেই বোঝা যায়, তিনি কেবল কাহিনিকার নন, কাহিনিকে অত্যন্ত স্বতন্ত্র ভঙ্গিমায় অন্যরকম এক উচ্চতায় নিতে নিরন্তর সাধনা করা এক জীবনশিল্পী। কাহিনি নির্বাচনে নয়, কাহিনি কথনে তিনি বহুর্ধ্বস্পর্শী ঔপন্যাসিক। উপন্যাসে তাঁর কাহিনি উপস্থাপন ভঙ্গি শুধু ব্যতিক্রমধর্মী নয়, জটিলতরও বলা যায়। চরিত্রের আন্তর্বাস্তবতাকে যে ভাষায় তিনি তুলে ধরেন, তা শাব্দিক অর্থে আপাত সহজ হলেও বয়নের মারপ্যাঁচে কখনো কখনো দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। বিশেষত চারিত্রিক মনোবাস্তবতাকে পাঠকের কাছে মূর্তিমান করে তুলতে ঘটনার বর্তমান-অতীত-অতীতের অতীত, আবার বর্তমান-অতীত-বর্তমান-অতীত... এভাবে অগণন ঘটনা-অনুঘটনার ক্ষণবর্ণনায় ভরিয়ে ফ্যালেন পাতার পর পাতা। আমাদের চোখ যখন কিছু দ্যাখে, দেখে অন্য কিছু ভাবে বা ভাবতে প্ররোচিত হয়, তখন আরও অসংখ্য স্মৃতি-অনুস্মৃতি তার সামনে এসে হাজির হয়। মনে পড়ে ওই দ্যাখা কিংবা দ্যাখার সাথে সংশ্লিষ্ট হতে পারার মতো অতীত ঘটনা অথবা ঘটনাসমূহ ও তার আনুভূতিক উপলব্ধিমালা।
শহীদুল জহির তাঁর উপন্যাসের চরিত্রের ভেতর বর্তমানের সাথে অতীত অতীতের ঘটনাসমূহকে মনের ভেতর ধারাবাহিক বা বিচ্ছন্নভাবে জাবর কাটতে দেন, কোনো কোনো ঘটনাকে চোখের সামনে আছড়ে ফ্যালেন; ফেলে বর্তমান ঘটনা ও তার বাস্তবতাকে উপলব্ধি করান। কিন্তু জটিলতর বয়ানে বাস্তবোত্তম গল্প শোনান পাঠককে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্ত-চারিত্র্যকে ধারণ করে গড়ে ওঠা ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নামের ক্ষুদ্র উপন্যাসেও এরকমভাবেই বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন জহির। আজ যাদেরকে আমরা যুদ্ধাপরাধী বলছি, সেই একাত্তরে পাকিস্তান আর্মিদের সহায়তাকারী, গণহত্যা, নারীধর্ষণ ও লুটপাটের সঙ্গী, রাজাকার আলবদররা, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অল্প কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও অচিরেই কীভাবে স্বভূমে ফিরে আসে এবং সকলের সঙ্গে মিশে যায়; এমনকি যেসব মানুষকে তারা হত্যা করেছিল, যেসব নারীকে তারা লাঞ্ছিত করেছিল, তাদের বাড়িতেও কীভাবে পুনরায় প্রবেশ করে বা করতে চেষ্টা করে; কীভাবে পুনরুদ্দোমে শুরু করে মোড়লপণা ও রাজনীতি; এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিরই সহযোদ্ধা হয়ে ওঠে— তারই নিরাপোষী ভাষাচিত্রায়ণ ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’।
উপন্যাসের শুরুতে দ্যাখা যায়, ১৯৮৫ সালের এক রৌদ্রময় দিনে লক্ষীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদ নবাবপুর রোডে চলার সময় কানে মাইকের আওয়াজ শুনে থেমে যায়। রাস্তার অপর পাশে পুলিশ ক্লাবের কাছে মাইক্রোফোন হাতে একই আবুল খায়েরকে দেখতে পায় হরতালের সপক্ষে বক্তব্য দিতে। মজিদের মনে হয়, ‘আকাশে যত কাক ওড়ে সেগুলো আবুল খায়েরের জোব্বার ভেতর থেকেই যেন বের হয়ে আসে।’ এরকম মনে হওয়ার কারণ ঐতিহাসিক ও দীর্ঘস্মৃতিচারণমূলক। আবুল খায়ের আশির দশকে সামরিক সরকার বিরোধী আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে। সঙ্গে আছে স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি। অথচ খায়েরের বাবা বদরুদ্দিন মাওলানা ওরফে বদু মাওলানা একাত্তরে ছিলো কুখ্যাত রাজাকার নেতা। শ্যামাপ্রসাদ লেনের অনেক বাড়িঘর ধ্বংস, লুটতরাজ এর নেতৃত্ব দেওয়া; মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর পরিবার-পরিজনসহ সাধারণ মানুষকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া; বালক আবদুল মজিদের বড় বোন মোমেনাসহ অনেক কুমারী মেয়ে ও গৃহবধুর সম্ভ্রমহানিতে খান সেনাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার শিরোমণি বদু মাওলানা এখন বড় নেতা! তার ছেলেও নেতা! অথচ স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী হিসেবে কঠোর সাজা পাওয়ার কথা ছিল তার। আবদুল মজিদ বর্তমান থেকে একাত্তরে, একাত্তর থেকে বর্তমানে, স্মৃতি-অনুস্মৃতির ভেতর ভ্রমণ করতে থাকে। তার সাথে আমরাও ঘুরে বেড়াই, বিস্মিত হই। হই ক্রুদ্ধ। কখনো বা প্রতিশোধপরায়ণ। আবার মজিদের মতো আমরাও সয়ে যাই অসহ্য অসহায়তায়। যে মুক্তিযোদ্ধার ঘরবাড়ি লুট করে বদু, যার ঘরের মাল-পত্র বদুর ঘর থেকে বের হয় একাত্তরের পর, তিনিও যখন নীরব থাকেন, বদু মাওলানার সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়েন, তখন বোন হারানো আবদুল মজিদ বুঝতে পারে, ‘সময়ের সঙ্গে সত্য বদলে যায়’।
