পুরানো সেই দিনের কথা

গ্রাম ও নগরজীবনে ঈদ উৎসব

Looks like you've blocked notifications!
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ

২০০৯ সালের কথা। সে বছর ঈদুল ফিতর ও দুর্গাপূজা কাছাকাছি সময়ে হয়েছিল। তখন ঢাকা শহরে বড় হওয়া আমার এক ছাত্রী প্রশ্ন করেছিল, স্যার, দুর্গাপূজা উপলক্ষে হিন্দুদের মধ্যে কেমন যূথবদ্ধ আনন্দ করতে দেখি, মণ্ডপে মণ্ডপে দলবেঁধে সবাই যাচ্ছে, একসঙ্গে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। আমরা ঈদে তো এতটা উচ্ছ্বাস দেখতে পাই না। আমি বললাম, দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের আনন্দ যার যার সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতা থেকেই হয়ে থাকে। মুসলমানদের ঈদ আনন্দ তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতিতেই জড়িয়ে আছে। এখানে কোনো প্রতীকী স্থাপনা নেই। ফলে পার্থিব ও অপার্থিব আনন্দ ফল্গুধারার মতো ছড়িয়ে থাকে। আজকের নগরজীবনে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম অনেক কিছু হারিয়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ঐতিহাসিকভাবে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছিল। গ্রামীণ ও শহুরে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ একে অন্যের সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবগুলো সমানভাবে উপভোগ করত। আজকের ডিজিটাল যুগের প্রজন্ম আমাদের এসব উৎসবের মূল সুর অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে। নিজের উৎসকে খুঁজে পেতে পেছনে দৃষ্টি ছুড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।

যুগ যুগ ধরে বাংলায় ঈদ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, মধ্যযুগের সাহিত্যে ঈদ সম্পর্কে তেমন কিছু লেখা পাওয়া যায় না। সমকালীন ইতিহাস গ্রন্থের তো অভাব রয়েছেই। অনেক পরে ইংরেজ শাসন যুগে, বিশেষ করে উনিশ শতকের সূত্রে বাঙালির ঈদ উদযাপনের কিছু ছবি পাওয়া যায়। সাধারণত গ্রামবাংলায় বেশি আনন্দ ঘন ছিল ঈদুল ফিতর। তবে ঈদের আগের সন্ধ্যার আনন্দও কম ছিল না। ঈদের চাঁদ দেখা ও চাঁদরাতে ঈদের প্রস্তুতি নেওয়ার আনন্দের মাত্রা ছিল ভিন্ন।

ঈদের দিন আনন্দের প্রধান জায়গাজুড়ে ছিল ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া। সে যুগে মানুষের ঘন ঘন পোশাকাদি কেনার সামর্থ্য ছিল না। সব বাড়ির ছোটরা অধীর আগ্রহে ঈদের জন্য অপেক্ষা করত। কারণ, বছরে একবার নতুন পোশাক পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা উজ্জ্বল থাকত। সাধারণ মুসলমান ঈদের দিন সন্তানদের নতুন পোশাক দেওয়া ধর্মীয় কর্তব্য মনে করতেন। বড়রাও সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন নতুন কিছু পরার। সামর্থ্যে না কুলালে পুরোনো পোশাক ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতেন। ধনী সামর্থ্যবানের সংখ্যা সে যুগে কম ছিল। তাই জাকাতদাতার সংখ্যা বেশি ছিল না। জাকাতদাতারা সাধারণত শাড়ি ও লুঙ্গি জাকাত হিসেবে দরিদ্র প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের দান করতেন।

সেমাই, পায়েস এবং ভাত-মাংস রান্নার চেষ্টা ছিল অনেক বাড়িতে। তবে ঈদ উপলক্ষে নানা ধরনের পিঠা বানানো গ্রামবাংলার একটি সাধারণ চিত্র ছিল। পোলাও-কোর্মা রান্নার রেওয়াজ দু-একটি ধনী বাড়িতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ঈদের দিন সবার দ্বারই ছিল অবারিত।

