হুমায়ূননামা

আহমদ ছফার আশ্চর্য স্বপ্ন

Looks like you've blocked notifications!

            ... terrible nouveauté!

Tout pour l’oeil, rien pour les oreilles!

            ... কি ভয়ানক আবিষ্কার!

সকলই চোখে পড়িতেছে, কানে কিছুই পশিতেছে না!

                                    —শার্ল বোদলেয়র

পরলোকগত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ জীবনের শেষদিকে একাধিক স্মৃতিকথায় মহাত্মা আহমদ ছফা প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়াছিলেন। একটি স্মৃতি আলেখ্যে তিনি জানাইয়াছিলেন তাঁহার প্রথম জননন্দিত উপন্যাস—‘নন্দিত নরকে’—প্রকাশের সার্বিক ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন আহমদ ছফা। হুমায়ূন আহমেদ স্মরণ করিতেছিলেন, ‘এক রাতে লেখা ষাট পৃষ্ঠার এই লেখাটির কাছে আমি নানানভাবে ঋণী। এই লেখাই আমাকে ঔপন্যাসিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছিল। এই একটি লেখা প্রকাশিত হবার পর অন্য লেখা প্রকাশে আমার কোনো রকম বেগ পেতে হয়নি।’ হুমায়ূন আহমেদ আরো জানাইয়াছিলেন, ‘কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, নন্দিত নরকে আমার প্রথম উপন্যাস নয়। আমার প্রথম লেখা “শঙ্খনীল কারাগার”; প্রকাশিত হয় নন্দিত নরকের পরে।’ (আহমেদ ২০১২: ৮ এবং আহমেদ ২০১৬: [সাত])

হুমায়ূন আহমেদ লিখিয়াছেন, ‘“শঙ্খনীল কারাগার” উপন্যাসটির সঙ্গে আনন্দ-বেদনার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমার বাবা আমার কোনো লেখাই পড়ে যেতে পারেন নি—এই পাণ্ডুলিপিটি পড়েছিলেন। বাবা যাতে উপন্যাসটি পড়েন সেই আশায় আমি ভয়ে ভয়ে পাণ্ডুলিপিটি তার অফিসের অসংখ্য ফাইলের এক ফাঁকে লুকিয়ে রেখে এসেছিলাম। উপন্যাস পড়ে তিনি কী বলেছিলেন, তা এই রচনায় লিখতে চাচ্ছি না। পৃথিবীর সব বাবাই তাদের পুত্রকন্যাদের প্রতিভায় মুগ্ধ থাকেন। সন্তানের অতি অক্ষম রচনাকেও তারা ভাবেন চিরকালের চিরদিনের লেখা।’ (আহমেদ ২০১২: ৮; আহমেদ ২০১৬: [সাত])

‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি পড়িয়া লেখকের বাবা সত্য সত্য কি বলিয়াছিলেন তাহা তিনি অবশ্য আরেকটি স্মৃতিকথায় লিখিয়াছিলেন: ‘একসময় বাবা এসে গম্ভীর ভঙ্গিতে দুপুরের খাবার শেষ করলেন। আমার লেখা বিষয়ে কোন কথা বললেন না। সন্ধ্যাবেলা মাগরেবের নামাজ শেষ করে মা’কে ডেকে বললেন, আল্লাহপাক তোমার বড় ছেলেকে লেখক বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। শুকুর আলহামদুল্লিাহ।’ (আহমেদ ২০০৯: ২৫)

২০১২ সনের পূর্বোক্ত স্মৃতিকথায় হুমায়ূন আহমেদ অধিক কিছু স্মরণ করিয়াছেন: ‘“শঙ্খনীল কারাগার” উৎসর্গ করি আহমদ ছফা এবং আনিস সাবেতকে। আহমদ ছফা আমার প্রথম উপন্যাস প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। অসাধারণ একজন মানুষ। আনিস সাবেত আরেকজন অদ্ভুত মানুষ!’ (আহমেদ ২০১২: ৮; আহমেদ ২০১৬: [সাত])

আহমদ ছফার কথা লইয়াই এই নিবন্ধ। তাই তাঁহার কথায় ফিরিবার আগে আনিস সাবেত নামটি লইয়া দুইটি কথা বলিয়া রাখি। বেশিদিন আগের কথা নহে। তবু বলিব এ যুগে যে সকল পাঠক-পাঠিকা আনিস সাবেতের নাম শুনিয়াছেন তাহাদের সংখ্যা আঙ্গুলেই গোণা যাইবে। জীবন এ রকমই। আনিস সাবেত চরিত্রটিকে হুমায়ূন আহমেদ বড় ভালবাসিতেন। তাঁহার অনেক কথাতে ইহার প্রমাণ মেলে: ‘রোগা লম্বা বৈশিষ্ট্যহীন এই মানুষটি হৃদয়ে ভালোবাসার সমুদ্র ধারণ করেছিলেন। মানুষ ফেরেশতা নয়। তার মধ্যে অন্ধকার কিছু দিক থেকেই যায়। আনিস সাবেতের ভিতরে অন্ধকার বলে কিছু ছিল না।’ হুমায়ূন আহমেদ স্মরণ করিয়াছিলেন, ‘সচেতন পাঠক হয়তো লক্ষ্য করেছেন, আমার অনেক উপন্যাস ও নাটকে আনিস নামটি ঘুরেফিরে এসেছে। যখনই কোন অসাধারণ চরিত্র আঁকতে চেয়েছি, আমি নাম দিয়েছি আনিস।’ (আহমেদ ২০১২: ৮, আহমেদ ২০১৬: [সাত]-[আট])

