গল্প

আসা-যাওয়ার পথের ধারে

Looks like you've blocked notifications!

ইদানীং প্রতিবার দেশে যাওয়ার সময় ভাবি, কারোর জন্য আর কিছু নিয়ে যাব না।

কিছুর অর্থ টুকিটাকি জিনিস, ছোটখাটো উপহার। দেশে থাকলেও পুজোয়, পয়লা বৈশাখে কাছের মানুষকে কিছু দেওয়া-থোয়ার রীতি তো আছেই। আমরা প্রবাসী। বছরকার দিনগুলোর সময় যাওয়া হয় না। শীতের সময়েই কয়েক সপ্তাহ ছুটি কাটাতে যাওয়া, আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ, দেখাসাক্ষাৎ।

হাতে করে কিছু একটা দিতে পারলে মনটা বেশ ভালো লাগে।

বুঝতেই পারি, কেউ কিছু পাওয়ার আশায় বসে থাকে না। তা ছাড়া ওপেন গ্লোবাল মার্কেটের সুবাদে, এখন সব জিনিসই সর্বত্র পাওয়া যায়। এমনকি দেশে বা কলকাতায়, দিল্লি-মুম্বাইয়ে, বিলেত-আমেরিকার থেকেও ভালো ভালো উপহারসামগ্রী অপেক্ষাকৃত সুলভে মেলে।

কিন্তু মেলা-মিলিটা ব্যাপার না। জিনিসটাও বড় কথা না।

আসল হচ্ছে আবেগ, কিছু একটু হাতে তুলে দেওয়ার ইচ্ছে, ভালোলাগা জানানো। আর কে না জানে, আবেগ-ভালোলাগা-ইচ্ছে... এসবের কোনো নিশ্চিত ব্যাখ্যা নেই। থাকলে আছে, নয়তো নেই। সংগতি সচ্ছলতার একটা বাস্তব প্রশ্ন আছে বটে, কিন্তু মন থেকে ভালোলাগার কাছে সেটা খুব বেশি গুরুত্ব পায় না। তা ছাড়া অবস্থাপন্ন বা অসচ্ছল, এসবের ওপর কি ভালোলাগা নির্ভর করে! নাকি দেওয়া-থোওয়া!

তো সে যাক।

কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেখছি, খুচরো এইসব দেওয়া-থোওয়ায় বেশ হ্যাপা আছে।

ঘুরে ঘুরে মনে করে করে কেনা, গুছিয়ে স্যুটকেসের ওজন বুঝে টেনে-টেনে নিয়ে যাওয়া—এসব তো আছেই। কেউ বাদ পড়ে যাচ্ছে কি না মাথায় রাখলেও দেখি, দু-একটা ভুল হবেই। তার থেকে ভুল বোঝাবুঝি। এসবের ওপরেও আছে পছন্দ-অপছন্দ, ঠোঁট ওলটানো, তুলনা করা... তার থেকে জটিলতা। ভাবি, সিস্টেমটা বন্ধ করে দেব।

ভাবনাই সার। পরের বছর আবার প্রিয় মুখগুলো চোখের ওপর ভাসতে থাকে। বাড়ি যাওয়ার সময় কাছাকাছি এসে গেলেই কে যেন ভেতর থেকে একটা ঠেলা দেয়। টেনে বার করে নিয়ে যায় টাউন সেন্টারে। দোকানে দোকানে ঘুরি। পারফিউম-শার্ট-সোয়েটার-ক্যামেরা-ওয়াকম্যান-চকোলেট... একটু একটু করে ব্যাগ ভর্তি হয়ে যায়।

এবারেও ঠিক তাই হলো।

ওপরের ঘরে গিয়ে জিনিসগুলো খুলে খুলে দেখছি, মনে মনে হিসাব করছি কোনটা কাকে দেব। দু-একটা এয়ারলাইন্স সম্প্রতি বেশি ওজন নেওয়া অ্যালাও করে যাত্রী আকর্ষণের চেষ্টা করছে। সে কারণেই যথারীতি কেনাকাটা একটু বেশিই হয়ে গেল। ওদিকে দেশেও তো দেওয়ার লোক কমছে না, বরং বাড়ছে। ভাগ্নে-ভাইপো-ভাইঝি...এদেরও এখন ছেলেপুলে হতে শুরু করেছে। দেখাসাক্ষাৎ-হৈচৈ-হাসাহাসি হবে, বিয়ে-অন্নপ্রাশন-এনিভার্সারিতে যাওয়া হয় না, দেখা হলে কিছু একটা দেব না!

