গল্প
নেকলেস
লাশটির গলায় নেকলেসটি আটকানো। হুকটা পেছন দিকে। নেকলেসটি নিতে হলে গলার পেছন দিকে হাত ঢোকাতে হবে। হুকটা খুলতে হবে। কাজটা সহজ নয়। অন্তত যুথির পক্ষে।
লাশটি সালমা মেহরাজের। ২০-৩০ মিনিট আগেও সালমা মেহরাজ নামেই তিনি সবার কাছে পরিচিত ছিলেন ছেলে আসাদ, ছেলেবউ যুথি আর একমাত্র নাতনি মারিয়ার কাছে। কবরে দেওয়ার আগ পর্যন্ত এ নামে এখন আর কেউ ডাকবে না। সব রক্তমাংসের মানুষই মারা যাওয়ার সাথে সাথে জন্মের পর থেকে ধারণ করা তার পরিচিতির নামটি গৌণ হয়ে যায়। মৃত ব্যক্তিটি সবার কাছে হয়ে যায় লাশ।
পান্থপথের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের ১১ তলায় আসাদের ফ্ল্যাট। বিল্ডিংটি বেশ বড়। বিশতলা। সব মিলিয়ে আড়াইশ ফ্ল্যাট। মানে আড়াইশ পরিবার। যেন এক বিল্ডিংয়ে একটি মহল্লা।
১১ তলার দক্ষিণ কোণার ফ্ল্যাটটিতে ওরা থাকে। বিজনেস করে আসাদ। মারিয়াকে দেখাশোনা, বিউটি পার্লার আর মহিলা সমিতি করেই সময় কাটে যুথির। আসাদের মা সালমা মেহরাজ ছিলেন যুথির গলার কাটা। ধর্মপ্রাণ মহিলা। যুথির বেপরোয়া চলাফেরা দেখলেই মুখের ওপর কথা বলতেন। আর তাতেই যত আপত্তি যুথির। মায়ের এ আচরণ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বেশ খারাপ সময় যেত। মারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে যুথির সবকিছুই মেনে নিত আসাদ।
সালমা মেহরাজ মারা গেলেন প্রায় আধা ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। রাত সাড়ে ৩টা। আসাদের চোখে নীরব জল। মারিয়া পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে।
রাত ৩টার দিকে মায়ের ঘর থেকে গোঙানির শব্দ পায় আসাদ। কয়েকবার। যুথি আর মারিয়াকে ঘুমে রেখেই ছুটে আসে মায়ের ঘরে। দেখে মা ছটফট করছে। আসাদ মায়ের পাশে গিয়ে বসে। কপালে হাত দেয়। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। জল খেতে চায় মা। আসাদ জল এনে খাইয়ে দেয় মাকে। দু-এক ঢোকের বেশি গিলতে পারে না। আসাদের হাত শক্ত করে ধরে রাখে। যুথিকে ডাকবে কি না ভাবে আসাদ। ডাকতে গিয়েও ডাকে না। নিজে নিজেই মত পাল্টায়। এসে হয়তো বলবে- তোমাদের মা ছেলের জন্য একটু ঠিকমতো ঘুমোতেও পারি না। কতবার বলেছি নূরজাহানকে এ ঘরে মেঝেতে থাকতে দাও। ওনার কিছু প্রয়োজন হলেই সে হেল্প করতে পারবে। কে শোনে কার কথা। এসব বলেই হয়তো যুথি হনহন করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়বে।
ইস্টার্ন হাউজিংয়ের এই বিল্ডিংয়ে কমন কাজের বুয়া নূরজাহান। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সারাক্ষণ গালে পান থাকে। পানকৌটাও থাকে হাতে। আড়াইশ ফ্ল্যাটের প্রায় সবার ঘরেই যাওয়া আসা নূরজাহানের। যখন যে ফ্ল্যাটে ইচ্ছে গিয়ে টুকটাক কাজ করে। গৃহকত্রীর সাথে খোশগল্প করে। খায়-দায়। করিডোরের যেকোনো একদিকে রাত কাটায়।
নূরজাহানের কথা থাক। সালমা মেহরাজের কাছে ফিরে আসি। বেশ ছটফট করছে। সালমা মেহরাজ। আসাদের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে শক্তভাবে ধরে আছে। মায়ের ছটফটানি দেখে আসাদ কর্তব্যবিমূঢ়। একবার ভাবে হাসপাতালে ফোন করি। কিন্তু মাকে ছেড়ে ওঠারও জো নেই।
