দেবী : কালির দাগ নিয়ে রূপকথা পাঠ
শহরে সম্প্রতি পরিবহন ধর্মঘটের বলি হয়েছে দুই শিশু। দুর্ঘটনায় মানুষ মরলেও চালকদের সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর দেওয়া যাবে না, আর ক্ষতিপূরণও পাঁচ লাখ টাকা তাঁরা দিতে পারবেন না। যেন তাঁরা মানুষ মারবেন বলেই ঠিক করে রেখেছেন। যেহেতু মানুষ মরবেই, তখন এই জেল-জরিমানা তাঁরা দিতে পারবেন না। এমন উদ্ভট আবদার আর অদ্ভুত সব উটকো বিপদ এই শহরে ওত পেতে থাকে দিন-রাত। রানুর সঙ্গে সর্বদা থাকা অশরীরী আত্মাটির মতোই, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনার ছাড় নেই।
রানু হলো হুমায়ূন আহমেদের ‘দেবী’ উপন্যাসের এক চরিত্র। উপন্যাস থেকে সম্প্রতি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন অনম বিশ্বাস। তো দুদিন ধরে চলা ধর্মঘটে ব্যক্তিগত গাড়ি বের করলেও তাঁদের মুখে মাখিয়ে দেওয়া হয় পোড়া মবিল বা সোজা বাংলায় কালি। একটি কলেজপড়ুয়া মেয়ের সাদা জামাতেও কালি ছিটিয়ে দেওয়া হয়। নৈরাজ্যের চূড়ান্ত উদাহরণ আর কী! এতে অন্য দেশবাসীর মতো আমার মনেও কালির দাগ পড়েছে। তো সেই দাগ নিয়েই আমি ‘দেবী’ দর্শনে যাই।
ছবির কাহিনী সংক্ষেপে এমন, রানু নামের একটি মেয়ে বিশ্বাস করে, তার সঙ্গে একজন অতিপ্রাকৃত সত্ত্বা বসবাস করে। ঘটনাক্রমে সেই অশরীরী হলো হিন্দুদের রুকমিনী দেবী। তার প্রভাবে রানু অনেক ঘটনা আগেভাগে বলে দিতে পারে। এটা নিয়ে সংসারে জটিলতা তৈরি হয়। এক বছর আগে বিয়ে করা স্ত্রীর এমন অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে স্বামী আনিস চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং এর প্রতিকার খুঁজতে দ্বারস্থ হন ক্লিনিকাল সাইকিয়াট্রির শিক্ষক মিসির আলির। আনিস আবার যে বাড়িতে ভাড়া থাকে, সেই বাড়ির মালিকের বড় মেয়ের নাম নীলু। মিসির আলি যখন দিন-রাত এক করে যুক্তিবিজ্ঞান দিয়ে রানুর রহস্যের কিনারা করার চেষ্টা করছে, তখন নীলু এক ভয়ানক সম্পর্কে জড়িয়ে যায় অপরিচিত এক পুরুষের সঙ্গে। তার নাম সাবেত। সাবেত আসলে একজন অসুস্থ মানসিকতার খুনি, ইংরেজিতে যাকে বলে সিরিয়াল কিলার। তার পাল্লায় পড়ে জীবন বিপন্ন হয় নীলুর। তখন রানুর সান্নিধ্য ত্যাগ করে সেই রুকমিনী দেবী নিজের অতিপ্রাকৃত শক্তি নিয়ে হাজির হয় নীলুর কাছে। সাবেতকে ছবক শিখিয়ে সঙ্গী হয় নীলুর। দেবীর প্রস্থানের পর মারা যায় রানু। পরে নীলুর চেহারাও ধীরে ধীরে রানুর মতো হয়ে যেতে থাকে, মানে দেবী দেবী একটা ভাব চলে আসে। এই হচ্ছে কাহিনী।