গিন্নি সবই খেয়াল রাখেন। স্যুটকেস গোছাচ্ছি, পাশ থেকে মুখ বাড়িয়েছেন।

কী কথা ছিল এবার! ঝাড়া হাত-পা চলে যাব, স্যুটকেস ভারী করব না...কী হলো?

ওই টুকটাক দু-একটা...।

বিছানার ওপর ডাঁই করা জিনিসের ওপর দৃষ্টি, এর নাম দু-একটা?

এক্সট্রা কিছু তো নিইনি! ছোটমামার জন্য মাছ ধরার হুইল, সুতো, বাদলদার একটা ম্যাসাজার, পন্টির একটা জ্যাকেট...আর সবই তো ছোটখাটো, শার্ট-সোয়েটারগুলোর কোনো ওজন নেই...।

কফির জার, স্যুপের প্যাকেট, চকলেটের বাক্স, মোজার বস্তা...ওগুলো?

নিলাম আর কী সঙ্গে... স্যুটকেসই যখন নিচ্ছি...ফাঁকা নিয়ে গিয়ে কী হবে! এবার থাকছিও এক সপ্তাহ বেশি। এ-ও-সে আসবে। দেওয়ার আর আছেটাই বা কী!

পরে কিন্তু বলো না, এত ভারী স্যুটকেস আর টানতে পারি না আজকাল।

কথাটা মিথ্যাও না। বয়স বসে নেই। প্রবাসী জীবনই ত্রিশ বছর হতে চলল। আগে আগে পাথরের মতো ভারী ভারী স্যুটকেস, হ্যান্ডব্যাগ, হাতে এক্সট্রা ঝোলা নিয়ে অবলীলায় যাতায়াত করেছি। ইদানীং হ্যান্ডব্যাগ ভারী হলে প্লেনের কেবিন-বক্সে তুলে রাখতেও কষ্ট হয়। তবু টানা-লাগেজ হওয়ায় অনেকটা সুবিধা।

শ্রীমতীর ঘরে গিয়ে দেখি, ওরে বাবা, জিনিস তো নয়, গন্ধমাদব পর্বত বিছানার ওপর। বুঝতে পারছি ওই মাল স্যুটকেসজাত করতে হলে, ঠেসে সব ভরে, ডালা বন্ধ করে ওপরে চেপে বসতে হবে। নয়তো তালা আটকানো অসম্ভব।

না বলে পারলাম না, এই এত জিনিস কার জন্য নিচ্ছো!

কিন্তু বলেই ভাবলাম, প্রসঙ্গটা উত্থাপন না করলেই ভালো হতো। আমার শ্বশুরবাড়ির দিকে পরিবারটি নেহাত ছোট না। আত্রেয়ীরা পাঁচ বোন, এক ভাই। গড়ে চার দিদিরই দুটি করে ছেলেমেয়ে, সবাই বিবাহিত, সকলেরই একটি-দুটি করে ছেলেমেয়ে হয়েছে, হচ্ছে। তা ছাড়া বউ-জামাইরা আছে। দিদি-বোনের সংসারের সঙ্গে বিবাহিতা মহিলাদের কত নিবিড় সম্পর্ক, স্বামী মাত্রই টের পেয়ে থাকেন। আমিও পেয়ে আসছি, তা সত্ত্বেও মুখ ফসকে...। প্রতিক্রিয়াও টের পেলাম মুহূর্তে।

এত কোথায়! সবই তো হালকা-পলকা, ছোটখাটো জিনিস। একমাত্র বুবাইয়ের স্যুটটাই যা..।

স্যুট! এ দেশ থেকে স্যুট নিয়ে যাচ্ছে ভাইয়ের জন্য!