বস্তুত, ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সত্য বদলে যাওয়ারই কাহিনী। গল্পের শেষ পর্যন্ত, বিপর্যস্ত, বীতশ্রদ্ধ আবদুল মজিদ ঘৃণা, বিতৃষ্ণা আর অসহ্য মনোবেদনা বুকে নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের বাড়িটি বিক্রি করে দিয়ে এলাকা ছেড়েছে নিজেই। মুক্তিযোদ্ধা কিংবা মক্তিযুদ্ধে রাজাকারদের হাতে লাঞ্ছিত মানুষ, লাঞ্ছিত ও নিহতের স্বজন যখন জন্মমাটি ছেড়ে যায় চিরদিনের জন্য, অথচ, মুক্তিযুদ্ধেরই বিরোধিতাকারী রাজাকার থেকে যায় বহাল তবিয়তে! পাঠক হিসেবে মনটা তা মেনে নিতে না চাইলেও, অস্বাভাবিক সমর্পণ মনে হলেও বাংলাদেশের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’য় সেটাই স্বাভাবিক ঘটনা বলে চিহ্নিত হয়। কেননা, এদেশের ‘রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্র“ বলে কিছু তো নেই, কাজেই অতীত ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কিইবা করার থাকে মানুষের।’ এটাই আমাদের প্রমাণিত বাস্তবতা। আবদুল মজিদ কিংবা আজিজ পাঠানের মতো এদেশের অগণিত মানুষও প্রত্যক্ষ করেছে এরকম কিংবা এরও চাইতে ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। এই বাস্তবতার উপরে কোনো কল্পনার রঙ না চড়িয়েই, কোনো অন্তরাল বা রূপকের সাহায্য না নিয়েই তুলে ধরেছেন শহীদুল জহির। প্রলেপহীন এই বাস্তবতাকে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি যে ভাষাভঙ্গির আশ্রয় নিয়েছেন তাকে অনেকেই সধমরপ ৎবধষরংস বা যাদুবাস্তবতা বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ম্যাজিক মানে তো মানুষের চোখ ভুলানোর খেলা। সেখানে সত্য অপেক্ষা মিথ্যারই বেশি বাহাদুরী। ম্যাজিশিয়ান সেখানে মিথ্যা কিংবা মিথ্যাপ্রতিম ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করেই হাততালি কুড়ান। আমার মনে হয়, ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’য় সেরকম মিথ্যা ইন্দ্রজাল তৈরি করে চোখ ভুলানোর কোনো ব্যাপার নেই; আছে প্রকৃত বাস্তবতাকে বুকে ধারণ করবার অনন্য ভাষাপ্রতিমা। একটানা, ধারাবাহিকভাবে গল্প বলার সনাতন রীতিতে আজকের জীবনের যথার্থ বাস্তবতা পূর্ণতা পায় না ভেবেই হয়তো জহির সে পথ পরিহার করে পাথর কেটে কেটে নতুন পথের সন্ধানী হতে চেয়েছেন। মুহূর্তের মধ্যে এক ঘটনা থেকে আরেক ঘটনায়, এক ভাবনা থেকে আরেক ভাবনায়, এক স্থান থেকে অন্যস্থানে প্রজাপতিবৎ ঘুরে বেড়ানোর এই প্রক্রিয়ায় পাঠক কোনো কোনো সময় খেই হারিয়ে ফেলেন, অতীষ্ট হয়ে ওঠেন, এবং পাঠকের এই অবস্থাকে হয়তো যুক্তিসঙ্গতও মনে হতে পারে; তথাপি জহিরের বর্ণনাভঙ্গির তাতে যায় আসে না, বরং কথাকার হিসেবে তাঁর বিশেষত্বই ফুটে ওঠে।
‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ সম্পর্কে অগ্রজ কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক লিখেছেন, ‘একেবারে প্রদীপ্ত যৌবনের রচনা। না কোনো খোকামি, না কোনো বালখিল্যতা, প্রখর পরিণত লেখকের লেখা উপন্যাস। বলতে ইচ্ছে হয়, এই লেখাটি আর তিনি কখনোই অতিক্রম করতে পারেন নি, (ছোটগল্পের কথা এখানে ধরছি না) এমনি সুপরিণত, এমনি আবেগ আর বুদ্ধির টান টান ভারসাম্যে তা বাঁধা।’ (সোনায় মোড়ানো কথাশিল্প : শহীদুল জহির )। পরম শ্রদ্ধেয় হাসান আজিজুল হকের এই লেখাটা পড়বার আগেই আমি ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ পড়েছি, পড়েছি পরের উপন্যাস ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ও; আমার কাছে মনে হয়েছে দুটোই অসাধারণ উপন্যাস, কিন্তু ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’তে কোথাও কোনো ফাঁক নেই, একেবারে ঠাস বুননে বাঁধা; ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’তে ভাষার বাঁধন অটুট থাকলেও ভাব ও বাস্তবতার বাঁধনে কোথাও কোথাও সুচভেদ্য ছিদ্রতা আছে, বাস্তবতার চাইতে বেশি কিছু প্রবেশ করিয়ে এক ধরণের তাক লাগানোর প্রবণতা আছে। এই প্রবণতায় অনেকক্ষেত্রেই অভিভূত হলেও যুক্তিশীল পাঠক কোথাও কোথাও বিস্মিত হতে হতে প্রশ্নশীল হয়ে উঠতে পারেন। হাভাতে আকালুর একরোখা পুত্র মফিজুদ্দিনের পুরো জীবন প্রক্রিয়াতেই এক ধরণের অতিনাটকীয়তা, অতিমানবিকতা, অতি-অমানবিকতা... এসবই লক্ষ্য করা যায় গল্পের শুরু থেকেই। তবে অবিশ্বাস্যতার লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় আকালু এবং মফিজুদ্দিনের মহাজন আলি আসগর খানের অত্যন্ত সুন্দরী ও একমাত্র কন্যা চন্দ্রভানের চাঁদের আলোয় নগ্ন হয়ে স্নানের দৃশ্য থেকে। কিন্তু সর্বোচ্চ আশ্চর্য হতে হয় ভাড়া করা খুনিদ্বয়ের হাত থেকে বেঁচে ওঠার প্রক্রিয়াটিতে। আলি আসগর মিয়ার লোকেরাই মফিজকে খুন করবার জন্য হালাকু ও জোবেদ নামে দুজন জোয়ানকে ঠিক করে। তারা মফিজুদ্দিনকে যমুনার নদীর উপর নৌকায় ফেলে ব্যাপক প্রহার শেষে জবাই করার জন্য বেঁধে রাখে। বাঁধা মফিজুদ্দিন জ্ঞান ফিরলে তৃতীয় একজন মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করে নৌকায়। খুনের বিনিময়ে ৩০০/৪০০ টাকা পাওয়া জোবেদ-হালাকুরা সিরাজগঞ্জ থেকে একরাতের জন্য একজন বেশ্যা নিয়ে এসেছে। তার সাথে নৌকার ছইয়ের ভেতরে সারারাতের উপর্যুপরি যে মৈথুনক্রিয়া চলে জোবেদ-হালাকুর, তাতে মফিজুদ্দিনের বাঁচার আশা জাগে না, তবে তার জীবনের আয়ু সামান্য কয়েক ঘণ্টা বাড়ছে বলে মনে হয়। কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেওয়ার ইঙ্গিত মেলে যখন দেখা যায় মফিজুদ্দিনকে একমুঠো ভাত খাওয়াতে আসে যৌনকর্মী নয়নতারা। কেবল ভাতই খাওয়ায় না, তার প্রতি করুণাবর্তী হয়ে ঘটাতে থাকে অবিশ্বাস্য ঘটনা।
