টঙ্ক আন্দোলন
আত্মত্যাগী হাজংরা বাধ্য হয় দেশ ছাড়তে
রাসমণি তাঁর বাহিনী নিয়ে পাহাড়ের অপরদিকে উপস্থিত হয়ে সোমেশ্বরী নদীর তীরে পুলিশ দলকে দেখে তাদের দিকে অগ্রসর হন। পুলিশদল তাদের সতর্ক না করেই প্রাণের ভয়ে মরিয়া হয়ে গুলি চালাতে থাকে। গুলি উপেক্ষা করে রাসমণির বাহিনী পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাজং চাষিদের দা, বর্শা ও তীর-ধনুকের আঘাতে কয়েকজন পুলিশ ধরাশায়ী হয়। আর পুলিশের গুলিতেও আহত হয় কয়েকজন চাষি। সবার সামনে থেকে প্রাণপণে দা চালাচ্ছিলেন রাসমণি, আর তাঁরই পাশে দাঁড়িয়ে বর্শা চালান তারই সাথি হাজংদের অন্যতম বীরসন্তান সুরেন্দ্র হাজং।
যে পুলিশটি হাজং-কন্যা সরস্বতীর (কুমুদিনী হাজং) ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছিল, রাসমণি তাকে খুঁজে পেয়ে তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে দায়ের এক কোপ বসিয়ে দিলেন। এই আঘাতেই পুলিশের মুণ্ডু তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। আর একজন এগিয়ে আসছিল তাকে রক্ষা করতে। সেও রাসমণির দায়ের আঘাতে ধারশায়ী হয়। বীর মাতা রাসমণির ভয়ংকর রূপ দেখে পুলিশদল তখন ভীত ও সস্ত্রস্ত হয়ে তাঁর দিকে উন্মত্তের মতো গুলিবর্ষণ করতে থাকে।
দশটি বুলেটে রাসমণির দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। যুদ্ধ করতে করতেই তাঁর প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাঁর পাশে যুদ্ধরত সুরেন্দ্র তাঁর বর্শা দিয়ে রাসমণির হত্যাকারী, সামনের পুলিশটির বুকে বর্শা নিক্ষেপ করে। মরণ আর্তনাদ করে ওই পুলিশ ধরাশায়ী হয়। কিন্তু তার আগেই পুলিশের ছোড়া একটি বুলেট সুরেন্দ্রের বুকে বিদ্ধ হয়। সুরেন্দ্রর প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
এভাবে প্রায় দুই ঘণ্টা চলে যুদ্ধ। খবর পেয়ে কয়েক গ্রামের যুবকরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দৌড়ে আসে। ক্ষিপ্ত হয়ে তারা পুলিশের দিকে বল্লম ছুড়তে থাকে। সশস্ত্র পুলিশ তখন নদীর দিকে আরো সরে যায়। শীতকালে নদীর জল অনেকদূর সরে গেছে। নদীর পাড় উঁচু। পুলিশের উদ্দেশ্য সেখান থেকে গুলি চালানো। সব পুলিশ নদীর দিকে সরে এলেও দুজন আলাদাভাবে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। সেখানে কিছু ঝোপঝাড় ছিল। ফলে দুজন পুলিশ বরাক বাঁশের বেড়ায় আটকে পড়ে। লতাপাতায় ঘেরা থাকায় ওখানে যে বেড়া আছে, তারা তা বুঝতে পারে না। ওই উঁচু বেড়া পার হওয়ার চেষ্টা করার সময় হাজংদের বল্লমের আঘাতে তারা মারা পড়ে। অন্যরা নদীর পাড়ে এলেও তাদের ওপরও বল্লম আসতে থাকে। এভাবে হাজং চাষি ও পুলিশ বা সিপাহিদের রক্তে সোমেশ্বরী নদীর বালুকাময় তীরভূমি রক্তরঞ্জিত হয়। পুলিশদের মধ্যে দুজন নিহত ও পনেরো জন আহত হয়। আর বিদ্রোহীদের মধ্যে বীরমাতা রাসমণি ও হাজংদের বীর সন্তান সুরেন্দ্র প্রাণ বির্সজন দিয়ে শহীদ হন। এভাবে বহেরাতলীর যুদ্ধে হাজং বিদ্রোহীরা জয় লাভ করে।
এর ফলে মামলা হয় মণি সিংহসহ অনেকের নামে। এই সংঘর্ষের পরে সরকারের তরফ থেকে ওখানে চলে ব্যাপক অত্যাচার। হেলিকপ্টার এসে আকাশে টহলও দিতে থাকে। বহেরাতলীর খবর পৌঁছে যায় কলকাতায়ও। তখন কলকাতার ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা হতে অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হয় একটি কমিটিকে। সে কমিটিতে ছিলেন জ্যোতি বসু, ব্যারিস্টার স্নেহাংশু আচার্য্য, সাংবাদিক প্রভাত দাশগুপ্ত প্রমুখ। কিন্তু টঙ্ক আন্দোলন তখন আর অগ্রসর হয় না।