মা, মাগো ওমা... ডাকে আসাদ। মা তোমার কী খুব কষ্ট হচ্ছে? আমাকে একটু ছাড়। হাসপাতালে ফোন করি। অ্যাম্বুলেন্স আসতে বলি। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে আসাদের। কিছুই করতে পারে না। মা সালমা মেহরাজের কণ্ঠে গোঙানির শব্দ বেড়ে যায়। শক্ত হাতে মাকে চেপে ধরে আসাদ।
বাবার কথা মনে পড়ে। প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন তিনি। বাবা মারা যাওয়ার সময় মায়ের কোলে মাথা রেখে এ রকম ছটফট করেছিলেন। সেই দৃশ্যটা আসাদের স্পষ্ট মনে আছে। তখন ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ছোটবোন দীবা মেট্রিক দিচ্ছে। ভাইবোন দু’জনে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাবা মায়ের কোলে মাথা রেখে ছটফট করতে করতেই চলে গেলেন। বাবা চোখ দু’টো খোলা রেখেই নিথর হয়ে গিয়েছিলেন। মা পাগলের মতো কান্না করতে করতে চোখ মুদে দিলেন।
আসাদ হঠাৎ লক্ষ করল তাকে শক্ত করে ধরে রাখা মা সালমা মেহরাজের মুষ্টিবদ্ধ হাত ধীরে ধীরে ছুটে যাচ্ছে। কোলে রাখা মাথাটা ঢলে পড়ছে একপাশে। বুঝতে বাকি রইল না আসাদের। মা বলে জোরে একটা চিৎকার দিতে গিয়েও আটকে গেল। সালমা মেহরাজের চোখ দুটো সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। ডান হাতে মায়ের চোখ মুদে দিয়ে চেহারার দিকে চেয়ে থাকল আসাদ। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। বুকের ভেতর চলছে অবিরাম ভূমিকম্পের তোলপাড়। পাশের ঘরে যুথি ও মারিয়া ঘুমোচ্ছে। ইস্টার্ন হাউজিংয়ের আড়াইশ ফ্ল্যাটের এই বিল্ডিং এখন নিথর নিস্তব্ধ। লিফট ওঠা নামার সাড়া শব্দও নেই। নাইট গার্ডের হুইসেলের শব্দে নীরবতা ভাঙছে কখনো সখনো। দূরে কোথাও ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠছে কুকুরের দল। গভীর রাতে বিমানের আকাশ পাড়ি দেওয়ার শব্দও কানে বাজে হঠাৎ করে। বিছানায় পা ঝুলিয়ে মায়ের হাত ধরে বসে আছে আসাদ। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। রক্ত সঞ্চালন থেমে গেছে।
ঢাকা শহরের যান্ত্রিকতার কথা পুনরায় বিষিয়ে তোলে আসাদের মন। আড়াইশ ফ্ল্যাটের একটি বিল্ডিং। একই ছাদের নিচে আড়াইশ পরিবার। পাশের দু-একটি পরিবার ছাড়া কারো সাথে কারো যোগাযোগ নেই। যাওয়া-আসা নেই। ভাব-বিনিময় নেই। বাচ্চারা সবাই মিলে যখন নিচে পার্কিংয়ে খেলাধুলা করে তখন তাদের মধ্যে জানাশোনা হয়। কথা হয়। ওই পর্যন্তই। বাচ্চাদের সম্পর্কটা বাবা-মাদের কাছে টানে না। কারণ বাবা-মারা প্রত্যেকে খুব ব্যস্ত। লিফটে দেখতে দেখতে অনেক মুখ চেনা হয়ে যায়। তারপরও কথা হয় না। পয়লা বৈশাখ অথবা অন্য কোনো বিশেষ দিনে বিল্ডিংয়ের ছাদে অথবা পাকিংয়ে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের আয়োজনে অনুষ্ঠান হয়। তখন আড়াইশ ফ্ল্যাটের অনেকেই সেজে গুজে জড়ো হয়। নানান আনুষ্ঠানিকতা আর খাওয়া-দাওয়ায় সময় পেরিয়ে যায়। অনুষ্ঠান