ভাড়াটে ঘাতকদুটোকে বাৎসায়নের কামকলা শেখানোর দায়িত্ব নেয় সে। বলে, ৮০টি আসনের সঙ্গমক্রীড়া শিখতে হবে। সারাদিন হালাকু-জোবেদকে নানা রকমের কামক্রীড়ায় ব্যস্ত রাখে। কামোন্মাদ হালাকু দুর্বল হতে হতে রাত্রির দিকে একসময় মারা যায়। জোবেদকেও শেষ করার জন্য যখন শেষবারের মতো তার সঙ্গে মিলিত হয়, তখন নয়নতারার পরিকল্পনা অনুমান করতে পারে জোবেদ, এবং ক্ষেপে গিয়ে নয়নতারাকেই হত্যা করে সে। অবশ্য নিজেও আর উঠতে পারে না। একা, মুমূর্ষুপ্রায় মফিজুদ্দিন কোনোরকমে বাঁধন খুলে মৃতদেহ তিনটিকে নদীতে ফেলে পাশের গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে বাঁচে। তার এই বেঁচে ওঠার প্রক্রিয়াটি, নিশ্চিত খুন হওয়া থেকে রেহাই পাওয়ার উপায়টিকে লেখক যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে প্রশ্ন উঠতেও পারে। কেননা, একজন নারী দুই কিংবা তারও চাইতে বেশি পুরুষকে তৃপ্ত বা প্রতিহত করতে পারে, তাদেরকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করা কিংবা ভিন্ন পথে পরিচালিত করে কালক্ষেপণের যাবতীয় ব্যবস্থাও করতে পারে; কিন্তু টাকার জন্যে যারা খুন করতে এসেছে, যাকে খুন করবে তাকে একেবারে পর্যুদস্থ অবস্থাতেই নৌকায় বেঁধে রেখেছে, তারা তাদের শিকারটাকে একেবারে শেষ করবার আগেই এভাবে ভিন্নগামী হলো, ভিন্নগামী হয়ে এতো দীর্ঘ সময় মোহাচ্ছন্ন থাকলো, একজন পেশাদার পতিতার নিকট থেকে বাৎসায়নের কামসূত্রের সঙ্গমরহস্য জানলো, জেনে, সঙ্গমক্রীড়া করতে করতে মারা-ই গ্যালো, এটা অতিনাটকীয় হয়ে গ্যালো না কি?
মফিজুদ্দিনকে বাঁচাতে হবে, এটা তো পাঠকমাত্রই বুঝতে পারেন, কিন্তু এইভাবে না বাঁচিয়ে আরেকটু বিশ্বাস্যভাবে কাজটা করা যেতো না কি? জহিরের মতো মেধাবি জীবনশিল্পী এবং বিশ্বসাহিত্যের রসসঞ্চারককে প্রশ্নসাপেক্ষ করবার দুঃসাহস থেকে নয়, আমাদের সমাজের বাস্তবতার নিরিখে, আমাদের সাহিত্যমননের সামান্য পাঠক হিসেবেই এই প্রশ্নটি জাগিয়ে তুললাম। ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসে এমন অনেক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনা আছে যার সম্পর্কে যদি দশটি বাক্য লেখা থাকে, সেই দশটি বাক্যই হয়তো দশ কিংবা নয় জায়গায় ঠাঁই নিয়েছে। এবং স্তবক বিন্যাস, পৃষ্টাসজ্জার ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথা প্রযোজ্য। জানি, এই উপস্থাপনভঙ্গি শহীদুল জহিরের একেবারে নিজস্ব একটি ব্যাপার। একথাও জানি, এরকম বাচনভঙ্গি আয়ত্ব করা এবং তা এতটা সাবলীলতায় পাঠকসমাজে তুলে ধরা সাধারণ কোনো কাহিনীকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এবং কাজটাও যে খুব দুঃসাহসিক, বিশেষত বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে, তা বলাই বাহুল্য।
যে পদ্ধতিতে জহির তাঁর উপন্যাসগুলো এবং অধিকাংশ গল্প বয়ান করেছেন, যাকে ইতোমধ্যে আমরা আলোচনায় এনেছি, সেই পদ্ধতিটি যে বেশ জটিল সে কথা জেনেও লেখক যে এই পদ্ধতিটিকে খুব ভালোবাসতেন, একথা তাঁর নিজের বয়ান থেকেই থেকেই জেনেছি, তবে তা আমার ব্যক্তিগত পাঠ ও পাঠপ্রতিক্রিয়াজাত দুটো নিবন্ধ লেখার পরে। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের কাছে দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারটিতে তিনি বলেছেন, ‘এটা লেখার একটা পদ্ধতি। এটা তুলনামূলকভোবে নতুন একটা পদ্ধতি। এই পদ্ধতির রচনার একটা বৈশিষ্ট্য হলো একরৈখিক ধারা বর্ণনায় না যাওয়া। এই পদ্ধতিতে একটা বিষয়ের বর্ণনা ভেঙে ভেঙে আসে, ফলে যতবার একটা বিষয়ের বর্ণনায় লেখা ফিরা যায় ততবার একটু পুনরাবৃত্তি দিয়া শুরু হয়, তারপর নতুন ভাবে আগায়া যায়। এখানে পাঠকের সতর্কতা লাগে, মনোযোগের খুব দরকার হয়। সরলরৈখিক বর্ণনার চাইতে ব্যাপারটা পাঠকের জন্য একটু জটিল। কিন্তু গল্প বলার এই পদ্ধতি আমাদের মুখে গল্প বলার যে পদ্ধতি তার কাছাকাছি এবং আমার মনে হয় যে, এই পদ্ধতিতে সময় এবং ঘটনার বিভিন্ন তলে একসঙ্গে যাতায়াতের সুবিধা পাওয়া যায়, অনুক্রমিকভাবে একটা বিষয় শেষ করে আরেকটাকে ধরার দরকার হয় না, অনেকগুলো বিষয় জড়ায়া প্যাঁচায়ে এক সঙ্গে আগায়া যাইতে পারে। আমার কাছে ব্যাপারটা খুবই সুবিধার লাগে, তবে এটা সরলপাঠ হয় না।’ সরলপাঠ হয় না বলেই তথাকথিত কাহিনিবুভুক্ষু পাঠকের কাছে তো দুষ্পাঠ্য বটেই, শিক্ষিত পাঠকের কাছেও এটা জটিলপাঠ হয়ে উঠেছে অনেকক্ষেত্রেই।