ঈদ উপলক্ষে অনেক গ্রামেই মেলার আয়োজন হতো। এখনো কোনো অঞ্চলে মেলা হয় শুনেছি। তবে ঈদুল আজহার চরিত্রটি ছিল আলাদা। এখনকার মতো গ্রামীণ সমাজে এত পশু কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। সাধারণত কোনো কৃষক তাঁর পালিত ষাঁড় বা অকর্মণ্য বলদ কোরবানি দিতেন। সীমিত সংখ্যক মানুষ সাত ভাগে গরু বা মহিষ কোরবানি দিতেন। বেশির ভাগ মানুষ কোরবানি দিতেন ছাগল বা ভেড়া। উনিশ শতকের নথিতে জানা যায়, সে যুগে ৫০ থেকে ১০০ টাকায় ভালো মানের খাসি পাওয়া যেত। কোরবানির শেষে মাংস বিতরণের পর ঈদের আমেজ অনেকটা থিতিয়ে যেত। পুরোনো ঢাকার আদি বসতিকারী পরিবারগুলোর মধ্যে ছেলে বা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কোরবানির গরুর আস্ত রান পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। এখনো রেওয়াজটি একেবারে হারিয়ে যায়নি।

তবে নাগরিক জীবনে ঈদের আবেদন ছিল কিছুটা আলাদা। পুরোনো নথিতে ঢাকার ঈদ উৎসব সম্পর্কেই বিশেষ জানা যায়। মোগল যুগে ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানী হওয়ার কারণে এবং ইংরেজ শাসনকালে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র হওয়ায় এখানে জনবসতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিদেশিদের মধ্যে উত্তর ভারত ও ইরান থেকে অনেক মুসলমান চাকরি ও ব্যবসা করার সূত্রে ঢাকায় বসবাস করেছেন এ সময়ে। তাই নানা অঞ্চলের মুসলমানদের সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটে ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে। এসব কারণে ঢাকায় ঈদ উৎসব একটি ভিন্ন মাত্রা পায়। মোগল যুগের শেষ অধ্যায়ে, অর্থাৎ নবাবি আমলে নায়েব-নাজিমদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল ঈদ উৎসব আয়োজনে। তবে সবচেয়ে বেশি আনন্দঘন ছিল ঈদুল ফিতরের দিনটি। এক মাস সিয়াম সাধনা, অর্থাৎ রোজা রাখার পর আসত ঈদের দিন। পুরো রোজায় শেষ রাতে সেহরি খাওয়ার জন্য ঢাকার মানুষের ঘুম ভাঙাতে মহল্লায় মহল্লায় হেঁটে হেঁটে কাসিদাশিল্পীরা কাসিদা গাইতেন।

ঈদের দিন ঢাকা শহরে ঈদের মিছিল বের করা হতো। ধারণা করা হয়, ঈদমিছিল আয়োজনের পেছনে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্মাষ্টমী মিছিলের প্রভাব থাকতে পারে। কারণ, অনেককাল আগে থেকে ঢাকা শহরে শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনে জাঁকজমকের সঙ্গে মিছিল বের করা হতো।

নবাবি আমলে ঈদের দিন নগরবাসীর প্রধান আকর্ষণ ছিল ঈদমিছিল। নায়েব-নাজিমদের তত্ত্বাবধানে এসব মিছিলে বেশ আড়ম্বর ছিল। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে চিত্রশিল্পী আলম মুসাওয়ার ঢাকার ঈদমিছিলের কয়েকটি ছবি এঁকেছিলেন। এই ছবি থেকেই আড়ম্বরের ধারণা পাওয়া যায়। এ সময় মিছিলে নেতৃত্ব দিতেন নায়েব-নাজিম স্বয়ং। সঙ্গী-সাথিসহ তিনি ঈদমিছিলে অংশ নিতেন। হাতির পিঠে তৈরি কারুকার্যখচিত হাওদায় বসতেন নায়েব-নাজিম। অন্যান্য অভিজাত বসতেন পালকিতে। ছাতা বরদাররা ছাতা হাতে এগিয়ে যেত। এসব ছাতাও হতো রঙিন ও কারুকার্য করা। এ ছাড়া রঙিন কাপড়ের পতাকা নিয়ে হাঁটত একেক দল মানুষ। মিছিলের সামনে বা শেষ দিকে ব্যান্ডপার্টি বাদ্য বাজাত। শত শত দর্শক ভিড় জমাত রাস্তার দুপাশে। আশপাশের বাড়িঘরের ছাদ ও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মানুষ এই মিছিল উপভোগ করত।

