টঙ্ক আন্দোলন
হাজং মাতা রাসমণির সংগ্রাম
দ্বিতীয়বারের মতো টঙ্ক আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৬ সালে। সুসং দুর্গাপুর স্কুলমাঠে সভা করার সিদ্ধান্ত হয় তখন। পাহাড় অঞ্চল থেকে মিছিল নিয়ে আসবে হাজং কৃষকরা। দুর্গাপুর থানার পাশে একটি রাস্তা ছিল। মিছিল যেন না যেতে পারে, সে জন্য দুই দিকে কাঁটাতারের পোক্ত বেড়া দেওয়া হয়। সশস্ত্র পুলিশও অবস্থান নেয় সেখানে।
হাজার পাঁচেক লোকের এক মিছিল পাহাড় অঞ্চল থেকে আসছিল। প্রত্যেকের হাতে বল্লম। সামনে সাদা একটি ঘোড়ার ওপর বসা তাদের নেতা বল্লভী বক্সী। পেছনে শখানেক হাজং নারী। পুলিশের কাঁটাতারের বেড়া তাদের থামাতে পারে না। আগতরা স্লোগান দিতে দিতে বেড়া ভেঙে ফেলে। তারা তখন টেলিগ্রাম অফিসের তারও উপড়ে ফেলে দেয়। ওই দিন আগতদের মিছিল আর হাতের বল্লম দেখে ভয়ে পুলিশের দল পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অতঃপর স্কুলমাঠেই চলে তাদের সভা।
এ ঘটনার কয়েকদিন পরেই ময়মনসিংহ থেকে সশস্ত্র পুলিশ দল আসে দুর্গাপুরে। তারা বিভিন্ন জায়গায় পজিশন নেয়। সুসং-দুর্গাপুরের অপর পাড়ে, অর্থাৎ বিরিশিরিতে তারা একটি সশস্ত্র ঘাঁটি গড়ে তোলে। গুলি চালানোর অর্ডার দিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটও থাকে পুলিশ দলের সঙ্গে। এরপরই ঘটে রাসমণিকে গুলি করে হত্যার ঘটনাটি। কিন্তু রাসমণিকে কেন হাজং মাতা হিসেবে মানত সবাই? সে ইতিহাস জানা থাকা দরকার।
রাসমণির জন্ম সুসঙ্গ পরগনার ভেদিপুর অঞ্চলের বগাবারী গ্রামে, এক দরিদ্র টঙ্ক চাষির ঘরে। বারো বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়া হয় এক নিঃস্ব টঙ্ক চাষি যুবকের সঙ্গে, পাঁচ মণ ধান আর নগদ দশ টাকার বিনিময়ে। কিন্তু বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই রাসমণি বিধবা হন। বিয়ের পরপরই স্বামী হারানোর ফলে ওই সময় গ্রামের সকলে তাকে ডাইনি বলে ডাকত। রাসমণি কারো কথায় কান দেন না; বরং জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হন।
তিনি পরের জমিতে রোয়া ধান লাগিয়ে আর ধান কেটে মজুরি বাবদ যে সামান্য ধান পেতেন, তাই আবার ঢেকিতে ভেনে চাল তৈরি করে তিনমাস হাটে-বাজারে বিক্রয় করে বেড়াতেন। প্রতিবছর চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই তিন মাস রাসমণি বনের কাঠ কুড়িয়ে বিক্রয় করতেন এবং শীতের জন্য সঞ্চয় করতেন। অবসর সময়ে তিনি তাঁতে নিজের হাতে গরিব হাজং মেয়েদের জন্য কাপড় ও ওড়না বুনতেন।
ডাইনি রাসমণি ছিলেন আরো একটি মহৎ কাজে যুক্ত। তিনি ছিলেন সুসঙ্গ অঞ্চলের মায়েদের আঁতুড় ঘরের শ্রেষ্ঠ দাই বা ধাত্রী। কেউ প্রসব বেদনায় কষ্ট পাচ্ছেন—এ খবর শোনামাত্রই রাসমণি সব কাজ ফেলে তার বাড়িতে ছুটে যেতেন। প্রাণপণ চেষ্টায় প্রসব করিয়ে মায়েদের যন্ত্রণার লাঘব করাতেন। এ ছাড়া নবজাতকের নানা চিকিৎসায় তিনি ছিলেন দক্ষ ওঝা। এইসব কাজের কারণে রাসমণির সাহায্য ছাড়া হাজং চাষিদের প্রায় চলতই না।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ রাসমণির জীবনে এনে দেয় এক নতুন পথের সন্ধান। সে সময় তিনি মহিলা-আত্মরক্ষা সমিতির মধ্য থেকে তাঁর নতুন কর্মজীবন আরম্ভ করেন। তেরোশ পঞ্চাশের মহামন্বন্তরে যখন সমস্ত বাংলার চাষি, ক্ষেতমজুর প্রভৃতি সকল দরিদ্র মানুষ খাওয়ার অভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন, তখন রাসমণি তিনটি গ্রামের জন্য লঙ্গরখানা খোলেন। তাঁর চাল-সংগ্রহকারী দল সারা পরগনা ঘুরে সংগ্রহ করত ধান, চাল, অর্থ ও বস্ত্র। রাসমণির নেতৃত্বে হাজং চাষিদের দল চোরাব্যবসায়ী মজুদদারদের গোপন খাদ্যের গুদাম খুঁজে বের করত এবং সেইসব খাদ্য লঙ্গরখানার জন্য বাজেয়াপ্ত করত।