তাঁর এই কথনভঙ্গিকে রহস্যময় করে তুলেছে আরো দু’একটি বিষয়, যেমন : ‘হয়তো’ নামক ক্রিয়া-বিশেষণের বিপুল ব্যবহার। বাংলা ব্যকরণের সূত্রমতে ক্রিয়া বিশেষণবাচক এই ‘হয়তো’ শব্দটি সাধারণত সম্ভাবনা প্রকাশ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এটাকে সন্দেহজ্ঞাপক শব্দও বলা যেতে পারে। এটি পাঠক-শ্রোতার মনোজগতে একধরণের অনিশ্চয়তার বার্তা প্রেরণ করে। জহির এই ‘হয়তো’ শব্দটিকে কোনো কোনো রচনায় এ্যাতো বেশি ব্যববহার করেছেন যে, সাধারণ পাঠক কোনো কোনো সময় বিরক্তও হয়ে উঠতে পারে। ‘মুখের দিকে দেখি’ থেকে উদাহরণ দেয় যেতে পারে :
কিন্তু মামুনুল তাই ওরফে মামুন বাসায় থাকে না কেন? ফলে ফখরুল আলম লেদু মামুনের মাকে জিগাস করে, মামুন কৈ গেছে, যায় কৈ? মামুনের মা হয়তো জানে সে কৈ গেছে, অথবা সে জানে না, সে হয়তো বলে, জানি না কৈ যায়, অথবা হয়তো বলে, অয়তো গেছে কাঠের ভুসি আননের লাইগা - মিসেস জোবেদা রহমান কাঠের ভুসির চুলা জ্বালায়।
মামুন হয়তো একদিন তাদের স্কুল বন্ধ থাকায় একটা গমের খালি ছালা নিয়া - যে ছালাটা তার মা অন্য একটা ছালা সেলাই করে জোড়া দিয়া লম্বা করেছে - বাসা থেকে বের হয়া নয়াবাজারের কাঠের গোলার দিকে যায়। হয়তো সে জোড়াপুল, লালচান মকিম লেন, মালিটোলার ভিতর দিয়া নয়াবাজারে ‘দি নিউ চন্দ্রঘোনা স মিল এন্ড টিম্বার ডিপোট’- এ হাজির হয়, তখন হয়তো বৃষ্টির দিন ছিল এবং সারাদিন চলার পর সন্ধ্যায় করাতকল বন্ধ হয়া গেছিল,...
(মুখের দিকে দেখি)
‘হয়তো’ শব্দের এরকমের ব্যাপক প্রয়োগ ছাড়াও ‘ফলে’ নামক নিরীহ শব্দটিকে যত্রতত্র, তাৎপর্য ও তাৎপর্যহীনভাবে ব্যবহার করেছেন শহীদুল জহির। উদাহরণ বাড়িয়ে তাঁর রচনার অখণ্ড আস্বাদন থেকে পাঠককে বঞ্চিত করতে চাই না। শুধু বলতে চাই, শহীদুল জহিরের রচনার আলোচনা করে তার স্বরূপ ফুটিয়ে তোলা এবং সব ধরণের পাঠকের উপযোগি করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তার চাইতে বরং তাঁর রচনা পাঠ করাই উত্তম।
জহিরের গল্প বলবার পদ্ধতির অবিস্মরণীয় উদাহরণ ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’, ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’, ‘চতুর্থ মাত্রা’, ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’, ‘ডলু নদীর হাওয়া’ গল্পগুলো। ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ জাদুবাস্তবতাপ্রভাবিত পৌনঃপুনিক ঘটনাপরম্পরার গল্প। ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পটি আমার কাছে কেবল বিস্ময়ই নয়, কিছুটা প্রশ্নচিহ্নও ঝুলিয়ে রাখে। সতেরো/আঠারো পৃষ্ঠার একটি গল্পে কোনো প্যারা নেই, চরণবৈচিত্র্য নেই, এমনকি একটি দাঁড়ি পর্যন্ত নেই! মাঝে-মধ্যে কমা-সেমিকোলন-বিস্ময়-জিজ্ঞাসা থাকলেও দাঁড়ির আরামে একবারের জন্যেও কোথাও দাঁড়ানোর জায়গাটুকু হবে না! পাঁচ দিন ধরে টেস্ট খেলার পর কোনো ফলাফল ছাড়াই ম্যাচটি শেষ হওয়ার মতোই এ্যাতো দীর্ঘ গল্পটির শেষে এসেও একটি কমা (,)! আর তরমুজের কী অভাবিতপূর্ব ইতিহাস! তরমুজ খাওয়া কিংবা তরমুজের বিচির সারাগল্পব্যাপী এমন বিশদ দোষ-গুণকীর্তন বিশ্বসাহিত্যের পাঠক দেখেছেন কি না জানিনে, তবে বাংলা সাহিত্যের পাঠক যে দ্যাখেনি তা বলাই বাহুল্য। তরমুজের সে কতো রকমের রূপোদ্ঘাটন! দু-একটি উদাহরণ না দিলে এই নিবন্ধের পাঠককেই বঞ্চিত করা হতে পারে।
এই অবসরে আমরা তরমুজ কাটি এবং তরমুজ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের বিষয়ে সমৃদ্ধ হই, গাঢ় সবুজ রঙের চামড়ার নিচে তরমুজের ভেতরটা হবে রক্তের মতো লাল, আমরা তখন তরমুজওয়ালাদের কাছে জানতে চাই, তরমুজ দুই রকমের কেন হয়; কারণ আমাদের সামনে তরমুজ নির্বাচনের এক সঙ্কট উপস্থিত হয়, যা আমাদের পিতাদের ছিল না, তরমুজ তখন, সে সময়, এক রকমের ছিল।
কিংবা :
তরমুজের বিচি খেয়ে ফেলার পর পেটে যে ব্যথা হয়, সেই ব্যথার ভেতর হাজি আব্দুর রশিদের অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচিত হয় এবং তিনি মহল্লায় লেদ মেশিনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা বুঝতে পারেন এবং তার মনে হয় যে, নিঃসন্তান বিধবা, বৃদ্ধা রহিমা বিবির দেড় কাঠার বাড়িটা তার প্রয়োজন; আমরা তখন জিরাতে জিরাতে আমাদের পেটের ব্যথার কথা ভাবি এবং আমাদের আক্ষেপ হয় এই জন্যে যে, এই গরমের ভেতর তরমুজই যদি খেতে না পারি তাহলে আমরা আর কী খাব! তরমুজ সম্পর্কে আমদের জ্ঞান বাড়ে, কারণ তরমুজের রসের গন্ধে মাছি বেড়ে যায় এবং মাছি আমাদের নাকের ভেতর প্রবেশ করে; আমাদের হাঁচি হয় এবং আমরা হাঁচি দেওয়ার শারীরিক-যৌন আনন্দকে আবিষ্কার করি, আমাদের জীবনে তিনটি জিনিস সনাক্ত করতে পারি, লেদ মেশিন, তরমুজ এবং মস্তিষ্কের শেকড়ের গোড়া থেকে উঠে আসা হাঁচি দেওয়ার আনন্দ; আমাদের মনে পড়ে...