একবারই তো। মুখ ফুটে কোনো দিন কিছু চায় না।

মাপজোক, ফিটিংস...।

টেলিফোনে সব জেনে নিয়েছি। যতই হোক, এ দেশের মতো কাটছাঁট এখনো কলকাতায় করতে পারে না।

কিন্তু নেবে কীভাবে! সুটকেসের ভেতর চাপে ক্রাস্ট হয়ে যাবে যে!

সে ইস্ত্রি করে নিলেই হবে। শুধু কোটটা তুমি হ্যাঙ্গারশুদ্ধ হাতে ঝুলিয়ে নেবে।

হাতে কোট ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে যেতে আমি যে কতখানি ঝুলে যাব, এ প্রশ্ন অবান্তর। ভয়ও আছে। আমিও জিন্স-জাকেট-জামা-সোয়েটার... যা যা নিয়েছি তার সব ফিরিস্তি দিতে হোক, আর চাই না। শুধু প্রতিবছরের মতো মনে মনে আর একবার সংকল্প করলাম, এই শেষবার। সামনের বছর থেকে শুধু হ্যান্ডব্যাগ নিয়েই...।

বাড়িতে আমাদের অংশটা তালা দেওয়া থাকে। চাবি থাকে দাদা-বউদির কাছে। কাছেপিঠে দুলু বলে আমার দীর্ঘকালের বন্ধু থাকে, ঘরবাড়ির ইন্টারনাল ডেকোরেশনের কাজ করে। একটা চাবি ওর কাছেও রাখা আছে। দু-এক বছর আগেই দিয়েছি। কাজকর্ম করানোর যুক্তিতে ইচ্ছে করেই রেখে এসেছি। মাঝে মাঝে যাবে, দেখবে।

মানুষ যেমন ঘরবাড়ি চায়, ঘরবাড়িও মানুষ ছাড়া থাকতে পারে না।

আমাদের অংশটা বেশ গোছানোই আছে। মোটামুটি বড় তিনতলা বাড়ি, খুব একটা সাবেককালের নয়, আবার ফ্ল্যাট সিস্টেম করা এখনকার মতোও না। একতলা দাদার, তিনতলাটা আমার, দোতলাটা আধাআধি। নতুন একটা সিঁড়ি করিয়ে নেওয়ার পরে, ইচ্ছে করলে আমরা আলাদা যাতায়াত করতেও পারি। দাদা-বউদির তিনটি কাজের মেয়ের মধ্যে একটিকে সম্বৎসর আমাদের দু-একশ টাকা করে দিতে হয়। সে আমাদের অংশ ঝাড়ামোছা, জানালা-দরজা খুলে দেওয়া, বন্ধ করা...এসব করে। মাধু মেয়েটা বিশ্বাসী, অনেক দিন ধরে থাকতে থাকতে প্রায় বাড়ির লোক। বছরান্তে চার-পাঁচ সপ্তাহ, আমরা গেলে ও আমাদের কাছেই থাকে।

এসবগুলো যাকে বলা যায়, অ্যারেঞ্জমেন্ট।

কিন্তু অ্যারেঞ্জমেন্ট থাকা, আর আসলে কী হয় বা থাকে, তা আমরা বেশ বুঝি। নিজেরা বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকলে, আর বাড়ির চাবি আত্মীয়র কাছে দিয়ে এলে, বাড়ি কার ভোগে লাগে সবাই জানে। এ তো আবার একই বাড়ি, শুধু আইনের দুই ভাগ। পন্টি দাদার ছোট ছেলে কিন্তু সে নায়েক হয়েছে। বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা-ফুর্তি, নাটকের রিহার্সালের জন্য আদর্শ জায়গা, আমার অংশ ছাড়া আর কোথায় হয়! দাদার মেয়ে-জামাইরা আগে। শালাশালিদের সঙ্গেও ওদের খুব যোগাযোগ।

প্রতিবার গিয়ে দেখি নানান উল্টোপাল্টা হয়ে রয়েছে।

দেয়ালে পেরেক, বিছানাপত্র ঘাঁটা, বালিশের ওয়াড় নেই, বইপত্র কমে গেছে, রান্নাঘরের অবস্থা খুব খারাপ, ফ্রিজের মধ্যে পুরোনো মাছের গন্ধ, বাথরুম নোংরা, ফ্ল্যাশের হ্যান্ডেল ভাঙা। মাধুকে নিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকে। আমরা চলে আসার পরে ওকে তো ওই বাড়িতে কাজ করতে হবে। আমরা যাওয়ার দু-একদিন আগে থাকতে যতটা পারে সাফসুতরো করে রাখে।

