গোপাল বাগচীর একগুচ্ছ কবিতা

Looks like you've blocked notifications!

জীবন-মরণ

ব্যাঙের মরণ সুর শুনেছো কখনো? যখন সে

সাপের গ্রাস থেকে নিজেকে ছাড়াতে ঢোল হয়ে ওঠে।

নিঝুম রাতে গা ছমছম করে,

তারপর একসময় পৃথিবী নিস্তেজ হয়ে পড়ে

ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত।

কোন পক্ষ নেবে তুমি? খাদ্য না খাদকের।

দু তরফেরই জীবন-মরণ সমস্যা।

খাদ্য-খাদকের এমন সম্পর্ক তো

পৃথিবীতে খাদ্য শৃঙ্খলেরই অংশ মাত্র।

তবে এ নিয়ে আর ভাববার কী? তবু

ইথারে ভেসে আসা ঐ করুণ সুরটুকু আর

ইতর প্রাণীতে থাকে না,

আঘাত করে চেতনার সমস্ত মর্মমূলে;

বুঝিয়ে দেয় জীবনের মাহাত্ম্য,

এক কঠিন আবেদনে।

 

মানুষ যদি কখনো মানুষের জন্য

খাদ্য কিংবা খাদক হয়ে ওঠে,

—কী বলবে তখন?

দেখবে, উচ্চতর জীবের বৈশিষ্ট্য মতো

পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে সে ভাগ হয়ে যাবে সুবিধে যেমন,

সেখানে ন্যায়-অন্যায় কেবল উপলক্ষ মাত্র।

 

হরণ যজ্ঞ

দেওয়া-নেওয়ার অভ্যেসটা ঠিক গড়ে ওঠেনি

কোনো কাল থেকে।

আমার রাজ্যে আমিই রাজা

বলতে পারো, নিভৃতচারী এক শাসক,

সেথা নেই কোনো আনাগোনা।

আমার কাছে তুমিও কিছু আশা করতে পারো না—

এই বইপত্র, প্রিয় কলম, সাজানো বাগান

রাজ্য, রাজদণ্ড কিংবা সোনার সিংহাসন।

তবে আমাকে নিরেট কৃপণ ভেবো না।

অন্তত একটি জিনিস তো আমি তোমাকে দিতেই পারি—

‘কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা অর্থাৎ

অধিকার করে নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা।’

তাতে আমার রাজ্য কেন শুধু?

আমিও যদি হরণ হয়ে যাই,

বাধা দেব না সে হরণ কার্যে, বরং

যোগ দেব তোমার যজ্ঞের আয়োজনে,

হতে রাজ-ভিখিরি এক, পরমানন্দে।

 

পথ গিয়ে মিশে

কাছাকাছি দুটি গাড়ি, জ্যামের মধ্যেও চলছিল,

থেমে থেমে, ধীরগতিতে।

একটিতে আমি অন্যটিতে অচেনা কেউ

তবু আমার দৃষ্টি পড়েছিল সেদিকে।

শাহবাগ থেকে গুলিস্তান, পাশাপাশি চলা

তারপর বিচ্ছিন্নতা, পথে যেটা হয়;

এ শুধু আমি জানতাম, উনি নন।

উনি কী ছিলেন, আমার জানা ছিল না

পুরুষ কিংবা নারী, কোন পেশার বা নেশার।

তবে মানুষ হিসেবে আমাদের

অমিলের চেয়ে মিলই থাকার কথা বেশি।

 

অমিল যা কিছু ছিল, ছোটখাটো সেসব

মানুষ মাত্রেই যেমনটি হয়।

তবে দু’একটিতে তফাৎ ছিল বিস্তর,

দেখলাম—

উনার ভবিষ্যৎ নেই, আমার একটু হলেও আছে।

আমি যখন চারপাশ দেখছিলাম, উনি ছিলেন চোখ মুদে।

আমি রুদ্রের কবিতা পড়ছিলাম,

উনি হয়তো আগেই পড়ে নিয়েছিলেন।

আমার পকেটে অনেকগুলো কেনাকাটার রসিদ ছিল

হিসাব-নিকাশ তখনো হয়নি;

ওনার ওসব গেছে চুকে।

আমি ছিলাম বসে, উনি শুয়ে।

আমি সময় দেখছিলাম, ওনার সে প্রয়োজন ছিল না।

 

বড় পার্থক্য—উনি পাশে থেকেও নেই, আমি আছি।

সম্ভবত ডাক্তাররা উনাকে আজই মৃত ঘোষণা করেছেন।

গাড়িটি ছিল লাশবাহী,

যে কারণে আমার চোখ পড়েছিল প্রথমে।

 

কিছুক্ষণ তরে ভাবনা ছিল সব জড় হয়ে।

মনে হলো—এত ছুটছি কেন? কিসের এত তাড়া?

