আলাউদ্দিন আল আজাদের জন্মদিনে বৃষ্টি ও তৈলচিত্রের স্মৃতি
স্মৃতি : ০১
আমি তখন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের গবেষণা সহকারী। তাঁর সম্পাদিত ‘জেন্ডার ও উন্নয়ন কোষ’ বইটি ততদিনে প্রকাশ হয়ে গেছে। চলছিল জেলাভিত্তিক বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান। ৩ জুলাই ২০০৯ সাল। সকাল। মাক্রোবাসে করে আমরা তখন যাচ্ছি কুমিল্লায়। আমরা বলতে, সেলিনা আপা, আনোয়ার ভাই ( সেলিনা আপার স্বামী), সাঈদ সুমন ( সেলিনা আপার ছোট ভাই) ও আমি। গাড়িটি তখন সেলিনা আপার শ্যামলীর বাসা থেকে ফার্মগেটের খামারবাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছে। এমন সময় আপার মোবাইল ফোনটি বেজে ওঠে। অপর প্রান্ত থেকে কেউ একজন জানালেন, আলাউদ্দিন আল আজাদ আর নেই। শুনে আঁৎকে ওঠেন আপা। বলেন, কী?
যেন এক মুহূর্তে বদলে গেল গাড়ির ভেতরকার পরিবেশ। বিমর্ষ কণ্ঠে সেলিনা আপা বলতে লাগলেন আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘বৃষ্টি’ গল্পটির আন্দোলিত করার কথা। ঘটনাটি কাকতালীয়। তারপরেও বলি। ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। মনে হলো যেন আজাদের মৃত্যুতেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
স্মৃতি : ০২
লেখাপড়ার বিষয়ে আমি ছিলাম চরম ফাঁকিবাজ। বইপত্র থেকে সবসময় একশ হাত দূরে থাকতাম। তা সে স্কুলের পাঠ্যবই হোক আর তার বাইরের বই-ই হোক। খেলাধুলা আর মাঝে মধ্যে আঁকাআঁকি করেই পার হয়ে যেত সারাদিন। তবে এর মাঝেই টুকটাক পড়াশুনা করেছি, তা ঠিক। সত্যি বলতে কি, পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই পড়ার অভ্যাস তেমন একটা আমাদের পরিবারে ছিল না বললেই চলে। স্বাধীনতাও ছিল না। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বইকে বলা হতো ‘আউটবই’। এই ‘আউটবই’ পড়লে নাকি ছেলেমেয়ে খারাপ হয়ে যায়, ছোটবেলায় এমনটাই শুনেছি। এজন্যই কিনা, বাড়ির কাউকে তথাকথিত সেই ‘আউটবই’ বই পড়তে দেখেনি। তাই বলে গল্প-উপন্যাসের বই পড়লে বাধা দেয়ারও কেউ ছিল না। পড়ালেখাই যার কাছে চোখের বালি, তার আবার বাড়তি বইপড়া! তবে কৈশোরের পর আমাকে সেই ‘আউটবই’-এর সঙ্গে সময় পার করতে হয় দিনের পর দিন। এখনও যা অব্যাহত। ময়মনসিংহ শহরে থাকাকালে মফস্বলের সেই পাবলিক লাইব্রেরিতে বসেই একদিন খোঁজ পাই ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’। ওই বয়সে সেটি পড়ে কিছুই বুঝিনি। পরে যা পড়ে মুগ্ধতায় মগ্ন হয়েছিলাম।
‘বৃষ্টি’ পড়া
গল্পটি পড়েছিলাম একটি গল্প সংকলনে। বইটি হাতে পেয়ে হঠাৎই মনে পড়ে যায় সেলিনা আপার কথাগুলো। শুরু করি গল্পটি পড়া। বৃষ্টি হচ্ছে না বলে মৌলানা সাহেব গাঁয়ের ভেতর খুঁজে বেড়ান, কার মেয়ের পাপে এমন অনাসৃষ্টি। কাজের মেয়ে জৈগুন জানায়, বাতাসীর ঘরে একজন লোককে সে দেখেছে। কারণ ওর স্বামী রজবালি বেঁচে থাকতেও বাতাসীকে নিয়ে নানা কথা উড়েছে। ওর কারণে আল্লাহ জমিনে বৃষ্টি বন্ধ করে দিয়েছেন। এর আগে ঘটনা। মৌলানা সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী মারা গেছে দুই বছর আগে। সংসার নিয়ে তেমন আর চিন্তা নেই তার। বয়স তখন ষাট। মজু প্রধান নাছোড়বান্দা, একুশ-বাইশ বছরের তার মেয়ের ঘরের নাতনির সঙ্গে হাজি কলিমুল্লাহর বিয়ে দিয়ে দেয়।
