প্রেম ও প্রত্যয়ের কবি কাজী নজরুল ইসলাম
নজরুলীয় রণতূর্যের ভৈরব গর্জনের সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। বাংলায় এমন জলদগম্ভীর সুরের লক্ষ্মী ছাড়া আর কে আছে? কাব্য উন্মাদনার তোড়ে পাঠককুল ভাসতে ভাসতে তাঁকে বিদ্রোহী অভিধায় যেন আয়ত্তে আনতে চাইল। সত্য-মঙ্গল-সুন্দরের সাধনায় তাঁর ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ উদ্দীপনার সঙ্গে অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলার মতোই খ্যাপাটে বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থেকে এমন বাসনার জন্ম হতে পারে। বাংলা সাহিত্যের চলন পথে নজরুল এমনই বিস্ময় ও দুর্বোধ্য এক সয়ম্ভু কণ্ঠস্বর, যার পূর্বসূরি অথবা উত্তরসূরি কোনোটিই নেই। ফলত তাঁকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা সাহিত্য ঘরানায় একটি ধারাবাহিকতায় পরিণত হতে চলেছে।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে যে কারণে স্থান হয়নি কবিদের—দৈব উন্মাদনা যখন কবির ওপর ভর করে, তখন রাষ্ট্র কাঠামোতে তাকে আর ধারণ করা যায় না। তিনি হয় ঈশ্বর অথবা শয়তান, আটপৌঢ়ে মানুষের কাতারে তাকে রাখা যায় না; এবং আমাদের অভিজ্ঞতা বলে ধারাপাতের মতো মানুষগুলো বস্তুত পৃথিবীর কোনো কাজে আসেনি। আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের এমন ফরমায়েশি চরিত্র প্লেটো কেন নির্ধারণ করেছিলেন, সেটি এখনো আমাদের দ্বিধাগ্রস্ত করে রাখে।
নজরুল ছাঁচে ফেলা কোনো চরিত্র নয়, আধুনিকতার লিনিয়ার কাঠামো তাঁকে ধরতে পারে না। তিনি নতুন ভাব, ভাষা ও বোধের যে নির্মিতি দিয়েছেন, তার সূত্র কিছুটা পাওয়া যেতে পারে সুইস ভাষাবিজ্ঞানী ফার্দিনান্দ দ্য সোস্যুরের স্ট্রাকচারাল লিঙ্গুয়িস্টিকস থেকে। নজরুল কেন তাঁর পূর্বসূরিদের ভাষাভঙ্গি, ধ্বনিবৈশিষ্ট্য, স্বরসাম্য অনুসরণ করলেন না অথবা তাঁর উত্তরসূরিদের কী এমন হলো যে তাঁরাও নজরুল থেকে দূরতম পথে চলতে থাকলেন? তিনি কি সম্পূর্ণ আলাদা কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতি ও পদ্ধতিতে বেড়ে উঠেছেন? তাঁর মনোগঠনের চূড়ান্ত প্রকাশ কি বিদ্রোহের অভিব্যক্তিতেই সীমায়িত? এমন অনেক প্রশ্নের জবাব আমরা পেয়ে যেতে পারি উত্তরাধুনিকতার বিবিধ ডিসকোর্স থেকে, সেটি হয়তো এই পরিসরে সম্ভব হবে না।
নজরুল যেসব অনুভূতির মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন, তাকে সরলীকরণ করলে শব্দটি দাঁড়ায় ‘মায়া’। তাঁর উদ্দাম ব্যক্তি ও শিল্পজীবনে এই মায়ার বাঁধন আশ্চর্য মাধুর্যমণ্ডিত হয়ে বিস্ময়কর বিষাদরূপে দেখা দিয়েছে। ১৯০৮ সালে তাঁর বালক বয়সে পিতৃবিয়োগ। মক্তবে পড়ালেখা এবং একই সঙ্গে মোল্লাগিরি, মাজার শরিফের খাদেমগিরি ও মসজিদে ইমামতি করেছেন। শৈশবে চাচা কাজী বজলে করিমের কাছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, স্থানীয় লেটো দলের জন্য বাংলা-উর্দু-ফারসি-ইংরেজি মেশানো ভাষায় গীতিকাব্য, প্রহসন, পাঁচালি, কবিগান রচনা। বর্ধমানে হাই স্কুলে পাঠ, রানীগঞ্জে বাবুর্চিগিরি, আসানসোলে রুটির দোকানে চাকরি, পুলিশ ইন্সপেক্টর কাজী রফিজউল্লাহর সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে ময়মনসিংহে গমন, ত্রিশালের দরিরামপুর হাই স্কুলে ভর্তি হওয়া, আবার পালিয়ে রানীগঞ্জ। এমন বাউণ্ডুলে শৈশব-কৈশোরের মূল অনুঘটক ‘মায়া’; কখনো আলগা হয়ে যাওয়া, কখনো বা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাওয়া। তাঁর ডাকনাম দুখু মিয়া এবং তারাখ্যাপা। নামেই যার ‘দুঃখ’ শব্দটি জড়িয়ে থাকে, তাঁর বেদনার গভীর দরিয়ায় কজন আর ডুবুরি হতে পারে। কবিতার ছদ্মাবরণ ছেড়ে কোথাও কোথাও বে-আব্রু হয়ে ওঠে তাঁর পঙ্ক্তিমালা—
“অন্তর-তলে অন্তরতর যে ব্যথা লুকায়ে রয়,
গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয়?