শেষে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর যে যার ফ্ল্যাটে চলে যায়। কখনো এমন হয় যে উত্তরের কোনো ফ্ল্যাটে একটা বাচ্চা জন্ম নিল আর একই সময়ে দক্ষিণের কোনো ফ্ল্যাটে প্রৌঢ় একজন পরপারে চলে গেলেন। বাচ্চা জন্মের খবরটা ঠিক সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের কাছে না গেলেও মৃত্যু সংবাদ সবার কাছে যায়। নিচের সিকিউরিটিজের লোকজন ইন্টারকম মাইকে ঘোষণা দিয়ে দেয়। কত নম্বর ফ্ল্যাটে কোন লোক মারা গেছে তার নাম এবং কোথায় শেষকৃত্য হবে তার স্থান, সময় সব।
মাস দুয়েক ধরে কোনো ফ্ল্যাটের মৃত্যু সংবাদ সিকিউরিটিজরা প্রচার করছে না। ফ্ল্যাট মালিকদের একটা মিটিং হয়েছিল। সেখানে অনেকেই মত দিয়েছে রাতে অথবা দিনের শুরুতে মাইকে মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হলে সবার মানসিক এবং দৈনন্দিন প্রস্তুতি থেমে যায়। ওই দিনটিতে মানুষ আর স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। তাই বেশির ভাগ ফ্ল্যাট মালিকের মতে সিদ্ধান্ত হয়েছে মাইকে আর ঘোষণা দেওয়া হবে না। তবে নিচে একটা নোটিশ বোর্ড দেওয়া থাকবে। যেখানে মৃত ব্যক্তির পরিচয়, শেষকৃত্য অনুষ্ঠান সবকিছুই উল্লেখ থাকবে।
আসাদ কর্তব্যবিমূঢ়। দীবা আসাদের একমাত্র বোন। স্বামী-সন্তান নিয়ে ধানমণ্ডিতেই থাকে। দীবাকে ফোন করবে কি না ভাবে আসাদ। না থাক ভোর হোক। তারপর জানাবে।
বিছানা থেকে নেমে ফ্ল্যাটের দরজা খোলে আসাদ। করিডর দিয়ে দেখে এদিক-ওদিক। নূরজাহান নেই। ওর তো করিডরের কর্নারেই থাকার কথা। লিফট বন্ধ। আসাদ সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে নিচের ফ্লোরে নামে। উত্তরপাশের করিডরে শেষপ্রান্তে নূরজাহানকে পেয়ে যায়।
আসাদের পায়ের শব্দেই জেগে ওঠে নূরজাহান। মায়ের কথাটা খুলে বলে নূরজাহানকে। নূরজাহান ও আল্লাহ ও আল্লাহ বলতে বলতে আসাদের পিছু নেয়। চুপ থাক নূরজাহান। চুপ থাক। অস্থির হয়ে ঘরে ঢোকে নূরজাহান। আসাদের সাথে সালমা মেহরাজের বিছানার পাশে দাঁড়ায়।
আপা কই? জানতে চায় নূরজাহান।
ঘুমোচ্ছে।
ডাকেন নাই?
ডেকে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী? ভোর হলেই জানতে পারবে।
বাড়িতে এত বড় একটা ঘটনা ঘইট্যা গেল আর আপা ঘুমাইতাছে। কথাটা বলতে গিয়েও নূরজাহান বলে না। কারণ সে জানে যুথির দুই চোখের বিষ ছিল সালমা মেহরাজ।
ভাইজান? নূরজাহান বলল।
হু।
আপনে অজু কইরা খালাম্মার পাশে দোয়া দরুদ পড়েন। বাসায় আগরবাতি আছে?
মনে হয় নাই।
ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা নিতাছি। আর সালেহা খালারে ডাইক্যা আনতাছি।
সালেহা খালা কে?
চিনলেন না? মাইয়া মানুষ মারা গেলে দোয়া, কালাম গোসলের কাজগুলো যে করে। রাজাবাজার মসজিদের লগেই তো হের বাসা। আমি জলদি কইরা যাই।
আসাদ আর নূরজাহানের কথা শুনে হঠাৎ ঘুম ভাঙে যুথির। চোখ কচঁলাতে কচঁলাতে এসে দাঁড়ায়।
কী হয়েছে? এত রাতে বকবক করছ কেন? অ্যাই নূরজাহান তুমি এখানে কী করছ?
আসাদ ও নূরজাহান দুজনেই চুপ।
কী ব্যাপার চুপ করে আছ কেন?