এই দেবীই রানুকে একবার রক্ষা করেছিল বিষ্ণুমন্দিরের ভেতর। জালালউদ্দীন নামের এক লোক মন্দিরের ভেতর কিশোরী রানুর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। তখন তথাকথিত দেবী প্রবেশ করে রানুর শরীরে। ঘটনার তোড়ে আতঙ্কিত জালালউদ্দীন সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে। উপন্যাসে আছে এই মন্দিরের বয়স বড়জোড় তিনশ বছর হবে। তখন পালবংশের লোকেরা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেবীকে তুষ্ট করার জন্য একটি বালিকা বলি দেওয়ার কথা। এখানে চলচ্চিত্রে অবশ্য বলা হয় আরো দুই বালিকাকে বলি দেওয়া হয়। যারা পরে দেবীর সঙ্গেই ঘোরাফেরা করে অতৃপ্ত আত্মা হয়ে। যেন দুই মেয়েকে নিয়ে এক মা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চলচ্চিত্রে মন্দিরের প্রাচীনত্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সময় ভ্রমণ হয় তিনশ বছর আগে, মানে ফ্ল্যাশ ব্যাক, সালটি দেখানো হয় ১৭৫৭ সাল। উপমহাদেশের রাজনীতির জন্য এই সালটি বেশ গুরুত্ব বহন করে। দেখা যায় ওই বছর এক বালিকাকে বলি দেওয়ার সময় খোদ দেবী এসে জল্লাদের কল্লা নিয়ে নেয়। রক্ষা পায় সেই বালিকা। একইভাবে আধুনিককালে এসেও এই রুকমিনী দেবী রক্ষা করে রানুকে। পরে খুন হওয়া থেকে বাঁচায় নীলুকেও। এই তিনটি ঘটনা থেকে যা দাঁড়ায় তা হলো দেবী নারীর রক্ষাকর্তী হিসেবেই হাজির হয় সব সময়। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এই যে নারীর অসহায়ত্ব ও শক্তিমত্তার জায়গাটি চিহ্নিত করা হয়েছে, সেটাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। অবশ্য মৌলিক ভাবনাটি হুমায়ূন আহমেদেরই। লেখক নারীশক্তির উদ্বোধন করতে চেয়েছেন। বলতে চেয়েছেন নারীকে হয় তো বলি দেওয়া যায়, ধর্ষণ করা যায়, বিকৃত লালসার বস্তু বানানো যায়, কিন্তু এসব কিছুর ঊর্ধ্বে নারীর শক্তি, অনেকটা যেন ঐশ্বরিক। এই শক্তিকে পার্থিব যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। মিসির আলিও তা পারেনি।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে হুমায়ূন তথা অনম কি তাহলে অন্ধ বিশ্বাসের প্রশংসা করলেন? বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে গেলেন? এই প্রশ্নের জবাবে আমি পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই, আরব্য রজনীর গল্পগুলো কি তাহলে জাদুবিদ্যার জয়জয়কার? শেক্সপিয়রের টেম্পেস্টও কি তাই? অথবা বাংলার ঠাকুরমার ঝুলি? নিদেনপক্ষে যদি বলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’? যেখানে এই দেবী উপন্যাসের মতোই অপার্থিব দুনিয়ার সুগন্ধ আর নূপুরের নিক্বণ নিয়ে হাজির হয় আড়াইশ বছর আগের দুনিয়া থেকে গুলবাগের কোন ইরানি ক্রীতদাসী? এগুলো কি তাহলে কুসংস্কারের প্রচারক? নিশ্চয় নয়। কাজেই আমি বলতে চাই ‘দেবী’ আধুনিক রূপকথা। এর বক্তব্য তাই আমার কাছে রূপক আকারে ধরা দেয়, বলতে চায়, নারীকে হয় তো আপাতদৃষ্টিতে দুর্বল ও ভঙ্গুর বলে বোধ হচ্ছে এবং সেটার সুযোগ পুরুষরা নিচ্ছে, কিন্তু নির্বোধ পুরুষেরা জানেনা নারী বা মাতৃশক্তি কি জিনিস! কেমনই বা তার দুর্গতিনাশিনী রূপ! নারীর অন্তর্শক্তিকেই উদ্বোধন করা হয়েছে এই রূপকথায়।
