পুরাণ বা মিথ বলতে কী বোঝায়?
অভিধানে মিথ শব্দটির বাংলা অর্থ পুরাণ। কিন্তু এ শব্দ দুটি কি একই অর্থ বহন করে? এমন প্রশ্ন মিথ গবেষকদের, পুরাণ বিশ্লেষকদের। বরং আলোচনা শুরু করা যাক শব্দ দুটির মর্মার্থ নিয়ে।
পুরাণ শব্দটি সৃষ্ট পুরা+ন যোগে। ‘পুরা’ অর্থ পূর্বে বা প্রাচীনকালে এবং ‘ন’ অর্থ সংঘটিত বা জাত, অর্থাৎ পূর্বে সংঘটিত বা সৃষ্ট হয়েছে এমন কিছুকে পুরাণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে অভিধানে। বুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এ শব্দটি সংস্কৃত ‘পুরাতন’ থেকে এসে প্রাকৃত ‘পুরাণ’ শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ পুরাণের ধাতুগত অর্থ পুরাতন। সংস্কৃত শব্দজাত এ শব্দটির নানা অর্থ করা হয়েছে বিভিন্ন অভিধানে। যেমন : বিশেষ্যরূপে পুরাবৃত্ত, ইতিহাস, ইতিকথা, ইতিবৃত্ত শব্দগুলো এ শব্দের সম্পূরক অর্থ বহন করে। তেমনই বিশেষণরূপে প্রাচীন, পুরা, পুরোনো, পুরাতন, পুরাণ, অনাদি ইত্যাদি শব্দও প্রকাশ করে একই অর্থ। শব্দটিকে আখ্যান ও পূর্বতন এই দুই অর্থে গ্রহণ করা যায়।
তা ছাড়া অভিধানে আরো যেসব অর্থান্তর দেখানো হয়েছে তা হলো : প্রাচীনকাল থেকে পুরুষানুক্রমে প্রবহমান কাহিনী, বিশেষত কোনো জাতির আদি ইতিহাস-সম্পৃক্ত বিশ্বাস, ধারণা ও নৈসর্গিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যা। এককথায় অতিকথন বা গল্পকথা। কিন্তু হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে ‘পুরাণ’কে দেখানো হয়েছে বিশেষণরূপে। এর বুৎপত্তি স্থলে— পুরা ভবম্ ইতি পুরা+তন (ষ্টন), নিপাতনে ‘ত’-লোপ নত্ব নির্দেশ করা হয়েছে। অর্থ লেখা আছে ১. পুরাভব, পুরাতন, চিরন্তন ২. আদিম ৩. চিরন্তন, অনাদিসিদ্ধ ৪. পুরা, অর্থাৎ আকাশাদি সৃষ্টির পূর্ব্বেও নব ৫. প্রাচীন ৬. পূর্ব্ব ৭. বাসিত, পর্য্যুষিত। বিশেষ্যরূপে— ১. ব্যাসাদিরচিত সর্গাদি পঞ্চ লক্ষণ শাস্ত্রবিশেষ ২. পুরাণ কথা, প্রাচীনবৃত্ত ৩. পুরাণপুরুষ— আদিপুরুষ, বিষ্ণু ৪. ব্রহ্মা ইত্যাদি। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ পুরাণের অর্থ দেখিয়েছেন প্রায় এমনটিই।
উল্লিখিত অর্থের পাশাপাশি সেখানে আরো যেসব অর্থান্তর লেখা আছে, তা হলো : অনাদিপুরুষ, পরমাত্মা, পরমব্রহ্ম, বিষ্ণু ইত্যাদি। সুবলচন্দ্র মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’-এ ‘পুরাণ’ শব্দটির অর্থ পুরাতন, প্রাচীন, অনাদি ইত্যাদির পাশাপাশি লেখা আছে প্রাচীন কিংবদন্তিমূলক কাহিনী, mythology। ‘চলন্তিকা আধুনিক বঙ্গভাষার অভিধান’-এর মতে পুরাণ হলো প্রাচীন ইতিবৃত্ত ও কিংবদন্তিমূলক শাস্ত্রগ্রন্থ। ‘সংসদ বাংলা অভিধান’ও একই মত প্রকাশ করে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান’ উক্ত শব্দটির অর্থ করেছে প্রাচীনকালের সমাজ, ব্যক্তি ইত্যাদি বিষয় রচিত ধর্মমূলক আখ্যায়িকা বলে।
