চতুষ্কের কবি
মমতাজুর রহমান তরফদার (১৯২৮-১৯৯৭) বগুড়া জেলার মেঘগাছা গ্রামে ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ব্রিটেনের নুফিল্ড ফাউন্ডেশন (১৯৭২-১৯৭৪), আমেরিকার ডারহামস্থ ডিউক ইউনিভার্সিটি (১৯৯৬) এবং ঢাকাস্থ বাংলা একাডেমি (১৯৯৭) ও বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের (১৯৯৭) ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমি তাঁকে সাহিত্য পদক প্রদান করে। হোসেন শাহের বাংলা ১৪৯৪-১৫৩৮ : সমাজ ও রাষ্ট্র পর্যালোচনা (১৯৬৫), বাংলা রোমান্টিক কাব্যের আওয়াধী-হিন্দী পটভূমি (১৯৭১) ও Trade, Technology and Society in Medieval Bengal (১৯৯৫) তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সাহিত্য, ধর্ম ও বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ছাড়াও সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদ, আর্থসামাজিক ইতিহাস ও ইতিহাস চর্চার সমস্যা নিয়ে একাধিক রচনা লিখেছেন তরফদার। কবিতাতেও তিনি ছিলেন সমান উজ্জ্বল। নিজে কবিতা লেখার পাশাপাশি বাংলা রোমান্টিক কাব্যের ঠিকুজিও অনুসন্ধান করেছেন তিনি।
আজ এই লেখকের ৯০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বর্তমান লেখাটি প্রকাশ করা হলো।
– ফিচার সম্পাদক
নার্সিসাস নই আমি; আত্মরতি শিখিনি জীবনে;
তবুও আমারই ছায়া ভেসে ওঠে আশ্চর্য দর্পণে।
—মমতাজুর রহমান তরফদার (১৯৭৬ : ১৪৩)
অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদার দেহত্যাগ করিয়াছিলেন ১৯৯৭ সালের ৩১ জুলাই। সেই দুঃখের দিনে কোন শোক প্রকাশ করিতে না পারিয়া আরো দুঃখ হইয়াছিল। তখন আমি উচ্চশিক্ষার ঘাস কাটিতে বিদেশে বসবাস করিতেছি। এই মৃত্যুর দেড় বছরের মাথায় অধ্যাপক আহমদ শরীফ আর আড়াই বছরের মধ্যে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকও ইহলোক ত্যাগ করেন। এই তিন অধ্যাপকের গুণ আমি যতদূর পারি গ্রহণ করিতে তৎপর ছিলাম। তিনের মধ্যে মাত্র আব্দুর রাজ্জাকের মর্সিয়াই আমি তখন তখন লিখিতে পারিয়াছিলাম। পাক্কা কুড়ি বছর পর আজ মমতাজুর রহমান তরফদারের কথা দুই কলম লিখিতে বসিয়াছি।
১
তরফদার সাহেব ভূ-বাংলাদেশে ইতিহাস লেখক পরিচয়ে বিশিষ্ট। বস্তুত তাঁহার সহিত তুলনা দিবার মতন ইতিহাস লেখক এদেশে বড় বেশি নাই। তাঁহার লেখা ‘হোসেন শাহের বাংলা ১৪৯৪-১৫৩৮ : সমাজ ও রাষ্ট্র পর্যালোচনা’ (১৯৬৫) আর ‘বাংলা রোমান্টিক কাব্যের আওয়াধী-হিন্দী পটভূমি’ (১৯৭১) বাংলাদেশের ইতিহাস সাহিত্যের দুইটি অমূল্য সম্পদ। একদা এক জায়গায় তিনি নিজেকে ‘কবিতা-লেখক’ উপাধিও দিয়াছিলেন। এই সত্যের সহিত সাক্ষাৎ-পরিচয় না থাকিলে অন্য অনেকের মত হয়ত আমিও বিশেষ অবগত থাকিতাম না।
১৯৭৬ সালে তরফদার সাহেব ‘চতুষ্ক’ নামক একটি কবিতা সংগ্রহ প্রকাশ করিয়াছিলেন নিজ খরচায়। সংগ্রহের মুখবন্ধ উপলক্ষে তিনি খবর দিয়াছিলেন কৈশোরে—মায় যৌবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত—তিনি কবিতা ব্যবসায়ে শরিক ছিলেন। ১৯৭৬ সালের তথ্য অনুসারে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তাঁহার কিছু কবিতা সেকালের পত্রপত্রিকায় মুদ্রিতও হইয়াছিল। ‘তারপর’—তাঁহার ভাষায়—‘কবিতা-রচনায় বিরতি ঘটে বিশেষ কারণে।’ বিশেষ কি তিনি আর বিশদ করেন নাই।
অনেকদিন—মানে কুড়ি বছর—পর আবার কবিতাক্ষেত্রে ফিরিয়া আসিলেন তিনি। অনধিক দুই বছরে গোটা চারি কেতাব ভরাইবার মতন কবিতা লিখিয়াও ফেলিলেন। এ সত্যের নিশ্চয় কোন তাৎপর্য আছে। একটা তাৎপর্য কবির একান্ত বা দৈনন্দিন জীবনের সহিত জড়িত বিষয়—সেই তাৎপর্যানুসারে চরিতামৃত লেখকেরা নিশ্চয়ই পদাবলি লিখিবেন। আরেকটা তাৎপর্য অনেকান্ত—ইহার সত্য ইতিহাসের অন্তর্গত। আমি আজ সেদিকেই মন যোগ করিতে চাই।
আমাদের পরম সৌভাগ্য যে মমতাজুর রহমান তরফদার প্রতিটি কবিতার পাদদেশেই একটি করিয়া রচনার তারিখ উৎকীর্ণ করিয়াছিলেন। চোখের পলকেই দেখা যায় ‘চতুষ্কে’র সকল কবিতা ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি হইতে ১৯৭৬ সালের জুলাইয়ের মধ্যে রচিত। ততদিনে মেঘে মেঘে অনেক বেলা হইয়া গিয়াছে। এ সত্যে সন্দেহ ছিল না বলিয়াই তরফদার সাহেব লিখিতে পারিয়াছিলেন, ‘কবিতা-লেখক হিসেবে আমি উদীয়মান নই, উদিতও নই, বরং অস্তগামী।’
স্বভাবের বশেই প্রশ্ন উঠিবে—কবিতা কবির কীর্তি, পড়িলেই বুঝিতে পারি কিন্তু যিনি এই কবিতাগুলি রাখিয়া গিয়াছেন তিনি কোন কারণে এইগুলি লিখিবার জন্য ১৯৭৫-৭৬ সাল বাছিয়া লইয়াছিলেন? প্রশ্নের একটা অপ্রত্যক্ষ জওয়াবও তরফদার সাহেব দিয়াছিলেন এইভাবে : ‘ইতিহাসকে বারবার ব্যবহার করেছি অতীতের কঙ্কাল হিসেবে নয়, বর্তমান সমাজ-জীবনের প্রতীক এবং অনুষঙ্গ রূপে, কখনো বা বৃহত্তর জীবনের পটভূমি রূপে।’ এই সত্যের আভাস কবিতার মধ্যেও ঢের পাওয়া যায়। উদাহরণ দিতেছি একটা। ‘ব্লাড ব্যাংক’ নামা একটি কবিতার নিচের তারিখ ৩০ জুন ১৯৭৬। তাহার একাংশে পড়িতেছি এমন এক বৈপরীত্যের গল্প যাহা রূপকথার অঙ্গ নহে। ইহাকে বরং ‘ইতিকথার পরের কথা’ বলা যাইতে পারে।
এখানে মানুষ ইস্পাত বা অন্য কোনো কঠিন ধাতুতে গড়া।
তারা রুপোর টেবিলে ঝুঁকে পড়ে সোনার অক্ষরে নাম সই করে।
আসবাব-পত্র, ঘরদুয়ার, পথঘাট, গাছপালা মুক্তায় তৈরী।
মেয়েদের শাটিন আর বুতিক কঠিন পাথরের
আর তাতে রক্তময় মণির আলো ঠিকরে পড়ে।
হীরকের কাছ থেকে অমৃতের ফল ঝরে।
পানীয় এখানে তরল সোনা; এখানে রক্ত নেই।
(তরফদার ১৯৭৬ : ১৫৯)
একদিকে তিনি দেখিয়াছেন হাসপাতালে রক্ত নাই, ব্লাড ব্যাংকে রক্ত পাওয়া ভার, রক্তের অভাবে রোগী মারা গিয়াছে অথচ চারিদিকে রক্তের সমুদ্র। এই বৈপরীত্যে তিনি হতবাক।
হাজার হাজার গ্রাম মানচিত্রে শুয়ে আছে
সবুজে, নীলে, আরো বিচিত্র রঙের সম্ভারে।
ভরে ওঠে লাখ লাখ সিরিন্জ্ তরমুজের রসের মত রক্তে—
গোলাপী, লাল লাল রক্তে।
এখন শহরের ব্লাড ব্যাংক রক্তের সমুদ্র,
তাতে অণু-পরমাণুর তরঙ্গ ওঠে।
গ্রামে গ্রামে নেমে আসে সন্ধ্যা—নরম নরম সন্ধ্যা।
আকাশে তারাগুলো কাঁপছে।
খেতে, খামারে, আঙিনায়, বারান্দায়
পড়ে আছে লাখ লাখ লাশ।
নিসর্গ ডুবে গেছে স্তব্ধতার সমুদ্রে।
সাত নম্বর ক্যাবিন ফাঁকা।
সে মর্গে—বোধ হয় রক্তের সন্ধানে।
ফিকে চাঁদ দিগন্তে;
আকাশ তারায় তারায় ঝাঁঝরা—
ওটা ক্যান্সার রোগীর হৃৎপিণ্ড।
গ্রামের আকাশের তারাগুলো
লাশের উপর মৃদু মৃদু আলো ছড়ায়।
(তরফদার ১৯৭৬ : ১৫৯-৬০)
বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের তুলনা খুব কম আছে। এই শ্বাসরুদ্ধকর ক্রান্তিকাল এদেশের ইতিবৃত্তে বহুদিন অনতিক্রান্ত থাকিবে বলিয়াই মনে হয়। মমতাজুর রহমান তরফদার দেখিতেছি কবিতায় ফিরিয়া আসিতেছেন এই কালসংক্রান্তির—এই ১৯৭৫ সালের—গোড়ার দিকেই। তাঁহার ‘চতুষ্ক’ গ্রন্থের পহিলা কবিতার নিচে তারিখ ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। এই দিনই তিনি দীর্ঘদিনের নীরবতা ভাঙ্গিলেন। তরফদারের প্রথম কবিতার নাম ‘অরণ্য’। এই সমাপতন একান্ত আকস্মিক মনে করার কোন হেতু দেখিতেছি না। চতুষ্কের শেষ কবিতা ‘বুকের আগুনে’। ইহার একটি পংক্তি : ‘আর কত বার আমরা নতুন ব্যাখ্যা দেব স্বাধীনতার’।
বাংলাদেশে একখণ্ড জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। যাঁহারা দীর্ঘ সাধনার বলে এই ভিত্তিটি পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিতে আবিষ্কার করিতেছিলেন ইতিহাস ব্যবসায়ী মমতাজুর রহমান তরফদার তাঁহাদের প্রথম সারিতে। দিল্লিতে সুলতানি শাসন প্রবর্তনের পরপরই বাংলাদেশেও স্বাধীন রাষ্ট্রের নতুন করিয়া গোড়াপত্তন হইয়াছিল। সেই গোড়াই পত্রেপুষ্পে ফলবান হইয়াছিল ইংরেজি পনের শতকের শেষ ও ষোল শতকের শুরুতে। এই সত্যে তরফদারের সন্দেহ ছিল না।
জনসাধারণের ইচ্ছাই রাষ্ট্রক্ষমতার ভিত্তি—এই সত্যের উপর দাঁড়াইয়াই বাংলাদেশের নতুন প্রজাতন্ত্র আপনার ঐতিহাসিক ন্যায্যতা অর্জন করিয়াছিল। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রাম প্রকৃত প্রস্তাবে সেই ন্যায্যতার মূলেই জয়ী হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী জনগণের সেই ইচ্ছার সাময়িক বিয়োগ ঘটায়। তরফদারের ‘অরণ্য’ কবিতায় দেখিতেছি সেই আবহের রূপকই পুরাদস্তুর উপস্থিত।
আদিম অরণ্য এই স্বর্গ, মর্ত্য অথবা পাতালে;
ছিল না সূর্যের আলো এ অরণ্যে আমাদের কালে।
স্যাঁৎস্যাঁতে এই মাটি, কর্দমাক্ত পথ ও প্রান্তর
নিঃশব্দ আরণ্য নদী, শব্দহীন বনবনান্তর।
এখন বাতাস ভারি এবং রক্তের গন্ধ সহজাত যেন;
প্রকৃতি আর্দ্রতা ঝেড়ে কঙ্কালের শুভ্রতা বাড়ায়।
(তরফদার ১৯৭৬ : ৩)
এই জায়গায় প্রসঙ্গক্রমে মহান লেখক আহমদ ছফার কথাও উল্লেখ করিতে হয়। তিনি কবিতা লেখা শুরু করিয়াছিলেন ১৯৫০ সালের পরের কোন এক পর্যায়ে। ১৯৬৪ সালের পর তাঁহার কোন কোন কবিতা ঢাকা শহরের পত্রপত্রিকায় ছাপা হইতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালের পর হইতে তিনি উপন্যাস-শুদ্ধ নানা প্রকার লেখা প্রকাশ করিতেছিলেন। কিন্তু যতদূর জানি ১৯৭৫ সালের আগে তিনিও নিজের লেখা কোন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন নাই। অথচ ১৯৭৫ সনের প্রথম ভাগে আহমদ ছফা যেন বা বড় কোন তাড়ায় পড়িয়া পরপর দুইটি ছোট ছোট কবিতার বই—যথাক্রমে ‘জল্লাদ সময়’ ও ‘দুঃখের দিনের দোহা’—প্রকাশ করেন। ‘জল্লাদ সময়’ কবিতা সংকলনের নামকবিতায় আহমদ ছফা অন্যান্যের মধ্যে এই কথা-গুলিও লিখিয়াছিলেন :
সূর্যালোকে পিঠ দেয় আততায়ী লজ্জিত সময়
যা কিছু প্রকাশ্য তুমি বামহস্তে করছ গোপন
সমূহ ধ্বংসের বীজ গর্ভাশয়ে করেছ রোপণ
কিন্তু কিছু সত্য আছে কোনদিন লুকোবার নয়।
(ছফা ২০১০ : ২৪)
আহমদ ছফার আরেকটি কবিতার নাম ‘দুঃসময়’। এই কবিতাটি ‘দুঃখের দিনের দোহা’ নামক সংকলনের অংশ। এখানেও কবি যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা দুর্দিনের বার্তা বৈ নয়।
নদীতে বইছে বেগে খরতর খরস্রোত
দুকূলে নামছে ধ্বস, অবিরত চলছে ভাঙন
ভাঙন ভাঙন শুধু চারদিকে ভাঙনের ক্ষণ।
বইছে কুটিল জল তটরেখা করে না শাসন
এই জলে পলি নেই, নেই কোন গর্ভের সঞ্চার
জাগবে না স্রোতোপথে চরের আদল।
(ছফা ২০১০ : ৫২)
আমার মনে হইয়াছে মমতাজুর রহমান তরফদারের কবিতা পড়িবার পূর্বাহ্নে ভূমিকাস্বরূপ এই কয়টি কথা না বলিলেই নয়। আমি আমার একান্ত অভিজ্ঞতা হইতেই জানি, আহমদ ছফার সহিত তরফদারের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। তিনি যে আহমদ ছফার কবিতার সহিত পরিচয় রাখিবেন—তাহা মোটেও অস্বাভাবিক মনে হয় না।
২
বাংলাদেশে যাহাকে বলে অনগ্রসর—তদুপরি মুসলমান—কৃষক-সমাজ তাহার অনেক সদস্যের মত আমিও কয়েক বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্দুকে জীবনপাত্র বন্ধক রাখিবার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছিলাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হইবার সুবাদে হাতে গোনা কয়েকজন গুণীর দেখা পাইয়াছিলাম। এই গুণীদের মধ্যে অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদার। তাঁহার কাছে আমার অনেক ঋণ আজও অপরিশোধিত। এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে আমি শুদ্ধ দুই-তিনটি ঋণের কথা স্বীকার করিব। তবে বলিয়া রাখিব তাহাতেই আমার কর্তব্যের তামাম হইবে না।
পরিচয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তরফদার সাহেব একদিন আমাকে ‘বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষৎ’ নামক যে প্রতিষ্ঠানের সহিত তিনি নিখিল জড়াইয়া ছিলেন তাহার কোন এক শীতকালীন সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাইয়াছিলেন। সনতারিখের বালাই আমার মনে বিশেষ থাকে না। একটার নাম ‘বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষৎ’ আর একটার পরিচয় ‘বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি’—এই ক্রমে যে দুইটা পদার্থ ঢাকায় আছে তাহাও আমি অনেকদিন পর্যন্ত আমল করি নাই। এতদিনে শুনিতেছি ইহাদের মধ্যে সংঘর্ষও আছে। তাহাতে আমার মাথাব্যথা নাই।
ঘটনাটি খুব সম্ভব ইংরেজি ১৯৭৭ সালের গোড়ার দিকের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের দোতলায় একটি সেমিনার ঘরে ইতিহাস পরিষদের ঐ অধিবেশন বসিয়াছিল। বিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বিশেষ বলিতে ততদিনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখিবার সময় হইয়াছে কিনা তাহাই ছিল বিবেচ্য। কেহ কেহ বলিতেছিলেন সময় হইয়াছে; এখনই ইতিহাস লেখা শুরু করিতে হয়। আর কেহ বা না লেখার পক্ষে যুক্তি দেখাইতেছিলেন। বলিতেছিলেন: না, না, এখনো সময় হয় নাই। এক্ষণে শুদ্ধ ইতিহাসের মালমশলা যোগাড় করিতে হইবে, পরিণাম ইতিহাস পরে দেখা যাইবে। মনে রাখিতে হইবে, তখনো বাংলাদেশে জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অর্ধযুগ পার হয় নাই।
অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন মমতাজুর রহমান তরফদার। প্রবন্ধ পড়িলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষক তাজুল ইসলাম হাশমী। হাশমী সাহেবের যুক্তি কি ছিল তাহা আমার এখন আর স্পষ্ট মনে পড়ে না। ইতিহাস পরিষদের নথিপত্র ঘাঁটিলে হয়ত কিছু প্রমাণ এখনো পাওয়া যাইবে।
মনে পড়িতেছে ভদ্রলোকের বাংলা উচ্চারণে একটু জড়তা ছিল। যতদূর জানি বাংলা তাঁহার মাতৃভাষা ছিল না কিন্তু তিনি দেখিলাম বাংলাতেই লিখিলেন। যাহা হৌক, আমাকে সেই অধিবেশনে হাজির করিয়াই তরফদার সাহেব আপন কর্তব্য সমাপন করেন নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢের ছাত্র ও সমাগত অনেক শিক্ষকের সামনে আমাকে দাঁড় করাইয়া পর্যন্ত দিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন হাশমীর প্রবন্ধের উপর মন্তব্য যোগ করিতে হইবে। বুঝিতে পারি নাই তিনি কেন এই অযৌক্তিক (‘গর্হিত’ বলা হয়ত সম্পূর্ণ ঠিক হইবে না) কাজটি করিতে গেলেন। এখন মনে হইতেছে ‘কবিতা-লেখক’ ছিলেন বলিয়াই হয়ত তাঁহার দেওয়ানে ইহা সম্ভব হইয়াছিল।
স্কুলবেলার পাঠ্যপুস্তকে পড়া একটি গল্প সেদিনের বক্তৃতার মধ্যে চোলাই করিয়াছিলাম। যতদূর মনে পড়ে পুস্তকের নাম ‘পাক মেট্রিকুলেশন ট্রান্সলেশন’। উপসংহারে বলিয়াছিলাম, ইতিহাস না পড়িয়াই মরিতে হইতেছে জানিয়া এক রাজা বড় দুঃখ পাইয়াছিলেন। দুঃখ দূর করিবার মানসে তাঁহার অন্তিম মুহূর্তে ধীমান এক মন্ত্রী রাজার কানে কানে বলিতেছিলেন, ‘রাজা মহাশয়, ইতিহাস পড়িতে না পাইলেন তাহাতে দুঃখ করিবেন না। পৃথিবীর ইতিহাসের সারমর্ম তো আমার জানাই আছে; এখনই শুনাইয়া দিতেছি: মানুষ জন্মিয়াছে, দুঃখ পাইয়াছে আর মরিয়াছে—ইহাই পৃথিবীর ইতিহাসের সারমর্ম।’ রাজা তখনই আনন্দাশ্রু নির্গত করিতে করিতে চক্ষু মুদিয়াছিলেন। কোন কোন আকলমন্দের জন্য—শুনিয়াছিলাম—গল্পের ইশারাই যথেষ্ট প্রমাণিত হইয়াছিল।
সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠানে পা দিয়াছি। সময়টা বেশ। প্রথম বছরটা শেষ করিয়াছি কি করি নাই। তাহার উপর আমি ‘ইতিহাস’ কিংবা ‘ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ কোন বিভাগের ছাত্র নহি। তরফদার সাহেবের সহিত আমার দেখা করাইয়া দিয়াছিলেন যিনি আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের সহিত আমার মোলাকাতের কারণও ছিলেন সেই মহাত্মাই। নাম আহমদ ছফা। তখন মনে মনে সন্দেহ জাগিয়াছিল তরফদার সাহেব হয়ত আহমদ ছফার কথায় প্রভাবিত হইয়াছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বাহির হই বাহির হই এমন সময়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের একটা লিখিত বক্তৃতা বা প্রবন্ধ সমালোচনা করিয়া আমি একটি ছোট্ট বেজায় প্রবন্ধ লিখি। তাহাতে মহাত্মা আহমদ ছফা সত্য সত্যই বেজার হইয়াছিলেন। তিনি আমাকে একবার ডাকিয়া বলিয়াছিলেন, ‘তোমার জিহ্বার মধ্যে একটি ঘাতক হাঙ্গর। তাহার আশীর্বাদে জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি জুটিবে না।’ গুরুজনের আশঙ্কা বৃথা যায় না। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি জুটিয়াও সেই অমৃতের ফল আমার হাত হইতে ছুটিয়া গিয়াছিল। চাকরির গোড়া শুকাইয়া গিয়াছিল।
আব্দুর রাজ্জাকের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোন মহাশয়ের সমালোচনা বিশেষ করি নাই। যদি কাঁহারও করিতে হইত তো আমি মমতাজুর রহমান তরফদার কিংবা তাঁহার গুরু আবু মহামেদ হবিবুল্লাহর কীর্তি লইয়াই তাহা করিতাম। মনোবল শেষ হইয়া গিয়াছিল। আর সাহস গিয়াছিল শুকাইয়া। সাহস বড়ই তরল পদার্থ। যে পাত্রে রাখেন তাহারই আকার ধারণ করে। আল্লাহতায়ালার পরম করুণায় অল্পেই—অপার বিলম্ব ঘটিবার আগেই—বুঝিয়াছিলাম অল্পবিদ্যা কত ভয়ংকর।
এক্ষণে বলিয়া রাখি, আমার চাকরি যাইবার পশ্চাতে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের কোন হাত ছিল না। তিনি বরাবরই আমার বরাভয় ছিলেন। এই জাতীয় ঘটনাকে গ্রিক পুরানে ‘ট্রাজেডি’ বলা হইত। একালে আমরা বলি ‘ট্রাউয়ারস্পিয়েল’।
৩
এক্ষণে আমাকে আরেকটি ঋণের কথা বলিতে হয়। ১৯৮৬ সাল নাগাদ আমি উচ্চশিক্ষার নামে বিদেশ যাইবার একটা সুযোগের সদ্ব্যবহার করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। দেশে ফিরিবার পথে কিছু দেরি হইয়াছিল। কিছু মানে গোটা চৌদ্দ বছর। আগেই কহিয়াছি আমার ফিরিবার আগেই তরফদার সাহেব পরলোকগমন করিলেন ৩১ জুলাই ১৯৯৭। এক্ষণে আঁক কষিয়া দেখি আর একদিন পার হইলেই তাঁহার জন্মের দিন আর মৃত্যুর দিন এক দিবস হইত। জীবনের ৬৮ বছর যেদিন পূর্ণ করিলেন সেদিনই তাঁহার ইহবিয়োগ হইল। তাঁহার সহিত এ জীবনে আর দেখা হইবে না। আমি যে তাঁহার কবিতা লইয়া এই প্রবন্ধ লিখিতেছি তিনি কোনদিন জানিতে পারিবেন না।
১৯৮৫ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র’ নামে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান খাড়া করিলে তরফদার সাহেব উহার সভাপতি নিযুক্ত হইলেন। আমি ততদিনে বছর দুই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটাইয়া ঢাকায় ফিরিয়া আসিয়াছি। উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের প্রথমদিকের একটি সেমিনারের বিষয় ছিল ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন বিষয়ে কার্ল মার্কস যে সকল লেখা লিখিয়াছিলেন সে সকল লেখার পর্যালোচনা। তরফদার সাহেব সেই সেমিনারেও সরকারি খামে আমাকে কেন জানি নেমন্তন্ন করিয়াছিলেন।
প্রচার করা হইয়াছিল এই সেমিনারে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মো. মোফাখ্খারুল ইসলাম একটা মূল্যবান প্রবন্ধ পড়িবেন। তাঁহার লেখার পর্যালোচনা করিতে মোট দুইজন আলোচক সরকারি ডাক পাইয়াছিলেন। একজনের নাম আবু আহমদ আবদুল্লাহ। নিজের নামেই ইনি যথারীতি দেশবিখ্যাত। সেই সময় ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ নামক এক আধা-সরকারি কেন্দ্রের অর্থনীতি ব্যবসায়ী পরিচয়ে ভূষিত তিনি। আরজন আমি। মাত্র নগণ্য প্রভাষক। তাহাও আবার ‘ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট’ নামক ইতিহাসে অব্যবসায়ী একটি গোমড়ামুখ শিক্ষাসত্রের।
