নিবন্ধ

বদলে যাওয়া যুদ্ধের মাঠে উৎসব

Looks like you've blocked notifications!

রোমান লেখক ভিগিটিয়াসের মতে, Qui desiderat pacem praeparet bellum। ইংরেজিতে কথাটিকে বলা হয়, Let him who desire peace prepare for war। তাহলে যে ব্যক্তি শান্তি চায়, তাকে সব সময় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে? তার জীবনে হাসি-আনন্দ-উৎসব বলে কিছু থাকবে না?

প্রাচ্যের বিখ্যাত বই, চৈনিক সেনাপতি সান জু-র লেখা ‘দি আর্ট অব ওয়ার’ এখন বিশ্বের প্রায় সবখানে ম্যানেজমেন্টের অন্যতম পাঠ্যবই হিসেবে গণ্য। কারণ, সামরিক যুদ্ধের চেয়ে জীবনযুদ্ধ কোনো অংশে কম তো নয়ই, বরং আরো বেশি কূটকৌশলসম্পন্ন। যুদ্ধ ব্যবস্থাপনায় যেখানে ধোঁকা ও প্রতারণা বড় হয়ে দেখা দেয়, জীবনের ক্ষেত্রেও প্রায় প্রতিটি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হয় ওই ফাঁকি ও ধোঁকা থেকে। কদিন আগেও একটা বিজ্ঞাপনের এমন কথা ছিল, বাজারের হাজার ধোঁকা/বানাচ্ছে রোজ বোকা। মানে যেখানে পা রাখবেন, সেখানেই আছে ধোঁকা। বঙ্কিমের ভাষায়, ‘এই বিশ্বসংসার একটি বৃহৎ বাজার—সকলেই সেখানে আপনাপন দোকান সাজাইয়া বসিয়া আছে।’ বেচাকেনাই হলো জীবন। উৎসবও বেচাকেনানির্ভর। পূজার বাজার, ঈদের বাজার বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ। আর সেখানেই আছে ঠকে যাওয়া ও জিতে যাওয়ার খেলা।

কথিত আছে, এক ইউরোপীয় রাজা, আরব-মুসলমানরা যখন অপ্রতিরোধ্যভাবে একের পর এক দেশ জয় করে চলছিল, তখন এক চরকে পাঠিয়েছিলেন ভালো করে বুঝে আসতে যে, কোন কৌশলের ফলে আরবরা এমন ক্ষমতা অর্জন করেছে। চর যথারীতি আরবে আসে। সেখানের সবকিছু বুঝে নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যায় এবং রাজাকে জানায়, তাদের এই ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার মূল সূত্র তেমন জটিল কিছু না। তারা মাত্র দুটো নিয়ম মেনে চলে : এক—নিজে ঠকব না, দুই—অন্যকেও ঠকাব না।

ঘটনাটা জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অর্ধসত্য হলেও হতে পারে, যুদ্ধের ক্ষেত্রে নয়। যুদ্ধ মানেই শত্রুকে ফাঁদে ফেলা, উদ্ভাবনী কূটকৌশলের ভেতরে দিয়ে তাকে পরাজিত করা। সেখানে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হয়, শত্রুর ক্ষমতা সম্পর্কে আরো বেশি নিশ্চিত হতে হয়, সান জু-র মতে এটাই যুদ্ধ জয়ের প্রধান শর্তগুলোর একটি।

বিশ্বাসে বিশ্বাস করা নাকি, কৌশলে বিশ্বাস—এ দুয়ের দ্বন্দ্ব আছে। বলা হয়, এ যুগ হিম্মত নয়, হেকমতের। আসলে মানুষমাত্রই হেকমতের পথ বেছে নেয়। হিম্মত দেখানোটা জন্তু-জানোয়ারের প্রধান দিক, কিন্তু তাদেরও কি কলাকৌশল নেই? শিকারি পশু বা পাখি—প্রায় সবই হিম্মত ও হেকমত—দুটো মিলিয়ে টিকে থাকে। টিকে থাকা ও বেঁচে থাকার ভেতরেও পার্থক্য আছে। বেঁচে থাকলে টিকে থাকা হয়, নাকি টিকে থাকলে বেঁচে থাকা হয়—এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। উৎসব বেঁচে থাকারই একটা প্রতিধ্বনি। যার বা যাদের জীবনের উৎসব নেই, সে বা তারা বেঁচে নেই—এমনটাও বলা যেতে পারে।