অথবা :
আমরা জাপানি লাল তরমুজ খাই কিন্তু আমরা নিশ্চিত হতে পারি না এটা লাল তরমুজই কি না, ফলে আমরা তরমুজের বিচি খেয়ে ফেলি এবং...
এ ছাড়া :
আমরা যখন তরমুজ কিনে আনি তরমুজওয়ালা চাকু দিয়ে চৌকো কোনাতোলা একটি টুকরো কেটে বের করে এর লাল রং দেখায়, আমরা সেটা পরখ করার পর সে বরে, এক্কলে মাখখন এবং টুকরোটা পুনরায় যথাস্থানে প্রবেশ করিয়ে দেয়, আমরা যখন এই তরমুজ বাসায় নিয়ে আসি, আমাদের স্ত্রীরা কাটা টুকরোটা প্রথমে পুনরায় টেনে বার করে এবং আমরা শুনতে পাই যে, তারা বলে এমুন লাল, মনে হয় য্যান বুকের ভিতর থেইকা কইলজা টাইনা বাইর করলাম, তাদের কথা শুনে আমরা প্রথমে চমৎকৃত তই, তারপর আমাদের একাধিক প্রতিক্রিয়া হয়, আমাদের মনে হয় যে, এই কথাটি আমাদের কেন আগে মনে হয়নি এবং তারা এই ধারণা কোথায় পেল? আজিজুল হকের কবিতায় কি তরমুজের এ রকম উপমা দেওয়া হয়ে থাকতে পারে?
অন্যত্র :
আমরা বুঝতে পারি যে, তরমুজ হচ্ছে ডিমের মতো, পচে যেতে পারে, ভেজাল হতে পারে না; কিন্তু এই বিষয়টি কালক্রমে আমাদেরকে অন্য এক ধরনের বিভ্রান্তির ভেতর ঠেলে দেয়, আমরা মহল্লায় দিনে দেড় মণ নাট-বল্টু, দশ মণ পাউরুটি/বিস্কুট/লেবেঞ্চুশ, সাত গ্রোস কাচের গ্লাস বানানোর পর বিকেলে অথবা সন্ধ্যায় জানতে পারি যে, তরমুজের ভেজাল হতে পারে, সাদা তরমুজের ভেতর লাল লাল রং এবং চিনির পানি ইঞ্জেকশন করে ঢোকানো হয়, ফলে তরমুজ হয় লাল এবং মিষ্টি, এই কথা শুনে আমরা বিস্মিত এবং একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ হই, আমাদের মনে হয় যে, মানুষের জীবনে কি কোনো মূল্যবোধই অবশিষ্ট থাকবে না!
অতঃপর :
...ফলে আমাদের স্ত্রীরা তরমুজ ছোট চৌকো করে কেটে বাটি ভরে নিয়ে আসে, আমরা টুকরো তুলে মুখে দিই, আমাদের মুখের গর্তেভেতর অল্প চাপে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো গলে যেতে থাকে তরমুজ এবং হাতের ভেতর নারী; এক হাতে তরমুজের বাটি, অন্য হাতে যুবতী স্ত্রীর একটি স্তন ধারণ করে আমরা পৃথিবীতে গোলাকার বস্তুর মর্ম বুঝতে পারি;
পুরো গল্পটি পাঠের পর মনে হয়, একি কুটির শিল্প নাকি তরমুজ রহস্য? নাকি তরমুজ রহস্যের আড়ালে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রথাগত কোনো জীবনালেখ্য? কিছু না হলেও এই গল্পের পাঠক যে তরমুজের মতো নিরীহ খাবারটাকেও আর বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করতে পারবে না, তা বলাই যায়।
‘চতুর্থ মাত্রা’ গল্পটি আমি প্রথম পড়ি একসময়কার খ্যাতনামা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা কবি কায়সুল হক সম্পাদিত ‘শৈলী’তে। তখন আমি কিছুই বুঝতে পারি নি; একেবারে দুষ্পাঠ্য ও দুর্বোধ্য এবং গল্প হিসেবে একেবারে বিরক্তিকর মনে হয়েছিলো। নব্বই দশকের তরুণ মনে আবদুল করিমের অকল্পনীয় অস্বাভাবিক আচরণ আমাকে কিছুই অনুভব করতে দ্যায় নি। গল্পের শুরতেই তৃতীয় বন্ধনী [ ] তে একটি প্যারা, তারপর কবিতার চরণের আকারে নিদারুণ অকবিতা:
আবদুল করিম অন্ধকারের ভেতর কাশি দিল
আবদুল করিম অন্ধকারের ভেতর দুইবার কাশি দিল
আবদুল করিম অন্ধকারের ভেতর তিনবার কাশি দিল
আবার তৃতীয় বন্ধনীতে একটি বর্ণনামূলক অনুচ্ছেদ, তারপর :
আবদুল করিম এবার আলোর ভেতর কাশি দিল
আবদুল করিম আলোর ভেতর দুইবার কাশি দিল
আবদুল করিম আলোর ভেতর তিনবার কাশি দিল
আবার তৃতীয় বন্ধনীতে বর্ণনা। তারপর কিছু আপাততুচ্ছ কথোপকথন, আবার তৃতীয় বন্ধনীতে বিবরণ, আবার সংলাপ, আবার তৃতীয় বন্ধনীতে... আবার কিছু আলাপন, আবার তৃতীয় বন্ধনীতে... ... ... এভাবেই চলতে চলতে দীর্ঘ একঘেঁয়েমি পার হয়ে পুনরায় প্রচণ্ড বিরক্তিকর সেই অন্ধকারের ভেতর কাশি দেওয়ার ব্যাপার নিয়ে কবিতার আকারে অকাব্যিকতা! আবার তৃতীয় বন্ধনী! আবার কাশি প্রসঙ্গ! এবার কাশি এলো না, এলো হাসি, নিদ্রা আছে, স্বপ্নও! পুনরায় পূর্বের ধরণে বর্ণনা ও সংলাপ! বার বার! তারপর আবারো কাশির মতো করে হাসির আবাহন!
