জার্মান থেকে অনুবাদ
মার্কসের আর্থ-দার্শনিক পাণ্ডুলিপি ১৮৪৪
ভূমিকা
ও্যকোনোমিস-ফিলোজোফিশে মানুসক্রিপ্টে ১৮৪৪ (Ökonomisch-philosophische Manuskripte) কার্ল মার্কসের যুবক বয়সের লেখা। ইউরোপে বিশেষত জার্মান দেশে যে আদর্শবাদী ঘরানা দর্শনশাস্ত্রে বিকশিত হয়েছে, মূলত এটি তারই ধারাবাহিকতা। বাংলায় এর নামকরণ করা যেতে পারে আর্থ-দার্শনিক পাণ্ডুলিপি ১৮৪৪। অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনার গোড়ার কথা হলো দর্শন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ অপরাপর সমাজবিজ্ঞানকে বুঝতে গেলে দর্শসশান্ত্র পাঠ যে অনিবার্য, তা এই পাণ্ডুলিপিতে ভালোমতো ব্যক্ত হয়েছে। এই বইতে কিছু কিছু অংশ খানিকটা খাপছাড়া। কারণ ভুলে গেলে চলবে না যে, এটি মূলত মার্কসের একটি খসড়া লেখা। তারপরও মার্কসের পুঁজি পড়ার আগে এই খসড়াটি পড়ে নিলে মার্কসপাঠ অনেকটা সহজ হবে পাঠকের কাছে। মার্কসের পাণ্ডলিপির মুখবন্ধটি জার্মান ভাষা থেকে সরাসরি অনুবাদ করেছেন তানিম নওশাদ।
প্রাক-কথন
আমি জার্মান-ফরাসি বার্ষিক বইতে হেগেলীয় দক্ষিণপন্থী দর্শনকে সমালোচনার আলোকে আইন-বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের (১) সমালোচনা প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছিলাম। ওই লেখার খসড়া মুদ্রণে যা প্রকাশিত হলো তা হলো শুধু লাগামহীন চিন্তার নিরিখে বহুবিধ বিষয়ের সমালোচনা; যেগুলো অবিকশিত এবং বুঝবার ক্ষেত্রে দুর্বোধ্য। এখন এই বিবিধ বিষয়ের প্রাচুর্যের যে ভিড় তা যদি সর্বসম্মতভাবে নীতিবাক্যের আদলে (aphoristische Weise) গৃহীত হতো, সে ক্ষেত্রে হয়তো বা এই নীতিবাক্যসুলভ প্রকাশ সবার মধ্যস্থতায় একটি পদ্ধতিগতভাবে নিষ্পন্ন প্রত্যয়নপত্র উৎপন্ন করতে পারত। এ জায়গা থেকে আমি নানান স্বাধীন পুস্তিকায় অধিকার, নীতি, রাজনীতি ইত্যাকার বিষয়ের সমালোচনা করবো এবং পরিণতিতে চেষ্টা করব একটি বিশিষ্ট কাজের আকারে আবারও সামগ্রিকের সঙ্গে প্রতিটি অংশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মননশীল চিন্তাবিদের বিবিধ বিষয়বস্তুর সাপেক্ষে যে তৎপরতা তার সমালোচনা হাজির করতে। এই জায়গায় মানুষ তার হাজিরকৃত লেখায় অর্থনীতির সঙ্গে রাষ্ট্র, অধিকার, নীতি, পৌর জীবনের সম্পর্ক খুঁজবে, যে বিষয়গুলো এখন পর্যন্ত শুধু স্পর্শ করা হয়েছে, আর জাতীয় অর্থনীতিও এই বিষয়গুলোকে ছুঁয়ে যায়।
এইক্ষণে জাতীয় অর্থনীতিতে আস্থা আছে এমন পাঠককে আমি নিশ্চিত করছি না যে, আমি যে ফলাফলগুলোতে উপনীত হয়েছি জাতীয় অর্থনীতির উপর সামগ্রিকভাবে বস্তুনিষ্ঠ, সতর্ক বিশ্লেষণাত্মক পর্যালোচনার ভিত্তিতে সেগুলোতে পৌঁছানো গিয়েছিল।
অন্যদিকে অজ্ঞ সমালোচক তার সামগ্রিক অজ্ঞতা ও চিন্তার দীনতা লুকাতে সচেষ্ট; তিনি কাল্পনিক বয়ানে (utopische Phrase) অথবা অপরাপর বয়ানে যেগুলোকে একেবারে নির্ভেজাল, একদম দৃঢ়সংকল্প, একদম পুঙ্খানপুঙ্খ সমালোচনা, যেগুলো কেবল আইনগত নয়, বরং সামাজিকভাবেও সামগ্রিক পরিমণ্ডলের নিরিখে দৃষ্ট সমাজের জায়গা থেকেও সুদৃঢ়, আমজনতার জায়গা থেকেও বার্তা প্রকাশক, যেখানে একজন ইতিবাচক সমালোচকেরও মাথা খাটানোর আরো বিষয় আছে, সেখানে তারো এ ক্ষেত্রে প্রমাণ দাখিলের বিষয় আছে যে, তারো পরম্পরাগত ধর্মীয় বিষয়াদির বাইরে দুনিয়াবি কোনো বয়ান বলার আছে।
