মুক্তগদ্য

করোটিতে রোদ

Looks like you've blocked notifications!

কয়টার ট্রেন ধরবে বাংলাদেশ, সমুদ্র জানতে চায়নি। রাজশাহীর ট্রেন ধরে পাকশীতে নামবে, এতটুকু জানা আছে। সমুদ্র জানতে চায়নি ট্রেনের নাম-সময়,বাংলাদেশও বলেনি কিছু্। সমুদ্র সকালেই স্টেশনে চলে এসেছে। রেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে পড়েছিল ভোরেই। রাতে ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে মৃদু লয়ে। মাটির ভেজা সৌরভ ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। তীব্রতা রয়েছে বৃক্ষের ভেজা ঘ্রাণের। সমুদ্র কাউকেই দূরে সরিয়ে দেয়নি; বরং একটা ভেজা লিচু পাতা কুড়িয়ে নিয়ে তার ঘ্রাণ নিয়েছিল অনেকক্ষণ ধরে। এখন বেঞ্চিতে পাশে পড়ে আছে পাতাটি।

কয়েক দফা দমকা বাতাস এলেও উড়ে যায়নি। সমুদ্রের সঙ্গেই আছে। ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না ওকে। ছেড়ে যাননি নিরঞ্জনও। সেই রেস্টহাউসের গেট থেকে পিছু নিয়েছেন। পথে দাঁড় করিয়ে চা খাওয়ালেন। সকাল সকাল গুড়ের চা। সমুদ্র খেতে চাননি প্রথমে। নিরঞ্জন জোর করেন, প্রকৃতি মিষ্টি করে হেসে আছে। আপনি একটু মিষ্টি মুখ করবেন না? সমুদ্র গিয়ে বসেন চা দোকানের বেঞ্চিতে, তাই বলে গুড়ের চা দিয়ে মিষ্টিমুখ? আপনাদের এখানের কোনো মিষ্টিরই তো সুনাম শুনেছি। লেপচা নামে একটা মিষ্টি আছে না? নিরঞ্জন চায়ের কাপ তুলে দেন সমুদ্রের দিকে, আছে। জিভে উঠবে। কিন্তু এই ভেজা সকালে গুড়ের চায়ের মতো স্বাদ দেবে না। এখানে এসে প্ল্যাটফর্মের ওপরে উঠবার আগে, টিকেট কাউন্টারের সামনের বটতলায় নিয়ে বসালেন। সমুদ্র বলেন, আমি তো কোথাও যাচ্ছি না। টিকেট করতে হবে নাকি? নিরঞ্জন হেসে বলেন, দুই আনা এখনো বাকি আছে। সমুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকান, কোথাও বকেয়া রাখিনি তো। নিরঞ্জনের হাতে ঘোলের গ্লাস, মিষ্টির সঙ্গে একটু নোনতা স্বাদ যদি জিভে না পড়ে, তবে বাকি চৌদ্দ আনাই তো যাবে জলে। এমন ঘোলে হাবুডুবু খাওয়া হয়নি বহুকাল।

প্ল্যাটফর্মের ওপরে উঠে নিরঞ্জন রেলসেতু দিয়ে পশ্চিম দিকে হেঁটে চলে গেছে। ফেরেনি এখনো। প্রকৃতির ভেজা সুগন্ধি নেই। রোদের তীব্রতা বেড়েছে। পূর্বদিকে একটু দূরে হুলস্থুল নির্মাণকাজ চলছে। সেখান থেকে বালু উড়ে আসছে। ওদিকে তাকিয়ে চোখ খোলা রাখাই মুশকিল। প্ল্যাটফর্মের দুই দিকে দুজন বসে কথা বলছেন। মাঝে রেললাইন। তাদের কথা কতটা ভেসে সমুদ্রের কানে এসেও আছড়ে পড়ছে। অনেকটাই উড়ে যাচ্ছে, হয়তো পাশের রূপপুর কিংবা পদ্মার ওপারের ভেড়ামারায়। উত্তরের মহিলা বলছেন, তুই আসলি কবে? দক্ষিণে পুরুষ বলছেন, তুই যাবি কবে? কিছুক্ষণ চুপ। তারপর আবার উত্তর বলে, ঝড় উঠব ভাগ। দক্ষিণ বলে, গাঙে যাবি? আবার কথা নেই কিছুক্ষণ উত্তর বলে, এইপারে আয়। দক্ষিণ বলে, কেমনে, গাঙে যে পানি। শুনে উত্তর উঠে দাঁড়িয়ে পাশের পাকুড় গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে রেললাইনের ওপর ছুড়ে দেয়, নে, নাও পাঠাইলাম। দক্ষিণ উঠে আনন্দে নাচতে থাকে। সেই নাচ উত্তর দেখতে পেল না। ওই সময়টায় ট্রেন ভেড়ামারার দিক থেকে স্টেশন পেরিয়ে গেল। থামল না। দক্ষিণ নাচ থামিয়ে এখন চুপচাপ বসে আছে। পূর্বদিকের লাইনে শালিক পাখিদের মেলা বসেছে। জোড়ায় জোড়ায় নেচে বেড়াচ্ছে ওরা। দক্ষিণ সেদিকেই তাকিয়ে। উত্তর চৈত্রের রোদকে পাত্তা না দিয়ে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

