স্মরণ

শহীদুল জহিরের গল্প

Looks like you've blocked notifications!

নন্দিত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ থেকে শুরু করে আরো যাঁরা লিখছেন বাংলার সাহিত্যভুবনের পরিচিত মুখ হিসেবে, তাঁদের কথা না হয় বাদ থাক। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তরকালের বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পকার হিসেবে যাঁদের নাম অনেক গুরুত্বসহকারে উচ্চারণ করা হয়, সেখানেও প্রথম দিকে পাওয়া যায়নি শহীদুল জহিরের নাম। হাল-আমলের ছোটগল্পকার হিসেবে শাহাদুজ্জামানের নাম যতটা পরিচিত, একটা সময়ে তিনি অতটা পরিচিতিও পাননি; বরং তখনকার ছোটগল্পকার হিসেবে বুলবুল চৌধুরী, আতা সরকার, আহমদ বশীর, মঞ্জু সরকার, সৈয়দ ইকবাল, হরিপদ দত্ত কিংবা মামুন হুসাইনের নাম উচ্চারিত হতে দেখা গেছে অনেক গুরুত্বের সঙ্গে। সেদিক থেকে শহীদুল জহিরের উত্থান অনেক পরের কথা। 

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ছোটগল্প পড়তে গেলে ঘুরেফিরে সেই চর্বিত-চর্বণই চোখে পড়ে বেশি। বিশেষ করে যুদ্ধোত্তর দেশের নানা সম্ভাবনা, যুদ্ধের ভয়াবহতা, শ্রেণিসংঘাত আর অভিশপ্ত জীবনের অপাঙক্তেয় আলেখ্য বেশি দৃশ্যমান এ দৃশ্যপটে। আর সেখানে একেবারে নতুন করে নিজস্ব ভাষাবিন্যাস, গল্প বলার ধাঁচ থেকে শুরু করে অন্য রকম এক ভাবালেখ্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন শহীদুল জহির। তাঁর নামে হক বদলে হঠাৎ জহির হয়ে যাওয়ার গল্পটা যেমন বিচিত্র, তেমনি পাঠকমহলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার ব্যাপারটাও বেশ চিত্তাকর্ষক বটে। তিনি মার্কেজের জাদুবাস্তবতায় কতটুকু বিশ্বাস করতেন, তাঁর গল্প পড়ে তা বুঝতে পারিনি, অস্কার ওয়াইল্ডের লেখা তাঁকে কতটা প্রভাবিত করেছে কিংবা তিনি নিজেকে নিজের মতো করে কতটুকু চিনেছেন, সেটা বলাও কঠিন। তবে পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, হতাশা-অবক্ষয় কিংবা অহেতুক নৈরাজ্যবাদিতার ফ্রেম ভেঙে নতুন করে শৈল্পিক পাটাতন তৈরির কৃতিত্বটা তিনি অবশ্যই পাবেন। 

জীবনযাপনের নানা গল্প-কল্পকথার আয়নায় যেভাবে বিম্বিত হয় তাঁর গল্পের রূপায়ণটা একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। বাংলা ছোটগল্পের ঠেলাগাড়িটি রবীন্দ্র-উত্তরকালে যেমন নিশ্চল, ম্রিয়মাণ ও বিমূঢ়, সেখানে শহীদুল জহিরের চিন্তা অবশ্যই আমাদের নতুন ভাবনার খোরাক দিয়েছে। আমাদের ভাবনার আকাশ থেকে চৈত্ররুক্ষ তিমির দূর করতে তাঁকে এক রকম পুরোধা বলাটা বোধকরি ভুল হবে না। আমাদের লেখকদের নতুন কিছু একটা করে দেখানোর ক্ষেত্রে যে আতঙ্ক ও ক্লীব অবিশ্বাস ভর করে, শহীদুল জহির তার থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন, তা বলা যায়। তাই তো প্রথম কয়েকটি উপন্যাস দুই-তিন কপি বিক্রি হওয়ার পর সেগুলোকে স্টোররুমের নোংরা-আবর্জনার মধ্যে ফেলে দিয়ে নতুন করে কলম হাতে তুলে নেওয়ার সাহস তিনি দেখিয়েছেন। আর তিনি নিজ ভাবধারা থেকে সরে আসতে চাননি কখনোই। উপন্যাসের নাম যেমন আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু; লেখকের মৃত্যুও হয়েছে বড্ড অসময়ে, তবে অমর হয়েছে তাঁর সৃষ্টিশীলতা। আর বড় পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, লেখক শহীদুল জহিরকে মানুষ চিনেছে তাঁর মৃত্যুর পরেই।

