বাংলায় দুর্গোৎসবের ইতিহাস
বাংলায় দুর্গোৎসবের প্রবর্তন কে কবে করেছিলেন, সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। বাংলায় যে দুর্গাপূজা প্রচলিত, তা মূলত মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা। মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ (রচনাকাল আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী)। এ ছাড়া দুর্গাপূজার কথা পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয় পুরাণ (মূল পুরাণটি চতুর্থ শতাব্দীর রচনা, তবে দুর্গাপূজার বিবরণ-সংবলিত সপ্তশতী চণ্ডী অংশটি পরবর্তীকালের সংযোজন), বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ (সঠিক রচনাকাল অজ্ঞাত), কালিকা পুরাণ (রচনাকাল নবম-দশম শতাব্দী) ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ-এ (রচনাকাল ১২শ শতাব্দী)। ৯ম-১২শ শতাব্দীর মধ্যকার সময়ে নির্মিত একাধিক মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি বাংলার নানা স্থান থেকে আবিষ্কৃতও হয়েছে।
একাদশ শতাব্দীর বাঙালি পণ্ডিত ভবদেব ভট্ট দুর্গার মাটির মূর্তি পূজার বিধান দিয়ে গেছেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে মিথিলার কবি বিদ্যাপতি ‘দুর্গা ভক্তি-তরঙ্গিণী’ ও বাঙালি পণ্ডিত শূলপাণি ‘দুর্গোৎসব-বিবেক’ বই দুটি থেকে দুর্গাপূজার কথা জানা যায়। অর্থাৎ, চতুর্দশ শতাব্দীতেই বাংলায় দুর্গাপূজা ছিল রীতিমতো ‘উৎসব’। দুর্গাপূজার প্রাচীনত্ব অনুধাবনে আরো একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ রঘুনন্দনের ‘দুর্গাপূজা তত্ত্ব’ গ্রন্থখানি। নবদ্বীপের এই স্মার্ত পণ্ডিতের লেখা গ্রন্থটিতে দুর্গাপূজার যাবতীয় বিধান রয়েছে। পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্র থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে পূজা পদ্ধতি লিখেছেন তিনি।
বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হলো পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা। দেবী মৃন্ময়ী ছিলেন মল্লভূম রাজ্যের রাজরাজেশ্বরীমূল্ল রাজবংশের কুলদেবী। মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন। এখানকার পূজা পদ্ধতি বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপূজার থেকে অনেকটাই আলাদা; কিছুটা আলাদা এখানকার দুর্গাপ্রতিমার গড়নও। মৃন্ময়ী দেবী সপরিবারা বটে, কিন্তু লক্ষ্মী-গণেশ ও কার্তিক-সরস্বতী এখানে স্থানবদল করে থাকে। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর স্থলে গণেশ ও গণেশের স্থলে লক্ষ্মী এবং কার্তিকের স্থলে সরস্বতী ও সরস্বতীর স্থলে কার্তিক। এই রূপে দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণের রীতিকে জগৎমল্ল-প্রথা বলা হয়। বাঁকুড়া জেলার অনেক প্রাচীন পরিবারেও জগৎমল্ল-প্রথায় নির্মিত দুর্গামূর্তি পূজিত হয়। মল্ল রাজবাড়ির পূজায় দেবী পটের যে ব্যবহার স্বতন্ত্র। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করেছিলেন।
কোনো কোনো ইতিহাসবেত্তা রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণের কথা উল্লেখ করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে মুঘল শাসনামলে বাংলার দেওয়ান রাজা কংসনারায়ণ নিতান্ত খ্যাতি লাভের নিমিত্তে আট লাখ ব্যয়ে ঘটা করে দুর্গাপূজা করেন। নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, বড়শিয়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরী, কোচবিহার রাজবাড়ি সর্বত্রই মহাসমারোহে দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। তাই বলা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীতেই দুর্গোৎসবের সূচনা।
ঢাকার দুর্গোৎসবের ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, ১৮৩০ সালে সূত্রাপুরে নন্দলাল বাবুর মৈশুণ্ডির বাড়িতে ঘটা করে আয়োজন করা হয় দুর্গাপূজার। দোতলা বাড়ির সমান উঁচু ছিল সে প্রতিমা। বিশ শতকের শুরুতে দুর্গাপূজা ছিল পারিবারিক। জমিদার বা ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা সেকালে পূজার আয়োজন করতেন। ত্রিশের দশকে শুরু হয় বারোয়ারি পূজা। আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরা সম্মিলিতভাবে পূজা করতেন। প্রথমদিকে কেবল বাবুগিরি ও ইংরেজদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্যই পালিত হতো এ উৎসব। বাবুদের সামাজিক মর্যাদা লাভের উপায়ও ছিল এ উৎসব! পূজায় ইংরেজদের আপ্যায়নের জন্য থাকত ব্র্যান্ডি, শেরি, শ্যাম্পেন। থাকত আমোদ-প্রমোদের সুব্যবস্থার অংশ হিসেবে বাইজি নাচ, কবিগান, চরস ও তামাকের ধোঁয়াও।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর দুর্গাপূজা হয়ে যায় সর্বসাধারণের উৎসব, তখন পূজা পালনে আসে ভিন্নতা। দেশভাগের পর বাংলাদেশে এককভাবে পূজা করাটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ নির্বিশেষে মিলেমিশে পূজা করার চল শুরু হয়। তবে এখনো পারিবারিক পূজার চল রয়ে গেছে বাংলাদেশের অনেক এলাকায়। পাকিস্তানি শাসনামলেও পূজার আনন্দে ভাটা পড়েনি। এ সময়ের পূজার স্মৃতিচারণ করেন মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি বাসুদেব ধর। স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি চলে যান সত্তরের দশকের দিনগুলোতে। তিনি বলেন, ‘পূজা শুরু হতো মহালয়া থেকে। মহালয়ার ভোরে সে কী ধুম! ভোরে রেডিও আকাশবাণী-তে কৃষ্ণ ভদ্রের দরাজ গলায় ‘মহালয়া’ শুনতাম পরিবারের সবাই মিলে। সে আসরের জন্য কত কী আয়োজন! সে দিন গেছে। তখন প্রতিমার নির্মাণের খরচ ছিল খুব কম। প্রতিমার সাজসজ্জা ছিল সাধারণ। ভ্যানে বা নৌকায় করে প্রতিমা আসত বাড়িতে। মায়েরা প্রতিমা বরণ করে নিতেন। এ গ্রাম-ও গ্রাম ঘুরে ঘুরে পূজা দেখতাম। অষ্টমী বা নবমীর সন্ধ্যায় হতো আরতি প্রতিযোগিতা। ঢাকের ঢেম কুড় কুড় ছড়িয়ে পড়ত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।’ স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শুরু হয় কেন্দ্রীয় দুর্গাপূজা। একে ঘিরেই চোখে পড়ে যত আয়োজন।