দুলুই বা কী করবে! ওর কাছে চাবি থাকাই সার। কোনো সময় ও গেলেও, আমি বুঝতে পারি, ঢুকতেও সংকোচ বোধ করে। আমার অনুপস্থিতিতে ওর যে ইচ্ছেমতো যাওয়া-আসার অধিকার আমি দিয়েছি, সেই অধিকার নেহাত আমারই মনের সান্ত্বনা।

বাস্তব অবস্থাটা আমার মেনে না নিয়ে উপায় নেই।

গলফগ্রিনের ফ্ল্যাটটা কেনার পর থেকেই দুলু বলছিল, বাড়ির একটা কিছু ব্যবস্থা কর শুভ।

করাটা দরকার হয়ে পড়ছে, আমি সব থেকে ভালো বুঝি।

মেইনটেন্যান্সের জন্য খরচ করতে হয়, বছরান্তে একবার গিয়ে থাকলেও, আয়োজন ঠিক রাখতে হয়। তার পর পৈতৃক বাড়ির সেন্টিমেন্ট আছে একই বাড়িতে নিজের দাদা আছে, সেটাও ব্যাপার। তা ছাড়া সব প্রবাসী বঙ্গসন্তানেরই ‘এবার বেশিদিন গিয়ে থাকব’ এই আবেগ আছে। তা ছাড়া দাদা-পন্টিরা রয়েছে বলেই অন্তত, আমার অংশটা হাতছাড়া হয়ে যায়নি, তাও ভাবি। ব্যবস্থা কর, বললেই কিছু করা যায় না। দুলুকে জিজ্ঞেস করি, কী করব?

যোধপুর পার্ক আর গলফগ্রিন কতদূর! ফ্ল্যাটটাও ছোট না, ওখানেই থাক এবার থেকে।

এটা নিজেদের বাড়ি, এলে সবার সঙ্গে দেখা, হৈচৈ হয়, কয়েক দিন সবাই একসঙ্গে থাকা হয়। যেমন রয়েছে...।

তেমন আর থাকবে না বেশিদিন।

এ কথার মধ্যে একটা সত্যের ইঙ্গিত আছে, বুঝেও যেন মানতে ইচ্ছে করে না। দুলুকে বলি, বিক্রি করতেও পারব না, ভাড়া দিতেও পারব না। একই বাড়িতে দাদারা রয়েছে।

আগে ওঁদেরই অফার দে। ওঁরা কিনে নেবেন তোর পোর্শন।

ওদের দরকার না থাকলে কিনবে কেন?

তখন তুই অলটারনেটিভ ব্যবস্থা করবি। ভাড়া দিয়ে দেওয়া, অথবা বিক্রি... আইন মেনে, ইচ্ছেমতো যেকোনোটাই করতে পারিস। তা নয়তো প্রতিবার তোর এই...।

ঠিকই বলেছিস...একটু একটু করে যেন ওদের হাতেই চলে যাচ্ছে।

অধিকারকে এস্টাব্লিশ করতে হয় শুভ। তার জন্য তোকে সময় দিতে হবে, এসে থাকতে হবে কিছুদিন... ফেলে রাখিস না।