এবার আসা যাক, মিথ শব্দে। গ্রিক শব্দ ‘মিথস্’ থেকে ‘মিথ’ শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ গল্প, কিংবদন্তি। অন্যদিকে ল্যাটিন ভাষায় ‘মিথস্’ শব্দটির অর্থ হলো নির্দিষ্ট কোনো জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিদ্যমান অতিমানবীয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস। কারও মতে, গ্রিক ‘মুথোস’ শব্দ থেকে এসেছে ল্যাটিন মিথুস শব্দ। এ শব্দে নিহিত ছিল সংগীত ও কবিতার ধ্বনিময়তা। [সূত্র : নজরুলের কবিতায় মিথ ও লোকজ উপাদান, মাহবুব হাসান, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, বৈশাখ ১৪০৮/এপ্রিল ২০০১, পৃষ্ঠা : ১২]। কলকাতা ‘আকাদেমি অব ফোকলোর থেকে প্রকাশিত, ড. দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ’ বইয়ে ‘লোকপুরাণ’ ভুক্তিতে লেখা হয়েছে— “মানুষের আদিতম সাহিত্যকৃতি লোকপুরাণ—তথা মিথ্ সম্পূর্ণতই মৌখিক ঐতিহ্যানুসারী। গ্রিক শব্দ ‘মুথোস্’ [অর্থাৎ মুখ], ‘মিথ্’ এবং ‘মাউথ্’—দুই শব্দের উৎস। বর্ণমালা সৃষ্টির বহু সহস্র বছর আগেই আদিম লোকপুরাণের সৃষ্টি; প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রগুলির মধ্যে ঐ আদিম পুরাণগুলির হদিশ খুঁজে পাওয়া যায়; পরবর্তী সময়ে পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক পরিবেশে তাদের বাইরের কাঠামো বদলে যায় ধীরে-ধীরে, যদিও ভিতরের কাঠামোটি মোটামুটি অপরিবর্তিতই থাকে।”
মিথ প্রসঙ্গে বর্ণিক রায়ের লেখা ‘কবিতায়’ (পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা : ০৯) বইটির একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করা যেতে পারে— “প্রত্যেকটি সৃষ্টিই মিথ। আমরা যেমন মিথ সংগ্রহ করি, তেমনি আমরা মিথ তৈরি করি এবং মিথের মধ্যে অজ্ঞাতে প্রবেশ করি। ভাষা ও জগৎটা মিথের এবং দুয়ে মিলের জীবন।” ইতালির বিশিষ্ট সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ইটালো ক্যালভিনো (১৫ অক্টোবর ১৯২৩ - ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫)-এর মিথ সম্পর্কে একটি উক্তি আছে— Myth is the hidden part of every story, the buried part, the region that is still unexplored because there are as yet no words to enable us to get there. Myth is nourished by silence as well as by words.
এ কথাটির সমর্থন পাওয়া যায় বিশিষ্ট ব্রিটিশ ইতিহাসবেত্তা ফিলিপ ফার্নান্দেজ-আর্মেস্তোর লেখায়। তিনি ‘ওয়ার্ল্ড অব মিথস’ [ওয়ার্ল্ড অব মিথস, অনুবাদ : আসাদ ইকবাল মামুন, ঐতিহ্য, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৯] গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন— “কোনো জনগোষ্ঠীকে জানতে হলে, জানতে হবে তাদের মিথকে। কোনো জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে উপলব্ধি করতে হলে এটিকে দেখতে হবে তাদের চোখেই— অর্থাৎ মিথের মধ্য দিয়ে। কোনো সংস্কৃতির মূলভাবকে উপলব্ধি এবং মূল্যায়ন করতে হলে এর প্রতীকী ও পরোক্ষ উপস্থাপনাসমূহ উন্মোচিত করার কোনো বিকল্প নেই। মানুষের আচরণ তাদের জীবনের গাঠনিক সত্যতার চাইতে বেশি প্রভাবিত হয় তাদের বিশ্বাসের অলীকত্ব দ্বারা। মিথ হয়ে ওঠে বাস্তবতা, কারণ যদি মানুষ একে যথেষ্ট আবেগসহ বিশ্বাস করে, তবে তারা কাজ করে এর বশবর্তী হয়ে এবং তার জগৎকে নির্মাণ করে এর মতো করে।” মিথ নিয়ে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত-সুন্দর উক্তিটি করেন মার্কিন পুরাণবেত্তা ও লেখক জোসেফ জন ক্যাম্বেল (২৬ মার্চ ১৯০৪ - ৩০ অক্টোবর ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দ): Myths are public dreams, dreams are private myths. অর্থাৎ মিথ হচ্ছে জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক কল্পনা, আর কল্পনা হচ্ছে ব্যক্তিগত মিথ।