১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাস। হালুয়াঘাটের নাগের পাড়ায় কমিউনিস্ট পার্টির ময়মনসিংহ জেলা কমিটির এক সভায় পুনরায় টঙ্ক আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। তড়িৎ গতিতে চলে এর প্রচার কার্যক্রমও। সে সময় আওয়াজ ওঠে—টঙ্ক প্রথার উচ্ছেদ চাই, জান দিব তবু ধান দিব না, জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ চাই, লাঙ্গল যার জমি তাঁর প্রভৃতি। এ ছাড়া লেভী ধানের বিরুদ্ধেও তখন আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এ সময়কার আন্দোলন চলে জঙ্গি রীতিতে। ফলে সরকার তখন পাহাড়ের পাদদেশে দুই তিন মাইল অন্তর অন্তর সশস্ত্র পুলিশ ক্যাম্প বসায়। তাদের এক একটি ক্যাম্পে রাখা হয় পঁচিশ-ত্রিশজন সশস্ত্র সিপাহি। ফলে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের বহু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে থাকে।
নীল চাঁদ হাজং থাকতেন চৈতন্য নগরে। তাঁর নিকট হতে জোর করে জমিদারের লোকেরা টঙ্কের বিশ মণ ধান নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ওই সময় গ্রামবাসী বাঁধা দিয়ে তা ছিনিয়ে নেয়। ১৯৪৮ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। কলমাকান্দার বটতলায় আটক করা হয় টঙ্ক ধান। খবর পেয়ে পরদিন থানার দারোগা আসে ছয়জন সশস্ত্র পুলিশ, আনসার ও চকিদার নিয়ে। তারা গরুর গাড়িতে করে আটক ধান তুলে নিতে চাইলে গ্রামবাসী বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশ প্রথমে তাদের লাঠিচার্জ এবং পরে গুলি করে। ফলে দুই কৃষক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়। কিন্তু তবুও ঐক্যবদ্ধ কৃষকেরা টঙ্কের ধান তাদের নিতে দেয় না। বরং গ্রামবাসীর ভয়ে পুলিশ তখন পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অতঃপর ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে চৈতন্যনগরে জমিদারের কাচারী দখল করে আন্দোলনকারীরা। এরপরই কালিকাপুরে দুই গাড়ি ধান আটক করে হাজং রমণী মানিক, কলাবতীসহ বিশজন নারী। এভাবে প্রায় সব গ্রামেই টঙ্ক ধান, লেভী, মহাজনের ধান দেওয়া বন্ধ করে দেয় আন্দোলনকারী কৃষকরা। আন্দোলনে হাজং কৃষকেরা ছিল খুবই দুর্ধর্ষ। তাই সশস্ত্র হলেও পুলিশরা তাদের খুব ভয় করত।
গারো পাহাড়ের কাছেই লেঙ্গুরা বাজার। সেখানে মঙ্গল সরকার ছিলেন হাজংদের নেতা। ১৯৪৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। হাটের দিন। মঙ্গল সরকার পঁচিশ-ত্রিশজন নিয়ে টঙ্কের প্রচারকাজে নামেন। ওখানে ছিল পুলিশের একটি সশস্ত্র ক্যাম্প। মঙ্গল সরকারের দল স্লোগান দিতেই পুলিশ তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। ফলে ঘটনাস্থলেই মঙ্গল সরকার, আগেন্দ্র ও সুরেন্দ্র শহীদ হন। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামে। গ্রামের মানুষ তখন হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়েই ছুটে আসে। তারা ঘেরাও করে পুলিশদলকে। পুলিশও অনবরত গুলি চালাতে থাকে। ফলে গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে মারা যায় শঙ্খমণি, রেবতী, যোগেন, স্বরাজসহ আরো ১৬ জন আন্দোলনকারী।