সমুদ্র রেলসেতুর দিকে তাকায় নিরঞ্জন ফিরছে কি না দেখতে। কিন্তু অনেকদূর পর্যন্ত কোনো মানুষের ছায়াটিও নেই। বাংলাদেশ ফোন বা এসএমএস কিছুই দেয়নি। ও ট্রেনে উঠতে পারল কি না, জানার ইচ্ছেটা কখনো কখনো হুল ফুটালেও, সমুদ্র ফোনটা হাতে নিচ্ছে না। বেঞ্চিতেই ফেলে রেখেছে। কখনো কখনো বেজে উঠছে ফোন। বাংলাদেশের ফোন নয় বলে তুলছে না। সমুদ্র দেখতে পান রেললাইনের দুধার দিয়ে কেমন রক্তজবা ফুটে আছে। সমুদ্র একটা জবা ছিঁড়ে নেন। ঠিক করে রাখেন বাংলাদেশ এলে ওর হাতে ফুলটা তুলে দেবেন। ওকে জবা ছিঁড়তে দেখে সিঁড়ির কাছ থেকে হাঁক দিলেন একজন, ফুল ছিঁড়লেন কেন, মালিকরে জিগাইছেন? সমুদ্র সত্যি যেন একটু ভয়ই পেলেন, জবা ফুল গাছ আপনার হাতে লাগানো? তিনি শসা, বাঙ্গি, তরমুজ আর বাদাম নিয়ে বসেছেন। বোঝাই যায় এই ইস্টিশনের পুরোনো হকার। বলেন, ইস্টিশনের মালিকই তো আমি। মালিকের উঠানের গাছ কার হইব? সমুদ্র অবাক হোন, আপনি মালিক? হকার একটা শসা কেটে ধরিয়ে দেন সমুদ্রের হাতে, আটত্রিশ বছর আছি। আর তো কেউ দখল নিতে আইল না।

সমুদ্র একটু ইতস্তত করে শসা হাতে তুলে নেন, সরকার? হকার পুরো ইস্টিশন তোলপাড় করে হাসতে থাকেন। তাঁর হাসিতে চারপাশের বয়সী গাছগুলো থেকে কাঠবিড়ালিরাও ঝাঁপ দেয়। তিনি বলেন, সরকারের সাহস আছে। আরে ভাই রেলে আটত্রিশ বছর সকাল-সন্ধ্যা আসা-যাওয়া করি, একবারও মুরোদ হইছে আমার কাছে টিকেট চাওয়ার। সমুদ্র জানতে চান, কেন হয়নি। ঠোঁট উল্টে উত্তর দেন, মালিকের কাছে টিকেট চাওয়ার মুরোদ আপনার আছে? সমুদ্র প্রসঙ্গ পাল্টান। উত্তর-দক্ষিণের মানুষ দুজন সম্পর্কে জানতে চান, চেনেন ওদের? আড়চোখে সেদিকটায় তাকান। তারপর বলেন, ও আজকে ও আইছে? সমুদ্র বলেন, কারা ওরা ? তিনি বিরক্তি নিয়ে বলেন, ভূত। সমুদ্র অবাক হন, ভূত মানে। হকারের বিরক্তি কাটে না, আরে মিঞা। ওই শালিকগুলিরে আপনার কী মনে হয়, পাখি? সমুদ্র মাথা নাড়েন, হুম।

হকারের ঠোঁটে তাচ্ছিল্য, বুঝছি আপনারও বেলা শেষ। ভাগেন। সমুদ্র তারপর অনেক কথাই বলতে চেয়েছেন হকারের সঙ্গে, কোনো সাড়া পাননি। শসার টাকা হাতে তুলে দিলে, ছুড়ে ফেলেদেন পদ্মার দিকে। টাকা উড়ে উড়ে মনে হলো গাঙ পেরিয়ে যায়।