এখন কথা হচ্ছে, ‘মিথ’ ও ‘পুরাণ’ কি একই বিষয় নাকি ভিন্ন। বিষয়টি নিয়ে একটু গভীরে চিন্তা করা যেতে পারে। বাংলা ও ইংরেজি অভিধানগুলোতে মিথ ও পুরাণের যে অর্থ করা হয়েছে তাতে করে এ দুটো শব্দ একই অর্থ-দ্রুতি ও ব্যঞ্জনার্থ বহন করে। বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ এবং ‘ইংলিশ-বাংলা ডিকশনারি’ কিন্তু দুটোকে এক হিসেবেই দেখিয়েছে। এ দুই অভিধানেই পুরাণের অর্থ মিথ এবং মিথের অর্থ পুরাণ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে সাধারণের কাছে না হলেও পণ্ডিত মহলে চলমান আছে খানিক মতভেদ। কেউ দুটোকে এক বলার পেছনে যুক্তি দেখান, কেউ-বা মতপ্রকাশ করেন— এক না হলেও প্রায় কাছাকাছি, কেউ কেউ-বা দুটোকে আলাদা অর্থেই ব্যবহার করার পক্ষপাতী।
মিথ ও পুরাণকে এক অর্থে প্রয়োগ করতে ইচ্ছুক নন প্রাবন্ধিক কমলেশ চট্টোপাধ্যায়। তিনি তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যে মিথের ব্যবহার’ (মডার্ন বুক এজেন্সি, কলকাতা, ১৯৮০, পৃষ্ঠা : ১৫) বইয়ে উল্লেখ করেছেন— “আমাদের মনে হয় ‘পুরাণ’ শব্দটি দিয়ে মিথের গতিপ্রকৃতি যথার্থভাবে প্রকাশ করা যায় না, যদি ‘পুরাভব’, ‘পুরাতন’, ‘চিরন্তন’ পুরাণের এই যে অর্থগুলো— তার সঙ্গে মিথের একটি চরিত্র-লক্ষণ অবশ্যই মিলে যায়। ‘মিথ’ও আমাদের পুরাণ-এর মতোই একাধারে চির-পুরাতন ও চির-নূতন।” কিন্তু বৈপরীত্যের মাঝেও উপরি-উক্ত অভিধানসমূহ পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পুরাণ ও মিথের যে সংজ্ঞা পাওয়া যায় তাতে করে এ দুটোকে সম্পূরক অর্থবহনকারী শব্দ হিসেবে গণ্য করা যায় বৈকি।
পুরাণ বা মিথ যাই বলি না কেন তার স্রষ্টা হলো মানুষ। সৃষ্টির পর থেকে নানা পরিক্রমার মধ্য দিয়ে মানুষ তার মেধা ও মনন দিয়ে গড়েছে মানবসংস্কৃতি। আর এ সংস্কৃতির প্রসূতজাত এই মিথ বা পুরাণ। এখানে নাভি ছেঁড়ার কোনো বালাই নেই। ছিন্ন করার কোনো অবকাশ নেই। অতএব কল্পনার সিঁড়ি বেয়ে সামান্য বাস্তবতার কাছাকাছি আসার নামই পুরাণ বা মিথ। মিথ বা পুরাণকে বলা হয় সৃষ্টির গল্পরূপে, আদিকালের মানুষের ইতিহাসরূপে। উনিশ শতকে পুরাণকে মনে করা হতো অতিকথা, লোককথা, নীতিগল্প বা ফেবল, রূপক বা রূপকথা ইত্যাদি রূপে। কিন্তু এ ধারণা পাল্টে যায় বিশ শতকে এসে। পাশ্চত্য মনীষীরা পুরাণকে মূল্যায়ন করতে শুরু করতে থাকেন ভিন্ন এক আঙ্গিকে। তারা পুরাণ বা মিথের নানা সূত্র অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, সমাজ ভাবনা, আচার-অনুষ্ঠান, পোশাক-খাদ্যাভাস থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক চর্চার নানা অনুষঙ্গের ভেতর। অনেকের মতে সংস্কৃতি ও মিথ পরস্পরের বাহন ও পরিপূরক।