টঙ্ক আন্দোলনের একপর্যায়ে হাজংরা বোমা ও বন্দুক তৈরি শিখে নেয়। নালিতাবাড়ির শচী রায় বোমা তৈরি করতে গিয়েই সে সময় মারা যান। বোমা ও বন্দুকের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্দোলনকারী হাজংদের মনোবল যায় বেড়ে। ক্রমে তারা পুলিশ ক্যাম্পও আক্রমণ করতে থাকে। এভাবে পুরো এলাকা তখন রণক্ষেত্রে পরিণত হতে থাকে। সশস্ত্র পুলিশদলও মরিয়া হয়ে ওঠে। কলমাকান্দার জায়গীরপাড়া গ্রামটি পুলিশ এক রাতে চারদিক থেকে ঘেরাও করে গুলি চালায়। ওইদিন অনেককেই হত্যা করে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর পুলিশ বাহিনী আক্রমণ করে গারো পাহাড়ের পাদদেশ, রানীপুরেও। সেখানে পুলিশের গুলিতে শহিদ হয় দুবরাজ, অনন্ত, ক্ষিরোদ প্রমুখ।
একসময় সিলেটেও টঙ্ক আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। সিলেটে টঙ্ক আন্দোলনের নেতা ছিলেন রবিদাম। তিনি খুবই সাহসী ও দুর্ধর্ষ ছিলেন। তিনি একদিন দলবল নিয়ে যান মোহনপুরে। সেখানে মজুদ করা ধান উদ্ধার করে তা বিলিয়ে দেওয়া হবে সাধারণ কৃষকদের মাঝে। এ খবর জেনে যায় পুলিশ। তারা গোপনে ঘেরাও করে রবিদামের দলকে। ফলে গোলাগুলি চলে। ওইদিন পুলিশের গুলিতে স্পটেই মারা যায় বীর যোদ্ধা রবিদাম। নানা জায়গায় এভাবে সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলে আরো প্রায় বছর দেড়েক।
তখন ১৯৫০ সাল। ক্ষমতায় আসে মুসলিম লীগ। তারা এসেই টঙ্ক আন্দোলনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন তখন জনসভা করেন সুসং এলাকায়। তিনি বক্তৃতায় সেখানে টঙ্ক উঠিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন—টঙ্ক উঠিয়ে দিচ্ছি। সবাই জমির স্বত্ব পাবে, জমিদারি প্রথাও আইন করে তুলে দেওয়া হবে। রাস্তা দিয়েছি, স্কুল দিয়েছি, কাজেই তোমরা এখন আন্দোলন থামিয়ে দাও।
এই ঘোষণায় আশ্বস্ত হয়ে টঙ্ক আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়া হয়। আন্দোলনকারী হাজং কৃষকরাও আশায় বুক বাঁধেন। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার তাদের ওপর শুরু করে আরেক অত্যাচার। হাজংদের তারা বিপজ্জনক মনে করে। সীমান্ত এলাকায় হাজং বিদ্রোহী গ্রুপকে সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে—মুসলিম সরকারের মনোভাব ছিল এমনটাই। তারা তাই হাজংদের গ্রামে গ্রামে বিভীষিকাময় অত্যাচার চালানো শুরু করে। বিদ্রোহীদের বাড়িগুলো ভেঙে ফেলা, লুণ্ঠন ও নারীদের ওপর অত্যাচার, ক্ষেত-খামার ধ্বংসের কাজ চলতে থাকে অনবরত। হাজংদের ঠেকাতে সরকার জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসলমান কৃষকদের এনেও বসিয়ে দিতে থাকে সুসং এলাকায়।
ফলে টঙ্ক আন্দোলনে যে হাজংশ্রেণি রক্ত দিল, টঙ্ক বাতিলের পর সেই হাজংদেরই দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হলো। লক্ষাধিক হাজং ছিল তখন। নির্মম অত্যাচারে টিকতে না পেরে তাদের অধিকাংশই ভারতের আসামে চলে যেতে বাধ্য হয়।
শহীদ রাসমণি হাজংয়ের আদর্শ, জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ বাংলা তথা ভারতের কৃষক-সংগ্রামে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিল। তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হাজংচাষিদের সংগ্রামের পরবর্তী স্তরেও টঙ্ক প্রথার উচ্ছেদের জন্য শহীদ হন হাজং চাষিদের বীরকন্যা রেবতী ও শঙ্খমণিসহ আরো প্রায় একশত পঞ্চাশ জন হাজং বীরসন্তান।
মূলত রাসমণি ও হাজংদের বীরসন্তান সুরেন্দ্রের মতো শ্রেষ্ঠ হাজং বীরদের আদর্শ এবং আত্মবলিদানের ফলেই পরবর্তীকালে, অর্থাৎ ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টঙ্কবিরোধী হাজং বিদ্রোহ আরো ব্যাপক আকারে, আরো রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে পেরেছিল। শেষ পর্যন্ত হাজংদের ওই বিদ্রোহের ফলেই পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চল থেকে টঙ্কপ্রথার অবসান ঘটে।