এটি না বললেও চলে যে, আমি ফরাসি ও ইংরেজি সমাজতান্ত্রিক কাজগুলোর বাইরে জার্মান সমাজতান্ত্রিক কাজগুলোও ব্যবহার করেছি। বিবিধ বিষয়সমৃদ্ধ মূল জার্মান কাজগুলোর এই জ্ঞানগত তৎপরতা কমে গিয়েছে, ভাইটলিঙের (Wilhelm Christian Weitling) কাজের বাইরে হেসের (Heβ) রচনায় ব্যক্ত ২১টি অনুচ্ছেদ এবং এঙ্গেলসের ‘জাতীয় অর্থনীতির সমালোচনার রূপরেখা’ (Umrisse yur Kritik der Nationalökonomie) বার্ষিক বইতে জায়গা করে নিয়েছে; সেখানে আমিও কাজগুলোর প্রথম উপাচারগুলোর সর্বজনগ্রাহ্য ধারণা দিয়েছি।
এইসব লেখকের বাইরে—যারা কিনা জাতীয় অর্থনীতির সমালোচনায় ব্যাপৃত, ঋণী থাকো চূড়ান্ত বিচারে ইতিবাচক সমালোচকদের প্রতি, যারা ফয়েরবাখের আবিষ্কারগুলোর সঠিক পর্যালোচনা ভিত্তিক মূল্যায়ন করেছেন, বিশেষত তার ভবিষ্যতের দর্শন (Philosophie der Zukunft) এবং দর্শনশাস্ত্রের পুনর্গঠনের তত্ত্বসমূহের (Thesen yur Reform der Philosophie) মধ্য দিয়ে তার যে উপকথার (Anecdotis) ন্যায় চাউড় হয়েছিল তাকে নীরব হতে দিয়ে—তিনি সেই একজন যিনি পাণ্ডিত্যাভিমানী, ক্রোধবশত অপরের ধারাবাহিক অবদানকে গোপন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন বলে মনে হয়।
ফয়েরবাখ থেকেই এসেছে ইতিবাচক ও অকৃত্রিম সমালোচনা। যত নীরব করতে চাওয়া হয়েছে ফয়েরবাখের লেখাগুলোকে ততই সুনিশ্চিত, গভীর, ব্যাপক এবং দীর্ঘমেয়াদি হয়ে উঠেছে তার লেখার প্রভাব; হেগেলের ফ্যানোমেনোলগী (Die Phänomenologie des Geistes) ও লগিকের (Wissenschaft der Logik) পর এতেই ছিল প্রকৃত এক তাত্ত্বিক বিপ্লবের ভিত্তি।
এই লেখার যেটি শেষ অধ্যায়, যেটি বিরচিত হয়েছে সামগ্রিকভাবে হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতা ও দর্শনের (Hegelische Dialektik und Philosophie) মোকাবিলায়, তা আমাদের সময়কার ক্রিটিকাল ধর্মতাত্ত্বিকদের বিরোধিতায় পুরোদস্তুর গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি; এই ধরনের কাজ ইতিপূর্বে কখনো সম্পন্ন হয়নি—যা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অসম্পূর্ণতা, যার অভাবে ক্রিটিকাল ধর্মতাত্ত্বিক ধর্মতাত্ত্বিকই রয়ে গেলেন। ফলত হয় দর্শনের কোন সুনির্দিষ্ট পূর্বশর্তসমূহকে কোনো কর্তৃত্ব থেকে উদ্গত হতে হয়েছে অথবা যখন তার মধ্যে সমালোচনার প্রক্রিয়া বিজাতীয় আবিষ্কারসমূহের মধ্য দিয়ে তার দার্শনিক শর্তসমূহকে সন্দেহে নিপতিত করেছে; তা ত্যাগ করা হয়েছে ভীরু কাপুরুষের ন্যায়, তাকে যাচাই-বাছাই না করেই। আর এই দাসবৃত্তিকে বিমূর্ত করা হয়েছে ওই একই ক্রোধ থেকে, দাসবৃত্তিকে শুধু আরো নেতিবাচক, অসচেতন এবং সোফিস্টদের ন্যায় বলে ঘোষণা দিয়ে।
টীকা
১. রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জার্মান মার্কস লিখেছিলেন Staatswissenschaft, যার আক্ষরিক অর্থও হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান। যদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জার্মান বর্তমান করা হয় Politikwissenschaft ও Politologie। অনুবাদক