যাই হোক, বাতাসীকে নিয়ে সাড়া পড়ে যায়। স্বামী নেই তার। হাজি সাহেব তসবিহ্ হাতে গভীর চিন্তায় মগ্ন। অল্প বয়সে স্বামী মারা যাওয়ার এই দোষ, স্বামীসঙ্গ একবার যে পেয়েছে সে সেই স্বাদ কি ভুলতে পারে? কেতাবে শাস্তি আছে, গলা-পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে এর মাথায় পাথর মারতে হবে, যতক্ষণ না প্রাণটা বেরিয়ে যায়। হাজি সাহেব যখন তন্ময় হয়ে ভাবছেন, তখন খালেদ তার নতুন মাকে বাপের বাড়ি থেকে আনছে। খালেদের ছোট ভাই সাজুকে কোলে নিয়েছে জোহরা। নতুন মাকে বেশ ভালো লেগেছে সাজুর। তাই নাইওর করতে গেলে সাজু কোলে উঠে গিয়েছিল। জোহরার কোল থেকে ঘুমিয়ে থাকা ভাইকে নিজের কাঁধে নিতে গিয়ে খালেদের অন্য অনুভূতি জাগ্রত হলো। কপোতের বুকের মতো উষ্ণ, প্রবালের মতো কোমল কীসের মধ্যে যেন তার বাঁ হাতের আঙুলগুলো ক্ষণিকের জন্য হঠাৎ হাওয়ায় চাঁপার কলির মতো কাঁপুনি খেয়ে গেল। নিমেষে তার সমস্ত শরীরটা শিরশিরিয়ে উঠল ভরা মেঘে বিদ্যুৎ সঞ্চারের মতো। জোহরা নানাভাবে প্রলোভন দেখায় বিশেষ ইঙ্গিতে, নানা কথায় ও ছলে। খালেদ বলে, কী হলো আপনার? জোহরা বলল, তুমি কিচ্ছু জানো না, কিচ্ছু বোঝ না! এমন মেয়ে জোহরা যার স্বামী কিনা ষাট বছরের বুড়ো। নানা বলেছিল দু-এক বছর সবুর কর, বুড়ো মরলে সম্পত্তি তোর, তখন জোয়ান দেখে জুটিয়ে দেব।
রাতে বুড়ো কপালে কোমল হাতের ছোঁয়া পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে নাক ডাকতে থাকে। জোহরার মনে হয় একটা মৃতলোক, বুক থেকে পা পর্যন্ত শাদা কাপড়ে ঢাকা। ‘সারাদিন কোথায় ছিলে’, চুপি-চুপি বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই জোহরার কথা শুনে খালেদ থমকে দাঁড়ায়। ‘না খেয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে, না’? হঠাৎ ডান হাত তুলে খালেদের গালে চড় মেরে খ্যাপা কণ্ঠে জোহরা বলে, আমি আর কষ্ট সইতে পারব না, বাড়ি থেকে চলে যাও, চলে যাও তুমি। অন্যদিকে হাজি সাহেব বেশ চিন্তায় আছেন। তিনদিন তিনরাত্রি হাদিস-কিতাব ঘেঁটে একটা ফতোয়া তৈরি করেছেন। শুক্রবার রাত্রে বিচার বসে। আলোচনা চলছে। মোক্ষম একটা শাস্তি হবে এই অনাচারের, যেন সমাজের কেউই আর এমন কাজ করতে না পারে। সে-সময় দক্ষিণ দিক থেকে পালে-পালে কালো মেঘ এসে সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলে। চাঁদ বারবার আড়ালে পড়ে, গাছপালা ও খামারে-নদীতে আলো-ছায়ার লুকোচুরি। রাত্রে কিছু ঘটবে, বৃষ্টি হবে, বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে সমস্ত পৃথিবী, ঠিক এমনি সময় হাজি সাহেবের বাড়ির পেছন দিকে আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটা মানুষের ছায়ামূর্তি, পা টিপে খোলা জানালার কাছে এসে অনেকক্ষণ সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। ঘরে আলো নেই, প্রেতপুরির মতো বাড়িটা ঝিম ধরে থাকে। তারপর অনেকটা সময় পর দরজা খুলে খাটের কাছে এসে দাঁড়ায়। বুকে ওর ভয় থাকলেও আমের বোল নাকি চুলের গন্ধ মাতোয়ারা করে। সে পিছিয়ে গেলেও একটা কোমল হাত আকর্ষণ করল। সে তখন নিজেকে ছেড়ে দিলো। বৃষ্টির ভেতর একসময় ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হলেও এলোমেলো কাপড়ে জোহরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির