গল্প

গল্পটি রতনের, পতাকারও

Looks like you've blocked notifications!

ওর নাম রতন। নামের আগে-পরে কিছু নেই। পুরো নাম মোহাম্মদ রতন মিয়া নাকি রতন কুমার দাস, সেটাও কেউ জানে না। মায়ের আংশিক সুলুক জানলেও, বাপের ঠিকুজি কারো জানা নেই। কারণ ওর মা ছিল বদ্ধ উন্মাদিনী। রাস্তায় রাস্তায় ছেঁড়া কাপড় পরে ঘুরে বেড়াত। একদিন সেই পাগলি গর্ভবতী হলো। মফস্বল শহরে তখন সেটি একটা রসালো খবর ছিল বটে! কে ওর সর্বনাশ করেছে? পাগলির নামও জানত না কেউ। একদিন হঠাৎ রেল জংশনের প্ল্যাটফর্মে উদয় হয়। গ্রামগঞ্জ থেকে কতজনই তো আসে-যায়। পাগলিও সেইভাবেই এলো। থেকে গেল অন্য অনেকের মতো বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে।

ছোট্ট ময়মনসিংহ শহরের গাঙ্গিনারপাড় এলাকা। চার রাস্তার ট্রাফিক মোড়ের পাশেই চুন্নু মিয়ার রুটির দোকান। দোকানের পাশের ফুটপাতে পাগলির সংসার। সংসার বলতে পুরোনো খবরের কাগজ, ফেলে দেওয়া টুকরো কাপড়, ছোট-বড় প্লাস্টিকের  ঠোঙা, দুর্গন্ধময় কাঁথার স্তূপ। চুন্নু মিয়ার ছিল এক বিচিত্র সংস্কার। বিশ্বাসও বলা যায়। সেই শুরু থেকে তা দেখে আসছে পাড়া-মহল্লার সবাই। ভোরে দোকান খোলে চুন্নু মিয়া। দোকানের প্রথম রুটিটি ছুড়ে দেয় সে কাকের উদ্দেশে। দ্বিতীয়টি কুকুরের দিকে। ফলে বংশপরম্পরায় কাকেরা রাত থাকতে থাকতেই সেই রুটির দোকানে হানা দেয়। আশপাশে কা কা শব্দে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে থাকে। বাপদাদার সেই পথ অনুসরণ করে আসছে শহরের নেড়ি কুকুরগুলোও। এই রুটি খাওয়ানোর কথা চু্ন্নু মিয়াকে জিজ্ঞাসা করলে বলত, ‘আল্লাতাল্লার দুনিয়ায় দানদক্ষিণায় খুঁটে খাওয়া দুইটা প্রাণীকে খাইয়ে তবেই ব্যবসা শুরু করি। এতে আল্লাহ্‌ করিমের নেক নজর পাই।’ এর মধ্যে একদিন পাগলি এসে হাজির হয় সেখানে। কাকের ভাগটা বসাতে না পারলেও কুকুরেরটা ঠিক ছোঁ মেরে খুবলে নেয়। রীতিমতো আপদ এসে জোটে যেন। এটা আর কত সহ্য করবে কুকুরের দল? শহরের মানুষেরা দেখে যায়, কুকুরের সঙ্গে পাগলির রুটি নিয়ে কাড়াকাড়ি। ওই দিনগুলোর কোনো একদিনে পাগলির পেটে এলো রতন।

রতনের বয়স তখন চার মাস কয়েক দিন হবে। সেদিন কোনো বিশেষ দিন ছিল না। অন্য আর সব দিনের মতো একদিন ভেদবমি করে রাস্তার পাশে হাঁ করে পড়ে থাকে পাগলি। অগোছালো ফুটপাতের সংসারের ওপর পড়ে থাকে তার নিথর দেহ। মুখের চারপাশে ভনভন করে কালো কালো মাছি। পাশেই অভুক্ত শিশুর আর্তচিৎকার। প্রাতঃভ্রমণে বের হওয়া মানুষের দল দেখে যায় এ দৃশ্য। আর জোর কদমে পাশ কেটে হেঁটে যায়। পাছে কোনো আপদ এসে না জোটে!