আসাদ মায়ের পায়ের কাছে বসে ফুফিঁয়ে কাঁদতে থাকে।
যুথি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তার বুঝতে বাকি থাকে না কী ঘটে গেছে। মুখের ভেতর থেকে কোনো শব্দ বের হয় না। নির্বাক তাকিয়ে থাকে সালমা মেহরাজের চেহারার দিকে।
রক্ষণশীল সেকেলে শ্বাশুড়িকে মোটেই পছন্দ ছিল না যুথির। কথায় কথায় বাদ-বিবাদ লেগেই থাকত। যুথির বেপরোয়া চলাফেরা, ছেলে বন্ধুদের সাথে অশালীন মেলামেশা সবকিছু নিয়েই কথা বলত সালমা মেহরাজ। আসাদকেও অনেকবার বুঝিয়েছে, স্ত্রীকে সামলানোর কথা বলেছে। কিন্তু আসাদ জোরগলায় তেমন কিছুই বলতে পারেনি। কারণ যুথির বাবার দাক্ষিণ্যের টাকা দিয়েই ব্যবসা করছে আসাদ।
নূরজাহান বেরিয়ে যেতেই ডাক দেয় যুথি, কোথায় যাচ্ছ?
সালেহা খালারে ডাকতে যাই। হেরাই তো সব কাজ করব।
লাশটা নামিয়ে রেখে যাও। মানুষ মারা গেলে বিছানায় রেখে দিতে নেই। নামিয়ে ফেলতে হয়। চেয়ার টেনে বসে কথাগুলো বলল যুথি।
যুথি সালমা মেহরাজকে লাশ বলাতে বুকের ভেতরটা ছিড়ে খানখান হয়ে যায় আসাদের। ভেজা চোখে একবার যুথির দিকে তাকায়। নূরজাহান থমকে দাঁড়ায়।
মা- মাগো, ও মা... মা। কান্নায় ভেঙে পড়ে আসাদ। নূরজাহান বেরিয়ে যায়।
নূরজাহানের মতো সালেহা বেগমও এই মহল্লায় সবার পরিচিত। বয়স ষাট পেরিয়েছে। বাচ্চা ডেলিভারি এবং মৃত মহিলাদের সৎকারের কাজটি সম্পন্ন করতে তিনি সিদ্ধহস্ত। অনেক বছর ধরেই এই দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সেবামূলক কাজ তিনি করে আসছেন। তাঁর জীবনের গল্পও সবার জানা। নূরজাহানের সাথে বেশ ভাব। কারণ নূরজাহানই সালেহা বেগমকে কাজের সংবাদগুলো দিয়ে থাকে। মানুষ খুশি হয়ে যা দেয় তাই নেয়। কখনো কারো কাছে বেশি কিছু দাবি করে না।
ইদানীং বাচ্চা ডেলিভারির কাজটা কমে গেছে সালেহা বেগমের। বেশির ভাগ ডেলিভারি ক্লিনিক, হাসপাতালে চলে যায়। সিজার হয়। সালেহা বেগম কাজ পেলে নূরজাহানও হাত লাগায়। তারও কিছু আয়-রোজগার হয়।
চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে যুথি। হঠাৎ করেই মনের ভেতরটায় অনুশোচনা ভর করে। প্রায় ১০ বছর হতে চলল সংসারের। এ ১০ বছরে শ্বাশুড়ির সাথে কত কিছুই না ঘটল। আজ সব শেষ। মারিয়ার জন্মের সময় পাশে থেকে নিজের মেয়ের মতোই আগলে রেখেছিল। ঘর-দোর, রান্না-বান্না সবকিছু একা হাতে সামলেছিল। সে রকম আরো কতভাবেই যুথির সংসারটা গুছিয়ে রাখতো শ্বাশুড়ি।
মানুষ চলে গেলেই কী শূন্যতাটা বড় হয়ে ওঠে! এমনি অনেক স্মৃতিই ভিড় জমায় যুথির মনে। আসাদ মায়ের পা ধরে বসে থাকে। থেকে থেকে ডুকরে কেঁদে ওঠে। বুকের ভেতরে তোলপাড় হয়ে বেরিয়ে আসে- মা, মাগো তুমি চলে গেলে কে আমাকে আগলে রাখবে? কে আমার পথ চেয়ে বসে থাকবে, জ্বর হলে কে সারারাত পাশে বসে মাথা টিপবে? কে আমাকে সাহস জোগাবে?