এই অধিবেশনে আমি ঠিক কোন কোন বাক্য আওড়াইয়াছিলাম তাহা আমার এখন আর মনে নাই। শুদ্ধ এইটুকু মনে পড়িতেছে যে মোফাখ্খার সাহেব যাহা বলিয়াছিলেন তাহার অনেক কথাই আমার মনে ধরে নাই। সে যুগে আমি মার্কস ব্যবসায়ে নামিয়াছি খুব বেশিদিন হয় নাই। আর এদিকে মোফাখ্খার সাহেব পশ্চিম দেশীয় পণ্ডিতদের পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করিয়া কার্ল মার্কসের মুণ্ডুপাত করিতেছিলেন। আর যায় কোথায়! ইহার ফল—বলা বাহুল্য—ভাল হয় নাই। আহমদ ছফার আবিষ্কৃত দুশমন হাঙ্গরটি তখনো আমার জিহ্বা ত্যাগ করে নাই।
এখন আমার তৃতীয় দফা ঋণ বা ঋণমালার কথা বলিব। মমতাজুর রহমান তরফদার তাঁহার নিজের লেখা দুই-তিনটা পুস্তক আমাকে উপহারস্বরূপ দিয়াছিলেন। একটির নাম ‘বাংলা রোমান্টিক কাব্যের আওয়াধী-হিন্দী পটভূমি’। দ্বিতীয়টির নাম ‘চতুষ্ক’। চতুষ্কের কথা এই নিবন্ধের গোড়াতেই একবার বলিয়াছি। এক্ষণে আরেকটু বিস্তার করিবার বাসনা হইতেছে।
তিনি খুব সম্ভব আশা করিয়াছিলেন অন্তত শেষের কেতাবটি লইয়া আমি দুই কথা মুসাবিদা করিব। এই কবিতাবলির ভূমিকাচ্ছলে তিনি যাহা লিখিয়াছিলেন তাহাতে যথেষ্ট ইশারা আছে যে লোকে ইহার সমালোচনা করেন। তাঁহার বিভাগের জনৈক সহকর্মী সমীপে প্রকাশ্যে এই বাসনা পেশও করিয়াছিলেন। তরফদার সাহেবের বাসনাটি ছিল এইরকম :
লিখেছিলাম নিতান্তই আত্মবিনোদনের জন্য। প্রফেসর আহমদ শরীফ, অধ্যাপক, কবি মুফাখ্খরুল ইসলাম এবং ডক্টর পারেশ ইসলাম মুস্তাফিজুর রহমানের তাগিদে কবিতাগুলো প্রকাশ করলাম। আমার বহু কবিতার জন্মলগ্নের সঙ্গে ডক্টর মুস্তাফিজুর রহমানের নিবিড় পরিচয় আছে। এখানে তাঁর নাম উল্লেখ করলেও আমার কবিতার সমালোচনার অধিকার তাঁর রইল। (তরফদার ১৯৭৬ : পাঁচ-ছয়)
‘আওয়াধী-হিন্দী পটভূমি’ বইটি ছাপা হইতে না হইতে ১৯৭১ সাল আসিয়া গিয়াছিল। ইহার গায়ে ছাপ মারা ছিল ১৯৭১ সালের। প্রকাশকাল জানুয়ারি ১৯৭১ আর প্রকাশক—পুস্তকে মুদ্রিত পাঠ অনুসারে—‘অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী, বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। মনে পড়িল সে যুগে বিভাগীয় প্রধান বাংলা প্রকরণে ‘অধ্যক্ষ’ পরিচয়ে চলিতেন। তবে শব্দটা শেষ পর্যন্ত চলিল না কেন সে প্রশ্ন নিহিতই রহিল। আরো জানিলাম, ‘বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগ’ তখনো এক পাত্রেই রাখা হইত।
সঙ্গত কারণেই বইটির ভালমত বিলিবিতরণ হয় নাই। ১৯৭৭-৭৮ সালের কোন একদিন আমার হাতে একটি কপি তুলিয়া দিবার কালে তরফদার সাহেব বলিতেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের বিপ্লবে আমার বইয়ের প্রায় সব কপি নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। গোটা দশ কপি আমার নাগালে ছিল। একটা দিয়াছিলাম হুমায়ুন কবিরকে, ১৯৭২ সালে। সে বলিয়াছিল একটি আলোচনা লিখিবে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই আততায়ীর গুলিতে মারা যায় হুমায়ুন।’
আমার কপিটি হস্তান্তরের সময়ও তিনি সেই পুরাতন কথাই বলিতেছিলেন, ‘এটাই আমার শেষ কপি।’ তখন থাকিতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসে। সেই এজমালি কাড়াকাড়ি ছাত্রাবাসের মধ্যেও কপিটি আমি বহুদিন যক্ষের ধনের মত রক্ষা করিয়াছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা করিতে পারি নাই। কথা রক্ষার প্রসঙ্গ উঠাইতেছি না। রক্ষার যোগ্যতা আমার তখন হয় নাই—সিদ্ধি আজও অধরাই রহিয়াছে।
পরে ‘আবদুর রহমানের সন্দেশ-রাস্ক’ নামে একটি আলাদা প্রবন্ধও তিনি প্রকাশ করেন। ইহাকে ‘আওয়াধী-হিন্দী পটভূমি’র পরিপূরক বলা যাইতে পারে। আওয়াধী-হিন্দী ও বাংলা কাব্যের তুলনায় সমালোচনা করিবার মানসে তরফদার সাহেব শুদ্ধ ‘আওয়াধী-হিন্দী’ ভাষাই শেখেন নাই, মনে হইতেছে বাংলা কবিতায়ও হাত মকশো করিতেছিলেন। শুদ্ধ কি তাহাই? তিনি দেখিতেছি ফরাশি ভাষাও অনেক দূর আত্মস্থ করিয়াছিলেন। মমতাজুর রহমান তরফদার ‘কবিতা-লেখক’ ছিলেন বলিয়াই হয়ত এই সাধনা তাঁহার দ্বিতীয় স্বভাব হইয়া উঠিয়াছিল।
পাঠিকা হয়ত লক্ষ্য করিবেন মমতাজুর রহমান তরফদার নিজেকে কদাচ ‘কবি’ বলেন নাই। বলিয়াছিলেন মাত্র ‘কবিতা-লেখক’। মনে পড়ে রাজা রামমোহন রায় তাঁহার জমানার কবিদের অন্তত একবেলা ‘কবিতাকার’ বলিয়া ডাকিয়াছিলেন। কোন এক কবি বলিয়াছিলেন, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। কথাটার সত্যাসত্য নির্ভর করে ‘কবি’ বলিতে আপনি কি বুঝাইতেছেন তাহার উপর। আমরা অন্য প্রকরণে বলিয়া থাকি মানুষ মাত্রেই কবি কেননা তাহার মধ্যে বাক্যের ঊষ হইয়াছে। আর কে না জানে ভাষার মধ্যে দুইটি নিয়ম যুগপদ ভাষাকে বাক্যের সমান করিয়াছে। ইহাদিগকে যথাক্রমে ‘রূপক’ ও ‘লক্ষণা’ বলিয়াই আমরা জানি।
৪
এক্ষণে আমি তরফদার সাহেব আমাকে দুই নম্বরে যে বইটি দান করিয়াছিলেন তাহার কথা পাড়িতেছি। বইয়ের নাম ‘চতুষ্ক’। ইহা চারিটি বইয়ের একত্রিত নাম। বই চারিটি যথাক্রমে ‘প্রত্ন’, ‘অন্ধকার অভিজ্ঞতা: আলোক’, ‘আভা’ এবং ‘অনন্য সুরগুলো’ নামে রচিত। বহিচতুষ্টয়ের অন্তর্গত কবিতার সংখ্যা গোটা ছিয়ানব্বই। অতিরিক্ত সংযোজনা আকারে আরো সাতটি কবিতা পাওয়া যাইতেছে।
বই চারিটি তিনি চারিজন ইষ্টের নামে উৎসর্গ করিয়াছিলেন। একটি উৎসর্গ প্রসঙ্গে খানিক শোকের কাহিনীও বিবৃত করিয়াছিলেন তিনি। তরফদার লিখিয়াছেন :
শেষ কাব্য ‘অনন্য সুরগুলো’ বহু দিন আগে পাণ্ডুলিপিতে শিল্পী জয়নুল আবেদিনের প্রতি উৎসর্গ করেছিলাম। তখন উৎসর্গের অংশে একটি-মাত্র কবিতা-পংক্তি ছিল। তাঁর দাফন শেষ করে এসে দ্বিতীয় প্রুফে ২৮/৫/৭৬ তারিখে প্রথম লাইনটি যোগ করে দেই। শিল্পী বিদেশ থেকে ফিরে এলে তাঁর সঙ্গে এপ্রিল মাসে দেখা করি। তাঁর শোয়ার ঘরে একটি অসমাপ্ত চিত্রের সামনে বসে দু’জন আড়াই ঘণ্টা কথা বলি। তারপর ‘জয়নুল আবেদিনের অসমাপ্ত চিত্র’ শীর্ষক কবিতাটি লিখি। কবিতাটি অথবা উৎসর্গের ঘটনাটি শিল্পী জানতে পারলেন না। আমার কাছে তাঁর মৃত্যুর মতই এই ঘটনাটি শোকাবহ। (তরফদার ১৯৭৬ : পাঁচ)
এখানে আমরা উৎসর্গপত্রের সেই দুইটি পংক্তি নকল করিয়া দিতেছি।
এখন ডুবেছে সূর্য সমাপ্তির গোধূলি-হাওয়ায়;
সব রঙ, সব রেখা বিদ্যুতের শিখা হয়ে সমুদ্রের দিকে চলে যায়।
(তরফদার ১৯৭৬ : ১১৫)
মমতাজুর রহমান তরফদার বগুড়া জেলার যে গ্রামে জন্মিয়াছিলেন তাহার নামেও আছে রূপক, আছে কবিতার গন্ধ। আর কি বাহারি সে নাম! ‘মেঘগাছা’! ‘গাছগুলো মেঘরঙ’ নামক একটি কবিতায় তরফদার মোটে একবার নয়, গোটা দুইবার জিজ্ঞাসা করিয়াছেন।
গাছগুলো মেঘরঙ—
এই নাম যারা দিয়েছিল গ্রামটিকে
তারা কি কবি ছিল?
