টঙ্ক আন্দোলন
টঙ্কবিরোধী হাজং বিদ্রোহ
বাংলাদেশ ও আসামের সীমান্ত রক্ষা করে চলেছে একটি পাহাড়। এটিই গারো পাহাড় নামে অধিক পরিচিত। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা আর জামালপুর—এই তিনটি মহকুমা এই পাহাড়ের গায়ে এসে মিশেছে। গারো আদিবাসী নাম থেকেই এই পাহাড়ের নামকরণ হলেও হাজং, বানাই, ডালু, কোচ, বংশী প্রভৃতি নানা জাতির মানুষ দীর্ঘকাল থেকে এই পাহাড় অঞ্চলে বসবাস করে আসছে।
সুসং দুর্গাপুরের জমিদাররা দীর্ঘদিন ধরে এই গারো পাহাড় ও পাহাড় অঞ্চলের মালিকানা ভোগ করে আসছিল। আর এখানে বসবাসরত গারো, হাজং প্রভৃতি আদিবাসীরা সুসং দুর্গাপুরের জামিদারদের তাদের মালিক বলে মানত। কিন্তু তখন প্রজা হিসেবে তাদের ভিটামাটি বা জমির ওপর কোনো খাজনা দিতে হতো না। এ নিয়ে সে সময় জমিদারদেরও কোনো দাবি ছিল না।
একসময় গারো পাহাড়ের এই অরণ্য সম্পদের দিকে দৃষ্টি পড়ে ব্রিটিশ বণিকদের। ফলে গারো পাহাড় অঞ্চলের ওপর তারা তাদের মালিকানার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ নিয়ে জমিদারদের সঙ্গে চলে মামলাও। মামলায় সুবিধা করতে না পেরে ব্রিটিশরা প্রিভী কাউন্সিলের দ্বারস্থ হয়। সেখানেও হার মানতে হয় তাদের। অতঃপর কৌশলে ১৮৬৯ সালে তারা গারো পাহাড় অ্যাক্ট প্রণয়ন করে। পরে এই অ্যাক্টের জোরেই সমস্ত গারো পাহাড় অঞ্চল ব্রিটিশদের অধিকারভুক্ত হয়ে যায়। ফলে পাহাড় অঞ্চলের নানা সম্পদও তখন জমিদারদের হাতছাড়া হয়ে পড়ে।
এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সুসং জমিদারদের নজর পড়ে প্রজাদের জমির ওপর। অন্যান্য জায়গার মতো জমিদাররাও তখন খাজনার নতুন বিধান জারি করে। তবে প্রচলিত ব্যবস্থা থেকে সেটা ছিল একেবারেই ভিন্ন।
কী সেই খাজনার বিধান?
পরিবারগতভাবে খাজনা ধার্য না করে জমিদাররা এক একটি গ্রামের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা নির্ধারণ করে দেয়। একইসঙ্গে খাজনা আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় গ্রামের মোড়লদের ওপর। মোড়ল গ্রামের পরিবারগুলোর মধ্যে মোট খাজনার অংশ ধার্য করবে এবং যথাসময়ে তাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে তা জমিদারদের নিকট জমা দিবেন।
পূর্বপুরুষদের আমল থেকে ভোগ করে আসা জমির খাজনা দিতে হবে—এ নতুন ব্যবস্থা সহজভাবে নিতে পারে না আদিবাসীসহ বসবাসরত অন্যান্য প্রজারা। তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। ক্রমেই তা দাবানলের মতো সমগ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যা একসময় সশস্ত্র অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এতে ব্যাপকভাবে অংশ নেয় হাজং আদিবাসীরা। তাই একে হাজং বিদ্রোহও বলা হয়ে থাকে। চার অঞ্চল থেকে চারজন হাজং কৃষক নেতা এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন গোঁড়া চাঁদ। ১৮৯০ সালে ঘটে যাওয়া এই বিদ্রোহ নিয়ে খুব একটা তথ্য ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ওই সংগ্রামই পরবর্তী বিদ্রোহগুলোর প্রেরণা জুগিয়েছিল।