হাজং অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করার জন্য যে বেশি খাদ্য ফলাও, খালকাটা, বাঁধ বাঁধার আন্দোলন আরম্ভ হয়, তারও পুরোভাগে ছিলেন রাসমণি। মহিলা-আত্মরক্ষা সমিতির নির্দেশে তিনি নিজের গ্রামে ধর্মখোলা (ফসল ওঠার সময় সকলে উদ্বৃত্ত ধান দান করে এবং প্রয়োজনের সময় তা থেকে ধান ঋণ করা বা দান করা যায়) এবং মেয়েদের জন্য কুটিরশিল্পের কেন্দ্র স্থাপন করেন।
কেবল খাওয়া-পারার ব্যবস্থা হলেই যে সুস্থ সুন্দর জীবন গড়ে তোলা যায় না, তা রাসমণির মতো বুদ্ধিমতীর বুঝতে সময় লাগেনি। হাজং চাষিরা যে এতকাল জমিদার, তালুকদার এবং মহাজনদের কৃপাভাজন হয়ে পড়েছিল, তাদের ভাগ্য নিয়ে যে এতকাল তারা ছিনিমিনি খেলেছে—তার প্রধান কারণ হাজং চাষিদের অশিক্ষা ও কুশিক্ষা। রাসমণি তাই হাজংপল্লীতে একটি নৈশ ও বয়স্ক বিদ্যালয় চালু করেন। তিনি হলেন সেই বিদ্যালয়ের প্রধান উদ্যোক্তা ও প্রথম ছাত্রী। এই নৈশ বিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে চলে রাজনৈতিক আলোচনার পাঠচক্র। রাসমণি প্রতিটি সভা, সমিতি, বৈঠক ও পাঠচক্রের আলোচনায় যোগ দিতেন। এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই লাঞ্ছিত ও অনগ্রসর এক হাজং ঘরের মেয়ে রাসমণি এক বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন।
১৯৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দ বাংলার কৃষক-সংগ্রামের এক স্মরণীয় কাল। হাজং ও অন্যান্য কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সভা, শোভাযাত্রা, বক্তৃতা, হাট-প্রচার ও গ্রাম্য বৈঠক চলতে থাকে সীমান্তের দীর্ঘ একশ পঞ্চাশ মাইল এলাকাজুড়ে। এইসব সভা ও মিছিলের পুরোভাগে নারী বাহিনী নিয়ে চলতেন বীরমাতা রাসমণি। প্রচার-বাহিনী নিয়ে গ্রামে থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে রাসমণি হাজং নারীদের উদ্বুদ্ধ করে তুলতে থাকেন মৃত্যুপণ সংগ্রামের জন্য।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের পয়লা জানুয়ারি। ময়মনসিংহ জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাস্টিন সাহেবের পরিচালনায় ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনী পূর্ণ শক্তি নিয়ে হাজং অঞ্চলের ওপর আক্রমণ করে। সৈন্যবাহিনী গুলিবর্ষণ, লুটতরাজ, ঘরবাড়ি ও গ্রাম জ্বালানো, শস্যহানি ও নরহত্যা অবাধে ও নির্বিচারে চালাতে থাকে। কয়েক হাজার উন্মত্ত হিংস্র দানব যেন চারদিকে ধ্বংসের তাণ্ডব চালাতে মত্ত হয়েছে।
হাজং বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান পরিচালক শ্রী প্রথম গুপ্তের ভাষায়—ব্যাস্টিনের আজ্ঞাধীন বর্বর সৈন্যবাহিনী উন্মত্ত হয়ে গ্রামের পর গ্রামে প্রবেশ করে চাষিদের মজুদ ধান-চাল, গরু-মহিষ, ঘটি-বাটি, টাকা-পয়সা যা কিছু পেল, সবই লুট করতে লাগল। তারা নষ্ট করল মা-বোনদের ইজ্জত, প্রকাশ্যে আগুনে পুড়িয়ে দিল সংগ্রামী চাষিদের প্রাণপণ চেষ্টায় গড়ে তোলা গ্রাম, পূজা-ঘর, সমিতির ঘর, স্কুল আর পাঠশালা। দানব-বাহিনীর ধ্বংসের তাণ্ডব থেকে কিছুই রক্ষা পেল না।