(তরফদার ১৯৭৬ : ২২, ২৪)
‘একটি প্রার্থনা শুধু’ নামের আরেকটি কবিতাযোগে তিনিও ‘মেঘগাছা’ গ্রামের স্মৃতি পুনর্জাগ্রত করিয়াছিলেন। প্রার্থনা জানাইয়াছিলেন সেই গ্রামে সমাহিত হইবার।
একটি প্রার্থনা শুধু তোমাদের কাছে—
যদি নানা রঙ ঝরে অমৃতের গাছে
জল দিও বনেদী আলবালে।
যদি অন্ধকার নামে অমৃতের গাছে
নিতান্ত অকালে,
লাশটিকে রেখে দিও মর্গের সোপানে।
যদি ঠাঁই নাই-ই মেলে, তবে অন্য খানে—
যে গ্রামের গাছগুলো মেঘরঙ আর
যে গ্রামের বাতাসেও বসন্তবাহার
শুনেছি অনেক বার।...
(তরফদার ১৯৭৬ : ১৫২)
মমতাজুর রহমান তরফদার কখনো কখনো দূর বিদেশে বসিয়াও এই মেঘগাছা নধর গ্রামের স্মৃতিকাতর হইয়াছিলেন। ‘ঋণ’ নামক একটি কবিতায় দেখি তাঁহার পুরানা সেই আকুতি ফিরিয়া আসিয়াছে। কোন এক দূরদেশে গিয়াছেন তিনি। ধরিয়া লইলাম বেড়াইতেই গিয়াছেন। সেখানে ‘প্রিমরোজ হিল গার্ডেনের। স্বাপ্নিক চূড়ায়’ দেখিতেছেন ‘জুনের নরম রোদ মায়ের স্তনের মত স্নিগ্ধ ও মসৃণ’—এমন সময় হঠাৎ তাঁহার মনে পড়িল ‘মেঘগাছা’ গ্রামের কথা।
চমকে-ওঠা হরিণের মন
আকস্মিক চলে গেল উত্তর বঙ্গের কোনো গ্রামে,
যে গ্রামের গাছগুলো মেঘের মতন,
যে গ্রামে এখন এক স্নিগ্ধ সন্ধ্যা নামে।
অনেক রক্তের ঋণ, অনেক অন্নের ঋণ
জমে আছে প্রিমরোজ হিলের মতন।
(তরফদার ১৯৭৬ : ৬৯-৭০)
গ্রামের সহিত এই বাঁধাপড়া কি বোঝাপড়া শুদ্ধমাত্র একটি গ্রামের ঘটনা? মোটেই নহে। ‘গাছের উক্তি : অনিকেত নই’ নামাঙ্কিত অন্য একটি কবিতায় গ্রাম ছড়াইয়া পড়িয়াছে ইতিহাস-প্রসিদ্ধ বড় বড় সব জনপদে। ফরাশি চিত্রশিল্পী এদুয়ার্দ মানের একপ্রস্ত আপ্তবাক্য উদ্ধার করিয়া তরফদার এই কবিতাটির বিসমিল্লাহ করিয়াছিলেন। মানের কথাটা তিনি ফরাশি জবানেই লিখিয়াছিলেন : ‘ইল ফোতেত দো সোঁ তঁ’ (Il faut être de son temps)—অর্থাৎ আপন যুগের মানুষ হওয়াটাই দায়। তরফদারের কবিতায় এই বাক্যটিই দেখিতেছি নতুন নিয়ম আকারে হাজির হইয়াছে। তিনি লিখিয়াছেন, ‘কেবলি আমার রক্তে বেজে ওঠে পুরাতন বীণা।’
আমার শিকড় বাঁধা বরেন্দ্রের রক্তিম মাটিতে
হাজার হাজার নিম্নগামী মূলের সম্ভারে।
কিন্তু এই সত্তা জাগে আকাশের সমুদ্রের গায়
রোদের বৃষ্টিতে আর রঙে রঙে নিসর্গের বিমুগ্ধ আমেজে,
ফুলে ফুলে, শাখা-প্রশাখায় অস্তিত্বের আকুল বিকাশে।
এখন আমার সত্তা ছায়া ফেলে সমুদ্র-আকাশে।
বারবার দুলে উঠি; ছায়া জাগে
অন্ধকার বঙ্গে, সমতটে, হরিকেলে,
কুয়াশার শালবন-বিহারের ধূসর প্রাকারে,
সুদূরের মহাস্থানে, করতোয়া নদীর কিনারে,
রক্তময় পাহাড়পুরের পথে, ভিক্ষুদের স্তূপের চূড়ায়,
সমুদ্রের কূলে-উপকূলে
সম্ভাবনাময় স্বপ্নে বারবার দুলে।
(তরফদার ১৯৭৬ : ১৪৮-৪৯)
শুদ্ধ এই কবিতায় কেন, তাঁহার প্রায় সকল কবিতায় এই একটু খোড়াখুড়ি করিতেই পৌঁছাইবেন—একটু আগাইতেই হোঁচট খাইবেন—এই ধরনের পংক্তিতে :
শুনেছি পাহাড়পুর, পৌণ্ড্রদেশ কিংবা ময়নামতী
পৃথিবীর ইতিহাসে রেখেছিল গভীর সঙ্গতি।
(তরফদার ১৯৭৬ : ৬১)
মমতাজুর রহমান তরফদারের তরফে পুরাতন ইতিহাস নেহায়েত নয়া জমানার প্রতীক মাত্র বনিবে না বা চাকরি মাত্র করিবে না, তাহার ঢের কাজ পড়িয়া রহিয়াছে। ‘কলরব তবু শোনা যায়’ শিরোনামের এক কবিতায় তাহাই দেখিতে পাইতেছি :
একটু দূরে খালটার নির্জন কিনারে
যখন হেমন্ত-সন্ধ্যা নেমে আসে বাবলার ঝাড়ে
কোনো এক নির্জন গুহায়
বারবার আজো শোনা যায়
অতীতের মৃদু কলরব;
নিসর্গ এখনো নয় গত-মহোৎসব।
(তরফদার ১৯৭৬ : ১৩২)
অতীত ও বর্তমানের যুগল রচনা করিতে বসিয়া তিনি কখনো কখনো চমকিয়া উঠিবার মতন সাকার পংক্তিও লিখিয়াছেন। ‘এই গ্রামে’ নামক একটি কবিতার একটি চিত্রকল্প পরখ করিলেই ধরা পড়িবে চিত্রকল্পের ক্ষমতা বলিতে কি বুঝায়। তরফদার লিখিতেছেন :
এই গ্রাম দ্বিখণ্ডিত শব।
এই রাস্তা তলোয়ার এ গ্রামের বুকের ভিতর।
থেমেছে অনেক আগে গ্রামিকার আদিম উৎসব।
আশেপাশে শূন্য খেত, তার পর অসংখ্য কবর।
প্রাচীন কঙ্কালগুলো এখন ঘুমায়
সময়ের বুকের ভিতর।
...