কাহিনীতে বর্ণিত রুকমিনী দেবীর অস্তিত্ব রয়েছে পুরাণে। তদানুসারে রুকমিনী বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কন্যা ও শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী। রুকমিনীকে বলা হয় লক্ষ্মীর অবতার। সে জন্যই কি পরিচালক ছবিতে রানুর পাশে একটি লক্ষ্মীপেঁচাকে বসিয়ে রেখেছিলেন? যদি সেই কারণেই হয়, তাহলে বলতে হয় চমৎকার রূপকের ব্যবহার করেছেন পরিচালক। ছোট করে বলে রাখি, এই রুকমিনী দেবীও পুরুষতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্রের শিকার হয়েছিল, কিন্তু যার প্রেমিক কৃষ্ণ তার আর চিন্তা কি? কৃষ্ণকেই বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে ফেলেছিল রুকমিনী, কিন্তু রুকমিনীর বাবা-ভাই কৃষ্ণের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে রাজি নয়। এমনকি তাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ারও বন্দোবস্ত করে ফেলা হয়। দমে যাওয়ার পাত্র নয় কৃষ্ণ। রুকমিনীকে সে হরণ করল এবং হবু শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলো। লড়াইয়ে জয় পেল কৃষ্ণ। যথাবিধি বিয়ের পর রুকমিনী হয় কৃষ্ণের প্রধানা স্ত্রী। কৃষ্ণ ও রুকমিনীর সংসারে দশ ছেলে ও একটি মেয়ের জন্ম হয়। পুরাণ অনুযায়ী হাঁটলে ছবির পরিচালক জোড়া ভূত না দেখিয়ে একটি ভূত রাখলেও পারতেন।
যাই হোক, ছবি দেখে আরেকটি প্রশ্ন দর্শকের মনে উদয় হতে পারে, উপন্যাসে তো তিনশ বছরের পুরোনো মন্দিরের কথা বলা ছিল, কিন্তু চলচ্চিত্র পরিচালক কেন ১৭৫৭ সালটিকেই বেছে নিলেন? স্রেফ অষ্টাদশ শতাব্দী বলেও তো ছেড়ে দিতে পারতেন। আমার ধারণা পরিচালক রাজনৈতিক পরাধীনতার সঙ্গে নারীর পরাধীনতাকে মিলিয়ে দেখাতে চেয়েছেন। ওই বছর পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের হাতে পরাজিত হন। ইংরেজরা যেন পুরুষতন্ত্রের রূপক আর সিরাজউদ্দৌলা যেন পরাধীন নারীদের প্রতীক। সেই পরাধীনতা থেকে নারীদের মুক্তি দিতেই যেন গুমরে গুমরে মরছে এক মহাশক্তি, যে শক্তি সুযোগ পেলেই ক্ষোভে, ক্রোধে, উন্মত্ততায় ফেটে পড়ে আর জালালউদ্দীন ও সাবেতের মতো লোকদের বিনাশ করে দেয়।
উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের এই বার্তাটি আমার কাছে খুবই অর্থবহ ও রূপক হিসেবে চমৎকার লেগেছে। জার্মান চলচ্চিত্র পণ্ডিত সিগফ্রিড ক্রাকোয়ারের ভাষায় চালচ্চৈত্রিক অভিযোজন বা সিনেম্যাটিক এডাপটেশনের পথেই হেঁটেছেন পরিচালক অনম বিশ্বাস। কয়েকটি জায়গায় পরিবর্তন আনলেও সাহিত্যের মূল প্লট ও বক্তব্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন পরিচালক। রানুর নীলু-বিলুকে গাড়িতে করে বাইরে যেতে নিষেধ করা, পরে গাড়িটি ছিনতাইয়ের কবলে পড়া, মিসির আলির সঙ্গে নীলুর শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কটি না দেখানো, দুটি বাচ্চা ভূতের আমদানি করা এমন কয়েকটি পরিবর্তন ছাড়া আর মোটামুটি প্রায় সব জায়গাতেই উপন্যাসকেই অনুসরণ করেছেন তিনি। তবে আমার মনে হয়েছে দৃশ্যের গাঁথুনি বা বয়ানরীতি আরো বেশি সুবিন্যস্ত হতে পারত।
