দুটি অণুগল্প
প্রুফ্রকের জয়
গত দুই বছর ধরেই এক জ্বালা হয়েছে বড়! দুধ-চা খেতে কোনোকালেই ভালো লাগে না—অম্বল হয় যে—বুক জ্বালা করে। অথচ দুধ-চা খেতে হয় সন্ধ্যাবেলায়। না, খেতেই হবে এমন কোনো মাথার দিব্যি নেই—কিন্তু খেতে হয়। গত দুবছর হলো শুধু টিউশন পড়িয়েই বেশ হাতখরচা বেরিয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হলো পড়াতে গিয়ে দুধ-চা খেতে। এই একটা জায়গাতেই শুধু দুধ-চা খেতে হয়। খুব ভয়ে ভয়েই খাই—এই বুঝি অম্বল করল বলে! কোনো কোনো দিন তো ভয়ের চোটেই অম্বল করে যেত, পেট অব্দি গড়ানো তো দূরে থাক। কিন্তু এভাবে আর কদ্দিন চলবে? কি ই বা বলা যায়? বারণ করে দেব কি! আজকাল বড্ড হেরে যাই আমি। শুধুই হেরে যাই—যেভাবে জিততে গেলে হারতে হয়, যেভাবে বাঁচতে গেলে হারতে হয়, ভালবাসতে গেলে হারতে হয়! আমার সেই আমিটার কী যে হলো যে জেতার হুঙ্কার ছেড়েছিল একদিন!
সময়ের সাথে সবকিছুই মানিয়ে যায় একদিন—এমই মন্ত্রবল বুকে নিয়ে দিব্যি একবছর কাটিয়েছিলাম সেই দুধ-চা খেয়ে। উঁহু! এটা মানাতে পারিনি তবুও। হাজারোবার ভেবেছি আজ ‘না’ বলব—বলেওছি; কখনো শরীর ভালো না তো কখনো পেট। হাজারোবার শুধুই ভেবেছি—আজ ঢুকতেই কথাটা বলব। আজ ‘না’ বলব। টিভির বিজ্ঞাপনগুলো মনে পড়ে যায় একের পর এক—সে নো টু ট্যাবাকো, সে নো টু ক্যানসার, সে নো টু অ্যালকোহল, সে নো টু ড্রাগস, সে নো টু র্যাগিং—শুধু সে নো টু দুধ-চা টাই আর বলা হয়ে ওঠেনি আমার কোনোদিন। কখনো লিভার খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয়ে দু চুমুকেই কাপ রেখেছি—কখনো কালো হয়ে যাওয়ার ভয়ে টেবিলের চা দূরে ঠেলেছি। শুধুই মনে হয়েছে লাল-চা বানাতে বললে ক্ষুণ্ণ হবেন কী! বড্ড বেশি চেয়ে ফেলছি না কী! যদি ছাড়িয়ে দেন? থাক না, কালই বলি বরং—বলবই। এভাবেই বছর গড়িয়েছে আরো এক।
তবে মহাপুরুষেরা সত্যই বলে গেছেন—দুঃখের অবসান একদিন ঘটেই। কাপে ঠান্ডা জল হয়ে যাওয়া চা পড়ে থাকতে দেখে হঠাৎ ছাত্রীর মা বলেই ফেললেন আজ—‘একি! তোমার চা যে ঠান্ডা হয়ে এক্কেবারে জল হয়ে গেল!’ আমি বড় কাঁচুমাচু করে বললাম— ‘আসলে দুধ-চা খুব একটা খাইনা তো। লিকার হলেই ভালো হয়।’
‘আচ্ছা। কাল থেকে তাই দেবো তোমায়—লিকার চা।’
মনের মধ্যে খুশির তরঙ্গ খেলে গেল। এক শান্তি! আর দুধ-চা খেতে হবে না। কোত্থাও না। কখনো না। আহা সে কী খুশি! এক প্রুফ্রকের জয় হলো।
নামহীন শরীরগুলো
রত্নদীপ সাহানি। নামটা মনে পড়ল। নাম ভুলে যাওয়ার এক বড্ড বাজে স্বভাব বরাবরই আমার মধ্যে আছে। খবরের কাগজে চোখ রাখতেই দেখতে পাই জনৈক এক রত্নদীপ সাহানির আঁকা ছবি ছাব্বিশ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছে। খুব ভালো করেই দেখলাম ছবিটা। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না কী আঁকা! এই কি সেই রত্নদীপ? হতেও পারে। অসম্ভব কিছুই নয়। বছর দশেক আগে পরিচয়। তখন মাস্টার্স চলছে। একই মেসে থাকতাম। রত্নদীপ আমার পাশের রুমে থাকত মনে পড়ে। ছবি আঁকার ভীষণ নেশা ছিল। অবসর সময়ে তো সারাক্ষণ বটেই, এমনকি পড়তে পড়তে বিরক্ত লাগলেও সবকিছু গুটিয়েপাটিয়ে ছবি আঁকতে বসে যেত। খুবই চুপচাপ, শান্ত আর চাপা গোছের ছেলে। মাঝে মাঝে আসতো আমার রুমে—গল্প করতাম টুকটাক। দ্বিতীয় বর্ষের শুরু দিকে—জানি না কী হয়েছিল—সে মেস ছেড়ে দেয়। ইউনিভার্সিটিতেও আর দেখতে পেতাম না ওকে। মাস্টার্স শেষ হতেই আমিও বাসা বদলাই। স্টেশনের কাছে একটা নতুন মেসে গিয়ে উঠি। রত্নদীপেরও আর খোঁজ পাইনি। জানি না আর মাস্টার্স কমপ্লিট করেছিল কি না।
প্রায় এক বছর পর—হঠাৎ একদিন সকালে মেসের ছাদে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছি—নিচে তাকিয়ে দেখি রত্নদীপ! নীল শার্ট আর কালো প্যান্ট—ফর্মাল পোশাকে—কাঁধে অফিসের ঝোলা ব্যাগ—রত্নদীপ হেঁটে যাচ্ছে—স্টেশনের দিকে। সাথে হু হু করে ছুটে চলা সারি সারি লোক—সারি সারি মাথা। সকলেরই অফিস পৌঁছানোর তাড়া। সেদিন আর কিছুতেই মনে পড়ছিলনা নামটা। কিছুতেই না। আজও মনে পড়ত না হয়তো, যদি না নামটা চোখের সামনে দেখতাম। আমি জোরে হাঁক দিয়েছিলাম ছাদ থেকে – ‘এএএইই!’ সে মাথা তুলে তাকিয়েছিল আমার দিকে। তারপর—জানি না চিনতে পেরেছিল কি না—আমার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে হাত নাড়িয়ে আবার এগিয়ে চলেছিল স্টেশনের দিকে। তার সাথে এগোতে থাকা সারি সারি নামহীন শরীরগুলোও মাথা তুলে চেয়েছিল সেদিন। তাদেরও হয়তো এটাই নাম— ‘এএএইই’। আজ রবিবার—ছুটির দিনে—রত্নদীপের নামটা চোখে আসতেই বড় মনে পড়ে গেল তার কথা। বাকি দিনগুলোতে আমিও সেই ছুটে চলা সেই নামহীন শরীরগুলোর মতোই এক সুখী সিসিফাস।