গুইন্টার গ্রাসের শেষ সাক্ষাৎকার

ছুঁয়ে যেতে হবে মানুষের হৃদয়

Looks like you've blocked notifications!

ভূমিকা ও তর্জমা : মুহাম্মদ তাসনিম আলম

ভূমিকা

গুইন্টার ভিলহেল্ম গ্রাস ১৯২৭ সালে ১৬ অক্টোবর ভাইমার রিপাবলিকের যে শহরে – ডান্তসিগে (Danzig)— জন্মেছিলেন তা আজকের পোল্যেণ্ডের গ্যেডাইস্ক (Gdańsk) নগরী হিসেবে পরিচিত। এ শহর বেশ পুরনো, আর নানা জনগোষ্ঠির সহবাসে বৈচিত্রময়। আর এখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। তাঁর প্রায় সব লেখায় একট টুকরো কমলালেবুর মতো হাজির থাকে এই বদলে যাওয়া শহরের কোনো না কোনো স্মৃতি।

‘টিনের ঢাক’/ Die Blechtrommel (১৯৫৯),‘ইঁদুর-বেড়াল’ / Katz und Maus (১৯৬১), এবং ‘কুকুরের দিনকাল’/ Hundejahre (১৯৬৩)  এই উপন্যাসত্রয়কে বলা হয়ে থাকে ডান্তসিগ ট্রিলজি। তাঁর অন্যান্য প্রায় সব বই নাম করলেও, তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘টিনের ঢাক’  আমাদের এই ঢাকাতেও প্রায় অনেক দিন থেকে প্রচারিত। যে বছর তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, সেই বছর তথা বিংশ শতাব্দির শেষ বর্ষে প্রকাশিত ‘আমার শতাব্দি’/ Mein Jahrhundert (১৯৯৯), বইটি বাংলায় তর্জমা হয়ে থাকবে।

২০০৬ সালে বের হয় আত্মজীবনীমূলক ট্রিলজির প্রথম খণ্ড , ‘পেঁয়াজ কাহিনী’/ Beim Häuten der Zwiebel, এই বই বের হওয়ার সাথে সাথে বেশ হৈচৈ শুরু হয়, কারণ এই বইয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি স্বীকার করেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি বিমান বাহিনীর (Luftwaffenhelfer ) সহায়ক দলের একজন স্বেচ্চাসেবক মাত্র ছিলেন না, বরং ১৭ বছরের নওজোয়ান হিসেবে নাৎসি বাহিনীর সহায়ক বাহিনী ভাফেন-এসএসের (Waffen-SS ) হয়ে লড়ার সময় আহত হয়ে মার্কিন সেনাদের হাতে ধরা পড়েছিলেন, এবং প্রায় এক বছর (মে, ১৯৪৫- এপ্রিল, ১৯৪৬)   বন্দী অবস্থায় থেকে অবশেষে মুক্তি পান।

অকপট দুর্বিনীত গ্রাসের এই সত্য প্রকাশ করতে দীর্ঘ ৬০ বছর লাগল কেন, তা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে।

জার্মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যে সাহিত্য আন্দোলন দানা বেঁধে উঠিছিল, তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সারথীদের একজন হিসেবে ধরা হয় গ্রাসকে। ‘অতীত মোকাবিলা’  বা ‘ভূত জাড়ানো’ (Vergangenheitsbewältigung) আন্দোলনটি যুদ্ধপরাস্ত জার্মান দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতি, মনস্ত্বাত্তিকসহ বিভিন্ন দিককে আলোকপাত করে থাকে।

দীর্ঘকাল স্যোসাল ডেমোক্রেটিক অব জার্মানের (SPD) সমর্থক ও মারমুখো বামদের সমালোচক এই লেখক জীবনের শেষেরদিকে এসে ‘যে কথা বলতেই হবে’ / Was gesagt werden muss (২০১২)  শিরোনামে একটি কবিতা লিখে বুড়ো বয়সে দুনিয়ার সর্বত্র আবার সাড়া জাগান। জার্মান কর্তৃক গোপনে ইসরাইলকে পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম ডুবোজাহাজ— যার মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তি অর্জনে আগ্রহী মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে আঘাত হানা সম্ভব—পাঠানোকে উপজীব্য করে সরস এক শৈলীতে লেখা এই গদ্য কবিতাটি বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। অনেকের মধ্যে সলিমুল্লাহ খানও এটির বাংলা তর্জমা করেছেন।

বিচিত্রগামী  গ্রাস ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ভাস্কর, গ্রাফিক ডিজাইনার। রাজনৈতিক কর্মী, শান্তিবাদী এই মহান লেখক ‘৮০ দশকে মাস ছয়েক কলকাতায় ছিলেন। বার দু-এক বার তিনি বাংলাদেশেও এসেছেন।

আমাদের দেশের স্বনামধন্য কবি শামসুর রাহমানের (১৯২৯-২০০৬)  সমসাময়িক এই মহান লেখক ২০১৫ সালের এপ্রিলে যখন দেহ রাখেন, তখন তিনি ৮৭ বছরের এক অশীতিপর ব্যক্তিত্ব। জার্মানের লুইবেক শহরে পারিবারিক গোরাস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