এখন ধর্ষিতা চাঁদ জেগে আছে রাতের গুহায়।
(তরফদার ১৯৭৬ : ১৫০; মোটা হরফ যোগ করা)
‘গ্রামিকা’ শব্দটি সামান্য শব্দ নহে। আমরা রোজকার কথাবার্তায় যেমন বলি পুস্তকের ছোট ‘পুস্তিকা’, পত্রের ছোট ‘পত্রিকা’, তেমনি গ্রামের ছোট ‘গ্রামিকা’। বাংলায় ‘ইকা’ প্রযুক্ত হয় ছোট অর্থাৎ তুচ্ছ অর্থে আবার এই শব্দের গর্ভাশয়ে নারী ও পুরুষের ভেদও বাসা বাঁধিতে পারে—যেমন শিক্ষকের স্ত্রীলিঙ্গ ‘শিক্ষিকা,’ লেখকের স্ত্রীলিঙ্গ ‘লেখিকা,’ কিংবা পাঠকের স্ত্রীলিঙ্গ ‘পাঠিকা’। তরফদার সাহেবের ‘গ্রামিকা’ কি গ্রামের ছোট না গ্রামের স্ত্রীলিঙ্গ? ভাবিয়া দেখিতে হইবে। হইতে পারে দুইটার অর্থ একই। তরফদার আরো অনেক জায়গায় এই ‘গ্রামিকা’ পদটি কাজে খাটাইয়াছেন।
কিন্তু সেই সুরগুলো এখনো অনাবিষ্কৃত, এখনো অজানা,
হয়ত সৃষ্টির লগ্নে গ্রামিকার বুকে দেয় হানা।
(তরফদার ১৯৭৬ : ১১৮; মোটা হরফ যোগ করা)
৫
এই পর্যন্ত আমরা মাত্র মমতাজুর রহমান তরফদারের কবিতার পদার্থ ধরিয়া আলোচনা করিলাম। এক্ষণে কবিতার পদ লইয়া দুই কথা বলিব। তাঁহার অধিক কবিতা অক্ষরবৃত্তের সরল পয়ারে রচিত। কোন কোন কবিতা মাত্রাবৃত্তের হালকা চালেও দুলিয়া উঠিয়াছে। ‘খুলো না চুলের গুচ্ছ’ নামের কবিতার কয়েক পংক্তি বাজাইয়া দেখা যাইতে পারে। অক্ষরবৃত্তের পয়ারে রচা এই পদ্যটিতে মাত্রাবৃত্তের চালও ইচ্ছা হয় খুঁজিয়া লওয়া যায়। এই নিবন্ধের শেষে নিদর্শনস্বরূপ এই কবিতাটির আগাগোড়া তুলিয়া লইব। তবে এখানে নগদ মূল্যে কয়েক পংক্তি আলাদা করিয়া দেখাইতে চাই।
মেলো না স্বপ্নের পাখা, খুলো না চুলের গুচ্ছ এখানে কুমারী;
কেন না আঁধারে কাঁপে মৃত্যুর উলঙ্গ তরবারি।
এখানে পাথর শুধু, মাটি নেই, নেই ত ঘাসের আলোছায়া;
নিরেট কুয়াশা ভরে জাগে শুধু পরিচিত, নগ্ন প্রেত কায়া।
বসে না গাছের ডালে রঙে রঙে পাখিদের ঝাঁক;
তরুণী হরিণীগুলি প্রাণহীন, বিস্ময়ে নির্বাক।
ঝরে না সূর্যের আলো সমুদ্রের রঙিন ফেনায়;
কাঁপে না নৌকার সারি মানবিক ছিন্ন নীলিমায়।
(তরফদার ১৯৭৬: ১৪১)
মাত্রাবৃত্তের চালেই মমতাজুর রহমান তরফদার অধিক সিদ্ধার্থ বলিয়া আমার ভ্রম হইয়াছে। উদাহরণের স্থলে বলিতে চাই, ‘জলের ধারে’ কিংবা ‘কালো মুখ’ নামক দুইটা কবিতায় একই ধরনের শক্তি ও সত্যের দেখা মিলিবে। পদ ও পদার্থের অভেদ বলিতে যাহা বুঝায়—বুনিয়াদি তত্ত্বজ্ঞানীরা যাহাকে বহুদিন ধরিয়া কলাসিদ্ধির পরাকাষ্ঠা জ্ঞান করিয়া আসিতেছেন—তাহার উদাহরণ এই সকল কবিতা।
মমতাজুর রহমান তরফদার কর্তৃক মাত্রাবৃত্তের চালে রচিত আরও একটি কবিতার কথা আমি পাড়িতে চাই যাহাতে পদ ও পদার্থের অভেদ প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে। কবিতাটির নাম ‘জাগ্রত’। এই কবিতার শক্তি গোটা চারি পংক্তি মাত্র উদ্ধার করিয়া বোঝান যাইবে না। আমরা গোটা কবিতাটিই সংযোজন অংশে জুড়িয়া দিতেছি। এই ক্রমে আরো অনেক কবিতা উদ্ধার করা যাইতে পারিবে। আশংকা হয় তাহাতে না স্মৃতিকথার সীমানা লঙ্ঘন করা হয়।
‘জাগ্রত’ নামের পদ্যটি শুদ্ধমাত্র ছন্দোসিদ্ধির উদাহরণই নহে, বেহ্তর বাগ্বিধির অভাবে যাহাকে আমরা বলিতে পারি ‘কবিতা লেখকের রাজনীতি’ ইহাতে তাহাও অনাবৃত হইয়াছে। বর্তমান দুনিয়ার বিবর্তমান শ্রেণীসংগ্রামের একটি স্থিরচিত্রও এখানে পাওয়া গিয়াছে। ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি লিখিত এই কবিতায় সে যুগের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পটভূমি পরিস্ফূট। দেখিতেছি এই কবিতার চারিসীমানায় হ্যানয়, সায়গন, সিনাই, তিমুর আর অ্যাঙ্গোলার মঞ্চের পেছনে লিসবন, মাদ্রিদ, লন্ডন, পারি, প্রাগ, ভিয়েনা আর ওয়াশিংটননামা সবুজ ঘারের পর্দাও ভাসিয়া উঠিতেছে।
একদা শ্রমিকশ্রেণির জাগরণ পূর্ব এয়ুরোপের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ ছাপাইয়া চিনদেশে জাতীয় মুক্তির পথও খুলিয়া দিয়াছিল। আজ সে যাত্রায় কোথাও ছেদ পড়িয়াছে কি? তরফদার লিখিয়াছেন—হয়ত পড়িয়াছে। তাহাতেই দমিবেন এমন পাত্র তিনি নন কিন্তু।
আপ্তবাণীর সমাহার মসিলেখা—
মার্কসের গোরে উইলোর শনশনি।
ভাল ভাল কথা বহু কাল আগে শেখা
—লেনিনের দেহ রঙিন প্রদর্শনী।
এখনো যাদের হৃদয় যায়নি মরে,
তারা ত কেবল শবের সংখ্যা গণে।
দূর ও নিকটে শকুনিরা ভিড় করে,
কেউ ঢাকে হিয়া রক্তের আবরণে।
জীবন এখন পণ্যের বিনিময়
আলোকের হ্রদে নামে কি অন্ধকার?
সত্য পুরুষ কোথায় দাঁড়িয়ে রয়?
তুলাদন্ডের কোথায় সাম্যভার?
ঢাকা-দিল্লীতে শরতের মেঘে মেঘে
সাত্যিক বুকে আলোক ত ঢাকবে না।
নীরব বজ্র এখন রয়েছে জেগে
বিবিধ প্রকার অন্ধকার যে চেনা
স্তব্ধ ভলগা যদি ভুলে যায় গান
হোয়াংহোর স্রোতত যদিও বা হয় ম্লান।
(তরফদার ১৯৭৬ : ১১০-১১)
তরফদারের এই দৃষ্টি আদৌ আপতিক নয়। এই দৃষ্টি তাঁহার ব্রতেরই অংশবিশেষ। বিষাদে পরিপূর্ণ তাঁহার অনেক কবিতা কিন্তু এই বিষাদ কদাচ বিতৃষ্ণায় পরিণতি পায় নাই। মহান ফরাশি কবি শার্ল বোদলেয়রের সহিত এই জায়গায় একটা তুলনা কাটিলে মন্দ হয় না। ‘একটি চিত্র দেখে’ নামের কবিতাটির মধ্যে খানিক বোদলেয়ারের ছায়া পড়িয়াছে এই কল্পনা করা চলে।
রাত্রি বমন করেছে এক রাশ আলকাতরা
পৃথিবীর বুকের উপরে।
অন্ধকার ঝুলে আছে কুয়াশার আস্তরণে
শবের ব্যারিকেড; ওদের মিছিল এখনো এগোয়নি
নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে।
(তরফদার ১৯৭৬ : ১৩৯)
আরেক কবিতায়—নাম ‘অন্য রূপ’—তরফদার সাহেব ‘বোদলেয়ারীয় বিতৃষ্ণার উৎস’ অনুসন্ধান করিতেছেন পারি নগরীর অন্তঃপাতী ধন ও দারিদ্রের বৈপরীত্যের মধ্যে। তিনি দেখিতেছেন ‘ওপেরা-থিয়েটারটাতে কোনো কমেড়ির অভিনয় চলছে’ আর ‘ইমারৎটা আলোয় আলোয় জ্বলছে।’ সম্পদ ও বিপদ, বৈভব ও নিঃস্বতা একই সত্যের দুই প্রান্ত বৈ নয়। একপ্রান্তে আছে সম্পদ। যুগপদ বিপদের ফলন না ঘটাইয়া সম্পদ আপন পদে স্থির হইতে পারে না। সম্পদ তবুও সত্য বৈ নয়।
রেপুবলিকের মত আরো বহু এলাকায়
আলোকে আলোকে, শেরী, শ্যাম্পেন এবং কোনইয়াকে
যে রূপ জেগে আছে, তা নিরেট সত্য।
(তরফদার ১৯৭৬ : ১৩১)
সমস্যার মধ্যে, ঘটনার আরো এক প্রান্ত আছে—সেই প্রান্তে আছে বিপদ। সম্পদের ‘আরো এক রূপ আছে’—সেই রূপ কিন্তু ‘মুলারুজ্বে,’ ‘ইফেল টাওয়ারের আশেপাশে,’ ‘লুকসেমবুর্গ বাগানে,’ ‘ল্যাটিন কোয়ার্টারে,’ কিংবা ‘কোনো চঞ্চল অথবা ঘুমন্ত স্টেশনেও’ দেখা যায় না। একই অঙ্গের কি সেই অপরূপ রূপ?