বিশ্লেষণটিকে একটু সহজবোধ্য করার জন্য আবার বর্ণিক রায়ের কাছে ফিরে যাওয়া যেতে পারে— “মিথ হচ্ছে একটি সমগ্র জাতির কলাসৃষ্টি; এই কলাসৃষ্টির মধ্যে মানুষের জ্ঞান কাজ করে, জ্ঞানকে সে ব্যাখ্যা করে সতেজ সজীবতায়, ছবির রূপে রঙে বেদনায় সংবেদনায় অনুভূতিতে। অভিজ্ঞতায় সে যে জ্ঞান পেয়েছে, সেই জ্ঞানকে এমনিভাবে ব্যাখ্যা করে। এর জন্যই এর ভাষা অনবরত পরিবর্তিত হয়, ভাষার পরিবর্তনের সঙ্গে ছবি ও রঙ পাল্টায়, ছবি ও রঙের সঙ্গে সুর ও ব্যাখ্যাও কিছু নতুন রূপ পায়। অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানে, জ্ঞানকে ছবির মধ্য দিয়ে আর এ অভিজ্ঞতায় ধাক্কা দেওয়াই মিথের কাজ। সুতরাং কবিরা যখন মিথ ব্যবহার করেন তখন এক সর্বজনীন সত্যকে লাভ করতে চান; কেন না মিথের মধ্যে গভীর সত্য প্রকাশিত হতে পারে সহজভাবে।”
বর্ণিকের এ কথাটির সমর্থন পাওয়া যায় বিশ শতকের অন্যতম কানাডিয়ান সাহিত্য-সমালোচক এবং সাহিত্য-তাত্ত্বিক হার্মান নরথ্রোপ ফ্রাই-এর একটি উদ্ধৃতিতে—“মিথকে যেমন সত্য কাহিনী বলে অনুভব করা যায়, লৌকিক গল্প কাহিনীকে তেমন করা যায় না। লোকগল্পে যেখানে জীবনের ‘মোটিফ’ বা জীবনের বহিরঙ্গ বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তোলা হয়, মিথ সেখানে জীবনের নিহিত অর্থের বা পরমার্থের সন্ধানী।” মিথের মূল প্রকরণগুলোর মধ্যে এক ধরনের বিশ্বজনীনতা রয়েছে, যা বিচার-বিশ্লেষণ করে সংস্কৃতি বিজ্ঞানীরা মোট চৌদ্দ রকমের মিথের কথা বলেছেন : ১. জগৎ সৃষ্টির রহস্য; ২. দেব-দেবীদের উদ্ভব; ৩. দেবতা ও দানবের দ্বন্দ্ব; ৪. মনুষের জন্ম; ৫. আত্মা; ৬. স্বর্গ-নরক-পাপ-পুণ্য; ৭. অগ্নির অধিকার লাভ; ৮. চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা; ৯. দিন ও রাত্রি; ১০. জন্ম ও মৃত্যু; ১১. মহাপ্লাবন; ১২. আচার-সংস্কার-রীতি-নীতি; ১৩. বিভিন্ন প্রাণী এবং প্রাকৃতিক সংঘটনের বৈশিষ্ট্য; ১৪. বিভিন্ন শিল্পবস্তুর উৎপত্তি ও মানুষের সভ্যতার বিস্তৃতি। এসব বিষয় নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বের সব মিথ বা পুরাণ।
উইকিপিডিয়াতে পুরাণ সম্পর্কে আছে বিস্তৃত আলোচনা। হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি সেখানে উল্লেখিত হয়েছে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রসঙ্গ : “পুরাণ (সংস্কৃত : প্রাচীনযুগীয় অর্থে) হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ আখ্যানমূলক ধর্মগ্রন্থ-সমুচ্চয়। পুরাণে সৃষ্টি থেকে প্রলয় পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস, রাজন্যবর্গ, যোদ্ধৃবর্গ, ঋষি ও উপদেবতাগণের বংশবৃত্তান্ত এবং হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্ব, দর্শন ও ভূগোলতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। পুরাণে সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো দেবতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং তাতে ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তার প্রাবল্যও লক্ষিত হয়। এই গ্রন্থগুলো প্রধানত আখ্যায়িকার আকারে রচিত, যা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।” [সূত্র : http:/ww/w.sacred-texts.com/hin/index.htm#puranas]