আমার কাছে মনে হচ্ছিল, চলচ্চিত্রটি যেন পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে, দর্শককে পরিচালক গল্প বলছেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কোনো কিছু দানা বেঁধে উঠছিল না। ছবির এমন বিন্যাস থাকার পরও দর্শক গল্পটির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছে সহজেই, তার বড় কারণ ‘দেবী’ উপন্যাসটি প্রায় সকলেরই পড়া। কিন্তু পূর্বধারণা ছাড়া এই ছবি দেখলে দর্শকের একটু অস্বস্তি হতে পারে। এর কারণ হলো একাধিকবার রানুর অলস মুহূর্তকে হুটহাট করে হাজির করা। কখনো কখনো কোনো কোনো দৃশ্যকে মনে হয়েছে শুধু সময়ক্ষেপণের জন্যই আনা। এতে সুর কেটে যাচ্ছিল চলচ্চিত্রের। তা ছাড়া চলচ্চিত্রে গান থাকার যে বাঁধাধরা সূত্র, সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে গান ঢোকানোয় বেখাপ্পা হয়ে উঠছিল দৃশ্যগুলো। এটা যেন অনেকটা সেই অঞ্জন দত্তের ‘একটা দুষ্টু গান ঢোকান না দাদা, দুষ্টু গান ঢোকান’ গানের মতোই এখানে একটি রোমান্টিক গান ঢোকানো হয়েছে।
ছবিটির বড় ধরনের ত্রুটি ধরা পড়েছে ডাবিংয়ে। বহু জায়গাতেই চরিত্রদের মুখের সঙ্গে সংলাপ মিলছিল না। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক জিনিস বা প্রপসের ক্ষেত্রেও ধারাবাহিকতা বা কন্টিনিউটি ছিল না। যেমন মিসির আলির গলায় কখনো পুরোনো আমলের ছাই রঙা নোকিয়া মোবাইল ফোন। আবার কখনো দেখা গেছে কালো রঙের একটি বেসিক ফোন। তো যে লোকের থাকার মতো কেবল ফুটোওলা টিনের ঘর ও যে লোক কৃচ্ছ্রসাধন করে চলে বলেই প্রতীয়মান হয়, তার দুটো মুঠোফোন থাকার কথা নয়। আবার যখন গ্রামে যায় মিসির আলি, সেখানে গিয়ে সে কথা বলে মোবাইল ফোনের দোকান থেকে। তাহলে সে সময় তার ফোনটি কোথায় ছিল? মোবাইল ফোনের দোকান থেকে কথা বলার এই ঘটনাও উপন্যাসে নেই।
চলচ্চিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের মধ্যে রানু চরিত্রে জয়া আহসান ছাড়া আর কারো অভিনয় মন ছুঁতে পারেনি। এটার বড় কারণ বোধহয় চরিত্র অনুযায়ী অভিনয়শিল্পী বাছাইয়ে গলদ অথবা সঠিক নির্দেশনার অভাব। যেমন মিসির আলির যা বয়স ও অভিজ্ঞতা তার কোনোটির সঙ্গে চঞ্চল চৌধুরী যান না। উনি ভালো অভিনেতা কিন্তু এই চরিত্রের জন্য তিনি উপযুক্ত নন। জয়াকে কোনোভাবে ২৫/২৬ বছরের রানুর সঙ্গে টেনেটুনে মানিয়ে যায়। যদিও উপন্যাসে রানুর বয়স আরো কম : ১৬/১৭। নীলু চরিত্রে শবনম ফারিয়ার যে রকম প্রতিক্রিয়া দেওয়ার কথা ছিল অপহৃত হওয়ার পর, তা পাওয়া যায়নি। আতঙ্কের লেশটুকু ছিল, কিন্তু আতঙ্ক তাকে গিলে খায়নি। অথচ ও রকম মুহূর্তে নীলুর মূর্ছা যাওয়ার কথা। উপন্যাসে এখানটায় নীলুর বমি করে দেওয়ার কথা আছে। রানুর স্বামী আনিসের চরিত্রে অনিমেষ আইচ বেশ আড়ষ্ট। সাবেত চরিত্রে ইরেশ যাকেরকে অতি অভিনয়ে দুষ্ট বলে মনে হলো। বাকিদের নিয়ে আর মন্তব্য করতে চাই না। চরিত্রদের পোশাক নিয়ে আরো ভাবার অবকাশ ছিল।