এরপরই সংগঠিত হয় টঙ্ক আন্দোলন, যা ছিল ব্রিটিশ-ভারতের সর্বশেষ গণআন্দোলন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার গারো পাহাড়ের পাদদেশে সুসং-দুর্গাপুর এলাকায় সংগঠিত হয়েছিল এ আন্দোলন। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নারী-পুরুষ-শিশুসহ অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। পাকিস্তান আমলেও বেশ কিছুদিন এই আন্দোলন অব্যাহত থাকে।
টঙ্ক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সুসং-দুর্গাপুরের জমিদার সন্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ। এ আন্দোলন সংগঠিত করে হাজং আদিবাসীরা। টঙ্ক আন্দোলনে যে সকল লড়াকু বীর শহীদ হন, তাদের মধ্যে রাসমণি অন্যতম। তিনিই টঙ্ক আন্দোলনের প্রথম শহিদ। তিনি টঙ্ক ও কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রীও ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে জানার আগে টঙ্ক বিষয়টি পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন।
টঙ্ক মানে ধান কড়ারী খাজনা। হোক বা না হোক কড়ার মতো ধান দিতে হবে। টঙ্ক জমির ওপর কৃষকদের কোনো স্বত্ব ছিল না। ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে কলমাকান্দা, দূর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ি, শ্রীবর্দ্দি থানায় এই প্রথা প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে সুসং জমিদারি এলাকায় এর প্রচলন ছিল ব্যাপক। টঙ্ক স্থানীয় নাম। এই প্রথা বিভিন্ন নামে ওই সময় পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত ছিল। যেমন- চুক্তিবর্গা, ফুরণ প্রভৃতি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও প্রচলিত ছিল ওই প্রথার। তবে সুসং জামিদারি এলাকায় যে টঙ্ক ব্যবস্থা ছিল তা ছিল খুবই কঠোর। সোয়া একর জমির জন্য বছরে ধান দিতে হতো সাত থেকে পনের মণ। অথচ ওই সময়ে জোত জমির খাজনা ছিল সোয়া একরে পাঁচ থেকে সাত টাকা মাত্র। তখনকার সময়ে ধানের দর ছিল প্রতিমণ সোয়া দুই টাকা। ফলে প্রতি সোয়া একরে বাড়তি খাজনা দিতে হতো—এগার থেকে প্রায় সতের টাকা।
এই প্রথা শুধু জমিদারদের ছিল তা নয়। মধ্যবিত্ত ও মহাজনরাও টঙ্ক প্রথায় লাভবান হতেন। একমাত্র সুসং জমিদাররাই টঙ্ক প্রথায় দুই লক্ষ মণ ধান আদায় করতেন, যা ছিল এক জঘন্যতম সামন্ততান্ত্রিক শোষণ।
মণি সিংহ তাঁর জীবন সংগ্রাম গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এই আন্দোলনের ইতিহাস। সুসং জমিদারেরা গারো পাহাড়ের অধিকার হতে বঞ্চিত হয়ে এই প্রথা প্রবর্তন করেন। জোতস্বত্ব জমির বন্দোবস্ত নিতে হলে প্রতি সোয়া একরে একশ টাকা থেকে দুইশ টাকা নাজরানা দিতে হতো। গরিব কৃষক ওই নাজরানার টাকা সংগ্রহ করতে সমর্থ ছিলেন না। কিন্তু টঙ্ক প্রথায় কোনো নাজরানা লাগত না। ফলে কৃষকের পক্ষে টঙ্ক নেওয়াই ছিল অধিক সুবিধাজনক।
প্রথম দিকে টঙ্কের হার এত বেশি ছিল না। কৃষকরা প্রথম যখন টঙ্ক জমি নেওয়ার জন্য এগিয়ে এলেন, তখন প্রতি বছর ওই সব জমির হার নিলামে ডাক হতো। এভাবে হার ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে। যে কৃষক বেশি ধান দিতে কবুল করত তাঁদেরই অর্থাৎ আগের থেকে বেশি ডাককারীর নিকট কৃষকের জমি ছাড়িয়ে নিয়ে হস্তান্তর করা হতো। এইভাবে নিলামে ডাক বেড়ে গিয়ে ১৯৩৭ সাল থেকে টঙ্ক হার সোয়া একরে পনের মণ পর্যন্ত উঠে যায়।
