আদিবাসী সংগ্রাম
তুলা করের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে চাকমা, কুকি প্রভৃতি আদিবাসীদের বাস। এই পার্বত্য অধিবাসীরা প্রকৃতির সাথে নিরবচ্ছিন্নভাবে কঠোর সংগ্রাম করে জীবন যাপন করে আসছিল। যা তাদের দুর্ধর্ষ করে তোলে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলটিতে প্রথমে বসবাস ছিল কুকিদের। এক সময় চাকমারা কুকিদের আরো উত্তর-পূর্ব দিকে সরিয়ে দিয়ে আরাকান দখলে নেয়। কিন্তু ব্রহ্মযুদ্ধের সময় (১৮২৪-৫২) মগেরা এসে চাকমাদেরই বিতাড়িত করে চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ অংশ দখল করে। তখন তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
চাকমারা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ঝুম চাষ করত। এ আদি নিয়মে প্রতিবছর এপ্রিল মাসে গ্রামের সব লোক কোনো একটি সুবিধাজনক স্থানে বসতি স্থাপন করে। অতঃপর প্রত্যেক পরিবারের সব লোক জঙ্গল কেটে চাষের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ জমি আবাদ করত। ফসল পাকলে তা বন্যপ্রাণীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য তারা ঝুম বা দলবেঁধে সারা রাত জমি পাহারা দিত। দুই বৎসর চাষের ফলেই জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায়। এভাবে যখন গ্রামের চারপাশের সব উর্বর জমি চাষ করা শেষ হয়ে যেত তখন তারা অন্যত্র গিয়ে বসতি স্থাপন করত। এই আদি প্রথায় চাষের ফলে কোনো জমির ওপরই ঝুমিয়াদের স্থায়ী স্বত্ব তৈরি হতো না। ফলে ওই সব জমির রাজস্ব নির্ধারণেরও কোনো উপায় ছিল না।
এভাবে ঝুমের মাধ্যমে দুর্গম পাহাড়ে অনুর্বর পার্বত্য জমিতে চাকমারা কার্পাস বা তুলা চাষ করত। অতঃপর সে তুলা সমতলে নিয়ে এসে তার বিনিময়ে সংগ্রহ করত প্রয়োজনীয় চাল, লবণ ও অন্যান্য জিনিস। এ ছাড়া ওই সময়ে উৎপাদিত শস্যের একটি সামান্য অংশ তারা মোঘল সম্রাটকে কর হিসেবে প্রদান করত। এভাবে মুগল আমলেও চাকমারা প্রায় স্বাধীনভাবেই বসবাস করছিল।
কিন্তু এই অঞ্চলটি ইংরেজ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাকমাদের স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের পুরাতন ব্যবস্থা ধ্বংস হতে থাকে। এক সময় অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদের মতোই তাদের ওপরও ইংরেজদের শোষণ আর অত্যাচার নেমে আসে।
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের কথা। এক চুক্তি দ্বারা ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মীরকাসেমের কাছে বাংলা-বিহার উড়িষ্যার নবাবী দান করে এবং প্রতিদান হিসেবে বর্ধমান, চট্টগ্রাম ও মেদিনীপুর অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে। এর ফলে চাকমাদের পার্বত্য অঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যটিও ইংরেজ বণিকদের হাতে চলে যায়।
বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জির লেখা তথ্যমতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ব্রিটিশদের অধিকারে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এই পার্বত্য অঞ্চলের কোনো অংশেই তারা শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেনি। বরং সে সময় ব্রিটিশরা মাত্র দুজন পাহাড়িয়া দলপতির সন্ধান পেয়েছিল। এদের একজন ফ্রু নামক আদিম জাতির নায়ক আর অপরজন চাকমা জাতির নায়ক।
এই দলপতিরা প্রথমে ব্রিটিশ শাসকদের কার্পাস বা তুলা কর হিসেবে দিত। কিন্তু তার পরিমাণ নির্দিষ্ট ছিল না। একেক বৎসরে করের পরিমাণ একেক রূপ থাকত। ফলে ইংরেজরা অধিক কর আদায়ের উপায় হিসেবে ওই সময় ফড়িয়া নামক এক শ্রেণির আর্বিভাব ঘটায়।
ফড়িয়ারা ইংরেজদের কাছ থেকে ওই অঞ্চলের কার্পাস বা তুলা-কর আদায়ের ইজারা নেয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলা কর হিসেবে আদায়ের কথা থাকলেও ফড়িয়ারা নানা ছল চাতুরির মাধ্যমে নির্ধারিত পরিমাণ থেকে কয়েকগুণ বেশি তুলা চাকমাদের কাছ থেকে আদায় করে। অতঃপর কর হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ইংরেজ শাসকদের হাতে তুলে দিয়ে বাকিটা নিজেরা আত্মসাৎ করতে থাকে। ওই তুলা বাজারে বিক্রি করেও তারা প্রচুর মুনাফা লাভ করত। ফড়িয়াদের এই কাজে ইংরেজদেরও সম্মতি ছিল।