প্রায় একশ গ্রামবাসী এই ভয়ংকর ধ্বংস ও নরহত্যায় আক্রান্ত হয়। কিন্তু তবুও হাজং চাষিরা ভয়ে পালিয়ে গেল না। অমানুষিক শোষণ-উৎপীড়নের মধ্যেই যারা জীবন কাটায়, তারা ধ্বংস ও মৃত্যুকে ভয় করে না! এই পশু-শক্তির সামনে হাজং চাষিরা অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়াল। তারা দা, তীর-ধনুক প্রভৃতি যে যা পেল, তা নিয়েই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। তাদের একেবারেই সামনে দাঁড়ালেন হাজং মাতা রাসমণি। তিনি চারদিকে ঘুরে ঘুরে সকলকে অভয় দান করতেন, সৈন্যদের রাইফেল, স্টেনগান ও মেশিনগানের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল শেখাতেন এবং কোন গ্রামের ওপর সৈন্যদের আক্রমণের সংবাদ শোনামাত্রই সেই গ্রামে দৌড়ে গিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করতেন।
সুসং-দুর্গাপুরের অপর পাড়ে বহেরাতলী গ্রাম। ওই গ্রামেই হাজং ও গারোদের বাস। বিরিশিরি হতে চার মাইল দূরে বহু বছর থেকেই একটি অস্ট্রেলিয়ান মিশন আছে। বিরিশিরি ক্যাম্প থেকে পাঁচজন পুলিশ চার মাইল দূরে এক হাজং বাড়িতে তল্লাশি করতে যায়। হাজং মেয়েরা তখন দা নিয়ে তাদের তাড়া করে। পুলিশ তাদের এই মূর্তি দেখে ভয় পেয়ে যায়। কারণ তারা জানত, সংকেত পেলে শত শত হাজং এসে সেখানে উপস্থিত হবে। ফলে ওই দিন তারা ভয়ে চলে আসে। পরে ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে আবারও ওই গ্রামে আসে ২৫ জন পুলিশ।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি। দুপুর বেলা তখন। পঁচিশ জন পুলিশ বহেরাতলী গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামের বালক, বৃদ্ধ, যুবা এবং গ্রামের সমস্ত পুরুষ তখন নিকটবর্তী জঙ্গলে গোপন সামরিক শিবিরে গিয়েছে প্রশিক্ষণ নিতে। সুযোগ বুঝে নারী-মাংস লোলুপ বর্বর পুলিশ ঘরে ঘরে প্রবেশ করে এবং চাষি মা-বোনদের ওপর অত্যাচার করে। তাদের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে। এ সময় গ্রাম থেকে বিশ-একুশ বছর বয়সের একজন বিবাহিত হাজং মেয়েকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। তার নাম সরস্বতী। আরেক নাম কুমুদিনী হাজং। লাঞ্ছিত কৃষক-বধূ কুমুদিনীর আর্তনাদ চতুর্দিকে প্রতিধ্বনিত হয়।
এই সময় বহেরাতলীর পার্শ্ববর্তী গ্রামে রাসমণির সশস্ত্র প্রচার দল ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। লাঞ্ছিত কুমুদিনীর আর্তচিৎকারে তারা সচকিত হয়ে ওঠে। রাসমণি বুঝলেন, পার্শ্ববর্তী গ্রামে শয়তানের দল আক্রমণ করেছে। নারীর আর্তনাদ রাসমণির প্রচার-বাহিনীকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। রাসমণির অন্তরে তখন জ্বলে ওঠে প্রতিহিংসার আগুন। তিনি নিঃশব্দে তুলে নেন তাঁর রক্তপতাকা আর তাঁর চিরসঙ্গী হাতিয়ার বড় দা-খানি।
সাথিদের রাসমণি আহ্বান করেন নির্ভয়ে তাঁকে অনুসরণ করতে। প্রচার-দলের পঁয়ত্রিশ জন বীর নিয়ে রাসমণি হাজং-কন্যা কুমুদিনীকে বর্বর পুলিশদের অত্যাচার থেকে বাঁচাবার জন্য ছুটে আসেন। রাসমণি তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে রাইফেলধারী পঁচিশ জন পুলিশের দিকে দ্রুত অগ্রসর হন। সুসঙ্গ পাহাড়ের অপরদিকে সোমেশ্বরী নদীর বালুকাময় তীরে সেইদিন সুশিক্ষিত আগ্নেয়াস্ত্র-সজ্জিত পঁচিশ জন পুলিশের সঙ্গে কেবল তীর-ধনুক, দা, লাঠি ও বর্শায় সজ্জিত মাত্র পঁয়ত্রিশ জন বীর হাজং চাষি বীরমাতা রাসমণি ও সুরেন্দ্র হাজংয়ের নেতৃত্বে যে যুদ্ধ করল, তা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
(চলবে)