আনিস সাবেত বড় অল্প—অনুমান ৪১ বছর—বয়সে ইংরেজি ১৯৮৮ সনের নবেম্বর মাস নাগাদ কানাডার কোন শহরে এন্তেকাল করেন। তাঁহার অন্তর্ধান উপলক্ষে শোকাতুর আহমদ ছফা কিছুদিন পর লিখিয়াছিলেন, ‘আমার চেয়ে বয়সে কম অনেক তরুণ আছেন, যাঁদের নানা বিষয়ে পারঙ্গমতার জন্য পছন্দ করে থাকি। কিন্তু মানুষ হিসাবে যথার্থ বড় অধিক তরুণের সাক্ষাৎ লাভের সৌভাগ্য আমার অদ্যাবধি ঘটেনি। ক্ষমা, মেধা ইত্যাদিতে বড় বেশ কয়েকজন তরুণের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কিন্তু যথার্থ অর্থে চরিত্রবান, দয়া, মমতা, দৃঢ়তা এবং নানাবিধ মানবিক গুণসম্পন্ন তরুণ একটিই দেখেছি—তার নাম আনিস সাবেত।’ (ছফা ২০০৮: ২৪৩)

এই আনিস সাবেত প্রসঙ্গে বলার মত একটা গল্প আমারও আছে। সে গল্পও আহমদ ছফার সহিত জড়িত। সে কথা পরে হইবে, এক্ষণে অন্য একটা কথা বলি। আহমদ ছফার লেখা হইতেই জানিতে পারিলাম, আনিস সাবেতের গ্রামের বাড়ি ছিল কুমিল্লা জেলায়। প্রসঙ্গক্রমে ছফা জানাইয়াছিলেন, ‘ডেমোক্রেটিক লীগের নেতা অলি আহাদ ছিলেন আনিসের আপন মামা।’ আহমদ ছফা আরো প্রকাশ করিয়াছিলেন, হুমায়ূন আহমেদের সহিত আনিস সাবেতের পরিচয়টাও সম্ভবত এই কুমিল্লাতেই ঘটিয়াছিল।

ঔপন্যাসিক পরিচয়ের আনন্দ গোটা বিশ কলা পুরা হইবার পর একপ্রস্ত স্মৃতিকথায় হুমায়ূন আহমেদ আরো একবার আহমদ ছফা আর আনিস সাবেতের কথা পাড়িয়াছিলেন। লিখিয়াছিলেন, ‘তখন দেশ সদ্য স্বাধীন হইয়াছে। আমি, আহমদ ছফা এবং আনিস ভাই তিন জন সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকি। আমাদের চোখে কত না স্বপ্ন! সাহিত্যের সাধনায় জীবন উৎসর্গ করব। চিরকুমার থাকব, জীবনকে দেখার ও জানার জন্যে যা করণীয় সবই করব।’ (আহমেদ ২০১২: ৮)

আহা, স্বপ্ন শব্দটার কতই না অর্থ মনুষ্যের ভাষায়! একটা অর্থ এই রকম—উৎসর্গ করার, চিরকুমার থাকার কিংবা যাহা যাহা করণীয় তাহার সবটাই করার সংকল্প। আরও একটা অর্থ কিন্তু আছে স্বপ্নের। সে অর্থ নিদ্রার চাহিতেও ঠুন্কা—অল্প বাতাসেই তাহার ডগা ভাঙ্গিয়া যায়। হুমায়ূন আহমেদের সততা অনিন্দ্যসুন্দর। তিনি অকপটে স্বীকার করিয়াছিলেন, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ বইটির চাপে তিনি আর স্বপ্নের পথে অধিকদূর যাইতে পারিলেন না। জানাইলেন, এই লেখাটি পড়িয়া একটি ‘অষ্টম শ্রেণীর বালিকা’ তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে আসিল। প্রথম আঘাতেই তাঁহার স্বপ্ন বা প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গিয়া গেল। শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অতি বিখ্যাত একটি কথার পুনরাবৃত্তি করিয়া তিনিও নিবেদন করিলেন, ‘তারা দু’জন তাদের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন। আমি পরাজিত হলাম জীবনের মোহের কাছে।’ (আহমেদ  ২০১২: ৮ এবং ২০১৬: [আট])