মণি সিংহের মনে প্রথম ভাবনা আসে টঙ্কের কঠোর নির্যাতন থেকে কৃষকদের বাঁচানোর। কৃষকদের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল বিশ্বাস। ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকের কথা। মণি সিংহ দশাল গ্রামে উপস্থিত হয়ে কৃষদের জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের প্রস্তাব করেন। কৃষকরাও রাজি হয়ে যায়।
প্রথম পরিকল্পনা হয় আন্দোলনের ধারা হবে অহিংস ও আইনসঙ্গত। ধান দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে—এটাই হবে মূল কাজ। কিন্তু সেটা সরাসরি বলা যাবে না। বললে খাজনা বন্ধের আন্দোলন বলে সরকার সেটা বেআইনি বলে ঘোষণা করবে। তাই কৌশলে বলতে হবে খাজনা দিতে চাই, তা জোত-স্বত্বের নিরিখ মতো। আন্দোলনের দাবী হবে—টঙ্ক প্রথার উচ্ছেদ চাই, টঙ্ক জমির স্বত্ব চাই, জোত-স্বত্ব নিরিখ মতো টঙ্ক জমির খাজনা ধার্য করতে হবে, বকেয়া টঙ্ক মওকুফ চাই, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ চাই প্রভৃতি।
সবার উদ্দেশে মণি সিংহ বলেন—কৃষকদের এক করো। ধান কেউ এক ছটাকও জমিদারদের দেবে না। বলবে জোতস্বত্বের নিরিখে খাজনা দেব। জমিদারদের পেয়াদা বরকন্দাজ জড়ো হলেও সকল গ্রামের সব লোক একত্রে তাদের মোকাবিলা করবে।
কৃষকরা এ খবর গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিতে থাকে। চলে বৈঠক ও মিটিং। ললিত সরকার ছিলেন হাজংদের নেতা। তাঁর মাধ্যমে আদিবাসী এলাকাতেও টঙ্ক আন্দোলনের প্রচার হতে থাকে। অল্পদিনের মধ্যেই দাবানলের মতো এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে টঙ্ক আন্দোলনের কথা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বসবাসরতদের ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবও তৈরি হতে থাকে।
ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে গারো পাহাড়ের পাদদেশে হাজং, গারো, বানাই, কোচ, ডালু প্রভৃতি আদিবাসীদের বাস। আদিবাসী এলাকার তিনটি মহকুমার ৫টি থানা ছিল আংশিক শাসনবহির্ভূত অঞ্চল। এখানে ললিত সরকার ছিল হাজং আদিবাসীদের নেতা। আন্দোলন সমানতালে মুসলিম ও আদিবাসী এলাকায় চলতে থাকলেও ক্রমে জমিদার ও জোতদারদের নানা কৌশলের কারণে তা গতিহীন হতে থাকে। একবার টন্কের খাজনা কিছুটা মওকুফসহ নানা সুবিধা প্রদান করা হয়। ফলে কৃষকরাও টঙ্ক আন্দোলনে আর সক্রিয় থাকে না।
এদিকে ব্রিটিশ সরকার দেখল এই অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ক্রমেই দানা বাঁধছে। তারা সতর্ক হলেন। অতঃপর গারো পাহাড়ের পাদদেশের ৫টি থানা—কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ি ও শ্রীবর্দ্দিতে ফসল উৎপাদনের হিসাব জরিপ করে সেখানে টঙ্কের হার বেশিরভাগ জায়গায় অর্ধেকে নামিয়ে আনেন। তা ছাড়া যার বছরে যে টঙ্ক খাজনা ছিল—তার সমপরিমাণ—বেশির পক্ষে আট কিস্তিতে তা পরিশোধ করে দিলে জমির স্বত্ব তার হয়ে যাবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এইভাবে টঙ্ক প্রথার কিছু সংশোধন আনা হয় ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তা সম্পূর্ণ বিলোপ করা হয় না।
চলবে...