জীবনানন্দের জীবন ও কবিতা

Looks like you've blocked notifications!

সৃজনশীলতার অপর পিঠে লেখা থাকে স্রষ্টার আপন জীবনের ইতিহাস। এ কথা প্রায় সকল লেখক বা কবির ক্ষেত্রেই বলা যায়। শুধু কবি বা লেখক নয়, সকল সৃষ্টির মধ্যেই এই সত্যিটা লুকিয়ে থাকে।

জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে কিছু বলতে গেলে তাই বারবারই মনে পড়ে কবির বেড়ে ওঠার পটভূমি। কেমন ছিল সেটা, তা জানা দরকার। জীবনে পথচলার কোন কোন বিষয় তাঁর লেখায় কী ধরনের প্রভাব ফেলল, তা জানাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্তত তার একটা রূপরেখা চোখের সামনে থাকলে বোধ হয় অনেক কিছুর মধ্যে প্রবেশ করতে সহজ হবে। আসলে এ আমার একান্ত ধারণা। তা যে সব সময় ঠিকমতো মানিয়ে যাবে কবির কবিতার বা যেকোনো রচনার সঙ্গে, তা নাও হতে পারে। তারপরও মাঝেমধ্যে তার যাপিত জীবন নিয়ে দু-চারটা কথা বলে আমরা বোধ হয় খানিকটা মিলিয়ে নিতেও পারি।

চিত্ররূপময়তা দিয়ে বিশুদ্ধ পঙক্তিতে নির্মাণ করা কবিতার প্রাসাদ। অথচ জীবনযাপন তার আটপৌরে, সাধারণ। লেখার ব্যঞ্জনায় ফুটিয়েছেন জীবনের যে ছবি তার সঙ্গে যাপিত জীবনের কত পার্থক্য। তবে তার অনেক কবিতাতেই যে দ্বৈত সত্তার দেখা মেলে তা হয়তো নিজের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। ক্ষণজন্মা এই কবির জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ (৬ ফাল্গুন ১৩০৫) বরিশাল জেলায়। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে। পদ্মাতীরের সেই গ্রামের নাম গৌপাড়া। জীবনানন্দের পিতামহ সর্বানন্দ দাশ প্রথম বরিশালে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি বরিশাল শহরে ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। এর পর থেকে তিনি নিজের নামের পেছনে দাশগুপ্তের স্থলে শুধু দাশ লিখতেন। কবির মাতামহ চন্দ্রনাথ দাশ হাসির কবিতা, গান লিখতেন। আর তাঁর মা কুসুমকুমারী দাশ তো আমাদের সবার পরিচিত কবি। তাঁর আদর্শ ছেলে কবিতাটা প্রকৃতই আদর্শ একটি কবিতা। ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’ কবিতা আমরা সবাই পড়েছি। বাবা সত্যনন্দ দাশ ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তিনি প্রবন্ধ লিখতেন, আবার সম্পাদনা করতেন পত্রিকা। তাঁর সম্পাদিত ‘ব্রহ্মবাদী’ ছিল ব্রাহ্ম সমাজের একটা মুখপত্র। জীবনানন্দ ছিলেন বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। তার পরের সন্তান অশোকানন্দ দাশের জন্ম ১৯০১ সালে। তার পরে কন্যা সুচরিতা, তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৫ সালে।

জীবনানন্দের একটা ডাকনাম ছিল। বাবা-মা তাঁকে মিলু বলে ডাকতেন। সেই ছোটবেলায় তিনি একবার বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কঠিন সে অসুখ থেকে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়লে ডাক্তারের পরামর্শে তাঁকে নিয়ে ভ্রমণে বের হন ভারতের বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর জায়গায়। তাঁর মা কুসুমকুমারী দাশ এবং মাতামহ জীবনানন্দকে নিয়ে লক্ষ্ণৌ, আগ্রাসহ অনেক জায়গা ঘুরে বেড়ান।