আবার ইংরেজ শাসকগণ রাজস্ব হিসেবে যে তুলা পেত তা বিক্রি করে মুদ্রায় পরিণত করত। এর জন্য তারা চুক্তি করত অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে। চুক্তিতে মুদ্রার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা থাকত। ফলে ওই দ্বিতীয় ব্যক্তি ইংরেজ শাসকদের কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ মুদ্রা জমা দিয়ে তুলা হতে ফটকাবাজির মাধ্যমে প্রচুর মুনাফা হাতিয়ে নিতে থাকে।
এ ব্যবস্থার ফলে চাকমাদের কর হিসেবে তুলা প্রদানের পর যে তুলা তাদের কাছে অবশিষ্ট থাকত তা তারা বাজারে ফটকাবাজদের নিকট নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হতো। এতে ধীরে ধীরে চাকমাদের উৎপাদিত তুলা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা প্রায় সম্ভব হয়ে ওঠে।
এ ছাড়া বিনিময় প্রথায় সহজ সরল চাকমা আদিবাসীরা সমান ওজনের দ্রব্যের বিনিময়ে সমাজ ওজনের দ্রব্য গ্রহণ করত। এটা ছিল তাদের আদি রেওয়াজ। কিন্তু এ সুযোগটি নেয় তুলা ব্যবসায়ী, ফটকাবাজ ও ইজারাদাররা। তারা চাকমাদের আট টাকা মূল্যের এক মণ তুলার বিনিময়ে দুই টাকা মূল্যের এক মণ লবণ প্রদান করে। ফলে একটি বা দুটি জিনিস নিলেই চাকমাদের সব তুলা শেষ হয়ে যেত। ফলে পরিবারে নেমে আসে অভাব। এভাবে নানা শোষণ ও নিপীড়নে তাদের জীবন কাটে অনাহার ও অর্ধাহারে। এক সময় বেঁচে থাকার তাগিদেই নতুন জীবনের স্বপ্নে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে চাকমা আদিবাসীরা।
প্রথম চাকমা বিদ্রোহের তথ্য পাওয়া যায় চট্টগ্রামের তৎকালীন কালেক্টর কর্তৃক গর্ভনর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস্কে লেখা একটি সরকারি পত্র থেকে। পত্রটি ইংরেজ শাসকদের অনুগত কালেক্টরদের নিজের মতো করে লেখা হলেও সেটিতে বিদ্রোহের বিষয়টি স্পষ্ট। কালেক্টর সেখানে লিখেছেন-রামু খাঁ নামক এক পাহাড়িয়া তুলা চাষের জন্য কোম্পানিকে সামান্য রাজস্ব দেয়। আমার ওই স্থানে আসার পর থেকে, ইজারাদারগণের দুর্ব্যবহারের জন্যই হোক, অথবা তার বিদ্রোহী চরিত্রের জন্যই হোক , রামু খাঁ কয়েক মাস কোম্পানির ইজারাদারদের সাথে ভীষণ দাঙ্গাহাঙ্গামা চালাচ্ছে। রামু খাঁকে বন্দি করার জন্য বিশেষ চেষ্টা চলছে, কিন্তু কালেক্টরের এই চেষ্টা সফল হয় নাই। পরবর্তীকালে ওই অঞ্চলের শাসনকর্তা রূপে দায়িত্বপালন করেন আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জি, ক্যাপ্টেন টি এইচ, লুইন ও এইচ এস হাচিন্সন প্রভৃতি উচ্চপদস্থ ইংরেজগণ। চাকমাদের বিদ্রোহ সম্পর্কে তারা বহু তথ্য উদঘাটন করেন। তার মধ্যে ক্যাপ্টেন লুইন-এর বিবরণটিতে বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে প্রকৃত সত্য তুলে ধরা হয়েছে বলে মনে করে চাকমারা।
লুইন তাঁর ‘দা হিলট্রেকস অব চিটাগাং’ গ্রন্থে লিখেছেন— ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগে চাকমারা প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন চাকমা দলপতি রাজা সের দৌলত ও তার সেনাপতি রামু খাঁ। তারা উভয়েই পরস্পরের আত্মীয় ছিলেন। রামু খাঁ ছিলেন সবার কাছে সেনাপতি হিসেবে অধিক পরিচিতি। চাকমাদের ওপর ছিল তার অসাধারণ প্রভাব-প্রতিপত্তি।
ইংরেজ শাসকদের দ্বারা নিযুক্ত ইজারাদারগণের শোষণ-উৎপীড়ন সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে রামু ও শের দৌলত চাকমা জাতির সব লোকদের ঐক্যবদ্ধ করে। অতঃপর ইজারাদারি ও ইংরেজ শাসনের সব অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হয়।
প্রথমে তারা তুলা-কর দেওয়া বন্ধ করে এবং ইজারাদারদের তুলার গোলা লুট করে। রামু খাঁর নেতৃত্বে এ সময় চাকমারা ইজারাদারদের বড় বড় তুলার ঘাঁটিগুলো আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। রাঙ্গুনিয়াসহ বিভিন্ন স্থানের বড় বড় গোলা লুট করে সব তুলা নিয়ে যায় তারা। ফলে ইংরেজদের অনুগত ইজারাদারদের বহু কর্মচারী এ সময় চাকমাদের হাতে মারা পড়ে।
(চলবে)