সাক্ষাৎকার

(এখনো মঞ্চনাটকের প্রয়োজনীয়তা কোথায়? ডিস্ সাইটের (DIE ZEIT) আমন্ত্রণে পের্সেভালো পরিচালিত ‘টিনের ঢাক’ এবং সাম্প্রতিক কালের নাটকের হালচাল নিয়ে কথা বলার জন্য এই বছরের শুভশুক্রবারে (Karfreitag)মিলিত হয়েছিলেন গুইন্টার গ্রাস ও লুক পের্সেভালো। এটাই গ্রাসের দেওয়া সর্বশেষ সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ক্রিস্টপ জিমেন্স।

২০১৫ সালের শুভশুক্রবার। ক্যাথলিক শিক্ষায় বেড়ে উঠা কিন্তু কোনো এক সময় ধর্মীয় বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা গুইন্টার গ্রাসের কাছে কিন্তু এ দিনটি অন্য আর দশটি দিনের মতো সাধারণ একটি কর্মদিবসের বেশি কিছু নয়। বেলেনডর্ফে তার বাড়িতে আমরা যখন আলাপচারিতা শুরু করি তখন অপরাহ্ন, বেলা ৩টা।

উপলক্ষটা হলো এই, বেলজিয়ামের সূত্রধার লুক পের্সেভালো গ্রাসের ‘টিনের ঢাকে’র  একটি মঞ্চরূপ দেন। মাত্র ৬ দিন আগে হামবুর্গের থালিয়া নাটমন্দিরে শেষ হয় এর মহরত অনুষ্ঠান। নাটক শেষে একেবারে প্রথম সারিতে বসা গ্রাস মঞ্চে এলে ব্যাপক কড়তালি ও হর্ষধ্বনিতে তাঁকে অভিনন্দিত করেন দর্শক।

উপন্যাস আদৌ মঞ্চের আওতায় পড়ে কি না, উপন্যাসকে মঞ্চরূপ দিলে তাতে কী কী ঘটে আর সমসাময়িক মঞ্চনাটকের অবস্থা তিনি কীভাবে মূল্যায়ন করে, ডিস্ সাইটের আমন্ত্রণে তিনি পের্সেভালের সাথে এ সব বিষয়ে আলাপ করতে আগ্রহী হন। দুই ঘণ্টার এই আলোচনায় পাইপ হাতে গ্রাস ছিল যথারীতি আক্রমণাত্মক ও অনমনীয়। এটাই তার সর্বশেষ সাক্ষাৎকার, যা আমাদের কাছে নাট্যকার হিসেবে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী গ্রাসের উইলের সমান।)

ডিস্ সাইট : গ্রাস সাহেব, কয়দিন আগেই তো লুক পের্সেভালের হাতে মঞ্চরূপ পাওয়া আপনার উপন্যাস ‘টিনের ঢাকে’র মহরত দেখলেন। কেমন লাগল আপনার?

গুইন্টার গ্রাস : মানুষের অভিজ্ঞতায় যতটা সম্ভব আমার খুব ভালো লেগেছে। মঞ্চায়নের সময় আমি এ কথা ভুলে গিয়েছিলাম যে, আমিই এই উপন্যাসের লেখক। এটা ছিল সম্পূর্ণ একটা স্বাধীন কাজ, এটাকে মহাকাব্যিক একটা বইয়ের সাথে তুলনা করাটা ভুল হবে।

একটা সীমিত সময়ের মধ্যে আপনাকে সবকিছু করতে হবে, অপরদিকে আপনাকে দিতে পারতে হবে সম্পূর্ণ আলাদা ধরণের উত্তেজনা, এই যে অবস্থা, তো আমি মনে করি মঞ্চনাটক এখনো একটা বাক্সবন্দি (Guckkastenbühne) যুগে পড়ে আছে। বুড়া অস্কারের স্মৃতিচারণা এবং অনেদিন পর পুনরায় ঢাকঢোল পিটানোর ব্যাপারটা আমার ভালোই লেগেছে। অনুরূপভাবে আড়াল থেকে ভেসে আসা তরুণ অস্কারের কণ্ঠস্বরটিও আমার মনে ধরেছে, যেটিকে বুড়া অস্কারের সাথে অল্পবিস্তর বিতর্কমূলক সংলাপসমেত আমি দেখাতে চেয়েছিলাম। ঠিক আছে তো না কি, পের্সেভালো আপনি কী মনে করেন?

লুক পের্সেভালো : এটা তো একটা দিক গেল। আমরা মূলত অতীত দিনের স্মৃতিঘেরা একটা ছবির কথা ভেবেছিলাম। গ্রাস সাহেব, এ ক্ষেত্রে আপনার মতোই বৃদ্ধ আমার মা-বাবা ছিল আমার জানার সরাসরি উদাহরণ।

তারা বেড়ে উঠেছিল আন্তভেয়াপ বন্দরের আশপাশে। এই জায়গাটিকে বলা হয় ছোট বার্লিন, কারণ জার্মান ভি১ ও ভি২ রকেটের আঘাতে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল এই শহর। তারপর থেকে আমার মা ছোট অস্কারের ভালো আচরণ করতে শুরু করে। যতদিন বেঁচে ছিলেন অবিচল এক বিচার-বিবেচনার আলোকে জীবন ও জগতের প্রতি তিনি হয়ে পড়েছিল বীতশ্রদ্ধ, সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। বইয়ের চরিত্রটিও যারপরনাই অবিরাম ভেবে চলছে, এ বিষয়টি আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। এখানটাই বলতে গেলে কোনো সংলাপই নেই। তো একদম চুপ একজন মানুষের মাথায় কী সব ঘটছে, সে সবের হদিস পাওয়াটা ছিল দর্শকদের জন্য একটা বিশাল চ্যালেঞ্জের ব্যাপার।