ছোটবেলার এই অসুস্থতা তার জীবনে কি কিছু প্রভাব ফেলেনি? শারীরিক দুর্বলতা মানুষের মনকে কিছুটা হলেও সন্ত্রস্ত করে দেয় না কি? আরো একটা বিষয় নিয়ে বলতে হয়। তাঁর পরিবার ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী। একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সংখ্যাগুরুদের কাছে কিছুটা কি দমনপীড়নে পড়েননি? বিশেষ করে যখন একটি ধর্ম ত্যাগ করে ওই ধর্ম গ্রহণ করা হয়েছে। এই কথাগুলো বলার কারণ পরবর্তীকালে জীবনানন্দের সংকোচপূর্ণ জীবনযাত্রা, এড়িয়ে চলার স্বভাব যেন এই কারণেই।

অবশ্য এই নিভৃতচারিতা তাকে হয়তো ভাবনার গভীরে ঢুকতে সাহায্য করেছে। একেকটি শব্দকে নতুন রূপরসে অলংকৃত করে উপস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন। লিখতে পেরেছেন :

‘এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে, -জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা।

 অনেক হয়েছে শোয়া; -তারপর একদিন চ’লে গেছে কোন দূর মেঘে।

 অন্ধকার শেষ হ’লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে :

 সরোজিনী চ’লে গেল অতদূর? সিড়ি ছাড়া -পাখিদের মতো পাখা বিনা?’

আর এই যে তাঁর কবি হয়ে ওঠা এ তো আর কাকতালীয় নয়। মাতামহ এবং মা এমনকি বাবাও সরাসরি সাহিত্য চর্চাই করেছেন। পিতামহও ছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। এর সবকিছুই যে তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

১৯০৮ সালে তাঁকে ভর্তি করা হয় ব্রজমোহন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে, তখন তাঁর বয়স আট। সেই প্রথম স্কুলে ভর্তি হলেন তিনি। দেরিতে ভর্তি করার ব্যাপারে তাঁর বাবার মত ছিল, বেশি ছোট বয়সে বাচ্চাদের স্কুলে দেওয়া ঠিক না। তার আগ পর্যন্ত তাঁর পড়াশোনা চলেছিল মা কুসুমকুমারী দেবীর কাছে। ছোটবেলাটা মানুষ হয়েছেন গৃহপরিচারক আর পরিচারিকাদের কাছে। ভোরবেলা বাবার উপনিষদ আবৃত্তি আর মায়ের গান শুনে তিনি যেমন উদ্বেলিত হতেন, তেমনি আপ্লুত হতেন পরিচারক-পরিচারিকাদের কাছে গল্প শুনে। তখন তাদের কাছেই শিখেছেন বিভিন্ন গাছ আর নানা রকম পাখির নাম। হয়তো অজান্তে তখনই মনে তাঁর ভিত্তি গেড়েছে ভবিষ্যতের জীবনানন্দ। ১৯১৫ সালে তিনি ব্রজমোহন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন প্রথম বিভাগে। এর দুই বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে পাস করেন ইন্টারমিডিয়েট। এরপর তাঁর জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড়। অবারিত সবুজের দেশ ছেড়ে গিয়ে পড়লেন ইট-পাথরের জগতে। বরিশাল ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর সত্তায় জড়িয়ে থাকা ধানসিঁড়ি নদী, রুপালি জ্যোৎস্নার রূপসী বাংলাকে ছেড়ে চলে যেতে হয়। একসময় বোধ হয় সেগুলো আশ্রয় নেয় তাঁর মনের গহিন কোঠরে।

১৯১৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ সম্মান ডিগ্রি লাভ করেন। সেই বছরই তাঁর প্রথম কবিতা বের হয় ব্রহ্মবাদী জার্নালের বৈশাখী সংখ্যায়। জীবনানন্দের এই কবিতার নাম বর্ষ-আবাহন। তাঁর প্রথম কবিতা কিন্তু ছাপা হয়েছিল বেনামে। অবশ্য বর্ষপূর্তি সংখ্যায় সূচিতে তাঁর পুরো নাম জীবনানন্দ দাশগুপ্ত, বিএ; প্রকাশ করা হয়। ১৯২১ সালে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর তিনি আইন পড়েছিলেন। সেই সময় ডিসেন্ট্রিতে ভুগে এমন অসুস্থ হয়ে পড়েন যে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। আইন পড়ার পাঠ সেখানেই সমাপ্ত হয়। তাঁর প্রথম গদ্য লেখা বের হয় ব্রহ্মবাদী পত্রিকাতেই ১৯২৫ সালে। লেখার নাম ‘স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে’। প্রথম দিকের লেখাগুলোতে তিনি দাশগুপ্ত ব্যবহার করতেন।