চলচ্চিত্রের এসব খুঁটিনাটি ভুলত্রুটি সরিয়ে রেখে বলা যায়, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এই ছবিটি বুঝি শেষ পর্যন্ত যুক্তির ধার ধারল না, কুসংস্কারকেই বিজ্ঞাপিত করল, আগেই বলেছি এই ভাবনার বিকল্পে এটিকে রূপকথা ভাবা যেতেই পারে। তবে সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ (১৯৬০) কিন্তু রূপকের আশ্রয় নেয়নি, বরং সরাসরি কুসংস্কারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলেছে। সেখানে দেখা যায়, ছেলেবউ দয়াময়ীর ভেতর শ্বশুর কালিকিংকর স্বপ্নের মাধ্যমে দেবীমাতার অবতারকে আবিষ্কার করে, এবং এর পরিণতি ভয়াবহ হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর এ রকম একটি অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে আক্রমণ করেই ছবিটি বানান সত্যজিৎ। এই ছবির একটি উপসুরেও কিন্তু বেজে ওঠে নারীর পরাধীনতার কথা এবং শেষ বিচারে নারীর অপরিসীম শক্তির কথা। শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি দয়াময়ী শ্বশুরালয়ের বিধিনিষেধ, স্বামী, সংসার, সমাজের সকল সংস্কারকে মাড়িয়ে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে চলে যাচ্ছে। স্বামী উমাপ্রসাদের শত আহ্বানেও আর কোনো কাজ হচ্ছে না। সে যেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে নিরুদ্দেশের দিকে এই প্রস্থান দয়াময়ীর প্রবল ইচ্ছাশক্তিকেই প্রকাশ করে।
সেই যে জামায় কালি মাখা মেয়েটি হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ধর্মঘটের সময়, তিনশ বছর আগে যে মেয়েটিকে বলি দেওয়া হচ্ছিল মন্দিরের সামনে, অথবা রানুর যে শ্লীলতাহনি হচ্ছিল, নীলুকে নির্যাতনের পর হত্যাচেষ্টা কিংবা দয়াময়ীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল পিতৃ তথা পুরুষতন্ত্রের কুসংস্কার, খোদ রুকমিনী দেবীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে বাবা ও ভাইয়ের জোরজবরদস্তি—এ সকলই একটি সুতোয় গাঁথা—সেটি হলো নারীর পরাধীনতা, তার অধস্তন অবস্থা। কিন্তু এই নারীই অন্তর্গতভাবে অপার শক্তির আধার। পরাধীনতার কথা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু শক্তির আধার কেন? কারণ নারীর গর্ভেই মানবজাতির বেড়ে ওঠার ইতিহাস, নারীর স্তন্যেই তার পুষ্টি। আজ এটুকুই থাক। নারীশক্তির জয় হোক।
পুঁজি
১. হুমায়ূন আহমেদ, দেবী, মিসির আলি অমনিবাস-১, প্রতীক প্রকাশনী (২০০৫), ঢাকা।
২. সুধীরচন্দ্র সরকার (সংকলিত), পৌরাণিক অভিধান, এম.সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রা. লি. (১৪১২ বঙ্গাব্দ), কলকাতা।