চুন্নু মিয়ার দোকানেই কাজ করে মর্জিনা। কাজ তার থালাবাসন ধোয়া। সেই মর্জিনাই এসে কোলে তুলে নেয় কান্নারত শিশুটিকে। আগের দিনের বাসি ভাতের ফ্যান দেয় শিশুর মুখে। শিশুর কান্না থামে। রেলওয়ে বস্তিতে মর্জিনার একটি খুপরি ঘর আছে। সংসারে তার ছোট দুই ছেলেমেয়ে। স্বামী আবদুল রিকশা চালায়। অভাবের ঘরে আরো একটি বাড়তি পেট জুটল। গালমন্দ, মারপিট, কান্নাকাটির দীর্ঘ পর্ব চলল মর্জিনা ও আবদুলের মাঝে। অবশেষে সেই ঘরেই ঠাঁই মিলল রতনের।

রতনের নামটি প্রথমে রতন ছিল না। বলতে গেলে কিছুই ছিল না। যে যার খুশিমতো নামে ডাকত। সেই মনগড়া নামেই দু-তিন দিন ধরে চলত তার পরিচয়। রতন তখন হামাগুড়ি দেয়। একদিন সিটি কলেজিয়েট স্কুলের বাংলার স্যার হারাধন মজুমদার এলেন চুন্নু মিয়ার দোকানে চা খেতে। মর্জিনার পাশে তখন খেলা করছিল নামহীন শিশুটি। এ দেখে হঠাৎ মনের খেয়ালে হারাধন স্যার আওরাতে থাকেন কবি গগন হরকরার সেই উক্তি, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।’ মর্জিনা পাশেই ছিল। কথাটা শুনে সে জিজ্ঞাসা করে, ‘মাস্টার সাব, এই কথাডার মানে কী?’

হারাধন স্যার কথাটির মর্মার্থ তাকে বুঝিয়ে বলেন। শুনে আপ্লুত হয় মর্জিনা। কোলের শিশুটির সেদিন নামকরণ হয় রতন।

এরপর পার হয়ে গেল অনেক শীত-বর্ষা। পড়াশোনা করলে রতন এখন ক্লাস সেভেনে পড়ত। মর্জিনার শরীরেও আর আগের মতো শক্তি-সামর্থ্য নেই। তাই ঘরে বসে সেলাইয়ের কাজ করে। বাসের তলায় বাঁ পা হারিয়ে ঘরে বসা আছে আবদুল সেই কবে থেকেই। তখন ফুটবল বিশ্বকাপ চলছে। মর্জিনা ঘরে বসে দেশি-বিদেশি পতাকা বানায়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মান, ফ্রান্স—কত রঙবেরঙের ছোট-বড় বাহারি পতাকা। সঙ্গে আছে লাল-সবুজের বাংলাদেশের পতাকাও। ওই পতাকা ফেরি করে বিক্রি করে রতন।

—পতাকা নেবেন, পতাকা?

হাতে ধরা লম্বা বাঁশ। সেই বাঁশের গায়ে গিঁট দিয়ে বাঁধা পতাকার সারি। কাঁধের ওপর সেটি ফেলে রতন হাঁক দেয় রাস্তায় রাস্তায়, ঘুরে বেড়ায় পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে। বাতাসে পতপত ভেসে বেড়ায় পতাকার সারি।

—পতাকা কত?

—একশ টাকা।

—বলিস কী রে? এত টাকা? কত হইলে দিবি বল?

—দশ টাকা কম রাখতে পারি? নব্বই টাকা।

—পঞ্চাশ টাকায় হবে?

রতনের উত্তর—না মামা। আশি টাকা হইলে নিতে পারেন।

অবশেষে সত্তর টাকায় দফারফা হলো। ছেলেটি ব্রাজিলের একটি পতাকা নিল।

এবার এক মেয়ের ডাক। এই পতাকাওয়ালা, আর্জেন্টিনার ফ্ল্যাগ কত?

—আপা, একশ টাকা।

—কম হবে?

—নব্বই টাকা দেন।

অবশেষে আশি টাকায় বিক্রি হলো আর্জেন্টিনার পতাকা। এরপর জার্মানি, ফ্রান্স একে একে সব বিদেশি পতাকা বিক্রি হয়ে গেল। নির্লিপ্তভাবে বাঁশের গায়ে ঝুলে রইল কেবল বাংলাদেশের পতাকাগুলো। সেগুলো কেউ কিনল না। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় রমনা পার্কের একটি বেঞ্চে বসে থাকে রতন। পাশে কাত করে রাখে পতাকা লাগানো বাঁশটি। সেইদিকে তাকিয়ে থাকে সে। মনে মনে ভাবে, সব দেশের পতাকাই বিক্রি হলো, তবে নিজের দেশের পতাকা কেউই নিল না। আহারে বাংলাদেশ!