১৯২৭ সালে এসে লিখতেন শুধু দাশ, জীবনানন্দ দাশ। তারপর শুধু লিখেই গেছেন, একটার পর একটা। যদিও জীবদ্দশায় তাঁর মাত্র সাতটি গ্রন্থ বের হয়েছিল। অজস্র লেখার পরও তাঁর লেখার তৃষ্ণা মেটেনি। তাঁর সম্বন্ধে এক জায়গায় বলেছিলেন লেখিকা বাণী রায় ‘...জীবনানন্দ একদিন কী সতৃষ্ণভাবে বলেছিলেন, আপনার বাড়িটায় যদি থাকতে পারতাম! লিখবার অবকাশ বা নির্জনতা পাই না। উপন্যাস লিখব ভাবছি। কত কি লিখবার আছে। আপনার ঘরটি যদি পেতাম।’ তিনি বিয়ে করেছিলেন খুলনার মেয়ে লাবণ্য গুপ্তকে। লাবণ্য দেবীর বাবার নাম ছিল রোহিণীকুমার গুপ্ত। ৯ মে ১৯৩০ সালে ঢাকার একটা ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। বিয়ের পর লাবণ্য স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি শিক্ষয়িত্রীর কাজ করতেন। তাঁদের সন্তান মঞ্জুশ্রী দাশ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালে। ছেলে সমরানন্দ দাশ জন্মেছিলেন ১৯৩৬ সালে। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ১৯২২ সালে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন ১৯২৮ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯২৯ সালে কলকাতা ছেড়ে চলে যান বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে অধ্যাপনা করতে। সেখান থেকে তিন মাসের মাথায় আবার ফিরে আসেন কলকাতায়। এই সময় শুরু হয় তার অর্থকষ্ট। স্থায়ী কোনো চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি টিউশনি করতে থাকেন।

কবির জীবনে ঘটে যাওয়া এই সব অনুষঙ্গগুলো নিয়ে যদি ভাবা যায় তাহলে কী বোঝা যায় না তাকে যেতে হয়েছে অনেক ধরণের প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে? চাকরির সমস্যায় পড়ে এই যে আর্থিক অনটন তাতে নিশ্চয়ই সংসারে তার অবস্থান খুব সুখকর কিছু ছিল না। এ ছাড়া তার স্ত্রী ছিলেন বিদুষী। স্ত্রী আবার চাকরি করেন। অর্থাৎ হীনমন্যতায় ভোগার অনেকগুলো কারণই কবির জন্য বিদ্যমান ছিল। ভূমেন্দ্র গুহের লেখা থেকে জানা যায় কবির সংসার জীবন মোটেও সুখকর ছিল না। ‘জানেন, একদিন হঠাৎ গিয়ে পড়েছি। ঐ তো একচিলতে ঘর, একচিলতে উঠোন। হয়তো স্নানে যাবেন, গামছা পরে আছেন, ঘর ঝাঁট দিচ্ছিলেন, শেষ করে আমার সামনেই ঘরটা মুছলেন। ... আচ্ছা, ওর স্ত্রী তখন কি করছিলেন? নাকি গৃহকর্ম উদযাপনের দায়ভার তিনি ন্যস্ত করেছিলেন জাগতিক সর্ববিষয়ে অক্ষম এই স্বামীটির উপরে?’