খেলা দেখতে লাগল। তারপর নিজেকে বৃষ্টির পানিতে ভাসিয়ে দিলো। কারণ বছরের পয়লা বৃষ্টিতে সর্দি হয় না, আবার ফসলও খুব ভালো হয়। জোহরার রহস্যময় কথাগুলো কেউ বুঝল কি বুঝল না সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু যে বোঝার সে ঠিকই বুঝে গেল। অদৃশ্য ছায়া দূরে সরে গেলেও জোহরার ঠোঁটে হাসির রেশ লেগে রইল। সে তখন বৃষ্টির মতোই ছন্দহীন। গল্পে যে জাদুবাসস্তবতা কাজ করেছে তা মুগ্ধ করেছে পাঠককে। ধর্মের খোলসে মানুষ। কিন্তু তার ভেতরে আরেক রহস্য। সে রহস্যের ভেদ দেখতে পাওয়া যায় ‘বৃষ্টি’ গল্পে।
‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ দেখা
বোধের পর থেকেই জানি, আমি আঁকতে জানি। সেই চিত্রকলার প্রেমের পড়েই বোধ হয় লাইব্রেরিতে বসে বইটি প্রথম হাতে নিয়েছিলাম। পড়তে শুরু করলাম। দুই-এক প্যারা পড়ার পর বুঝতে পারলাম, এটি চিত্রকলা-বিষয়ক কোনো প্রবন্ধের বই নয়; বরং উপন্যাস। বইটি পড়ে কিশোর মস্তিষ্ক সেদিন অনুধাবন করতে না পারলেও, যুবাকালে সেই একই বই আমাকে মোহিত করে রাখে অনেকদিন।
খানিক ইতিবৃত্ত
‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ আলাউদ্দিন আল আজাদের প্রথম উপন্যাস। ১৯৬০ সালে পদক্ষেপ নামে এক পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রথম ছাপা হয় সেটি। পরবর্তীকালে ১৯৬১ সালে নওরোজ কিতাবিস্তান উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশ করে। নওরোজের পর সাতবার প্রকাশ করেছে মুক্তধারা। অনেক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে এটি। ১৯৭৭ সালে বুলগেরীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে ‘পোত্রেৎ নমের দুবাতসাৎ ত্রি’ নামে। উপন্যাসটি অবলম্বনে সুভাষ দত্ত তৈরি করে চলচ্চিত্র ‘বসুন্ধরা’। সাতটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় পুরস্কার লাভ করে সিনেমাটি ।
যৎসামান্য বিশ্লেষণ
গঠনে উপন্যাসটি kunstlerroman ধারার। জার্মান ভাষায় kunstler অর্থ শিল্প এবং roman অর্থ উপন্যাস। মোট কথায় একজন শিল্পীকে কেন্দ্রে রেখে যে উপন্যাস গড়ে ওঠে তাঁকে kunstlerroman বলা যায়। উপন্যাসে জাহেদ সেই শিল্পী আর তাঁর শিল্পী হয়ে ওঠার গল্পই ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’। গল্পের কথন ধারায় flash back ও flash forward কারিগরির ব্যবহার আছে। মূলত কাহিনীর উন্মোচন কিছুটা মন্তাজ ধরনের। উপন্যাসের কাহিনীর নায়ক জাহেদের চিত্র ‘মাদার আর্থ’ করাচিতে এক আন্তর্জাতিক একজিবিশনে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। এ খবর দিয়ে উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদের যাত্রা। আর সাত দিনের সেই একজিবিশনের চার দিনের মাথায়ই জাহেদ স্ত্রী বিরহে ব্যাকুল হয়ে ঢাকায় ফিরে আসে। দরজার কড়া নাড়ার আগেই দরজা খুলে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘সরুপাড় সালোয়ার-কামিজ পরা’ তার স্ত্রী ছবি- এ বর্ণনা দিয়ে ইতি টানা হয় উপন্যাসের। চার দিনের এ-মাথায় ও-মাথায় এভাবে উপন্যাসের শুরু ও শেষ দেখানো হলেও এরই মধ্যে আটকানো হয়েছে জাহেদের শিল্পী জীবনের প্রায় পুরোটা। ফলে বর্ণনায় মন্তাজ ধারাটি সফল হোক আর না হোক, উপন্যাসের প্রয়োজন মিটিয়েছে তা নিঃসন্দেহে।