গ্রাস : আমাদের প্রথম সাক্ষাতের পর আমার মনে হয়েছিল যে, না, চিন্তার কোনো কারণ নেই, আমার বইটা পের্সেভালো সাহেবের মতো একজন যোগ্য লোকের হাতে পড়েছে। কারণ, তাঁর সাথে কথা বলে আমার মনে হয়েছিল যে, উনি ধরে ধরে উপন্যাসের শুধু উত্তেজনাপূর্ণ অংশগুলোর নাট্যরূপ দিতে চান না। উদাহরণ স্বরূপ ঘোড়ার মাথায় বানমাছের দৃশ্যটির কথা ধরা যায়। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর এই দৃশ্যটি খুব হৈ চৈ হয়েছিল, বেশ তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় সেই সময়। এমন কি কিছু লোক তো রীতিমতো বানমাছ খাওটাই বন্ধ করে দিয়েছিল, যদিও তারা জানত যে ঐ ব্যাপারটা মৃতদেহের সাথে সম্পৃক্ত, বানমাছের সাথে নয়। চিত্রনাট্যে এই অস্বস্তিকর অংশটুকু ফেলে দেওয়া হয়েছে, তো বলা যায় চিত্রনাট্যটা হচ্ছে পুরা উপন্যাসেরই একটা সারবান উপস্থাপনা।

সাইট : পার্সেভালো সাহেব, মোটের উপার আপনি এই বইটিই বা কেন বেছে নিলেন? অথচ কোনো এক সময় আপনিই বলেছিলেন যে, বইটি আপনার জন্য এতটা সহজগম্য ছিল না...

পের্সেভালো : পরিকল্পনাটা এসেছিল মূলত আমার দলের পরিচালক ও মঞ্চবিদের কাছ থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তারা কিছু একটা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। এই বইটির উপজীব্য বিষয়বস্তু কিন্তু ধ্রুপদি কোনো নাটকের মতো না। দ্বন্দ্ব না থাকলে তো মঞ্চ ঠিক জমে না। বইয়ে শিশুটি যা যা বলে, আমরা সেগুলোকে না এঁকে (illustrieren) বরং ব্যাখ্যা (interpretieren)করতে চেয়েছিলাম। আর এ ব্যাপারটি সম্ভবত মূল উপন্যাসের বয়ন ও চিত্রনাট্যে মধ্যে একটি স্ববিরোধ তৈরি করে থাকবে। আমাদের চিত্রনাট্যটি কোনো মহাকাব্যিক নাটক নয়, বরং মূল বইয়ের একটি ব্যাপক সারসংক্ষেপ মাত্র। যার মাধ্যমে আমরা বলতে চেয়েছি, এই যে দেখ! দেখ! পাষণ্ডগুলো সেই সব অসহায় বাচ্চাদের উপর কতটা নির্মম ছিল!

সাইট : এই নাটক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লেখকের সাথে যোগাযোগ আপনার জন্য নিয়ামক নাকি প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিয়েছিল?

পের্সেভালো : এটা ছিল আমার জন্য খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। গ্রাস সাহেবের খোলাখুলি ও কৌতূহল আমাকে খুবই নাড়া দিয়েছিল। কেউ একজন আমাকে বলেছিল যে, তাঁর কাছে যা যা গুরুত্বপূর্ণ সবই তিনি তোমাকে খুলে বলবেন, কিন্তু কীভাবে নাট্যরূপ দেওয়া দরকার সে বিষয়ে তিনি আমাকে কিছু বলেননি। এ ব্যাপারে মহড়া শুরুর আগ পর্যন্ত বস্তুত আমার নিজেরও কোনো পরিষ্কার ধারণা ছিল না। নাটক পরিচালনা তো অনেকটা কম্পাসবিহীন জাহাজ চালানোর মতো একটা ব্যাপার। উত্তর কোন দিকে এ ব্যাপারে নাবিকের হয়তো খানিকটা ধারণা থাকে, কিন্তু আসলে উত্তর যে কোন দিকে সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত কিছু জানে না।

গ্রাস : এভাবে কোনো কিছু ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে লেখকের জন্য একটা ঝুঁকি কিন্তু সবসময় থেকে যায়।  কোন দৃশ্যগুলো আমার মতে অবিচ্ছেদ্য, তা কিন্তু আমি বলেছি। কিন্তু এ  ধরনের প্রকল্পে অনেক সময় এমন অনেক বয়ানসূত্র বাদ দেওয়া হয়, যার কারণে মাঝে মাঝে পুরা গল্পটাই একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।

সাইট : আপনার তো আরো আরো গদ্যের চিত্রনাট্য হয়েছে। নাট্যজনদের হাতে পড়ে আপনার রচনার কী দশা হয়, এ ব্যাপারে আপনি কি কখনো শঙ্কিত ছিলেন?