নিমাই পাল প্রাগুক্ত গ্রন্থে ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে পুরাণের সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলেন— “পুরাণ আমাদের প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির আধার। অতীত ভারতের নানা কীর্তি ও কাহিনী পুরাণপাঠে অবগত হওয়া যায়। পৌরাণিক ভারতকে জানতে হলে পুরাণগ্রন্থ আমাদের কাছে অপরিহার্য।... পুরাণে অলৌকিকতা ও অতিরঞ্জন বহুলাংশে আছে সত্য। তবুও প্রাচীন ভারতের পুরাবৃত্তি, ভূগোল, জনপদের বিবরণ, লোকাচার, জ্ঞানচর্চা ও ধর্মসাধনা, জীবনচর্যার নানা কথা জানতে আমাদের পুরাণ পাঠ জরুরি। এই অর্থে পুরাণ ইতিহাস নির্ভর রচনা— প্রতীচ্য পণ্ডিত কথিত নিছক আজগবী রচনা, অতিরঞ্জনের আধারমাত্র অথবা Mythology নয়। মহাপুরাণসমূহে রামচন্দ্র, যুধিষ্ঠিরাদি রাজবর্গ ও তৎকালীন সাধারণ মানুষের খাদ্যরুচি, পোষাকাদির নানা বিবরণ আমরা জানতে পারি। প্রাচীন ভারতের চলমান জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে পুরাণকারেরা যতই অতিরঞ্জন ও অবিশ্বাসের রঙ ছড়ান না কেন তার ভিতর থেকে সত্যের নির্যাসটুকু আহরণ করতে আমাদের অসুবিধা নেই। প্রাচীন ইতিহাস বোধকে সঞ্চারিত করতে পুরাণের ভূমিকা অপরিহার্য।”
পাশ্চাত্য পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীর অনেকাংশের বৈসাদৃশ্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। দুটো ভূখণ্ডে দুই রকম সাংস্কৃতিক চর্চার ফসল যে এ পৌরাণিক কাহিনী, ভিন্নতা তো থাকবেই। এ প্রসঙ্গে সুধীরচন্দ্র সরকার সংকলিত ‘পৌরাণিক অভিধান’-এ (প্রথম সংস্করণ, আষাঢ় ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ) সংকলক ব্যক্ত করেন— “আমাদের (ভারতীয়) সমগ্র পৌরাণিক কাহিনী সংগ্রহ করলে রোমান, গ্রীক ও অন্যান্য পাশ্চাত্য কাহিনী থেকে দশ-বারো গুণেরও যে বেশী হবে তাতে সন্দেহ নাই। ইউরোপীয় পৌরাণিক কাহিনী ও আমাদের পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে প্রধান প্রভেদ এই— আধুনিক ইউরোপীয় সমাজ ও সাহিত্যের সঙ্গে এই পাশ্চাত্য কাহিনীর কোনো যোগাযোগ নাই, কেবল প্রাচীন গল্প হিসাবেই এর এখন মূল্য আছে। আর আমাদের পৌরাণিক কাহিনী হচ্ছে প্রাণবন্ত। আমাদের দৈনন্দিন ধর্ম, সমাজ, কাজকর্ম ইত্যাদির সঙ্গে এর চিরকালের সুদীর্ঘ সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য হয়ে আছে। পুরাকালের দেবদেবী আমাদের জীবনে ও সাহিত্যে আন্তরিক স্থান অধিকার করে আছে। তাছাড়া তুলনা করে দেখলে আমাদের পৌরাণিক কাহিনী বিচিত্রতায় ও চারিত্রিক উৎকর্ষে বৈদিশিক পৌরাণিক কাহিনীর চেয়ে অনেক উচ্চতর।”
প্রাচীন ভারতীয় ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, সংস্কৃতিবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও সূত্র পর্যবেক্ষণ করে ভারতবিদ্যাবিশারদ এবং জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কর্নেলিয়া ডিমিট সম্পাদিত ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক জোহার্নেস অ্যাড্রিয়ানাস বার্নাডাস্ ভ্যান বুইটেনেন কর্তৃক অনুবাদিত ‘ক্লাসিক্যাল হিন্দু মিথোলজি : অ্যা রিডার ইন দ্যা সাংস্কৃট পুরানস’ বইটিতে দেখা যায় ২০টি মহাপুরাণে একটি তালিকা। অন্যদিকে আভিধানিক সুধীরচন্দ্র সরকার তাঁর অভিধানে পুরাণের সংজ্ঞায় বলেন— “যে গ্রন্থে