উৎসবের হয়ত অতি কাছেই
আলোয়, অন্ধকারে, জীবনে, মৃত্যুতে
নির্বেদে, আনন্দে
অতি প্রাচীন ব্যাধি দগ্দগ্ করে জ্বলছে
নতুন ক্ষতের পরিপূর্ণ যন্ত্রণা নিয়ে।’
(তরফদার ১৯৭৬ : ১৩১)
‘অন্য রূপ’ কবিতার মাথায় মমতাজুর রহমান তরফদার বোদলেয়ারের ‘ঢাকনা’ নামক কবিতা হইতে দুইটি পংক্তি অলংকারস্বরূপ—না, ভুল বলিলাম, ইশতেহারস্বরূপ—স্থাপন করিয়াছিলেন।
Le Ciel ! Covuercle noir de la grande marmite
Où bout l’imperceptible et vaste Humanité.
(বোদলেয়র ১৯৭৫ : ১৪১)
আকাশ একটা আস্ত কৃষ্ণবর্ণ ঢাকনার মতন পৃথিবীকে চাপিয়া আছে, আর ইহার নিচে সীমাসরহদহীন অবয়বহীন মানবজাতি টগবগ সিদ্ধ হইতেছে—এই রূপকল্পের দেখা আমরা বোদলেয়রের ‘বিতৃষ্ণা’ নামের চার নম্বর কবিতাটিতেও একবার পাইয়াছিলাম। সেই কবিতায় শার্ল বোদলেয়র লিখিয়াছিলেন, যখন আকাশ ভারে আনত হইয়া ঢাকনার মতন নামিয়া আসে যন্ত্রণাকাতর দীর্ঘ বিতৃষ্ণায় বিদ্ধ মনুষ্যের মাথায় ইতি আদি।
Quand le ciel bas et lourd pèse comme un covuercle
Sur l’esprit gémissant en proie axu longs ennuis,
Et que de l’horizon embrassant tout le cercle
II nous verse un jour noir plus triste que les nuits;
(বোদলেয়র ১৯৭৫ : ৭৪)
শার্ল বোদলেয়ারের আরো ঢের ছাপ আছে তরফদারের কবিতায়। ফরাশি কবির Le Soleil বা ‘সূর্য’ কবিতাটির আলো বাঙালি কবিতা লেখকের ‘সূর্যের প্রণতি’ কবিতায় উজ্জ্বলতর হইয়াছে। আমরা এই নিবন্ধের পরিশিষ্টে দুই কবির কবিতাই পুরাপুরি তুলিয়া দিতেছি। এখানে আপাতত দুই কবির শেষ স্তবক দুইটি মাত্র পাশাপাশি পড়িতেছি। প্রথমে দেখি শার্ল বোদলেয়রের চারি পংক্তি:
Quand, ainsi qu’un poète, il descend dans les villes,
II ennoblit le sort des choses les plus viles,
Et s’introduit en roi, sans bruit et sans valets,
Dans tous les hôpitaxu et dans tous les palais.
(বোদলেয়র ১৯৭৫ : ৮৩)
[যখন এভাবে কবির মতন তিনি নামেন শহরে, অতি
তুচ্ছ পদার্থ যে তাহাকেও বানান মহান সন্ততি
নিরব নিঃসঙ্গ কোন রাজার মতন ধামাধরাহীন
আরোগ্য সদনে কি রাজপ্রসাদে কাটে নিরপেক্ষ দিন।]
তুলনীয় মমতাজুর রহমান তরফদারের ছয় পংক্তি:
একটি ধূসর হাত আজো ডাকে দুর্মর সঙ্কেতে;
কেননা আরেক বিশ্ব গড়ে ওঠে পলির ফসলে
যেখানে সবুজ, নীল, বহু রঙ নিরালম্ব জ্বলে।
প্রাচীন স্তূপের পাশে অনেকেই এসেছে সম্প্রতি—
সূর্যের বলয়ে বুঝি অনিবার্য মানবীয় গতি।
ইমারতে ভাঙা ঘরে, খেতে, মাঠে সূর্যের প্রণতি।
(তরফদার ১৯৭৬ : ১২৩)
মমতাজুর রহমান তরফদার আধুনিক বাংলা কবিতার যাহাকে বলে ‘মূলধারা’ তাঁহার মধ্যে প্রবেশ করিতে চাহেন নাই। তাহা সত্ত্বেও তিনি যে ভাষায় লিখিয়াছেন তাহা ১৯৩০ সালের পরের কবিদের ভাষাই। তিনি নতুন ভাষার সন্ধান করেন নাই। এখানেই তাঁহার কবিতা মার খাইয়াছে। কিন্তু তিনি মরেন নাই। তিনি নিজের জগতে যাহা চাহিয়াছেন তাহাতেও বাংলা কবিতার দিগন্ত আরো দূরে সরিয়া গিয়াছে। এই মহান ইতিহাস লেখকের ‘কবিতা-লেখক’ পরিচয়—হয়ত সম্পূর্ণ বিফলে যায় নাই।
দোহাই
১. আহমদ ছফা, আহমদ ছফার কবিতা, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত (ঢাকা : খান ব্রাদার্স, ২০১০)।
২. মমতাজুর রহমান তরফদার, চতুষ্ক (ঢাকা : মমতাজুর রহমান তরফদার, ১৯৭৬)।
৩. মমতাজুর রহমান তরফদার, বাংলা রোমান্টিক কাব্যের আওয়াধী-হিন্দী পটভূমি (ঢাকা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭১)।
৪. মো. মোফাখ্খারুল ইসলাম, ‘ভারত উপ-মহাদেশে ইংরেজ শাসন সম্পর্কে কার্ল মার্কস,’ সালাহউদ্দীন আহমদ গয়রহ সম্পাদিত, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ স্মারকগ্রন্থ (ঢাকা : বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষৎ, ১৯৯১), পৃ. ৩২২-৪৭।
৫. Charles Baudelaire, Oevures complètes, tome 1, texte établi, présenté et annoté par Claude Pichois (Paris : Éditions Gallimard, 1975).
৬. Momtayur Rahman Tarafdar, Husain Shahi Bengal 1494-1538 A.D.: A Socio-Political Study (Dacca : Asiatic Society of Pakistan, 1965).
সংযোজন
কালো মুখ
হানা দেয় একটি কালো মুখ
শার্সিভাঙা জীর্ণ জানালায়।
কিছুতেই ভাঙে না কৌতুক,
বারবার সে যে ফিরে চায়।
জানে না সে অথবা সে জানে
ছুঁয়ে ছুঁয়ে মাটির পাহাড়
বুক ভরে কি বিশাল গানে।
ক্ষুদ্র দেহ বিশ্বের প্রাকার।
পথ আজো নভ-চারী নয়;
কিন্তু এ সরণী করে ভেদ
সুদূরের সূর্য জ্যোতির্ময়।
এই গানে পড়ে নাক ছেদ।
পরাজিত নোংরা কালো মুখ
জানালায় এখানে উন্মুখ।
১৯ জুন ১৯৭৫
(তরফদার ১৯৭৬ : ৭৩)
জাগ্রত
আকাশের হ্রদে চাঁদ গলে গলে যায়
শরতের মেঘে ঈষৎ বজ্ররেখা।
লতাপাতাহীন অগণিত প্রশাখায়
নীরব অগ্নি এখন দিয়েছে দেখা।
বড় মহীরুহ সরবে গুটায় পাখা—
জেগে থাকে শুধু দিগন্তময় মরু।
রসকণাহীন ফুল, ফল, বহু শাখা—
সব গাছ মৃত; কোথায় কল্পতরু?
হ্যানয়-সায়গনে চলছে পলেস্তারা
ধ্বসে যাওয়া যত সুপ্রাচীন ইমারতে।
খামারেও ছিল শকুনির পাঁয়তারা—
সবুজ আলোক ভরবে কি মরকতে?