বিশ শতকে ইংরেজ শাসন যুগেও ঢাকা শহরে ঈদ উৎসবে ভাটা পড়েনি। এ সময় ঈদ উৎসবের প্রধান আয়োজক ছিলেন ঢাকার নবাবরা। তখন বাণিজ্য ও চাকরির সূত্রে অনেক ধনী অভিজাত শ্রেণির মানুষের বাস ছিল ঢাকায়। নানা অঞ্চলের জমিদারদের অনেকে ঢাকা নগরীতে বাগানবাড়ী কিনে বসবাস করতেন। সাধারণ মানুষের ভাষায় এঁরা ছিলেন ‘বাবু’। এই বাবুরা তাঁদের যাপিত জীবনে যে সংস্কৃতি ধারণ করতেন, তা ‘বাবু সংস্কৃতি’ নামে পরিচিত ছিল। বাবুরা ঈদ উৎসবে বাড়তি কিছু আয়োজন যুক্ত করতেন, যে কারণে বাংলার আটপৌরে ঈদ উৎসবের চেয়ে ঢাকার ঈদ উৎসব ভিন্ন মাত্রা পেয়ে যায়।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে ঈদের দিন রমনা, আরমানিটোলাসহ ঢাকার বড় বড় মাঠে মঞ্চ বানানো হতো। এসব মঞ্চে আয়োজিত হতো কত্থক নাচ। শহর ও শহরতলি থেকে অনেক মানুষ এসে এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করত। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত হতো নৌকাবাইচ ও ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতা। এসব আয়োজনে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। তবে বাবুদের তত্ত্বাবধানে ঈদের দিন দুটো অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো ঢাকায়। এর একটি হিজড়া নাচ আর অন্যটি ঘোড়দৌড়। হিজড়া নাচের আয়োজন তখন আভিজাত্যের প্রতীক ছিল। এ কারণে ঈদ এগিয়ে এলে হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের কদর বেড়ে যেত। যাঁর যাঁর মহল্লায় বাবুরা হিজড়া নাচের আয়োজন করতেন। তাই আগেভাগেই এক-এক হিজড়া দলকে বায়না করা হতো। একইভাবে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঘোড়দৌড়ের আয়োজন হতো। ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় বাবুরা অংশগ্রহণ করতেন।

বিশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকায় সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্ভবত ১৯১৯ থেকে ১৯২২ সালে আরমানিটোলায় প্রতিষ্ঠিত ‘পিকচার প্যালেস’ হলটি ছিল ঢাকার প্রথম সিনেমা হল। পরে যার নাম হয় ‘শাবিস্তান’। ঈদের দিন নগরবাসীর কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল সিনেমা হলে ‘ফুল সিরিয়াল’ দেখা। এতে এক টিকেটে রাতভর সিনেমা দেখার সুযোগ ছিল।

এমনি নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আঠারো, উনিশ ও বিশ শতকে ঢাকাবাসী ঈদ উদযাপন করতেন। এসব বিচারে বলা যায়, গ্রামীণ জীবনের উৎসবের চেয়ে নাগরিক জীবনের উৎসবে অনেকটা ভিন্নতা ছিল। তবে দুটোর মিলনেই ছিল আবহমান বাংলার ঈদ উৎসব।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।