প্রকৃত সুখী মানুষ তার প্রতিটি দিনকে উৎসবে পরিণত করতে পারে। আর জীবন তো ছোট। উৎসবের আনন্দ জীবনকে একটু বিস্তার দেওয়ারই একটা কৌশল। আনন্দময় জীবন ছোট হলেও বিস্তারে বড় হয়ে ওঠে। প্রতিদিন কোনো না কোনো অনুযোগ-আফসোস নিয়ে জেগে ওঠার তো কোনোই দরকার নেই। জীবনের কিছু সহজ নিয়মে বা কৌশলে যাপন করলেই তো আর কিছু লাগে না। যে যাকে ভালোবাসে তাকেও নিজে ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করা, যারা করে না—তাদের কথা মাথা থেকে দূর করে দেওয়া—এর একটি প্রধান ও সহজতম উপায়।

রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন, আমরা সবাই রাজা। রাজাকে রাজত্ব করতে হয়। শান্তি বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হয়, তেমন দুষ্টের দমন করতে হয়। আর করতে হয় যুদ্ধ। আমরা ষড়রিপুর (কাম-ক্রোধ-লোভ-মদ-মোহ-মাৎসর্য) কথা খুব বলি, কিন্তু ষড়গুণের (সন্ধি-বিগ্রহ-যান-আসন-দ্বৈধ-আশ্রয়) কথা বলি না। ষড়রিপুতে রয়েছে কাম—দৈহিক কামনা; ক্রোধ—রাগ মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না-পারা; লোভ—পরের জিনিস নিজের করে পাওয়া ইচ্ছা; মদ—নিজের ওপর মিথ্যা শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ, আমি কী হনুরে; মোহ—মনের অন্ধত্ব, বুদ্ধিলোপ বা মতিচ্ছন্ন দশা; মাৎসর্য—পরশ্রীকাতরতা, অন্যের ভালো দেখতে না পারা। অন্যদিকে ষড়গুণ যা মূলত রাজার থাকে, সেসবের একটু পরিচয় নেওয়া যাক : সন্ধি—চুক্তি; বিগ্রহ—যুদ্ধ; যান—অভিযান, যাত্রা; আসন—মর্যাদা, সম্মান; দ্বৈধ—সংশয়, সন্দেহ; আশ্রয়—সুরক্ষা করা।

আমরা যে বিষয়গুলো ষড়রিপু আর ষড়গুণের ভেতরে দেখলাম, প্রত্যেকটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘সামাল দেওয়া’ বা ম্যানেজ করার প্রসঙ্গ। আমরা এত এত মূল্যবোধের কথা বলি। সেটা তো ব্যক্তিকে এসব বিষয়কে সামাল দেওয়ার ভেতর দিয়েই অর্জন করতে হয়। কারণ জীবনের একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে শান্তি আর মাঝখানে থাকে নিয়ন্ত্রণ বা সামাল দেওয়া। তলস্তয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ উপন্যাসটি কেন আজো সবচেয়ে সেরা উপন্যাস হয়ে আছে, তার পেছনে আছে এই বিপুল সমাজ-সংসারের সামাল দেওয়া ও না দিতে পারার বাস্তবতা।

সামালটা দিতে পারলেই যুদ্ধ শান্তিতে পরিণত হয়, আর না দিতে পারলে শান্তি যুদ্ধতে রূপান্তরিত হয়। ভিগিটিয়াস বা সান জু-র সমস্ত কথার মূল হলো : নিজেকে এমন একটা প্রক্রিয়ার ভেতরে রাখা, যাতে সব সময় একটি জাতি বা মানুষ সতর্ক থাকে। এই সতর্ক থাকার আরেকটা মানে একালের এক দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী ধরিয়ে দিচ্ছেন : সতর্ক থাকার মানে হলো তর্কে থাকা। যখনই মানুষ তর্ক থেকে সরে যাবে, তখনই তার শান্তি যুদ্ধের দিকে মোড় নেবে। এটা কেবল সামরিক যুদ্ধ নয়, জীবনের প্রতি পদে বারবার এই কথাটি আমাদের মনে রাখার দরকার আছে। কিন্তু জীবন তো কেবল যুদ্ধেরই নয়, এতে হাসি আছে, আনন্দ আছে, ফুর্তি আছে, আছে উৎসব উদযাপনের দিন। সব মিলিয়েই জীবন। জীবন এক অনন্ত প্রবাহ। জগতের প্রাজ্ঞবান প্রায় সবাই এই প্রবাহকে মানতেন। কিন্তু তারা অন্য অনেক বিষয় নিয়ে তর্ক করেছেন। একজনের মতের সঙ্গে অন্যজন তো বটেই, বহু জনের মেলে না। তার পরও তর্ক চলে। তর্ক-ঘর আলোয় ভরে ওঠে বলে আমরা অনেক কিছু দেখতে পাই। তর্ক আসলে জীবনে যে কাজে লাগে, তা হলো মগজের ব্যায়াম। শারীরিক ব্যায়াম তো শরীরকে তাজা রাখে, তর্কের ব্যায়াম তেমনি তাজা রাখে বুদ্ধিকে। যত মত, তত পথ—তাই সত্যের একটা দিক, কিন্তু এটাও তো চূড়ান্ত সত্য নয়। চূড়ান্তে গিয়ে নেমেই আসাটাই বাস্তবতা। কারণ ওপরে উঠলে অনেক কিছু দেখা যায়, কিন্তু নিজেকে দেখাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সেটা হিমালয় জয় করাই বলি, আর নিজের দক্ষতার চূড়ান্তে ওঠাই বলি। নেমে আসাটাই অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর নেমে এসে যে জায়গাটতে সবার সঙ্গে মেলা যায়, সেই জায়গাটা উৎসবের জায়গা।