গ্রাস : না। তার কারণ হচ্ছে যে, যখনই কোনো নাট্যকার আমার কোনো গদ্যকে চিত্রনাট্য করার জন্য কোনো সংক্ষিপ্তসার জমা দিত, আমি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করতাম, কীভাবে আমার লেখাকে ব্যবহার করা হয়েছে, যখন দেখতাম যে তিনি আমার লেখাকে খালি এক টুকরা পরশ পাথরের মতো দেখতে চাইছেন, তাইলে কিন্তু আমি সরাসরি না বলে দিতাম। এভাবে আমি মঞ্চায়নের গৌরব থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতাম।

ভিডিও আমাকে খুব উত্ত্যক্ত করে

সাইট :  আপনার সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘তারও আগে’ (Davor) বের হয় ১৯৬৯ সালে। এ বইতে প্রথমবারের মতো আপনি একটা নির্দেশনামূলক বক্তব্যে বলেছিলেন: ‘লেখকের অনুরোধক্রমে সূত্রধররা যাবতীয় ফিল্ম-ক্লিপস, পান্থশালাময় দৃশ্যের সংযোজন এবং অপ্রয়োজনীয় গণদৃশ্যের ব্যবহার থেকে বিরত থাববেন। কারণ এসব এমন কিছু জিনিস দেখানো উচিত বলে মনে করে, যা লেখক দেখানোর পক্ষপাতি নন।’

গ্রাস : পরবর্তী সময়ে আমরা যাকে কি না ‘স্বৈরতান্ত্রিক নাটক’ (Regie-Theater) নামে ডাকতাম, তখন থেকেই কিন্তু তার শুরু। আর আমি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও নির্ঘাত শক্তিমান কোনো মঞ্চপরিচালককে আমার কোনো নাটকের সাথে নাটক মঞ্চস্থ করার বিধি-বিধান সংবলিত কোনো পুস্তিকা পাঠাতে চাইনি। আমি আপন শক্তিতে আপনার ভাষায় কিছু কিছু জিনিস লিখেছি, আর আমি চেয়েছি সে সবের সারবত্তা আত্মস্থ করতে। মোটের ওপর স্বৈরতান্ত্রিক নাটকের বিরুদ্ধে তা সিদ্ধান্তমূলক কোনো কিছু ছিল না, আদৌ আমি নীতিবাগীশ কোনো লোক নই।

তবে হ্যাঁ, যখন কোনো নাটক সংক্ষিপ্ত না করে আর কোনো উপায় থাকেনা অথবা পেশাগত বিভিন্ন প্রশ্ন দেখা দেয়, যে সব বিষয়ে নাটক রচয়িতা আগ থেকে তেমন একটা চিন্তা-ভাবনা করতে পারে না, সে সব বিষয়ে নাটক বিশেষজ্ঞরাই সিদ্ধান্ত দিবেন। এই সতর্কবাণীর উদ্দেশ্য হল এই, যাই হোক না কেন, সবই শ্রদ্ধাপূর্ণভাবে হতে হবে।

সাইট : পের্সেভালো সাহেব, আপানি তো মনে হয় তাঁকে বেশ সম্মান দেখিয়েছেন?

পের্সেভালো : তা নিয়ে আমার সম্ভবত কোনো সমস্যা নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি ভিডিওর এতটা ভক্ত নই। এতে আমার চোখ ব্যথা করে। এই জিনিসটাই এমন করে নকশা করা যে, আপনাকে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে আর হজম করতে হবে যত্তসব ভয়াবহতা। প্রথমবারের মতো আমরা যখন চোখ বন্ধ করে শ্রবণে অভ্যস্ত হয়ে উঠব, কেবল তখনই আমরা নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে মেলে ধরতে পারব।

আমার মঞ্চগুলো অধিকাংশক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ফাঁকা। আপনারা কেবল সেই সব লোকদের দেখেন, যারা কথা বলছে। শিল্পের, মঞ্চের মাধ্যমে আমরা অপরাপর লোকদের সাথে একটা যোগযোগ তৈরি করতে চাই, চাই একটি বারওয়ারি ব্যাপার ঘটাতে। এটা এমন একটা তীব্র উচাটন, যা আমাদের সবার মধ্যে আছে। মনোনিবেশের মধ্যে এটি ফুটে উঠে, যা সাধারণত আমরা পড়ার ক্ষেত্রে করে থাকি। আমি তো মনে করি না তা করার জন্য মানুষের আদৌ কোনো ভিডিওর দরকার  আছে, ভিডিও জিনিসটি আামাকে বিরক্ত করে।

সাইট : উপন্যাস কে মঞ্চরূপ দেওয়ার আবেদনটা কোথায়?

পের্সেভালো : আমি সব সময় ভালো মাল-মশলার সন্ধানে থাকি। দেখুন আমি একজন বেলজীয়ান কিন্তু কাজ করি জার্মানীতে। কিসে মানুষ জার্মানবাসীর হৃদয় জয় করতে পারে, সে কথা ভাবতে আমি বাধ্য। আবেগ ছাড়া মঞ্চ হয় না। মঞ্চের নট-নটীরা আমাকে কেবল তখনই আগ্রহী করে তোলে, যখন দেখি তারা ব্যক্তি মানুষের কোনো কিছু বর্ণনা করছে।

সাইট : কিন্তু এখনো তো হরদম দেখায় যায় যে, মঞ্চ উপন্যাসের চিত্রনাট্যে ঠাসা। মর্মস্পর্শী মাল-মসলা নিয়ে সরাসরি মঞ্চের জন্য এখন আর মনে হয় তেমন একটা কিছু লেখা হয় না।

পের্সেভালো : আমি মনে করি এই পর্যবেক্ষণটি ভুল। মানুষ এখন আর শুধুমাত্র নাটকের কলকব্জা নিয়েই কাজ করে না। আমাদের পূর্বপ্রজন্ম সাহিত্য সাহিত্য করে বড় হয়েছে, কিন্তু আমার প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে চোখে-মুখে চলচ্চিত্র, টেলিভিশনের জৌলুস নিয়ে। আমি তো মনে করি, প্রকৃত প্রস্তাবে ছবি (Fotografie) উদ্ভাবনের পর থেকে মাধ্যমের  (Medien)ক্রমবিকাশের সাথে তাল মিলিয়ে অনেক কিছু করার আছে। ইতিমধ্যে কিন্তু মাধ্যম শিল্পকলাকে খোলনলচে ব্যাপক বদলে দিয়েছে, মঞ্চনাটক আমরা কীভাবে দেখি তাও বদলে দিয়েছে, বদলে দিয়েছে আমাদের বিভিন্ন সংকেতের পাঠোদ্ধার, গুজবে আমরা কীভাবে কান দেই তার পাটাতনও এলোমেলো করে দিয়েছে এই মাধ্যম।