স্থাবর, জঙ্গম, দেবতা, অসুর, গন্ধর্ব, যক্ষ, মনুষ্যাদির বৃত্তান্ত এবং সৃষ্টি-বিবরণ, ব্রহ্মানুসন্ধান, ব্রহ্মের সাকার ও নিরাকার বর্ণন, অন্ততত্ত্ব নির্ণয়, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পূর্বতন রাজন্যবর্গের বংশাবলী প্রভৃতি নানা বিষয় সবিশেষ লিখিত আছে, এবং যদ্দারা ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান অবস্থার পরিজ্ঞান, জ্ঞানের নির্মলতা ও বুদ্ধির প্রাখর্য জন্মে, তার নাম পুরাণ।”
হাল আমলে মিথ বা পুরাণের ওপর যাঁরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন এমন দুজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে লেখাটির পরিসমাপ্তি ঘটানো যাক। ফিরে আসতে হয় আবার ফিলিপ ফার্নান্দেজ-আর্মেস্তো-র কাছে। তাঁর মতে : “পুরাণের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের সবারই আছে পুরাণ: ইতিহাস, নৈতিকতা এবং প্রকৃতিতে আমাদের অবস্থান নির্দেশক উপাখ্যানসমূহ—কালের বিপত্তিসমূহ, মঙ্গল এবং অমঙ্গলের পথসমূহ, আমাদের চারপাশের পরিবেশের সাথে পারস্পরিক ক্রিয়াসমূহ। পুরাণ ব্যতিরেকে আমরা জানতে পারতাম না—কী আমাদের আত্মপরিচয়, কী হতো আমাদের আচরণ, কিংবা অন্য সম্প্রদায়সমূহ থেকে কীভাবে আমরা নিজেদেরকে আলাদা করব। হয়ত আমরা হয়ে পড়তাম হতবুদ্ধি। এমনকি এখন আমরা যতটুকু দিক্ভ্রান্ত, হয়ত হয়ে পড়তাম তার চেয়েও অধিক বিভ্রান্ত—কীভাবে ব্যবহার করতে হবে পৃথিবীকে, কী আচরণ করতে হবে অন্য প্রজাতিগুলোর সাথে। কারণ এসব বিষয়ের ওপর আমাদের পূর্বপুরুষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরাণ রেখেছিল এক বিশেষ ভূমিকা—যেসব সিদ্ধান্ত দ্বারা আমরা শৃঙ্খলিত না হলেও শর্তাধীন।”
অন্যদিকে বর্তমান সময়ে মিথ বা পুরাণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী সেসকল মনীষী কাজ করছেন তাঁদের মধ্যে ব্রিটিশ লেখক ও ধারাভাষ্যকার ক্যারেন আর্মস্ট্রং-এর নাম কমবেশি অনেকেই জানেন। তাঁর লেখা ‘অ্যা সর্ট হিট্রি অব মিথ’ [পুরাণ: সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ক্যারেন আর্মস্ট্রং, অনুবাদ: সাদেকুল আহসান, সন্দেশ, শাহবাগ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৯, পৃষ্ঠা : ১০] বইটিতে মিথ সম্পর্কে তিনি বলেন— “বর্তমান সময়ে পৌরাণিক চিন্তা খ্যাতিহীনতার গর্ভে পতিত হয়েছে; আমরা প্রায়শই একে অযৌক্তিক এবং অস্তিত্বহীন অভিধা দিয়ে বাতিল করে দেই। কিন্তু কল্পনাশক্তিই বিজ্ঞানীদের নতুন জ্ঞান আহরণে সাহায্য করে এবং তাদের এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহায়তা করে যা পক্ষান্তরে বহুগুণ বৃদ্ধি করে আমাদের দক্ষতা। বিজ্ঞানীদের কল্পনাশক্তির বরাভয়ে আমরা মহাশূন্যে ভ্রমণ করে চাঁদের বুকে হাঁটতে সক্ষম হয়েছি, যা একসময়ে ছিল কেবলই পৌরাণিক আখ্যানের অংশ। বিজ্ঞান এবং পুরাণ উভয়েই মানুষের সম্ভাবনার জায়গা বিস্তৃত করেছে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির মতো আমরা পরবর্তীকালে দেখব যে পুরাণও, এই পৃথিবীকে বাদ দিয়ে চিন্তা করেনি বরং এখানেই আরো সক্রিয়, আরো প্রাণবন্তভাবে বাঁচতে আমাদের সহায়তা করেছে।”
এরপর আর কীই-বা বলার থাকে মিথ ও পুরাণ নিয়ে!