প্রতিবার এই একই কথা হয়।

চারটে সপ্তাহ যেন দেখতে দেখতে কেটে যায়। বন্ধুবান্ধব নাটক-শান্তিনিকেতন-পিকনিক-বইমেলা-সুন্দরবন-বিয়ে খাওয়া... আমরা গিয়ে পৌঁছালেই বাড়িটায় যেন বাবা-মার কাল ফিরে আসে। পুরো বাড়িতে আলো জ্বলে। দিদি আসে, বোন আসে, ভাগ্নে-ভাগ্নি। জ্যাঠতুতো দাদা-বউদি, টিকে থাকা মামা-মামিরা। বাড়ির আলাদা অংশ বলে কিছু থাকে না। এদিকে মাংস রান্না হচ্ছে তো ওদিকে পাকোড়া ভাজা হচ্ছে। আমরা স্কচ খুলে বসেছি তো আর এক ঘরে কথার ঝাঁপি, টুকিটাকি দেওয়া-থোওয়া। হাসিহাসি, কথার টুকরো উড়ে আসে কানে। কেউ আবার গ্লাস নিয়ে নলচে আড়াল করে একটু ঢেলে নিয়ে যায়। সারা বাড়িজুড়ে রান্নার গন্ধ। ছোটখাটো উপহারগুলো যেন মহার্ঘ্য হয়ে ওঠে। ...এই সোয়েটারটা কী স্মুথ গো... কিংবা, আহ্ এই সেন্টটা কী দারুণ গন্ধ... একবার মাখলে সারা দিন থাকবে তো... এবার ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়েই পাহাড়ে যাব... বোন এসে পাঞ্জাবিটা গায়ের ওপর ধরল, এই রংটা তোকে খুব মানাবে। ভাগ্নে আসতে পারেনি, জামাটা খুব পছন্দ হয়েছে নিয়ে গ্যাছে। ভাইঝি বাচ্চার ড্রেসগুলো পেয়ে উচ্ছ্বসিত। ভগ্নিপতি বলল, আমার জন্য আবার কী দরকার ছিল!

ও তরফের জিনিসগুলোও ঠিক জায়গা এবং সময়মতো পৌঁছে যায়।

কিছু কিছু আমি জানতে পারি, কিছু আবার পারিও না। মুখগুলো খুশি দেখলে বেশ তৃপ্তি পাই।

দু-একদিন পাঁচ মিশেলি ঘরোয়া আড্ডা হয়। রোজ রোজ বেরোতে ইচ্ছে করে না। এবার ঠান্ডাটা ভালো পড়েছে কলকাতায়। দাদা-বউদিও যেন একটু বেশি ঠান্ডা হয়ে গেছে। দু-একদিন আমার এদিকে আড্ডা শেষ হতে হতে দেখি, ওদিকে অন্ধকার, গেটে তালা পড়ে গেছে। অসুবিধা নেই, আমার এ পাশ দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে।

আমরা ছুটি কাটাতে এসেছি। ওদের তো নিত্যদিনের কাজকর্ম আছে। খ্রিস্টপুজো-পয়লা জানুয়ারিও শেষ।

আমি আর দুলু আড্ডা দিচ্ছি। পন্টি এলো। ও এই রকমই আসে। গন্ধে সাড়ে ৭টা-৮টা।

দাদা কিংবা অন্য বড়রা থাকলে ও বেশি ফ্রি হতে পারে না। আমি কিংবা আমার বন্ধুদের সঙ্গেও দিব্যি সহজ বোধ করি। না করার কোনো কারণ নেই। ওর জন্য আমার একটা স্কচের কাটপিস রাখাই থাকে আলাদা করে। সময় সুযোগ মতো বসি।

আয় বোস। চেহারাটা ঝড়ো কাকের মতো কেন? কোত্থেকে এলি?

নানান ধান্ধায় ঘুরতে হয় কাকা। তোমাদের মতন কি সুখের জীবন!

আমাদের জীবনযাপনটা আর দেখলি কোথায়! ও দেশের মাটি বড় কঠিন রে।

হাহ, সে তোমাদের লাইফস্টাইল দেখেই তো মালুম হচ্ছে।

সে তো ওপর ওপর দেখা, যখন আমরা ছুটির মুডে আসি, থাকি।

ভালোই, বেস্ট অব চোখ সাইড...এখানকার হার্ডলাইফে আর কোপ করতে পারবে! মনে হয় না।

দেখি...এবার তো সেটাই হচ্ছে। নিবি তো একটু, তোর কোটা আমার রাখাই থাকে। বোস।

নেব! ক্লাবে অলরেডি আজ...আচ্ছা দাও...তোমার সিঙ্গল মন্ট তো?

মাধু নেই, তোর কাকিমাও এখনও ফেরেনি। একটা গ্লাস নিয়ে আয় রান্নাঘর থেকে। সঙ্গে খাবি কিছু...আনাবো?