আবদুল করিম অন্ধকারের ভেতর একবার হাসল
আবদুল করিম অন্ধকারের ভেতর দুইবার হাসল
আবদুল করিম অন্ধকারের ভেতর তিনবার হাসল
কিছুদূর এগোনোর পর :
আবদুল করিম এবার আলোর ভেতর হাসি দিল
আবদুল করিম আলোর ভেতর দুইবার হাসি দিল
আবদুল করিম আলোর ভেতর তিনবার হাসি দিল
এভাবে প্রায় তিরিশ পৃষ্ঠা অতিক্রমের পর গল্পটি শেষ হয় কোনো গল্পপ্রসূত বৈচিত্র্য ছাড়াই সেই তৃতীয় বন্ধনীতে!
[আবদুল করিম তখন বেঞ্চের ওপর পড়ে থাকবে চোখ বুজে। আমাদের CASIO Lithium ALARM CHRONO-য় সময় নেচে যাবে, ৩২ সেকেন্ড, ৩৩ সেকেন্ড, হয়তো অনন্ত...]
এই গল্প নিয়ে পাঠকেরও থেকে যায় এক অনন্ত বিস্ময়! আবদুল করিম নামের এক ব্যাচেলরের একঘেয়ে জীবনের বিব্রতকর উপস্থাপনা। এটাকে এলিয়েনেশন এর চূড়ান্ত প্রকাশ বলা যায়। এলিয়েনেশন তথা বিচ্ছিন্নতাবোধ হলো, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ থেকে, ব্যক্তিক-পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়-দায়িত্ব থেকে নিজেকে বিচ্যূত রাখা বা পরিবেশপ্রভাবে বিচ্যূত হওয়া। কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা থেকেই বিচ্ছিন্নতার উদ্ভব এবং বিচ্ছিন্নতাই একজন মানুষকে নৈসঙ্গতার অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে। পুঁজিবাদী সমাজেই বিচ্ছিনতাবোধ গ্রাস করে বেশি। মার্কসপ্রভাবিত জহিরের ‘চতুর্থ মাত্রা’য় একাকি আবদুল করিমের একাকিত্ব গভীর এলিয়েনেশনে রূপ নিয়েছে। ব্রেখ্ট তাঁর নাট্যতত্ত্বে এই অষরবহধঃরড়হ বভভবপঃ বা বিচ্ছিন্নকরণ প্রভাবপ্রসূত শিল্পকলার প্রয়োগ করেন। এলিয়েনেশন তত্ত্ব বা বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রভাবে কোনো কাহিনি লিখিত হলে সে কাহিনির কেন্দ্রিয় চরিত্র ঠিক নায়কোচিত গুণাবলীর হয় না, পাঠকের মন জয় করা বা আবেগকে নিজের অনুকূলে টেনে আনবার মতো তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য তার থাকে না। চরিত্রের ভেতরে ডুবে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ না দিয়েই পাঠককে বিশেষ এক প্রকার আঙ্গিকের দিকে পুনঃ পুনঃ ঠেলে দেওয়া হয়।
পাঠক-দর্শক-শ্রোতা মাঝে মধ্যেই বুঝতে পারে, এটা বাস্তবজাত কিন্তু বাস্তব নয়। প্রথাগত পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করে লেখা এই গল্প স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ পাঠকের প্রিয়তার বাইরে থেকে যায়। এই গল্পের প্রগাঢ় একাকিত্বের হতাশায় আচ্ছন্ন আবদুল করিমের সাথে কি লেখক শহীদুল জহির নিজের কোনো যোগসূত্র রেখেছেন? জহির নিজেও তো অকৃতদার ছিলেন; মাঝে মধ্যে প্রবল একাকিত্বে ভুগতেন তা এমনিতেই অনুমান করা যায়। তিনি নিজে যদিও বলেছেন একাকিত্বকে উপভোগ করার কথা, একাকিত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা, তথাপি সঙ্গ কিংবা যৌনতা তাঁরও যে দরকার তা তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। আবদুল করিমের চরিত্রে অবরুদ্ধ এক যৌনতার ইঙ্গিত কি লেখকের মতোই শরীরে আগুন বয়ে নিয়ে বেড়ানোর ফল? তবে আবদুল করিমের চরিত্রের বিপরীত অবস্থানে তথা বিবাহিত জীবনে থেকেও যে মানুষ নানা রকমের টানা-পোড়েনের কারণে সমাজবৃন্ত থেকে বিচ্যূত হতে পারে, তার উদাহরণ ‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু’ উপন্যাসখানি। এ উপন্যাসে বিশেষ ব্যতিক্রমী কোনো বাচনভঙ্গি ছাড়াই (অর্থাৎ নিজস্ব ভঙ্গিতেই) একটি পরিচিত গল্পকে তুলে ধরেছেন জহির। বলা যেতে পারে, উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটাই জহিরের নিছক ব্যক্তি ও পারিবারিক প্রেম-বিরহ-ব্যর্থতাপ্রসূত কাহিনি। নায়ক আবু ইব্রাহিমের অনাকাক্সিক্ষত ও অতি তুচ্ছ প্রক্রিয়ায় মৃত্যুর মাধ্যমে লেখক জীবনের করুণ নিয়তিকে ইঙ্গিত করেছেন।
‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ গল্পটি সত্যিই আমাদের সমাজের রূঢ়বাস্তব এক খেলাই। ক্ষমতাবানেরাই এখানে বিলাই (বিড়াল), আর ক্ষমতাহীনেরা ইঁদুর। পাড়ার মাস্তান থেকে মাস্তানপালক রাজনীতিক - সকলেই দুর্ধর্ষ বিলাই; দুর্বল মহল্লাবাসী থেকে শুরু করে সংখ্যালঘু হিন্দু - সকলেই বিলাইয়ের নির্মমতার স্বীকার ইন্দুর। এই গল্পের ২৫টি ঘরওয়ালা তিন-তিনটি ছক আমাদেরকে খেলার ধরণে আসলে নিষ্ঠুর ফাঁদের কথা মনে করিয়ে দেয়। ‘ডলু নদীর হাওয়া’তেও মেলে বিশেষ ছকের দ্যাখা। সেখানে গল্পের শাব্দিক বিবরণের সাথে আছে মানচিত্রের বিকল্পে পথনির্দেশক স্কেচ। পাঠকের জন্য এ এক ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা। এইসব গল্পের কোনোটাই হয়তো সাধারণ গল্পখোর পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে বিশেষ সমর্থ নয়, কিন্তু বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে এগুলো বিশেষ ও ব্যতিক্রমী সংযোজন নিঃসন্দেহে।
ভূতের গলি বা সুহাসিনী, আকালু কিংবা আবদুল করিম...