এই পর্যন্ত তাঁর জীবন নিয়ে বলা কথাগুলো যদি আমরা মাথায় রাখি তাহলে মনে হয় কিছুটা বোধগম্য হয়, কেন তিনি মুখচোরা ছিলেন বা মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলার কারণটা কী। নিজের এই সংকোচ আমার মনে হয় তার লেখা নিয়েও ছিল। তিনি উপন্যাস লিখতে চেয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয় তিনি লিখেছিলেন অনেকগুলো উপন্যাস। সেগুলো তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন নিশ্চয় সংকোচের কারণেই। আর এ সব লেখা আবিষ্কার হয় কবির মৃত্যুর পর।

 প্রথম জীবনে তার কবিতা নিয়ে অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করেছেন। সত্যিকার মূল্যায়ন তার তেমন হয়নি। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলতেন জীবনানন্দ স্বভাব কবি। স্বভাব কবি কখনো ভালো কবিতা লেখেন না। মনে যা এসে গেল তাই লিখে ফেললেই কবিতা হয় না। কবিতা নির্মাণ করতে হয়, গেঁথে তুলতে হয়। এসব কথা তিনি সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে বলেছেন, বলেছেন বুদ্ধদেব বসুকেও। ঠিক এই জায়গায় এসে আমার মনে পড়ছে ভিনসেন্ট ভ্যান গগকে নিয়ে Don Mclean-এর গাওয়া গাওয়া `Starry Starry Night' গানের `How you suffered for your sanity' লাইনটি।

জীবনানন্দ নিজের কবিতা সম্বন্ধে উচ্চ ধারণাই পোষণ করতেন, কিন্তু সমালোচকদের তীর তাঁকে রক্তাক্ত করত। এই যে সম্পূর্ণতা থাকা সত্ত্বেও তাকে বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়েছে, এসবও তার লেখায় প্রভাব ফেলেছে বলেই মনে হয়। আর এই সমস্ত কিছু বিবেচনায় রেখে যদি আমরা তাঁর লেখার সঙ্গে মেলাই তাহলে আমার আগের করা মন্তব্য বোধহয় সঠিক বলেই প্রমাণ হবে। তার লেখা থেকে যদি আমরা ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা নিয়ে আলোচনা করি তাহলে মনে হয় সম্পূর্ণটাই বলা হয়ে যায়।

মানুষ জীবনের পূর্ণতা পেয়ে গেলে কর্মস্পৃহা কমে যেতে পারে। এমনকি আর কিছু করার ইচ্ছা একেবারেই চলে যেতে পারে। এ থেকে জন্ম নিতে পারে হতাশার। ভোগবাদী মানুষ ভোগের চূড়ান্ত পর্যায়ে জীবনের প্রতি হয়ে যেতে পারে একেবারে বিতৃষ্ণ। তখন একটা মানুষ কী করতে পারে? সে তার যা কিছু সঞ্চয় বিলিয়ে দিতে পারে অক্লেশে, এমনকি জীবন পর্যন্ত। আবার এমনও হতে পারে তার এই বেঁচে থাকার অর্থ তাকে পীড়িত করতে পারে। জীবনের মানে খুঁজতে গিয়ে যেমন মাওলানা রুমী জন্ম আর মৃত্যুকে তুলনা করেছেন সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে। ঢেউ যেমন একটা বিন্দুতে ভেঙে পড়ে আবার সেখান থেকেই আবার উত্থিত হয়। মৃত্যুকে তিনি তুলনা করেছেন ভেঙে পড়ার সঙ্গে আর ওঠাকে জীবনের সঙ্গে। আর এভাবেই ঢেউয়ের ওঠা নামা চলতে থাকে। রুমীর মতে মৃত্যু না আসা পর্যন্ত জীবন-ধর্ম পালন করে যেতে হবে। আর মৃত্যু হলো এই জীবনের সবচেয়ে মহত্তম ঘটনা। আমাদের সত্তা অস্তিত্বকে ঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারে মৃত্যুর পরে। রুমীর লেখা একটি শায়েরির অর্থ দাঁড়ায় এমন: হে মানব সন্তান মানুষ নিজে যেভাবে কল্পনা করে সেভাবেই মৃত্যু তার সামনে এসে দাঁড়ায়। শত্রুর কাছে সে শত্রু আর বন্ধুর কাছে সে বন্ধু। ... যার কাছে মৃত্যু পরমানন্দের, তার কাছে সেরকম দৈববাণীই আসে, দ্রুত সেখানে পৌঁছানোর সংগ্রাম করো।

যখন মৃত্যুর এরকম অর্থ আমরা পাই তখন

 ‘বধু শুয়েছিল পাশে—শিশুটিও ছিল;

 প্রেম ছিলো, আশা ছিলো—জ্যোৎস্নায় তবু সে দেখিল

 কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?’