শেক্সপিয়র কিন্তু সদা প্রতিটি অঙ্কের আদিতে এরইমধ্যে যা যা ঘটেছে তার একটা সারমর্ম করেছেন। তার দর্শকরা নিরক্ষর থাকার দরুণ তারা যা দেখে ফেলেছে, শিশুতোষ উপায়ে পুনরায় তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া লাগত।

আজকাল তো আমাদের মগজকে দৈনিক দশ লাখের মতো ছবিকে (Bilder) মোকাবেলা করতে হয়। মোটের উপর আমরা বেশ তরিৎ চিন্তা করি।

গ্রাস : সবই ঠিক আছে। তারপরও আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, শেক্সপিয়রের কাজের প্রতি অনুগত থেকে, তাতে হাইনা ম্যূইলারের কোনো কিছু হরদম না গুঁজে দেওয়ার পরও, তার নাটকগুলো এত ভালো হয় কেন? এ সব ভাষার গুণপনা ছাড়া আর কিছু নয়। জার্মানীর রোমান্টিকদের হাতে শেক্সপিয়র এত সুমিষ্ট হয়ে তর্জমা হয়েছে যে, কোনো কোনো পাড়ভক্ত বলতে শুরু করেছিল যে, বস্তুত তিনি একজন জার্মান!

আপনি যেমনটি বলেছেন যে আপনি এমন সব মাল-মসলা খুঁজে বেড়ান, যা একেবারে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে যাবে, এ ব্যাপারটি লেখকদের বেলায়ও একই রকম সত্য।

জার্মানীর লেলিয়ে দেওয়া ভয়াবহ যুদ্ধে আমি আমার দেশেরবাড়ি ডান্তসিগ (Danzig)হারিয়েছি। তরুণ লেখক হিসেবে এটা বুঝতে আমার খানিকটা সময় লেগেছে যে, আমিই সবচেয়ে বেশি মনযোগি ব্যক্তি যে কিনা স্বীয় ভাষার বিবিধ রতন নিয়ে লিখতে পারে। তবে তা তখনই সম্ভব, যদি আমি সেই সবের জন্য আরাধনা করতে পারি, যা আমি বেমালুম হারিয়েছি। লেখার বুনিয়াদ হিসেবে এই ক্ষতটাই আপনি আমার সমস্ত বইয়ে দেখতে পাবেন। আর এ বিষয়টি তো আপনার দৃশ্যায়নেও সহজে চোখে পড়ে।

কিন্তু আমি মনে করি, শব্দে শব্দে যা বর্ণনা করা হয়, তা কল্পনা করাটা দর্শকদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ, একটা চাপিয়ে দেওয়া ব্যাপার।

পের্সেভালো : সবাই মিলেমিশে শুনছে, মঞ্চের এ দিকটিই আমার সব চেয়ে ভালো লাগে। একটা রুমে হাজার হাজার মানুষ বসে একসাথে কোনো কিছু শুনছে, এ দৃশ্যটি তো আমাদের সময়ে কদাচিৎ চোখে পড়ে। সবাই খুবই অস্থির, উড়োউড়ো। কানে হেডফোন লাগিয়ে রাস্তাধরে একা একা যে যার মতো দৌঁড়াচ্ছে, খেতেখেতে স্মার্টফোনে যোগাযোগ করে নিচ্ছে হয়তো বা কেউ। আমাদের মনযোগের প্রতি আমরা খুব উদাসীন, অথচ মঞ্চ এই মনযোগটাই খুব বেশি দাবি করে। আর এভাবে এ মাধ্যমটা একই সাথে বেশ বিপন্ন ও শক্তিশালী মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

গ্রাস : উপন্যাস, নাটক বা কাব্য যাই বলেন না কেন, এ সবের যদি সারবত্তা কিছু থেকে থাকে এবং সফল হয়, তাইলে পরবর্তী সহস্র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষেণ হজম করা সেগুলোর জন্য কোনো ব্যাপার না।

যতক্ষণ পর্যন্ত পাণ্ডুলিপি আমার হাতে আছে, ঠিক ততক্ষণ পর্যন্তই বইটা আমার আপন। প্রকাশিত হওয়ার পর সেটা যেন পর হয়ে যায়, সে চলে আপনার পথ ধরে। প্রত্যেক পাঠক একই বই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পড়লেও, বইয়ের প্রাণভোমরা নিয়ে কিন্তু বেশি মতোপার্থক্য দেখা দেয় না। অনেক সময় সূত্রধার এমন সব রদবদল করে থাকে, যা নাট্যকারের পরিকল্পনাকেই মাটি দেয়। যদি কোনো সূত্রধার মনে করে যে, কোনো নাটকে তার প্রাণবন্ত কল্পনাকে ফুটানোর মতো যথেষ্ট উপাদান নেই, তার উচিৎ ওটা বাদ দিয়ে অন্য কিছু নিয়ে কাজ করা। প্রথমার (Primäre) উপর দ্বিতীয়ার (Sekundären) জয়-জয়কার দেখতে দেখতে আমি নাটক লেখার ইচ্ছাই হারিয়ে ফেলেছি। একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এটা আমাকে ব্যথিত করেছে।

সাইট : আপনার সর্বশেষ নাটক বের হল তাও প্রায় ৫০ বছর হয়ে গেল। এ সময়ের মধ্যে নাটকতুল্য বাস্তব কোনো ঘটনা আপনার মনে ধরেছে কি না, যাকে আপনি মঞ্চনাটকে রূপান্তরিত করতে চান?