শহীদুল জহিরের লেখার একটি বিশেষ স্টাইল হলো একই স্থান এবং একই চরিত্রের পুনরাবৃত্তি। তাঁর অধিকাংশ গল্পোপন্যাসের পটভূমি জুড়ে আছে ভূতের গলি। তাকে যদি ভূতের গলির গল্পকার বলা হয়, তাতে সত্যের অপলাপ হয় না। এক দিকে যেমন রাজাকার বিরোধিতা তাঁর লেখার একটি অন্যতম উপকরণ তেমনি ভূতের গলি তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোর অনন্য ভুবন। অন্য জায়গাও আছে, তবে ভূতের গলি দিয়েই শুরু হয়েছে বেশ কয়েকটি কাহিনি। আছে সিরাজগঞ্জেরও আধিপত্য। ক্যানো তিনি এটা করলেন? ক্যানো তিনি একটি বা দুটি স্থানেই অনেক গল্পকে উপস্থাপন করলেন? বিভিন্ন প্রকারের চরিত্র আর নানান ঘটনা, সে কি এক ভূতের গলিতেই ঘটা সম্ভব? এর উত্তর লেখক নিজেই দিয়েছেন। এবং এই পদ্ধতিতেও যে তিনি অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন তা তাঁর বক্তব্যেই প্রকাশিত, ‘গ্রাম বা শহরে যা ঘটে তা সুহাসিনী কিংবা ভূতের গলিতে ঘটতে পারে, ফলে একটা নতুন গল্প বলার জন্য নতুন পাটভূমি এবং নতুন জায়গার নাম ব্যবহার আমার কাছে অপরিহার্য মনে হয় না। সহাসিনীতে যা ঘটতে পারে না, আমি অবশ্যই তা সুহাসিনীর নামে লিখবো না, সুহাসিনীতে ডলু নদী নাই, পাহাড় নাই, আমি এই গল্প সুহাসিনীতে নিয়া যাই নাই...’।
হ্যাঁ, লেখকের এই বক্তব্য এবং তাঁর রচনা পর্যবেক্ষণ করলে এই বিষয়টি মোটামুটি পরিস্কার যে তিনি খুব সচেতনভাবেই তাঁর গল্পগুলোকে ভূতের গলি কিংবা সুহাসিনীতে স্থাপন করেছেন। এবং এই উপস্থাপন প্রক্রিয়া এমনই যথার্থ হয়ে উঠেছে যে, একই জায়গায় হলেও কোনো ঘটনা কিংবা কোনো চরিত্রকেই তাঁর উপস্থাপিত স্থানে অপ্রাসঙ্গিক বা অনাকাক্সিক্ষত মনে হয় না। একজন লেখক যদি তাঁর চরিত্র ও ঘটনাবলীকে পাঠকের কাছে স্বাভাবিকতায় ও স্বাচ্ছন্দ্যে তাঁর রচনায় তুলে ধরতে পারেন, পাঠকের মন জয় করতে পারেন, তবে কোন স্থানে করছেন কতবার কতবার করছেন, তা বিশেষ বাধা হতে পারে না, শৈল্পিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য ও উৎকর্ষ করে উপস্থাপন করাই আসল কথা। রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন, কবি তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য, অর্থাৎ ইতিহাস সত্য আসল শিল্পসত্য নয়, কবিতার সত্যই প্রকৃত শিল্পসত্য, সেই কথাটার স্বার্থকতা জহিরের গল্পের বেলাতেও প্রযোজ্য। তিনি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই তাঁর গল্পকে কখনো সুহাসিনী আবার কখনো নারিন্দার ভূতের গলির প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন।
‘এই সময়’, ‘কাঁটা’, ‘চতুর্থ মাত্রা’, ‘কোথায় পাবো তারে’, ‘মহল্লায় বান্দর, আবদুল হালিমের মা এবং আমরা’, ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’, ‘প্রথম বয়ান’, ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’... এই সব গল্পের অকূস্থল ভূতের গলি; ‘মুখের দিকে দেখি’ উপন্যাসও প্রধানত ভূতের গলির কাহিনি (কিছুটা চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার); কিন্তু কোনো গল্পেই বোধ করি মনেই হয়নি যে, ভূতের গলি বাদ দিলেই এর চেয়ে বেশি উপযুক্ত হতো। আসলে লেখক নিজে যে এলাকায় থাকেন, যে মানুষদের সাথে জীবন-যাপন করেন; সেই এলাকায় এবং সেই মানুষগুলোর জীবনে, তাদের ভাষা ও আচার-আচরণে, অন্য জায়গার কাহিনিসমূহকেও যতো স্বাচ্ছন্দ্যে ও বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে উপস্থাপন করা সম্ভব, অন্য কোনো অজানা বা অল্প জানা জায়গার প্রেক্ষাপটে তা যে সম্ভব না, লেখক-পাঠক সকলেই তা অবগত।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে পদ্মানদীর মাঝিদের জীবন তুলে ধরেছেন, তা কি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্ভব? অদ্বৈত মল্লবর্মণের মতো লেখকের অল্পসংখ্যক রচনার গুণেও তিতাস পারের মানুষেরা যে অমরত্ব পায় সে তো সরাসরি সমপ্রকৃতির জীবনাভিজ্ঞতার প্রকাশেই। নারিন্দার ভূতের গলিতে জন্ম নিলে, বেড়ে উঠলে এবং সিরাজগঞ্জের গ্রামের বাড়ি হলে, একজন জহিরের কলমে ভূতের গলি বা সুহাসিনী (সিরাজগঞ্জের একটি গ্রাম) তো বেশি বেশি উঠে আসবেই। এ দিক থেকে দেখলেও অনুধাবন করা যায়, অনেক লেখকের মতো কাল্পনিক নাম গ্রহণ না করে জহির তার কাহিনিগুলোকে বরং বিশ্বস্তপ্রকারেই পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছেন।
যাবার বেলায় এই কথাটি...