এই পরিস্থিতি থেকেও এক গাছা দড়ি হাতে দ্বিধাহীনভাবে মৃত্যুর জন্য বেরিয়ে পড়া, জীবনেরই একটা অংশ মনে হয়। আর তাতে অবাক হওয়ার নিশ্চয়ই কিছু থাকে না।

জীবনানন্দের কবিতার কিছু পরম্পরাও আছে। আমরা যদি বনলতা সেন কবিতার কথা মনে করি। একটা জীবনবাদী কবিতা। হাজার বছর পরিক্রমা কবিকে ক্লান্ত করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে করেছে নানা অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ। এত কিছু সত্ত্বেও তাকে শান্তি দিয়েছে নাটোরের বনলতা সেন। রবীন্দ্রনাথের সেই লাইন ‘একটি ধানের শীষের উপরে, একটি শিশিরবিন্দু’। এর পরে কবি জীবনের অভিজ্ঞতার গল্প নিয়ে দিন শেষে বসতে চেয়েছেন বনলতা সেনের সঙ্গে। এ এক জীবনময়তার প্রকাশ। প্রকৃত জীবনে যাই থাক তাঁর ভাবনায় পরিতৃপ্ত এক জীবনের ছবি।

পরবর্তী সময়ে এই পূর্ণ পরিতৃপ্তিই তার কাছে অর্থহীন হয়ে ওঠে প্রাকৃতিক নিয়মে। আমরা ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় যাকে আবিষ্কার করি তার জীবন কানায় কানায় পূর্ণ। এই ভোগী জীবনের অর্থহীনতা তাকে জীবনের অন্য অর্থ খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করে। আর সেখান থেকে উত্তরণ কালেই তাকে বিস্মিত হতে হয়। আবার এই বিস্ময় থেকে মুক্তিই তাকে জীবন অক্লেশে বিলিয়ে দিতে অনুপ্রাণিত করে। সেটা মৃত্যু নয় অন্য এক জীবন।

মৃত্যু মানুষের জীবনের পরিণতি। একটা জীবন পরিপূর্ণ হলেই মৃত্যু আসে। আমরা অনেক সময় বলি, অকাল মৃত্যু। কে বলতে পারে ঐ মানুষটার জীবনের পরিধি ঐটুকুই ছিল কিনা! তার জীবনের পরিপূর্ণতা ঐ সময়ের মধ্যেই ঘটে যায়। জীবনানন্দ তাঁর “মানুষের মৃত্যু হ’লে” কবিতাতেই বলেছেন প্রায় এই কথা,

 ‘আজকের আগে যেই জীবনের ভিড় জমেছিলো

 তারা মরে গেছে;

 প্রতিটি মানুষ তার নিজের সতন্ত্র সত্তা নিয়ে

 অন্ধকারে হারায়েছে;

 তবু তারা আজকের আলোর ভিতরে

 সঞ্চারিত হ’য়ে উঠে আজকের মানুষের সুরে

 যখন প্রেমের কথা বলে

 অথবা জ্ঞানের কথা—

 অনন্ত যাত্রার কথা মনে হয় সে সময়

 দীপংকর শ্রীজ্ঞানের”