এমন সময় জোর বৃষ্টি নামে। সেই বৃষ্টিতে ইচ্ছে করেই ভেজে রতন। বৃষ্টির জলে স্নান করতে তার ভালো লাগে। সারা দিনের ক্লান্তি ধুয়ে দেয় সেই জলে।

কাদাময় রাস্তা পেরিয়ে ভেজাকাক হয়ে রমনা থেকে বস্তির পথে হাঁটতে থাকে রতন। পথে পথে হাঁক দেয়, ‘পতাকা নেবেন নাকি, পতাকা?’ সেই ডাকে অনেকে তাকায়। কেউ কেনে না। অবশিষ্ট পতাকা নিয়ে ঘরে ফেরে সে। ঘরে এসে দেখে মা নেই। সেলাই মেশিনের পাশে বেশ কিছু বিদেশি পতাকা তৈরি করা আছে। পাশের ঘরের সবিতা মাসির কাছে শুনতে পায়, মর্জিনা গেছে কিশোরগঞ্জ। বড় মামার মরার খবর শুনে সেখানে ছুটেছে বোন মরিয়মকে নিয়ে। বড় ভাই মানিক সেখানেই থাকে। মামার মুদির দোকানে কাজ করে। বাড়িতে আছে কেবল পঙ্গু বাবা। ঘরে ঢুকতেই বাবা বলেন, কী রে, আজ কত বিক্রি হলো?

রতন উত্তর দিল, এগারোশ আশি টাকা।

—টাকাগুলো আমারে দে।

রতন জানে বাবার কাছে টাকা দিলেই সে চোলাই মদ খাবে। গাঁজা টানবে। মায়েরও কড়া নিষেধ আছে। টাকা-পয়সা বাবার হাতে দেওয়া চলবে না। রতন টাকা দেয় না। আবদুল খেপে ওঠে। হাতে ধরা স্ক্র্যাচটা দিয়ে আচ্ছামতো পেটাতে থাকে রতনকে। রতন কেবল মার ঠেকিয়ে যায়। একসময় দৌড়ে পালায়। অনেক রাতে ঘরে ফেরে রতন। ঘর তখন বাইরে থেকে তালা দেওয়া। বাবা কোথায় গেছে, জানা নেই। তালা ভেঙে ঘরে ঢোকে সে। পেটে তখন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। হাঁড়িতে একদানা ভাতও নেই। সব খেয়ে ফেলে গেছে আবদুল। খিদেয় শরীরটা কাঁপতে থাকে। পকেটে যদিও টাকা আছে। কিন্তু সেই টাকা সে খরচ করে না। প্রতিদিনের মতো এসে মায়ের হাতে তুলে দেয়। এক পয়সা নিজের জন্য খরচ করে না। ঘরের এক কোণে সিলভারের কলসি। সেখান থেকে এক গ্লাস জল খায় সে। হঠাৎ বড় শীত অনুভূত হয়। গলা কাটা পাঁঠার মতো থরথর করে কাঁপতে থাকে পুরো শরীর। জড়সড় হয়ে ঘুমুতে যায় মাটিতে পাতা চটাইয়ে। পিঠে-পায়ে মারের ব্যথা টনটন করতে থাকে। রাত বাড়তে থাকে। সেইসঙ্গে বাড়তে থাকে জ্বরের উত্তাপ। একের পর এক কাপড় টানতে থাকে রতন। একের পর এক গায়ে জড়াতে থাকে ঘরে থাকা কাঁথা, পতাকা, টুকরো কাপড়। জ্বর থামে না। রতনের মনে হতে থাকে, সে বুঝি মারা যাচ্ছে। মা, মা বলে ডাকতে থাকে অস্ফুট স্বরে। জ্বরের ঘোরে গোঙাতে থাকে। হঠাৎই বেড়ার পাশে দাঁড় করানো বাঁশটি তার পাশে ধপ করে মাটির ওপর পড়ে। সেখান থেকে পতাকা টেনে গায়ে জড়ায় রতন। এই প্রথম সে ওম অনুভব করতে থাকে। মনে হতে থাকে, কে যেন টান মেরে শরীর থেকে জ্বরটি ছুড়ে ফেলে দিয়েছে দূরে কোথাও। যেন, মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে সে। খুব ক্লান্ত লাগে তার। লাল-সবুজের উষ্ণতায় কখন ঘুমিয়ে পড়ে রতন, টেরই পায় না।