মানুষ যা কিছু আবিষ্কার করেছে, তার মহোত্তম জিনিসটাই মনে হয় ভাষা। মনের অভিব্যক্তি তথা সার্বিক ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভাষাকে যদি না পেতো তবে মানুষের হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি সত্যিই কি পূর্ণ হতো কোনো দিন? মানুষের অভিজ্ঞতা, তার শিক্ষা-দীক্ষা, শিখিয়ে দেওয়া ও নেওয়ার মানসিকতা; তার জাতিসত্ত্বার অগ্র-পশ্চাতের ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ভাষা না থাকলে কীভাবে জানতো বা জানাতো মানুষ? আর ভাষাকে লিখে প্রকাশ করবার, সংরক্ষণ করবার যে পদ্ধতি? এটাও তো মহৎ যোগ্যতা! কত ভাষায় কতোভাবেই না লিখে চলেছে মানুষ! আমার কথা, আমি যেভাবে বলতে চাই, যেভাবে শুনতে চাই, যেভাবে পড়তে চাই; যেভাবে পড়াতে চাই, সেভাবেই কি সব সময় পারি? পারি না। একজন কৃষক, একজন কারখানাকর্মী কিংবা একজন যে কোনো পেশা অথবা পেশাহীনতার মানুষ, সবারই তো প্রেম আছে, যাতনা আছে, আশা-হতাশায় মিইয়ে পড়া আছে। আছে আরো অনেক সাগর প্রমাণ রহস্য। তারা কি তাদের সকল অভিব্যক্তি প্রকাশ করে, নাকি করতে চাইলেও পারে?
আমাদের আড্ডাবাজ বাঙালিদের ভেতরে কেউ কেউ আছেন, চমৎকার ঢঙে গল্প বলতে পারেন, মাতিয়ে রাখতে পারেন উপস্থিতিদেরকে। সে যদি লেখাপড়া জানা মানুষও হয়, তার বলা গল্পটাকেই লিখে ফেলতে বলুন না। পারবে না। অনেকেই বলতে পারেন, কেউ কেউ লিখতে পারেন। যারা লিখতে পারেন, তাদের মধ্যে কারো কারো লেখা ধুলোর মতো, খাওয়াও যায় না, রাখাও যায় না; কারো লেখা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো, দেখতে ঝকমকা মুখে দিলে মিলিয়ে যায়, রোগজীবাণুর আক্রমণে কখনো কখনো শরীরের মস্ত ক্ষতিও হয়; কারো কারো লেখা আপেলের মতো, দেখতেও সুন্দর, দাঁত ভালো থাকলে খেতেও ভালো, উপাদেয়ও বটে; দু-একজনের লেখা রসুনের কোয়ার মতো, দেখতে বিশেষ যৌনতাবাহী নয়, খেতেও বিদ্ঘুটে, কেউ কেউ বলেন, মুখের কাছে নেওয়া যায় না, যে খায় তার মুখের কাছে দাঁড়ানো যায় না; কিন্তু কষ্ট করে খেয়ে নিতে পারলে অনেক রোগ-জীবানুর আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া যায়, ফলে দীর্ঘায়ুও হওয়া যায় বৈকি।
শহীদুল জহিরের লেখা মাঝেমধ্যে আপেল, কখনো কখনো রসুনের মতোই, আস্বাদনে যতই ঘাম ঝরুক আখেরে মুক্তি মেলে, জনপ্রিয় হাওয়াই মিঠাইমানের সাহিত্যজীবানুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, মনের নয়ন আর আয়ু দুটোই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। আর এই যে প্রাপ্তির কথা বললাম, এর জন্যে জহিরের ভাষা বা বলবার পদ্ধতিই সবচাইতে বেশি দায়ী বলে মনে হয়। জহিরের শিল্পকথনে মুগ্ধ অগ্রজ হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘শহীদুল তাঁর নিজের সৃষ্টির ধনুতে বাণ যোজনা করে তার জ্যা আকর্ণ আকর্ষণ করেছিলেন, তাঁর ডান হাতের বুড়ো আঙুল কর্ণমূল স্পর্শ করেছিলো। বেশি কিছু তাঁর আর করার ছিলো না বোধ হয়।’ অসাধারণ কথা। এমন সুন্দর করে কেবল হাসান আজিজই বলতে পারেন বুঝি! কথাটাকে শিরে রেখেই বলি, জহিরের সাক্ষাৎকার পড়ে এবং ‘মুখের দিকে দেখি’র মতো উপন্যাস কিংবা ‘ডলু নদীর হাওয়া’ ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’র মতো গল্প পড়ে এবং অবলোকন করে, মনে হয়, অন্তত গল্প বলার ঢঙে, শব্দ ব্যবহার ও বাক্যবিন্যাসের উপর্যুপরি স্বতন্ত্রতায় বাংলা কথাসাহিত্যের ভাষার আকাশকে আরো সম্প্রসারিত করতে পারতেন তিনি। উদাহরণস্বরূপ, স্বয়ং হাসান আজিজুল হকের কথাই বলা যেতে পারে, তাঁর উপন্যাস ‘আগুনের পাখি’তে যে ভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন তা তাঁর পূর্বের যে কোনো রচনার থেকে স্বতন্ত্র ও অগ্রগতির চিহ্নে ভাস্বর। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে হয়তো বিষয়বস্তুর উপস্থাপনে অনন্য একজন শহীদুল জহিরের অকালপ্রয়াণ আমাদের নবতর কোনো ভাষ্যনান্দনিকতা থেকে যে বঞ্চিত করেছে তা বলাই যায়।