এ মানুষটির জন্য রাস্তার জ্যাম কিংবা ফাঁকা

সে তো নয় কোনো বিষয়।

 

ক্ষণকালের জন্য আমরা একপথে ছিলাম বটে, তবু

আমার গন্তব্য ছিল জানা যদিও অস্থায়ী।

উনারটি ছিল অজানা-অনন্তে তবে স্থায়ী

যেখানে সব পথ গিয়ে মিশে। আর সেখানে

নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে আমাদেরও পথ বেয়ে চলা।

 

পরিমলের জীবন

পরিমলকে আমি চিনি, আমার প্রতিবেশী।

শুধু চিনি বললে কম বলা হয়,

ভালো করে তাকে জানিও বটে।

যুগের পরিবর্তন তাকে ছোঁয় না,

ভবিষ্যৎ তাকে টানে না, বর্তমান ছাড়া

নতুনের আহ্বানে বিশ্বাস নেই তার।

তাকে যদি কল্পনা করি, মনে হয়

একচাদরে সে কেবল শীত নয়,

পুরো জীবনটাই কাটাতে চায়

 এবং ভালোও বাসে।

 

এহেন পরিমলকে একবার বলেছিলাম,

স্কুল ভবনের কাজ চলছে

কালেকশনে এলে কিছু ধান দিও,

সবাই যেমন দিচ্ছে;

পরিমল দেয়নি।

‘দাওনি কেন ? আশ্রমে যে দাও।’

বলল, ’সাধু আমাদের শিলপড়া থেকে ধান রক্ষা করে,

স্কুল আমাদের কী করে?’

বললাম, ‘যেদিন তোমার ঘরে শিক্ষার আলো আসবে

সেদিন বুঝবে।’

প্রায় দু’যুগ পেরিয়ে গেল,

আমার অভিমানের অভিশাপ আজো ফলেনি;

হয়তো দূর্বাসা মুনি হলে কথা ছিল।

 

আজ এত বছর পরেও এসে দেখি,

পরিমল, সেই পরিমলই আছে,

—এতটুকুন বদলায়নি তার।

এখনো সে আগের মতই খবর রাখে :

কোথায় বাইচ, কোথায় ঘোড়দৌড়

কোথায় গান, কোথায় মেলা, আর

নিশি জেগে তার পালা-কীর্তন শোনা।

আছে খেলাধুলা কিংবা রথযাত্রা দেখা, সাথে

উৎসব-মহোৎসব, মানত, কত না সভা।

আছে বেড়ানো আর জরুরি নিমন্ত্রণ রাখা

আছে শ্রাদ্ধ-শান্তি কিংবা পুণ্যস্নানে যাওয়া।

কার বিয়েতে কীভাবে সকলে রওনা হবে,

নির্বাচন এলে কোন দলে যাবে,

এসব নিয়ে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।

তাস খেলা, পড়ে পড়ে ঘুম সেও আছে

গল্প-গুজব, তর্ক-বিতর্ক ঢের চলে মাঝে।

আছে টিভি চ্যানেল, সিনেমা শোতে বসা,

আবার সাধু-কবিরাজ, তেলপড়া-জলপড়া,

আর জাদুতে যত আস্থা।

 

এমনি করে,

জীবন কাটে তার সন্তান-সন্ততি নিয়ে

পরিমল বেশ সুখেই আছে, শান্তিতে কাটে।

কিন্তু এত কিছুর পরও এ যুগে এসে

সংসারে তার শিক্ষার কিছু নাহি ঘটে।

আজো সে পড়ে আছে—

শতবর্ষ আগের এক জীর্ণ সন্ধ্যাপাটে।

ভাবতে কষ্ট হয়—

পরিমল শুধু একা নয়, ওরা আছে

গ্রামের পর গ্রাম ধরে সব।

কেমন আছে, কী সুখে আছে,

 কে জানে?

 

স্বাভাবিক থাকতে চাই

আমি এমন অমৃত চাই না, যা খেলে

আর কোনো খাবার রুচবে না এ মুখে।

 

আমি এমন সৌন্দর্যে বিচলতি হই,

যাতে চোখ পোড়ে ; নার্সিসাস হই, কিংবা

অহংকারে মাটিতে পা না পড়ে।

 

এমন গান থাক না,

যাতে বাকি গান মনে না ধরে।

 

আমি এমন বিশ্বাসকে ভয় পাই, যা

অন্য কোনো বিশ্বাসকে রুদ্ধ করে দেবে,

আর অন্ধ করে দেবে।

 

আমি ধনকুবের হতে চাই না,

যাতে আমার ঘুম চলে যায়।

 

এমন খ্যাতি চাই না, যাতে

আমার জীবন আমার না থেকে

অন্যের হয়ে যায়।

 

আমি কেউকেটা হতে চাই না, যাতে

আমার জন্য সভা মুলতবি হয়ে যায়,

কিংবা দেরি করে শুরু হয়।

 

এমন প্রতিজ্ঞা করতে পারব না,

যাতে বাকি কাজ ভেস্তে যায়।

 

আমি এমন লেখা চাই না, যাতে

বাকি কোনো লেখা না পড়ি,

কিংবা অবজ্ঞা করি, আর

আমার পড়ার জগৎ ছোট হয়ে যায়।

 

আমি কট্টর হতে চাই না, যদি

কারো কোনো কথা কানে না তুলি।

 

আমি স্বাভাবিক থাকতে চাই,

আমাকে সাধারণ থাকতে দাও।

যা আমি নই, তা আমাতে আরোপ করো না

তা ভালো কিংবা মন্দ, যাই হোক।

আমার সত্যটিই কেবল প্রকাশিত হোক।