রবিকবি : আকাশতলে ফুটে ওঠা আলোর শতদল

Looks like you've blocked notifications!

জীবনদেবতার বর চেয়েছিলেন কবি, অন্তর মম বিকশিত করো, নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো, জাগ্রত করো, উদ্যত করো, মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে। আশি বছরের জীবনসাধনায় কবি নিরলসভাবে ধ্যান ও জ্ঞানের বাণীতে আমাদেরকে ব্যাপৃত রেখেছেন। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, অন্তরতর কবির চাওয়ার চেয়ে খানিকটা বেশিই দিয়ে রেখেছিলেন। কবি চেয়েছিলেন, ঈশ্বরের ছন্দে সুশান্ত কবি সবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তির দেখা পান। নন্দিত হওয়ার প্রত্যাশাও ছিল কবির। কিন্তু রবিকবি তাঁর চর্চিত জীবন দিয়ে আমাদের যে বিস্ময় উপহার দিয়েছেন তা সকল প্রত্যাশাকেই ছাপিয়ে গেছে। যুগশ্রেষ্ঠ এই বিশ্বকবি এক অবিশ্বাস্য আনন্দধাম আবিষ্কার করেছিলেন। যেই ধামে বসে আঁধারবিনাশী এক অনির্বচনীয় আলোকসাধনায় মনুষ্যত্বের জয়গান করেছেন। যেই শিক্ষাটা তিনি তাঁর প্রাণের ভক্তদের মাঝেও ছড়িয়ে গেছেন আর বলে দিয়ে গেছেন, ‘সমস্তই ওই মনুষ্যত্বের শিক্ষার অধীন’! কবিগুরুর গীতাঞ্জলি তাঁর গুণমুগ্ধ শিষ্যদের সেই সাক্ষ্যই দেয় :

আকাশতলে উঠল ফুটে/ আলোর শতদল/ পাপড়িগুলি থরে থরে/ ছড়ালো দিক-দিগন্তরে,/ ঢেকে গেল অন্ধকারের/ নিবিড় কালো জল।/ মাঝখানেতে সোনার কোষে/ আনন্দে, ভাই, আছি বসে-/ আমায় ঘিরে ছড়ায় ধীরে/ আলোর শতদল।

আমাদের এই দার্শনিক কবি মানবজীবন পড়তে জানতেন। আর সেই পাঠাভ্যাসে যে নিজের জীবনকাব্যই বহুলচর্চিত তা কে না জানে? না হয় এই কাব্য লিখবার কাল ঘনঘোর শ্রাবণের সঙ্গে উত্তরকালের ট্রাজিক শ্রাবণ এভাবে মিলে যায় কেমন করে? কবি ওই শ্রাবণেই মহামরণ পারে উড়ে যেতে চান কীভাবে? এ যে অবিস্মরণীয় জাদু বাস্তবতা। ২৩ শ্রাবণ ১৩১৭ সালে কবি তাঁর প্রভুর উদ্দেশ্যে কী দারুণ নৈবেদ্য দেন এভাবে :

একটি নমস্কারে, প্রভু,/ একটি নমস্কারে/ সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক/ তোমার এ সংসারে/ হংস যেমন মানস-যাত্রী/ তেমনি সারা দিবস-রাত্রি/ একটি নমস্কারে, প্রভু,/ সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক/ মহামরণ-পারে।

আজ ২২ শ্রাবণ। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭৭তম প্রয়াণবার্ষিকী। আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই মহান কবিকে। বাংলা ভাষা খুঁড়ে যিনি আমাদের অমৃতের সন্ধান দিয়েছেন। সর্বমানবীয় বাঙালিয়ানাকে যিনি চিনিয়ে দিয়ে নিজের শেকড়ের অনুবর্তী থাকবার মন্ত্রণা দিয়েছেন। তাঁর অবিনশ্বর রচনাবলিতে অনাগত উত্তরাধিকার চোখ বুলালেই পেয়ে যাবে বাংলার জল, আকাশ বা পাতাদের অমূল্য ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পাতাভরে কবির বিচরণ আছে থাকবে। দেহাতীত কবি ভক্তের দিব্যদৃষ্টিতে চির আয়ুষ্মান। আক্ষরিক যে মরণ কবির দোসর ও শ্যামসমান সেই কবির মুখেই অমরত্বের কথা ভালো মানায়। যেমনটা ভানুসিংহ নিজেই স্বচ্ছন্দ্যে উচ্চারণ করেন :

মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান ।/  মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,/  রক্তকমলকর, রক্ত-অধরপুট,/  তাপবিমোচন করুণ কোর তব মৃত্যু-অমৃত করে দান ।

বৈশাখী ঝড়ের কাছ থেকে ধরাধামে আবির্ভাবের প্রেরণা নিয়ে এসে শ্রাবণের মেঘমেদুরতায় বিলিয়মান কবি জীবনের শেষদিককার আকুতি, মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’ই হলো তাঁর সত্যিকারের মৃত্যুঞ্জয়ী অভিভাষণ। এবং এটাই চিরসত্য যে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ শেখানো কবি আছেন, এইখানে আমাদের রোজকার দিনলিপিতে, সুগন্ধ বিলানো আমাদের চৈতন্যের ধূপকাঠিতে আর প্রাগ্রসর ভাবনায়। রবীন্দ্রকাব্যের আধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিসিজম, সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা ও ছন্দের আবেদনই হলো আমাদের সেই ভাবনার অনুপুঙ্খ নিদান।

আমাদের বাঙালি মানস নিজের শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তির ওপর ভরসা না করে পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে অভ্যস্ত। রবিকবি সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ ‘নৌকা’তে তাদের চরিত্র অঙ্কণ করেছেন এভাবে :

মানুষের মধ্যে এক একটা মাঝি আছে, তাহাদের না আছে দাঁড় , না আছে পাল, না আছে গুণ; তাহাদের না আছে বুদ্ধি, না আছে প্রবৃত্তি, না আছে অধ্যবসায়। তাহারা ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া স্রোতের জন্য অপেক্ষা করিতে থাকে।

বাংলাদেশে রোজ ঘটে চলে অপঘাতে কত মৃত্যু। এই যেমন সড়কসন্ত্রাসে দুই শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যু নিয়ে দেশব্যাপী শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী আন্দোলন চলছে। ওরা প্রতিবাদ করবার আগে এমন অকালমৃত্যু আমাদের প্রায় গা সওয়াই হয়ে গিয়েছিল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে নিজের স্বজন মারা গেলেও কারো যেন কোনো বিকার হতো না। আমাদের শিশু সন্তানরা আধমরা সেই বিবেকটা জাগিয়ে দিয়েছে। একজন মানুষ যে কেবল একজন মাত্র ব্যক্তিই নয়, প্রতিটি মানুষের আলাদা জগৎ আছে।  ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের খামখেয়ালিতে একজন মানুষকে অকালে বিদায় বলে দেওয়া মানে যে একটি জগৎ ধ্বংস করে দেওয়া রবিকবির চেয়ে ভালো করে আর কে বলেছে? কবি তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ ‘জগতের জন্ম-মৃত্যু’তে বলেন :

‘জগৎ একটি বই নয়। কিন্তু প্রতি লোকের এক একটি যে পৃথক জগৎ আছে, তাহাই গণনা করিয়া দেখ দেখি! কত সহস্র জগৎ! আমি যখন রোগযন্ত্রণায় কাতর হইয়া ছটফট করিতেছি তখন কেন জ্যোৎস্নার মুখ ম্লান হইয়া যায়, উষার মুখেও শ্রান্তি প্রকাশ পায়, সন্ধ্যার হৃদয়েও অশান্তি বিরাজ করিতে থাকে? অথচ সেই মুহূর্ত্তে কত শত লোকের কত শত জগৎ আনন্দে হাসিতেছে! কত শত ভাবে তরঙ্গিত হইতেছে! এক জন লোক যখন মরিয়া গেল,তখন আমরা ভাবি না যে একটি জগৎ নিভিয়া গেল। একটি নীলাকাশ গেল, একটি সৌর-পরিবার গেল, একটি তরুলতাপশুপক্ষী-শোভিত পৃথিবী গেল।’