ঢাকার দিক থেকে একটা ট্রেন এসে সেতু পেরিয়ে গেল। সমুদ্রের ভয় হয়, নিরঞ্জন যদি এই সময়ে ফেরার পথে থাকে? চৈতালি হাওয়া বইছে। সূর্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ডুবে যাওয়ার। পদ্মার জলে যেন লাবণ্য আর ধরে না। আম-লিচুর মুকুল থেকে উগ্র সুবাস এসে মাতোয়ারা করে দিচ্ছে পুরো ইস্টিশনকে। নিচের পথে মহিষের দল ঘরে ফিরছে। তাদের পেছনে ক্লান্ত রাখাল। কোনো কোনো দল ফিরে যাচ্ছে অভিভাবক ছাড়াই। পাখিদের দলে কে যে অধিনায়ক বলা মুশকিল। সমুদ্র দেখছে আশপাশের গাছগুলোর বাড়িতে দলে দলে এসে ঢুকে পড়ছে ওরা। সমুদ্র ভাবে, গোধূলি বেলায় একদিন তারও ঘরে ফেরার তাড়া ছিল। জানালায় অপেক্ষায় ছিল কোন চোখ। না, নিরঞ্জন বুঝি এই পাড়েরই মানুষ নন। ওই পাড়ের হবে। তাই ফেরার ধ্বনি নেই। কিন্তু ভোরে এপাড়ে এসেছিলেন কার খোঁজে? উত্তর তো নিরঞ্জনই বলে গেছেন সকালে। সেই গুড়ের চা খাবার সময়ে, মানুষ কখন কার খোঁজ করে, মানুষ নিজে জানে না।

সমুদ্র দূরে ট্রেনের হু্‌ইসেল শুনতে পায়। বুঝতে পারে না সেই হুইসেল পূর্ব নাকি পশ্চিম থেকে আসছে। হেঁটে গিয়ে রেলসেতুর পাটাতনে কানপাতে। না, কারোরই পদধ্বনি নেই। না, নিরঞ্জন না ট্রেন। অবশ্য বাংলাদেশের পশ্চিম থেকে আসার কথা না। তবুও বলা কি যায় ও কখন কোন পথে চলে। এক বছরে কতটাই বা বাংলাদেশকে বুঝতে পেরেছেন সমুদ্র? বাংলাদেশ কখনো এসে কপাল ছুঁয়ে যায়, চুলগুলো করে দিয়ে যায় এলোমেলো। তাতেই আপ্লুত হয়ে পড়েন সমুদ্র। হাত বাড়ান যেন বৈশাখে আষাঢ় নেমে আসবে তার করতলে। কখনো কখনো নেমে আসে বটে। আবার অনেক দিন জ্যৈষ্ঠের কঠোরতা। গাঙের পাড়ে আসা। পদ্মার কাছে আসা সমুদ্রের অভিমান জানাতেই। বাংলাদেশকে নিয়ে নালিশ করবে। নালিশ করা হলো কই। মহুয়ার গন্ধে, বাদুরে নৃত্যের মুগ্ধতায় মজে গেছে সমুদ্র। নালিশ যাকে নিয়ে জানাবার। তাকেই ডেকে পাঠালেন পাকশি, চলে আয়। এখানে আছে আশ্চর্য এক চৈত্র মাস। আসছে প্রেমে পড়ার মতো গ্রীষ্ম। আসবি? আয়।

বাংলাদেশ আসবে বলেছিল মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই। চৈতালি রাতে চাঁদ আজ পুরোটাই ঝলসানো। লাল মরচে ধরা রেলস্টেশন যেন মরিচবাতির মতো জ্বলছে। ট্রেনের বাঁশি বেজেই চলছে। সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠছে ক্রমশ। কোনো এক বাঁশিওয়ালার সুরে সমুদ্রের আফালে জলোচ্ছ্বাস ভেসে যাচ্ছে পাকশি। সমুদ্র নিশ্চিত বাংলাদেশ আসছে। সমুদ্র চিৎকার করে বলছে, বাঁশিওয়ালা থামিও না তোমার বাঁশি। আসছে। আসতে হবেই ওকে। কন্যা আমার, মা আমার আয়। তোকে এক অপূর্ব চৈতালি রাত দেখাব, নরম গ্রীষ্ম দেখাব, দেখবি না—মা, তুই আমার বাংলাদেশ!