প্রতিশ্রুতির ফলকের গায়ে আলো—
বারবার এল বিমুখী প্রস্তাবনা।
ভোরের বাতাস পরিমেল ঝলসালো—
কালিক সিঁড়িতে কস্মিন সম্ভাবনা।
মুসার সিনায়ে এখন নতুন নবী—
চেয়ে দেখে শুধু খনিজ ফল্গুধারা।
নীলনদে ভাসে উটপক্ষীর ছবি—
মরুভূমি-রাতে জাগে তবু ধ্রুবতারা।
তিমোর-এ্যাঙ্গোলায় এখন অগ্নি উঠে;
লিসবন কাঁপে অভাবিত ভাবনায়।
কোন অলক্ষ্যে মাদ্রিদ এখন ছুটে—
পিরেনিজ বুঝি আলোকের সীমানায়।
লন্ডন, পারি, প্রাগ ও ভিয়েনা জাগে;
লক্ষ্মীপেচক এখন ওয়াশিংটনে।
শাম্পেন-শেরীতে বেয়ারের অনুরাগে
কর্নিয়া-আলো উদগত লিসবনে।
আপ্তবাণীর সমাহার মসিলেখা—
মার্কসের গোরে উইলোর শনশনি।
ভাল ভাল কথা বহু কাল আগে শেখা
—লেনিনের দেহ রঙিন প্রদর্শনী।
এখনো যাদের হৃদয় যায়নি মরে
তারা ত কেবল শবের সংখ্যা গণে।
দূর ও নিকটে শকুনিরা ভিড় করে;
কেউ ঢাকে হিয়া রক্তের আবরণে।
জীবন এখন পণ্যের বিনিময়—
আলোকের হ্রদে নামে কি অন্ধকার?
সত্য পুরুষ কোথায় দাঁড়িয়ে রয়?
তুলাদণ্ডের কোথায় সাম্যভার?
ঢাকা-দিল্লীতে শরতের মেঘে মেঘে
সাত্যিক বুকে আলোক ত ঢাকবে না।
নীরব বজ্র এখন রয়েছে জেগে;
বিবিধ প্রকার অন্ধকার যে চেনা—
স্তব্ধ ভলগা যদি ভুলে যায় গান,
হোয়াংহোর স্রোত যদিও বা হয় ম্লান।
১৯ আগস্ট ১৯৭৫
(তরফদার ১৯৭৬ : ১০৯-১১)
জলের ধারে
জলের ধারে যদি বা তুমি গেলে,
আবার কেন মাটির ঘরে এলে?
ভালই ছিল পাহাড়ী মৃদু ঢেউ,
আঙুল তুলে রুখত নাক কেউ।
নদীর আলো তন্বী স্বচ্ছতা;
আকাশ বেয়ে সরু আলোক-লতা।
জীবন দিয়ে কে পায় জলধারা?
স্বপ্নসিঁড়ি কোথায় ধ্রুবতারা?
অন্ধকারে যদি বা স্রোত বয়,
তুমি ত জান সে ত আলোক নয়।
দিবসরাত অন্ধ হাতী জাগে,
সবুজ গাছে কেবল খাদ্য মাগে।
নরম দেহে যদিও বায়ু ভাসে,
ধরবে তাকে সে কোন অভিলাষে?
অন্ধকারে আংটি খুলে রাখা,
পথের ধারে ভ্রুণ রক্তমাখা।
আজকে ভোরে জানালা খুলে দাও।
আকাশ, আভা আবার ফিরে নাও।
ঘরের পাশে বাউলি-সিঁড়ি বেয়ে
শেওলা-ঢাকা জলের ধারে মেয়ে
আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে দেখ।
আঁধারটুকু ঢেকেই তুমি রেখ।
১৪ জুন ১৯৭৫
(তরফদার ১৯৭৬ : ৬৮-৬৯)
সূর্যের প্রণতি
বারবার কলরব শোনা যায় রাস্তায় রাস্তায়
এবং শার্শিতে ভাসে স্বচ্ছ রোদে প্রাচীন পিপাসা।
মনে হয় বুঝি কোনো মানবিক সূর্যের উদয়ে
শস্যের বাগান আর প্রাণীদেহ পরিণতি পায়
বাঞ্ছিত আকারে আর পরিপূর্ণ জৈবিক সত্তায়।
শরীরে রৌদ্রের বৃষ্টি, প্রাণেরও প্রদেশে রোদ ঝরে;
কিন্তু আসে প্রাচীন বীজাণুগুলো দেহকোষ ভরে।
রোগের বিরাম নেই, প্রাণেরও যে নেই-ক সীমানা—
উত্তমর্ণ, অধমর্ণ একই বৃত্তে খুঁজেছে ঠিকানা।
স্বদেশে, বিদেশে আর অন্য গৃহে পূর্ণ প্রতিশ্রুতি;
তাই ত শরীরে-মনে আলোকের অবারিত গতি।
একটি ধূসর হাত আজো ডাকে দুর্মর সঙ্কেতে;
কেননা আরেক বিশ্ব গড়ে ওঠে পলির ফসলে
যেখানে সবুজ, নীল, বহু রঙ নিরালম্ব জলে।
প্রাচীন স্তূপের পাশে অনেকেই এসেছে সম্প্রতি—
সূর্যের বলয়ে বুঝি অনিবার্য মানবীয় গতি।
ইমারতে, ভাঙা ঘরে, খেতে, মাঠে সূর্যের প্রণতি।
২০ নবেম্বর ১৯৭৫
(তরফদার ১৯৭৬ : ১২৩)
খুলো না চুলের গুচ্ছ
মেলো না স্বপ্নের পাখা, খুলো না চুলের গুচ্ছ এখানে কুমারি;
কেন না আঁধারে কাঁপে মৃত্যুর উলঙ্গ তরবারি।
এখানে পাথর শুধু, মাটি নেই, নেই ত ঘাসের আলোছায়া;
নিরেট কুয়াশা ভরে জাগে শুধু পরিচিত, নগ্ন প্রেত কায়া।
বসে না গাছের ডালে রঙে রঙে পাখিদের ঝাঁক;
তরুণী হরিণীগুলি প্রাণহীন, বিস্ময়ে নির্বাক।
ঝরে না সূর্যের আলো সমুদ্রের রঙিন ফেনায়;
কাঁপে না নৌকার সারি মানবিক ছিন্ন নীলিমায়।
নিঃশব্দ কান্নায় ভাঙে আদিগন্ত নিরেট পাথর;
তৃষিত আকাশতলে পৃথিবীও কাঁপে থর থর।
ধূসর আকাশে সূর্য জাগে বটে অনেক প্রহর;
মৃত্যুর চোখের মত তারকারা অনন্ত ভাস্বর।
গোধূলির সীমা থেকে যদিও বা স্নিগ্ধ রাত্রি আসে
অনন্ত কান্নার স্রোত ভেঙে পড়ে আকাশে-বাতাসে
আর ঝরে আলকাতরার মত ঘন পুরু অন্ধকার
যে আঁধারে বহু আলোবর্ষ গড়ে মৃত্যুর পাহাড়।
এই বার রাখ হাত আলোকের লৌকিক হাতলে
যেখানে পৃথিবী জাগে বীজকম্প্র ফসলে ফসলে
এবং রৌদ্রের ধারা ঝরে পড়ে স্নিগ্ধ নীলিমায়
অথবা সঙ্গীত গায় বহু পাখি সবুজ আভায়।
তুমি ত দেখেছ বহু বার
উন্মুক্ত গানের নদী, অবারিত আলোকের ধার।
পাহাড়ে পাহাড়ে কাঁপে আলোকিত বরফের ঝড়;
খেতে, মাঠে, গানে গানে আলোয় আলোয় অনন্ত নির্ঝর।
খুলো না চুলের গুচ্ছ পৌরাণিক নদীটির তীরে;
আলোর মতন হাত রাখ এই আলোর শরীরে।
১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬
(তরফদার ১৯৭৬ : ১৪১-৪২)
Le Soleil
Charles Baudelaire
Le long du vieux faubourg, où pendent aux masures
Les persiennes, abri des secrètes luxures,
Quand le soleil cruel frappe à traits redoublés
Sur la ville et les champs, sur les toits et les blés,
Je vais m’exercer seul à ma fantasque escrime,
Flairant dans tous les coins les hasards de la rime,
Trébuchant sur les mots comme sur les pavés
Heurtant parfois des vers depuis longtemps rêvés.
Ce père nourricier, ennemi des chloroses,
Eveille dans les champs les vers comme les roses;
II fait s’évaporer les soucis vers le ciel,
Et remplit les cerveaux et les ruches de miel.
C’est lui qui rajeunit les porteurs de béquilles
Et les rend gais et doux comme des jeunes filles,
Et commande aux moissons de croître et de mûrir
Dans le coeur immortel qui toujours veut fleurir!
Quand, ainsi qu’un poète, il descend dans les villes,
II ennoblit le sort des choses les plus viles,
Et s’introduit en roi, sans bruit et sans valets,
Dans tous les hôpitaux et dans tous les palais.
(Charles Baudelaire 1975 : 83)