কবি রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে সযতনে মনের বাগানবাড়ি চিনিয়েছেন। প্রেমাস্পদের প্রতি তাঁর প্রিয়জনের আচরণ কী হবে তার হদিস পাই কবিকথায়। আজকের ঘৃণার পৃথিবীতে ভালোবাসার বড় অভাব। আত্মস্বার্থনিমগ্ন মানুষ এখন আর প্রেমে সুখ খোঁজে না। ইচ্ছা অবদমনের বিকৃতিকে সে আরাধ্য করে নিয়েছে। কিন্তু একমাত্র অনিন্দ্য ভালোবাসাই পারে নিঃস্বার্থ সাধুসন্তুর ঘর চেনাতে। আমাদের রবিকবি তাঁর ‘মনের বাগান-বাড়ি’ প্রবন্ধে আছে এমন প্রীতিময় অমৃত বাণী :

‘যাহাকে তুমি ভালবাস তাহাকে ফুল দাও, কাঁটা দিও না; তোমার হৃদয়-সরোবরের পদ্ম দাও, পঙ্ক দিও না। হাসির হীরা দাও, অশ্রুর মুক্তা দাও; হাসির বিদ্যুৎ দিও না, অশ্রুর বাদল দিও না। প্রেম হৃদয়ের সারভাগ মাত্র। হৃদয় মন্থন করিয়া যে অমৃতটুকু উঠে তাহাই। …নিজের মনের সর্বাপেক্ষা ভাল জমিটুকু অন্যকে দেওয়ায়, ভালবাসা ছাড়া অমন আর কে করিতে পারে? তাই বলিতেছি ভালবাসা অর্থে আত্মসমর্পণ করা নহে, ভালবাসা অর্থে ভাল বাসা, অর্থাৎ অন্যকে ভাল বাসস্থান দেওয়া, অন্যকে মনের সর্ব্বাপেক্ষা ভাল জায়গায় স্থাপন করা। যাঁহাদের হৃদয়কাননের ফুল শুকাইয়াছে, ফুলগাছ মরিয়া গিয়াছে, চারি দিকে কাঁটাগাছ জন্মিয়াছে, এমন সকল অনুর্বরহৃদয় বিজ্ঞ বৃদ্ধেরাই ভালবাসার নিন্দা করেন।’

রবিকবির ভালোবাসার বন্দনা তাই অনন্য ও অদ্বিতীয়।

ভালোবাসি, ভালোবাসি—

এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি॥

আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে,

দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখির জলে যায় ভাসি॥

ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠসন্তান মানুষের সাধনায় বাউল কবি রবীন্দ্রনাথ ‘সমাপণ’ প্রবন্ধে নিজের ভাবনাগুলি কোনো এক প্রেমাস্পদকে নৈবেদ্যরূপে সমর্পণ করেন। ‘এ ভাবগুলির সহিত তোমাকে আরো কিছু দিলাম , সে তুমিই দেখিতে পাইবে! সেই গঙ্গার ধার মনে পড়ে? সেই নিস্তব্ধ নিশীথ? সেই জ্যোৎস্নালোক? সেই দুই জনে মিলিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ? সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা? সেই দুই জনে স্তব্ধ হইয়া নীরবে বসিয়া থাকা? সেই প্রভাতের বাতাস, সেই সন্ধ্যার ছায়া! এক দিন সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, শ্রাবণের বর্ষণ, বিদ্যাপতি গান? তাহারা সব চলিয়া গিয়াছে ! কিন্তু আমার এই ভাবগুলির মধ্যে তাহাদের ইতিহাস লেখা রহিল। এই লেখাগুলির মধ্যে কিছু দিনের গোটাকতক সুখ দুঃখ লুকাইয়া রাখিলাম, এক-একদিন খুলিয়া তুমি তাহাদের স্নেহের চক্ষে দেখিও, তুমি ছাড়া আর কেহ তাহাদিগকে দেখিতে পাইবে না! আমার এই লেখার মধ্যে লেখা রহিল -এক লেখা তুমি আমি পড়িব, আর এক লেখা আর সকলে পড়িবে।

হে প্রিয় কবি আজ ২২শে শ্রাবণ। প্রিয়াস্পদের বিয়োগ ব্যথায় আকাশের মুখ ভার। গাল গড়িয়ে ভূমিতে লুটাল কি একফোঁটা অশ্রুজল? হে আলোকের ঝর্ণাধারা, দেখো তোমার এক লেখা আমি পড়ছি আর এক লেখা তুমি!

সুর গিয়েছে থেমে, তবু—

থামতে যেন চায় না কভু—

নীরবতায় বাজছে বীণা

বিনা প্রয়োজনে।