গ্রাস : তেমন কিছু ঘটে নি। অবশ্যই থেকে থেকে নিজে নিজেই  অনমনে বলে উঠি, আহা!  ভিলহেল্ম গুস্টলফের বিনাশ হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে যদি একটি নাটকে রূপান্তরিত করতে পারতাম!

এই ঘটনাকে কোনো এক সময় জীবন্ত করে তোলার জন্য, কোনো একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাসে রূপান্তরিত করার জন্য, বাসি হয়ে যাওয়া বিপুল মাল-মসলা দীর্ঘ সময় নিজের মধ্যে ধারণ করেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলাম কই, এ সব বেশ কঠিন। লুকের মাতা-পিতার মতো আমার বেলাও একই ঘটনা ঘটছে, আদৌ তো আমার মাথায় যুদ্ধ বন্ধ হল না।

সাইট : আপনি যখন ভিয়েতনামের যুদ্ধ নিয়ে ‘তারও আগে’ লিখেছিলে, তখনও কিন্তু ভিয়েতনামের যুদ্ধ শেষ হয় নি। আজকের ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে সমসাময়িক কোনো নাটকের কথা চিন্তা করা যায় কি?

গ্রাস : কোনো সন্দেহ নেই, এটা একটা মহাকাবিক্য আখ্যান। রাশিয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, এই দেশটি সুইডেনের এক উন্মাদ সম্রাট কর্তৃক প্রথমবারের মতো আগ্রাসনের শিকার হয়, তারপর তো আসল নাপোঁলিও, আর সর্বশেষ তো হিটলার এ দেশটাকে দখল করে নেয়ার মতো স্পর্ধা দেখিয়েছে। এ সব কারণে রাশিয়া আজঅব্দি খানিকটা মৃগরোগে (Hysterie) আক্রান্ত। আর এ সব কারণে কোনো ব্যাপারে তার যে রকম প্রতিক্রিয়ার দেখানো কথা, সে সে রকমই দেখায়।

এটাও আমলে নিতে হবে যে, ১৯৮৯ সালে যুদ্ধ বিরোধী চুক্তি ভেঙ্গে যাওয়ার মধ্যদিয়ে পশ্চিমার সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়েছে। অনুরূপভাবে ন্যাটোও ভেঙ্গে দিতে হবে, গড়ে তোলতে হবে নতুন নিরাপত্তাজোট। তা কিন্তু ঘটবে না, কেননা দিন দিন রাশিয়া গুটিয়ে আসছে, এ ক্ষেত্রে রাশিয়া ঠিক কি বেঠিক সেটা সম্পূর্ণ আদালা প্রশ্ন।

আপনাকে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, পুতিনের জায়গায় দাঁড়িয়ে রাশিয়া পাঠ অসম্ভব।

কেউ যদি এই পটভূমিতে কাজ করতে চায়, তার উচিৎ ‘সমর ও শান্তি’র দিকে দৃষ্টিপাত করা, তলস্তয় নাপোঁলিওর সময় থেকে একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়েছিলেন একটি মহাকাব্যের দিকে, এতে সেই সব কাহিনিসূত্রই কেবল আছে, যা তিনি জরুরী মনে করেছেন।

সাইট : পের্সেভালো সাহেব, সমসাময়িক বিষয় নিয়ে নাটক লিখতে আগ্রহী এমন লেখক আজও খুঁজে পাওয়া যায় তো না কি?

পের্সেভালো : আলবৎ। কিন্তু নাটকের তো একটা অর্থনৈতিক বাস্তবতাও আছে। টাকা-পয়সার দিক থেকে সংস্কৃতির রাজনীতি আমাদের একটা বড় ধরনের নির্ভশীলতায় ফেলে দিয়েছে। একজন নবাগত নাট্যকারকে মঞ্চে উঠাতে গেলে, শুরু থেকেই আমার জানা থাকে যে বেশের মধ্যে ২৫০ জন লোক আসতে পারে। মঞ্চ মূলত দর্শকদের টাকায় টিকে থাকে, যাদের বড় অংশটাই আসে মূলত পরিচিতির কারণে। সে পরিচিতি হতে পারে নাটকের শিরোনাম, যা তার কাছে পরিচিত অথবা প্রিয় নট-নটী ইত্যাদি। মঞ্চের জন্য এটা যে ক্ষতিকর তাতে কোনো সন্দেহ নাই। যখন চেকভ মঞ্চস্থ হয়, অধিকাংশ দর্শক মঞ্চে একটা সামোভার দেখতে চায়। অথচ রাশিয়ানদেরও আজকাল এ সবে মন নাই। কিন্তু ব্যবসা এমনই এক চিজ!

প্রত্যেক পটভূমির একজন নিজস্ব শক্তিমান লেখক দরকার

সাইট : আপনি কি মাঝে মধ্যে দর্শকদের হতাশ করেন?