আমরা বলতে পারি জীবনের পরিপূর্ণতা আসে মৃত্যুতে। মৃত্যুর অনিবার্য সময় জানা হয়ে যাওয়া মানে জীবন পরিপূর্ণ বা আর কিছু পাওয়ার নেই। এখানে সোমেন চন্দের “স্বপ্ন” গল্পের কথা মনে পড়ছে। গল্পের নায়ক শঙ্কর যখন তার নিজের মৃত্যুর অনিবার্যতা টের পায় তখন মুক্ত হস্ত হয়ে ওঠে। শুধু টাকা পয়সায় না। জীবনকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে উপভোগ করতে সে যা খুশি করতে থাকে। কিন্তু মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সে আবার সেই মৃত্যুর কথা জোর গলায় অস্বীকার করতে চায়। অথচ সে এগিয়ে যেতে থাকে অমোঘ মৃত্যুর দিকে। তার কাছে জীবন মৃত্যু যেন একই সুতোয় বাঁধা। যখন তার মনে গেঁথে গেছে মৃত্যুই তার পরিণতি তখন সেটাই তার পূর্ণ জীবন। এক সময় সে মৃত্যুভয় দূর করে জীবনের পূর্ণতার সুখে ভাসে। জীবনের ভাঁড়ারের যা কিছু তা অকাতরে ব্যয় করতে থাকে আর এভাবেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে।

জীবনানন্দ ব্যক্তি জীবনে সসংকোচ উপস্থিতি নিয়ে সমাজে বিড়ম্বিত জীবন কাটিয়েছেন। আপাত দৃষ্টিতে তার জীবনে সংসার, সন্তান সবই ছিল। আমরা যে মাঝেমধ্যে শুনি স্ত্রীর সঙ্গে বিরূপ সম্পর্কের কথা সেটাও কোন কোন মানুষের বক্তব্যে আবার পুরোপুরি সমর্থন পায় না। কিন্তু বিস্তারিত বর্ণনায় তা অস্বীকার করাও যায় না। অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে তিনি স্বাভাবিক জীবন যাপনই করেছেন এবং তিনি যেহেতু নিজে মুখচোরা ছিলেন সে জন্য সমস্যার কথা কাউকে বলেন নি বা সেভাবে বুঝতেও দেন নি। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রকে সংসারের সর্বউপস্থিতির পরও পরিতৃপ্ত দেখাতে পারেন নি। তাঁকে অন্য একটা জীবন খোঁজার পথে ঠেলে দিয়েছেন। যে জীবন হয়তো ছিল তার কাছে বিস্ময় বিহ্বলিত। বা রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘হেথা নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে’।

অন্য কোনখানে অর্থাৎ অন্য কোন জীবনে বা জগতে। অন্য কোন জীবন দর্শনের কথায় বলতে হয় গৌতম বুদ্ধের কথা। বুদ্ধ যে ধ্যান করেছেন সেটাকে বলা হয় ‘মহাসমাধি চক্র’। বুদ্ধের আগে এই ধ্যান আরো কয়েকজন করেছেন। এই ধ্যানের চূড়ান্ত পর্যায়ে নাকি এমন এক জগতে প্রবেশ করা যায় যা আমাদের এই জীবন থেকে একেবারেই আলাদা। বলা হয়ে থাকে সেটা এমন এক জগৎ যেখান থেকে আসতেই মন চায় না। অনেকেই ‘মহাসমাধি চক্র’ ধ্যানে বসে অন্য এক জগতে পৌঁছে গেছেন এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেন নি। গৌতম বুদ্ধ মানুষের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতেন। তিনি ধ্যান করছিলেন মানুষের জন্য কিছু করতে। তাই তিনি ধ্যানের আগে একটা পিছুটান রেখে দিয়েছিলেন। তাই তিনি সেই জগৎ থেকে ফিরে এসেছিলেন মানবজাতির কল্যাণে।

যাই হোক, আমাদের আলোচনা সেই অন্য জগৎটা নিয়ে। জীবন আর মৃত্যু কেবলই অবস্থানের বিষয়। আর এই সত্যটা মেনে নিতে পারলেই মনে হতে পারে সবই স্বাভাবিক। সময়মাত্রার রথে চড়ে বসতে পারলে যেকোনো অবস্থানে অবস্থান করা বিস্ময়কর নয় বলে মনে হবে। তার এই কাব্যময় জীবন বা জীবনময় কাব্য আমাদের যেমন বিস্মিত করে আবার অনুগামীও করে।