ওহ নো। তোমার সঙ্গে কথা হচ্ছে না বলেই...। জল মিশিয়ে দিও না যেন। দুলু কাকু কেমন আছেন?

আছি আর কী...তোমার কাকা এলেই একটু চাঙ্গা হয়ে উঠি। আমি এবার উঠব।

উঠবেন কেন, বসুন। কাকা আর আপনাকে তো একসঙ্গে ধরাই যায় না।

কাকাকেই ধরো, আমি তো ‘ঘরকা মুরগি দাল বরাবর’। সময় পেলে চলে এসো বাড়িতে।

দুলু উঠেই পড়ল। আমিও আটকালাম না। পন্টির সঙ্গে একটু নিজের মতো ঘরোয়া আড্ডা দেওয়া যাবে।

উঠে দরজা বন্ধ করে দিলাম। তখনই মনে পড়ল পন্টির গিফটটা তো দেওয়া হয়নি। ওর জন্য সেন্ট মাইকেলের জ্যাকেট নিয়ে এসেছি। ডার্ক খয়েরি রং, কডের জিনস কাটিং। আমরা জানি, দুলু এই মার্চে বিয়ে করছে। পাত্রীকেও আমরা চিনি, চাকুরিয়ার এক প্রভাবশালী নেতার মেয়ে, অল্পস্বল্প এ বাড়িতে যাতায়াত আছে। বিয়ের সময় আমরা থাকব না, আবার আগে থাকতে যৌতুক দেওয়াটাও যেন বাড়াবাড়ি। সাময়িকভাবে পন্টির প্রেমিকার জন্য আত্রেয়ী একটা ঘড়ি উপহার নিয়ে এসেছে।

ফিরে আসতে গিয়ে বললাম, এক মিনিট বোস পন্টি, আসছি।

প্যাকেট নিয়ে এসে দেখি, পন্টি গ্লাস খালি করে ফেলেছে। হাতে একটা সিগ্রেট রয়েছে, ধরায়নি তখনও। বোধ হয় আমার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছে। কেননা, আমি ধূমপান করি না।

নিজে থেকেই বললাম, খাস যখন... ধরা। তবে স্মোকিংটা সময় থাকতে ছেড়ে দে। এটা দ্যাখ কেমন লাগে। তোর জন্য এনেছি।

পন্টি হাতে নিল জ্যাকেটটা, কিন্তু ভালো করে না দেখে পাশে রেখে দিল। ঘরের আলোটা জোরালো নয় বলেই বোধ হয়।

বললাম, দেখছি না জিনিসটা! দাঁড়া আলোটা জ্বেলে দিই। আর একটা ছোট্ট জিনিস আছে।

বড় আলো জ্বেলে দিলাম। পন্টি বলল, এটা তো দেখছি কডের জ্যাকেট। আবার কী?

তোর হবু-বউয়ের জন্য... তোর কাকিমা নিয়ে এসেছে। বিয়ের গিফট না, এমনিই।

আচ্ছা... ঠিক আছে। একটা ঢালো আমার গ্লাসে।

কোনো উচ্ছ্বাস টের পেলাম না। পন্টি যেন স্টিফ হয়ে রয়েছে। মুখটা থমথম করছে। গ্লাসে পানীয় ঢেলে এগিয়ে দিলাম। নে। গ্লাসে চুমুক দিল পন্টি। তারপর সোজাসুজি কথা বলল।

শোনো কাকা, তোমার সঙ্গে স্পষ্ট কয়েকটা কথা বলার আছে। প্রতিবারই ভাবি...।

বল না। কী এমন কথা!

তুমি বাড়িটা ছাড়ছো কবে বলো তো?

হঠাৎ যেন ঝাঁকনি খেলাম। বাড়িটা মানে! কোন বাড়ি? কার বাড়ি?

কোনটা আবার। আমাদের এই বাড়ি।

আমাদের বলতে... কাকে, কাদের মিন করছিস বল তো?

অভিয়াসলি আমাদের মানে... আমাদেরই...বাবা-আমি-মা-দিদিরা...এ আর বলার কী আছে!

ওর মধ্যে তাহলে আমরা নেই! আমি তোর কাকিমা, বুবু-দীপা...!