ভোর হয়। সালেহা বেগম ও নূরজাহান সালমা মেহরাজকে উত্তর শিয়র করে মেঝেতে রাখে। ইতিমধ্যে সিকিউরিটিজের লোকজন এসে সব তথ্য নিয়ে যায়। নোটিশ বোর্ডে নোটিশ টাঙায়। আশপাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলারা এসে ভিড় জমায়। হায়, আফসোস আর সমবেদনা জানিয়ে চলে যায়।
বাবার মৃত্যু দিনের কথা পুনরায় মনে পড়ে আসাদের। মৃত্যু সংবাদটি মসজিদের মাইকে ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই পাড়া-প্রতিবেশী শত শত মানুষ এসে ভিড় জমিয়েছিল। আত্মীয়স্বজনরা তো কান্নার রোল ফেলে দিয়েছিল। চেনা-অচেনা কত মানুষ যে কেঁদেছে তার ইয়ত্তা নেই।
আর আজ! তথাকথিত ভদ্র্রতার চাদরে ফ্ল্যাটবাসী মানুষগুলো আবেগ বিবর্জিত যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। একটি দুঃখভারাক্রন্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর সময় কারো নেই। আসাদ, যুথি কারো নেই।
বাচ্চাদের স্কুল, কোচিং, স্বামীদের অফিস। অনেক মহিলা নিজেই চাকরিজীবী। দিনরাত সবকিছুই একটি নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা পড়েছে। এর থেকে বেরুনোর সাধ্য-সাহস ফ্ল্যাটবাসীদের নেই। কারণ মাস শেষ হলেই দীর্ঘ খরচের তালিকা মাথায় নিয়েই তাদের প্রতিটি দিন পার করতে হয়।
স্বামী-সন্তান নিয়ে দীবা এসেছে। আসাদকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল দীবা। ভাই-বোনের কান্নায় আশপাশের আরো কিছু ফ্ল্যাটে জানা হয়ে গেল এই ফ্ল্যাটে কেউ একজন মারা গেছে। আত্মীয়স্বজনরাও দু-একজন করে আসতে লাগল।
ইতিমধ্যে নূরজাহান আগরবাতি এনে জ্বালিয়েছে। দু-একজন লাশের পাশে বসে কোরআন পড়ছে। দোয়া-দরুদ জানামতো পড়ছে।
সালেহা বেগম লাশ ধোয়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। নূরজাহান চুলোয় পানি বসিয়েছে। হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে লাশের পাশে এসে দাঁড়ায় যুথি। সালেহা বেগমকে লক্ষ্য করে বলে, খালা লাশের গলা থেকে নেকলেসটা খুলে নিন।
যুথির কথায় অবাক হয়ে তাকায় আসাদ, দীবা, নূরজাহানসহ উপস্থিত অনেকেই।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে দীবা আসাদকে বলে- ভাইয়া মায়ের নেকলেসটা আমি রাখব। এটা আমার কাছে মায়ের স্মৃতি হয়ে থাকবে। আসাদ যুথির দিকে তাকায়। তাকিয়েই বুঝতে পারে যুথি নেকলেসটা নিতে চাইছে। প্রায় বছর পাঁচেক আগে মায়ের গলায় নেকলেসটা দেখে যুথি বলেছিল- তোমার মায়ের গলার নেকলেসটা এক্কেবারে খাঁটি সোনা। ইদানীং এ রকম নির্ভেজাল সোনা পাওয়াই যায় না। তখন আসাদ বলেছিল- নেকলেসটা ওর দাদিমার। বাবার বিয়ের সময় দাদিমা নিজের গলা থেকে খুলে মাকে দিয়েছিলেন।
দোটানায় পড়ে গেল আসাদ। বোনের শেষ ইচ্ছে মেটাবে নাকি স্ত্রীর চাওয়া। আসাদকে চুপচাপ দেখে যুথি মুখ আটকে রাখতে পারেনি। বলেই বসল- নিয়মানুসারে নেকলেসটা আমারই পাওয়ার কথা। যুথির কথা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। দীবার চোখে জল। দীবা মনে মনে বলল- মাগো মরেও তুমি শান্তি পেলে না?
নীরবতা ভাঙল সালেহা বেগম। নেকলেসটি বিক্রি করে টাকাটা এতিমখানায় দিয়ে দিন। এতিমদের দোয়া মৃত ব্যক্তির আত্মাকে শান্তি দেবে। সালেহা বেগমের এমন কথায় রা করল না কেউ। সালেহা বেগম নিজে সালমা মেহরাজের গলার পেছন থেকে হুক খুলে নেকলেসটি নিয়ে আসাদের হাতে দেয়। আসাদ মায়ের নেকলেসটি নিয়ে চুমো খায় আর কাঁদে। নেপথ্যে সালমা মেহরাজের লাশ, লাশের মুখে হাসি।