হয়তো কেবলি গাহিয়াছি গান, হয়তো কহিনি কথা,
গানের বাণী সে শুধু কি বিলাস, মিছে তার আকুলতা?
হৃদয়ে কখন জাগিল জোয়ার, তাহারি প্রতিধ্বনি
কণ্ঠের তটে উঠেছে আমার অহরহ রণরণি,—
উপকূলে বসে শুনেছ সে সুর, বোঝ নাই তার মানে?
বেঁধেনি হৃদয়ে সে সুর, দুলেছে দুল হয়ে শুধু কানে?
হায়, ভেবে নাহি পাই—
যে চাঁদ জাগালো সাগরে জোয়ার, সেই চাঁদই শোনে নাই”
তাঁর নামের ‘খ্যাপা’ শব্দটিও একই মর্মমূল থেকে উৎসারিত। সংসার অনভিজ্ঞ অবুঝ কিশোরের তীব্র অভিমান রূঢ় বাস্তবতার প্রতি; ভগবান, আল্লাহ, ঈশ্বর, ভাগ্যচক্র, ক্ষমতাধর মানুষ সবকিছুর প্রতি ধিক্কার আর গরল উগড়ে দেওয়া বিদ্রূপ। পাষাণ পৃথিবীকে মানুষের জন্য আনন্দময়, মায়াময় করে তোলাই তাঁর সকল অনুধ্যানের লক্ষ্য। দশম শ্রেণির অধ্যয়ন অসমাপ্ত রেখেই ১৯১৭ সালে তিনি নাম লেখান ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধের কলাকৌশল রপ্ত করে কীভাবে ব্রিটিশ শাসকদের ভারতছাড়া করা যায়, সেই গুপ্ত বাসনায়। ১৯২১ সালে সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয়, কুমিল্লায়। বিয়ের রাতেই নজরুল দৌলতপুর ত্যাগ করেন এবং নার্গিসের সঙ্গে কখনো একত্রে বসবাস করেননি। ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একই বছর তাঁর সম্পাদনায় অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ধূমকেতু সম্পর্কে তিনি বলেন, সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। “স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা ও-কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম ক’রে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভরতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ-দেশে মোড়লী ক’রে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করছেন, তাদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগর-পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবেন না। তাদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদেরও এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।”
১৯২২ সালেই ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা ও অন্য লেখকের অপর একটি রচনার জন্য সম্পাদক নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো। কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার হলেন তারুণ্যের উদগাতা এই কবি। আদালতের রায়ে তাঁকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো। কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেল থেকে তিনি লিখলেন ‘রাজবন্দির জবানবন্দী’, যার শেষ চরণগুলো মায়াময়তার আবেশে আপ্লুত হয়ে আছে, “কারাগারে আমার বন্দিনী মায়ের আঁধার-শান্ত কোল এ অকৃতী পুত্রকে ডাক দিয়েছে। পরাধীন অনাথিনী জননীর বুকে এ হতভাগ্যের স্থান হবে কিনা জানি না, যদি হয় বিচারককে অশ্রু-সিক্ত ধন্যবাদ দিব। আবার বলছি আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই। আমি অমৃতস্য পুত্রঃ।”
আজন্ম অভিমানী নজরুলের আপাত বিদ্রোহের অন্তরালে লুকিয়ে আছে ‘গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি’। তাঁর প্রিয়তমা কখনো দেশমাতৃকা, কখনো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, কখনো বা ‘যৌবন-ভীতু পল্লীবালার’ শ্যামল মুখচ্ছবি। মানুষের সীমাবদ্ধতার এক মর্মান্তিক ব্যথার নদী তিনি নিভৃতে বহন করে চলেন—
“হয়ত তোমার শাখায় কখনো বসে নি আসিয়া শাখী,
তোমার কুঞ্জে পত্রপুঞ্জে কোকিল ওঠেনি ডাকি।
শূন্যের পানে তুলিয়া ধরিয়া পল্লব-আবেদন
জেগেছে নিশীথে জাগে নি ক’সাথে খুলি’ কেহ বাতায়ন।
—সব আগে আমি আসি’
তোমারে চাহিয়া জেগেছি নিশীথ, গিয়াছি গো ভালোবাসি!
তোমার পাতায় লিখিলাম আমি প্রথম প্রণয়-লেখা
এইটুকু হোক্ সান্ত্বনা মোর, হোক্ বা না হোক দেখা।”
জেল থেকে মুক্তির পর ১৯২৪ সালে যেন নতুন আশ্রয়ের সন্ধান পেলেন কবি। কলকাতায় প্রমীলা সেনগুপ্তার সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন, কিন্তু বেদনা তাঁকে ছাড়বে কেন! আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীতে শিশু বয়সেই তাঁর প্রথম এবং দ্বিতীয় পুত্রের মৃত্যু হয়। ‘প্রলয়-শিখা’ কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত এবং কবির ছয় মাস কারাদণ্ডের আদেশ হয়। এমন ভাঙা-গড়ার ভিতরে এক প্রত্যয়ী রুদ্র-সুন্দর রূপের শিখা তিনি অনবরত জ্বালিয়ে রেখেছেন। রূপের তৃষ্ণা সম্ভবত থেকেই যায়, অনন্ত মায়া আর বিরহ বিষণ্ন সুরে ক্রমাগত বেজেই চলে, “যদি আর বাঁশি না বাজে—আমি কবি বলে বলছিনে—আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি—আমায় ক্ষমা করবেন—আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি—আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম—সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।”
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, চারুকলা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।