তোমরা আছো কোথায়? ছোটবেলা থেকেই তো দেখছি তোমরা নেই। বছরে একবার করে আসো, আনন্দ-ফুর্তি করে, এক মাস ছুটি কাটিয়ে নিজের ডেরায় ফিরে যাও। ওটাকে থাকা বলে না।

এবার আমাকেও স্পষ্ট হতে হবে। বললাম, তা...তোদের মধ্যে, তোদের সঙ্গে আমরা থাকি না, নেই, সেটা বলতেই পারিস। কিন্তু তার সঙ্গে বাড়ি ছাড়ার কথাটা উঠছে কীভাবে। আমার ভাবনা ছাড়ব, নাকি উঠব...আমিই ভাবব।

আলবৎ উঠছে। আমাদের বাড়ি, আমরা থাকি, মেনটেইন করি... প্রতিবছর তোমরা এসে কিছুদিন করে জুড়ে বসে থাকবে...এটা তো চলতে দেওয়া যায় না। ফ্ল্যাট কিনেছ...এবার ফোটো।

একসঙ্গে অনেক কথা এসে যাচ্ছিল। কিন্তু বলতে রুচিতে বাধছে। এ কার সঙ্গে কথা বলছি!

তার মধ্যেই পন্টি বলল। ফি বছর একবার এসে সবাইকে কিছু প্রেজেন্টেশনের ঘুষ দিয়ে ভাবছো, তোমাদের অধিকার কায়েম করে রাখবে সে জামানা আর নেই।...ভালয় ভালয় বললাম, ব্যবস্থা করো, নয়তো...। আর তোমার ওই টিকটিকি বন্ধুটাকেও বলে দিও, যেন বাড়ির চাবিটা আমাদের ফেরত দিয়ে যায়। তোমার মান রাখতেই নিজে থেকে চাইনি।

কয়েকটা শব্দ মাথার মধ্যে ঘুরছে... ঘুষ অধিকার জামানা। দেখছি, নিজের ভাইপোর বাচনভঙ্গিও। টের পাচ্ছি, আত্মসাৎ করার মানসিকতাজনিত ভয়, লোভ, স্বার্থপরতা, ইতরতা ওকে যেন কিছুটা পঙ্গুও করে তুলেছে। তাই অমার্জিত মুখের ভাষা।

হঠাৎ হেসেই ফেললাম। পন্টি চমকালো। বললাম, আচ্ছা পন্টি, একটা কথা বলত, বছরান্তে একবার ওই সব ছোটখাটো গিফটগুলোকে তোর ঘুষ দেওয়া মনে হলো কেন? ওগুলো তো সামান্য জিনিস। বাড়ির সঙ্গে তুলনা করা যায়!

আবার কী! ওগুলোর টোপ দিয়েই তো প্রতিবার এসে...।

আমি যদি এ বাড়ির আমার অংশটুকু তোকে বিয়ের যৌতুক হিসেবে দিয়ে দিই, সেটাকে কী বলবি! টোপ নাকি ঘুষ, আর কিছু? নাকি তারপর আর কোনোদিন আমি বাড়িতে ঢুকতে পাবো না? একটু ভেবে বলিস তো!

পন্টির মুখের ওপর দিয়ে দিশেহারা ভাবের যাতায়াত আমার নজর এড়ালো না। ও উঠে দাঁড়াল। জ্যাকেট আর ঘড়িটা ফেলে রেখেই পেছন ফিরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

আমি বাধা দিয়ে ডাকলাম। দাঁড়া পন্টি। ও দুটো নিয়ে যা... তোদের কথা মনে করেই এনেছি। অত সামান্য জিনিসকে ঘুষ বা টোপ কিছুই বলা যায় না, কিন্তু ‘ভালোবাসা’ বলে একটা কথা আছে। সে তুই বা তোরা মানিস বা না-মানিস।

দ্বিধাগ্রস্ত হলেও পন্টি জিনিসটা হাতে তুলে নিল। একটু দাঁড়াল। কিছু বলি বলি করেও বলতে পারল না। চলে গেল। আমি নিশ্চিত বুঝলাম, পন্টি একটা দোলাচলে পড়ে গেছে।