পের্সেভালো : নাটকের সেই সব উপাদানই আমাকে আনন্দ দেয়, যা বড় স্বার্থ হাসিলের জন্য মানুষ ও তার আচার-ব্যবহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। দেড় বছর ধরে আমরা দস্তয়ভস্কির কারমাসভ ভইয়েরা মঞ্চস্থ করে আসছি, ব্যাপারটি কিন্তু এত সহজ না।

দর্শকদের একটা বিরাট অংশ টেলিভিশন ও ইন্টানেটের মতো দ্রুতগতিশীল  মাধ্যমগুলোর বিপরীতে মঞ্চকে মৌলিকভাবে মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়, যা উচিৎ নয়।

সাইট : গ্রাস সাহেব, আপনি কি এখনো নিয়মিত নাটক দেখতে যান?

গ্রাস : না। পঞ্চাশের দশকের বার্লিন, তখনও দেওয়াল ওঠেনি, তা ছিল এক উত্তাল সময়। ককেশাসের ছকবৃত্তান্ত  (Kaukasischen Kreidekreis) আর কলিজা  (Courage) দেখেছিলাম বার্লিন নাট্যশালায়। শ্লসপার্ক থিয়েটারে গডোর আশায়’র  অন্যতম প্রথম মঞ্চায়ন দেখাটা তো একটা বিশেষ ঘটনা। ডেটমুল্ট নাট্যশালায় সর্বশেষ দেখলাম হেয়াত্সগ থেয়োড়র ফন গতলান্ট, গ্রাবের প্রায় ভুলতে বসা এই নাটকটির মঞ্চায়ণ ছিল চমৎকার।

একটা মজার ধারণার কথা বলি : ধরুন, ধারাভাষ্যকার হিসেবে উপস্থিত আছেন বুড়া গ্রাবে। আর ভুলক্রমে লোকজনকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে হাইনা ম্যুইলারের রচনা! আমার বক্তব্য হচ্ছে যে, গ্রাবে জার্মানীর আন্যতম সেরা বাগ্মীদের একজন। কিন্তু মানুষ তা তেমন একটা স্বীকার করতে চায় না। মানুষ যদি ভাবে যে, তারা বানিয়ে বানিয়ে ধারাভাষ্য দিতে পারঙ্গম এই লোকের মুখে কুলুপ এঁটে দিবেই দিবে, তা অসম্ভব, কারণ গ্রাবের তূণে যথেষ্ট পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি বাক্যবাণ আছে। এ সব কথা হাইনা ম্যুইলার বিরোধিতা করার জন্য নয়। সত্যি বলতে কি, ম্যুইলার কথার পিঠে কথা বলতে তেমন একট পারঙ্গম ছিলেন না।

সাইট : আচ্ছা, তারপরও কেন ম্যুইলা থিয়েটারে অবিসংবাদিতভাবে এত বেশি জনপ্রিয়?

পের্সেভালো : এটা আমি বলতে পারব না। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, সঙ্গত কারণে তাঁকে আমি কখনো ব্যবহার করি নি। এটা বোধ হয় সমালোচকদের জন্য রেখে দেওয়াটাই ভালো। তবে আমার মনে হয়, এটা কতকটা স্বর্ণখণ্ডের মতো একটা ব্যাপার, যা আভা ও প্রভা দুইই ছড়াতে সক্ষম। আর একমাত্র সমালোচকরাই সম্ভবত এমন কথা লিখতে পারেন যে, তাঁরা একটুকরা ম্যুইলা আবিষ্কার করেছেন।

তবে নাট্যকার আর সূত্রধারের মধ্যকার উত্তেজনা নিয়ে আমার কিছু বলার আছে। আমার তো মনে হয় থিয়েটারে উত্তেজনা জিনিসটি একটা স্বভাবজাত ব্যাপার।

আমাদের এ কথা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, স্বয়ং শেক্সপিয়রও রূপকথা, কিংবদন্তী এবং প্রাচীন খনি থেকে দু’হাতে চুরি ও নকল (geklaut und abgeschrieben) করেছেন।

 এমন কি মোলিঁয়েখ্ও (Molière)  তাঁর নিজের নাটক মঞ্চায়নের সময় কেউ যাতে তার নাটক নকল করতে না পারে তা নজরদারি করার জন্য একজন বিশেষ লোক পাঠাতেন। যে ধরা পড়ত, তার কপালে জুড়ত গণধোলাই। থিয়েটার সবসময় একটা বিজয় সাপেক্ষ শিল্প। এটা সম্ভবপর যাবতীয় উপাদানকে আত্মস্থ করে, আর ওটাই হয়ে দাঁড়ায় তার এক টুকরা প্রাণ।

গ্রাস : এই জায়গায় আমাকে ভিন্ন মতো পোষণ করতে হচ্ছে। প্রথমতো আমরা উভয়ে শেক্সপিয়র সম্পর্কে খুবই কম জানি। আর যখনই  তিনি লিভিয়ুস ও প্যেলাতেরসকে নকল করতে গেছেন, সেখানে তাঁর ভাষা হয়েছে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তো আমি মনে করি, প্রত্যেক পটভূমির একজন শক্তিমান নিজস্ব লেখক দরকার।

পের্সেভালো : হ্যাঁ, সে কারণেই তো প্রতিনিয়ত শেক্সপিয়রের নিত্য নতুন অনুবাদ দরকার হচ্ছে, কারণ ভাষা তো বিকাশমান।  সৌভাগ্যক্রমে তাকে আক্ষরিকভাবে তর্জমা করা যায় না। তাই শেক্সপিয়রের পদ্য কি বিষয়বস্তু অনুবাদ করার ক্ষেত্রে যে কোনো কবির একই সাথে স্বাধীনতা এবং চ্যালেঞ্জ দুটোই আছে বৈ কি। 

সূত্রধার ফ্রাঙ্ক কাস্টরফ সম্প্রতি ব্রেশটের বাআল (Baal) নকল করেছেন, এ ঘটনা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? ব্রেশট নিজে এ নাটকের পাঁটটি সংস্করণ লিখেছিলেন, কিন্তু কোনোটি নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

অথচ কত বিচিত্র সব ক্ষেত্র পড়ে আছে, সূত্রধাররা কি সে সব থেকে তার নিজস্ব কাজটি বেছে নিতে পারে না?