আমরা উৎসবের সময় তর্ক করি না—এটা তো জানা, কিন্তু জোরের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়, উৎসব কী? যেখানে তর্ক নেই, আছে সবার সঙ্গে নিজের মিলবার মিশে যাওয়ার আনন্দ। উৎসবের সময় সেই আনন্দই আমাদের আরাধ্য। মজার ব্যাপার হলো, আনন্দ ও উৎসব ও তর্ক—সবই জীবনের নিত্যদিনের বিষয়। আমার আজকে আনন্দ নাও থাকতে পারে, কিন্তু অন্যদের আজকে উৎসবের দিন। এক বাড়িতে মৃত্যুর শোক, পাশের বাড়িতেই হয়তো তখন চলতে পারে জন্মদিনের উৎসব। এমনই আরো অনেক কিছু নিয়ে জীবন। আর প্রত্যেকটি মাত্রায় জীবন এক-এক সময় ওঠে ও নামে। সবার ওপরে জীবনের এই বহুমাত্রিকতার সত্যই আসলে আমাদের বাস্তবতা হওয়ার কথা ছিল। সেটা হয়নি। কারণ আমরা বৈচিত্র্যের সুস্থতাকে নিজেদের জীবন দিয়ে বিচার করতে চেয়েছি। অথচ আমাদের প্রত্যেকেরই সীমাবদ্ধতা আছে।

অন্যের দিকে তর্জনী তুললে তিনটা আঙুল সব সময় নিজের দিকে থাকে। রবীন্দ্রনাথ এই বিষয়টি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তো আরো অনেক কিছু ধরিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে তার অবস্থানটাই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। আমরা তার দেখানো সত্য ও বাস্তবতাগুলো প্রায় ক্ষেত্রে ভুলে যাই।

সবচেয়ে বড় কথা এই যে, জগতের তাবৎ নিন্দা-মন্দ প্রায়ই অর্থহীন হয়ে যায়। প্রশংসাগুলোর দশাও তা-ই। হা হা হা করে হাসি পায়। অসুস্থ তর্কে দেখি কানা কানাকে পথ দেখাতে চায়। কে কাকে কী বলে? চালুনি বলে সুঁই তোর....হা হা হা—নিজের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় সীমাবদ্ধতার দেয়াল থেকে কেবল ধিক্কারের হাসি আমাদের দিকে ফিরে ফিরে আসে, আমরা শুনতে পাই না। এক বাউলের মূলমন্ত্র ছিল, ‘আমিই সব দোষের দোষী, সব দোষ আমার’—এটা জপ করো, তাহলে হয়তো মুক্তির একটা দিশা পাওয়া যেতেও পারে। কিন্তু তার মানে তর্ক-ঘর অন্ধকার করে রেখে দেওয়া যায় না। সেখানে আলো জ্বালাতে হয়, তর্কে বিশ্বাস রাখতে হয় যতটা, ততটাই রাখতে হয় কাজে। আর কাজের ভেতরেই মাঝেমধ্যে একটা আনন্দ আর উৎসব চাই। জীবনের উদযাপন চাই। টমাস আলভা এডিসন বলেছিলেন, সাফল্য মানে এক ভাগ প্রেরণা আর নিরানব্বই ভাগ পরিশ্রম। আমরা সেটার সাথে যোগ করতে চাই, ৩৫৬ দিনের মধ্যে এক ভাগ যতটা হয়, ততটা দিন উৎসব আনন্দ ও জীবনকে উদযাপনের জন্য রাখলে বাকি নিরানব্বই ভাগ কাজে বিপুল জোর আসে। যুদ্ধ তো থাকেই। কখনোই থামে না, কেবল মাঠ বদলে যায়, পরিপ্রেক্ষিত পাল্টে যায়। এর ভেতরে তাই উৎসব চাই। উৎসব তাই জীবনের চাবি, প্রেরণার সেই এক ভাগ। যুদ্ধ ও শান্তির মাঝখানের জায়গাটা উৎসব আনন্দ দিয়ে সামাল দিলে শান্তিটাই বড় হয়ে থাকে। একদিনের সুখ-আনন্দ-শান্তি নিয়ে হাজার দিনের দুঃখ-বেদনা-কষ্টকে সামাল দেওয়া যায়।