ছোটগল্পকার শহীদুল জহিরকে চিনে নিতে গেলে সব গল্প পড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে শুরু থেকে সেই গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’ (১৯৮৫), ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৯৯), ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ (২০০৪)—এগুলোর পাশাপাশি আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু বইগুলোর পাতায় চোখ বুলালেই হবে। এদিকে ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’, ‘যে রাতে পূর্ণিমা ছিল’, ‘মুখের দিকে দেখি’ নামেও উপন্যাসগুলো চিনিয়েছে তাঁর জীবদর্শন ও ব্যক্তিসত্তা। এ ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠভাবে ফুটে উঠেছে বাস্তব-পরাবাস্তবের মাঝখানে থেকে যাওয়া অনিশ্চিত একটা শূন্যস্থান। তিনি আসলে কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করতেন। তাই তিনি পেরেছেন প্রতিটি চরিত্রকে একই সঙ্গে অন্তরঙ্গ ও দ্বান্দ্বিক অভিধায় চিত্রিত করতে। তিনি বিমূর্ত যে ভাষায় চিন্তার গভীর দ্যোতনা ও ভাবার্থের মেলবন্ধন ঘটানোর সাহস দেখিয়েছেন, তা বোধকরি আর কেউ দেখাতে দেখাতে পারেনি। বিশেষ করে শহীদুল জহির চেষ্টা করেছেন চেনা গণ্ডির মধ্য থেকে অচেনা এক জগৎকে চিনিয়ে দিতে। আর সেখানে তিনি শতভাগ সফল বলেই এত আলোচনা তাঁর লেখাজোকা নিয়ে। তাঁর গল্পে কোনো কাহিনীর সুনির্দিষ্টতা নেই, অহেতুক কোনো মেদও নেই সেখানে। তাই পাঠককে তাদের বোধের মধ্যে আটকে রেখে অন্য রকম পথ দেখিয়েছেন তিনি। তাঁর লেখালেখির সঙ্গে যেহেতু অন্য কাউকে মেলানোর সুযোগ নেই, তাই শহীদুল জহিরের গল্প অন্য কারো নয়, নিজেরই প্রতিদ্বন্দ্বী।

নন্দিত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন পুরান ঢাকার জনজীবনের সবকিছু নিয়েই বেশি লিখেছেন, তেমনি শহীদুল জহিরের অধিকাংশ গল্পে ওই এক ভূতের গলি ঘুরেফিরে এসেছে পৌনপুনিকতায়। পুরান ঢাকার মানুষের চালচিত্র আর আচার-আচরণ থেকে শুরু করে উৎসব আয়োজনও তাঁর গল্পে ঠাঁই পেয়েছে গুরুত্ব নিয়ে। এটুকু সমালোচনার দৃষ্টি থেকে বললে শহীদুল জহির তাঁর চেনা জগতের বাইরে খুব একটা বিচরণ করতে চাননি। তবে এখানেই তাঁর লেখালেখির সাফল্য কম কিসে। কমলকুমার মজুমদারের কাঠখোট্টা বাংলা শব্দের অনেক কিছু তাঁর লেখায় কখনো কখনো ফুটে উঠলেও শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে তিনি শহীদুল জহিরই, তিনি উজ্জ্বল আপন আলোয় আর বাকিটুকু পার্শ্বপাত মাত্র। কেউ কেউ বলেন, মার্কেজের জাদুবাস্তবতাও তাঁকে টেনেছে বেশ, প্রভাবিত হয়েছেন ভাববাদিতায়ও। তবে এটুকু যেকোনো পাঠকই বলতে চাইবেন যে শহীদুল জহিরের হাত ধরেই একুশ শতকের বাংলাদেশি বাংলা গল্প পেয়েছে তার নতুন যৌবন, একটি অন্য রকম প্রশ্নবোধক অবয়ব আর ভাববস্তুর প্রকরণগত সর্বজনীনতা। তাঁর জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সব ধরনের সাহিত্যালেখ্য আর অর্জনকে।

লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।