গ্রাস : তার তথা ফ্রাঙ্ক কাস্টরফের উচিত এই তেনা, ওই তেনা কুঁড়ানো, আর একটি নতুন চিত্রনাট্য লেখা। ব্রেশটের সাথে তাল মিলানোর মতো তার যদি শক্তি ও যথেষ্ট পরিমাণ শব্দভাণ্ডা থাকে, তাইলে তো সে তা করতেই পারে। 

সাইট : একটি সফল নাট্যসন্ধ্যা থেকে আপনি কি আশা করেন? লেসিংয়ের মতো সদা ভয় ও অনুতাপ আপনাকে ঘিরে থাকে কি না?

গ্রাস : আমার পাশে কে বসল না বসল তা আমি দু-তিন ঘণ্টার জন্য ভুলে যাই। মঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যথাযথ সংলাপ, অপ্রয়োজনে উচ্চস্বরে ফেটে না পড়া, বোধগম্যভাষায় কথা বলার মতো ছোটখাট ব্যাপারগুলোর মধ্য দিয়ে মঞ্চ যে এক ধরনের নতুন বাস্তবতা ছুঁড়ে দেয় তা আমাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলে।

সংলাপগুলো এমন এক ঢঙে জীবন্ত করে তোলা হয় যে, তা মঞ্চ বহির্ভূত শ্রোতাদের পারফরম্যান্সকে (চেচামেচি) ছাড়িয়ে একটা মৃদু গুঞ্জরণ বয়ে দিয়ে সক্ষম হয়। তবে সবসময় তা কিন্তু সম্ভব হয় না। জার্মানির মঞ্চগুলো খুব বেশি চেচামেচিতে ভরা।

পের্সেভালো : আজকাল অভিয়ন স্কুলগুলো বিষয়বস্তুর সত্যতা নিয়ে যে মহাব্যস্ত পড়েছে, তা নিয়ে তো অনেক কিছুই করা যায়। কারণ প্রতিনিয়ত প্রচুর লোকজনকে ফিল্ম ও টেলিভিশনের জন্য প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারটির (তথা বিষয়বস্তুর সত্যতার) প্রতি আমার তেমন একটা আস্থা নেই, অন্ততপক্ষে মঞ্চের ব্যাপারে নয়। কারণ কৃত্রিমতা ছড়া মঞ্চ অচল, যা প্রকৃত প্রস্তাবে এক ধরনের মিথ্যাই। কথা কীভাবে বলতে হয় তা এক ধরনে মেধার ব্যাপার হওয়ায় আমি মনে করি, মানুষ তা কদাচিৎ শিখতে পারে।

তবে থিয়েটারে শুধু মানুষ কতটা উচ্চগ্রামে এবং টেকনিক্যালি যথার্থতার সাথে কথা বলল তা কিন্তু নয়, বরং দক্ষতার সাথে সংবেদনশীলতা ও সম্ভোগবেদনাকে কতটা যুক্ত করতে পারল তাও নিয়েও তো অনেক কিছু করার এখনো বাকি।

সাইট : ধ্রুপদী কোনো নাটকের কোনো বিখ্যাত উক্তি কথার ফাঁকে ফাঁকে আওড়ানোটা বেশ কিছু দিনকাল যাবৎ একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্ততপক্ষে আমার সমসাময়িকদের বেলায় এটা সত্যি। বুজরুকি আর কাকে বলে! অথচ এই সমস্ত প্রবাদ এখনো সচল এবং এদের নিজস্ব অর্থ আছে, যেমন: ‘হবে, না কি না’(Sein oder Nichtsein)

পের্সেভালো : মার্লোন ব্রাণ্ডো ও জেমস ডিনের কাছে আমাদের অনেক দায় আছে, এরা আপনার সমসাময়িক তো নাকি! সেই সব আমেরিকান সিনেমা, যেগুলোতে ব্রাণ্ডো খালি বিড়বিড় করে গেছেন, তা আজকের মঞ্চকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছে।

আমার অভিনয়ের শিক্ষক আমাকে একদম সাবলিল ও শান্তভাবে অভিনয় করার ব্যাপারে বেশ সাহস যুগিয়েছেন।

সাইট : সময়ের ঘড়ি কোনো এক সময় হয়তো আবার বেজে উঠবে, হয়তো আবার অবকাশ হবে আমাদের আরো কথা বলার, গ্রাস সাহেব আপনার কী মনে হয়?

গ্রাস : এক্সপ্রেশেনিজমের থিয়েটারের ভাষা নিয়ে আবার কথা বলাটা নিশ্চয় উচিত হবে না! আপনি যেমনটি শুরুতে বলছিলেন যে, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো লেখার কথা, আমি চাই সে রকমট অপূর্ব, উদ্দীপনাপূর্ণ কোনো কিছু নিয়ে কথা বলতে।