আহমদ ছফা ২০০১ সালের মধ্যভাগ নাগাদ এন্তেকাল করিলেন। তাঁহার অন্তর্ধান উপলক্ষে হুমায়ূন আহমেদ আরো একপ্রস্ত স্মৃতিকথা লিখিয়াছিলেন। তাহাতে বেশ কিছু নতুন কথা পাইলাম। আবার ২০০৮ নাগাদ বলপয়েন্ট নামে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের নতুন কিছু স্মৃতিকথা বাহির হইয়াছিল। তাহাতেও আহমদ ছফার কথা সবিস্তার লেখা। হুমায়ূন আহমেদ বাহ্যত অত্যন্ত নিরীহ গোছের মানুষ ছিলেন। তাঁহার বিনয় অসাধারণ। তিনি কদাচ অতিশয় কথা বলিতেন না। বলপয়েন্টে তিনি লিখিতেছেন, ‘ছফা ভাইকে লইয়া আমার অসংখ্য স্মৃতি আছে। তাঁর ওপর দুশ’ পাতার একটা বই অবশ্যই লিখতে পারি।’ (আহমদ ২০০৯: ৩২)

এক্ষণে অন্তত একটি স্মৃতির আলোচনা করা যাইতে পারে। হুমায়ূন আহমেদ লিখিয়াছেন, ‘ছফা ভাই তখন দারুণ অর্থকষ্টে। থাকার জায়গা নেই। ক্ষীণ সম্ভাবনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে সিট পাবেন। পাচ্ছেন না। একদিন আমি ছফা ভাইকে ভয়ে ভয়ে বললাম, হলে সিট না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের বাসায় কি থাকবেন?’ (আহমেদ ২০০৯: ৩০)

ঔপন্যাসিক বয়ান করিতেছেন, ‘আমার মা তখন বাবর রোডে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্ত্রী  হিসাবে একটা বাড়ির দোতলাটা বরাদ্দ পেয়েছেন। সেখানে না আছে পানির ব্যবস্থা, না আছে কিছু। ছফা ভাই আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হলেন। আমরা তাঁকে সবচেয়ে বড় কামরাটা ছেড়ে দিলাম। মা তাঁর নিজের সন্তানদের যে মমতায় দেখেন, একই মমতা ছফা ভাইয়ের দিকেও প্রসারিত করলেন।’ (আহমেদ ২০০৯: ৩০)

মোহাম্মদপুরের বাসায় আহমদ ছফার স্বল্প সময়ের জীবনটা মন্দ কাটে নাই! হুমায়ূন আহমেদের সত্য কাহিনী মোতাবেক, ‘ছফা ভাই বাইরে-বাইরেই থাকতেন, রাতে এসে শুধু ঘুমাতেন। বেশির ভাগ সময় বাইরে থেকে খেয়ে আসতেন।’ আহমেদের ধারণাটা হয়ত পুরাপুরি ভুলও নয়: ‘অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া পরিবারটির উপর বাড়তি চাপ হয়তো তিনি দিতে চান নি।’ (আহমেদ ২০০৯: ৩০)

আহমদ ছফার সহিত বসবাসের একটা আলাদা আনন্দ আছে না! আর সে আনন্দ তো নিতান্ত নিদ্রাপর্বে সীমিত থাকিতে পারে না। হুমায়ূন আহমেদ যোগ করিয়াছেন, ‘প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছফা ভাই কিছু সময় মা’র সঙ্গে কাটাতেন। গত রাত্রে যে সকল স্বপ্ন দেখেছেন তা মাকে বলতেন। মার দায়িত্ব স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা।’ (আহমেদ ২০০৯: ৩০) আহমদ ছফার এই স্বপ্নের কাহিনী হুমায়ূন আহমেদের মা বেগম আয়েশা ফয়েজও তাঁহার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি কিন্তু শুদ্ধ বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে আহমদ ছফা ঐ সময় তাঁহার বাসাতেই বাস করিতেন।

বেগম আয়েশা ফয়েজ লিখিয়াছেন, হুমায়ূন আহমেদ—অর্থাৎ তাঁহার বড় ছেলে যাঁহার ডাকনাম কাজল—তখন ‘সত্যিকার লেখালেখি’ শুরু করিয়াছেন মাত্র। আহমদ ছফা সেই লেখা পড়িয়া মুগ্ধ। এই তরুণ লেখককে লইয়া তিনি প্রকাশক পাড়ায় ঘোরাঘুরি করিতেছেন। আয়েশা ফয়েজ লিখিয়াছেন, ‘সেই থেকে আমাদের সঙ্গে পরিচয়। প্রায়ই বাসায় আসে। কীভাবে তার ধারণা হয়েছে আমি স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পারি।’ (ফয়েজ ২০০৮: ৯৪)

‘কি স্বপ্ন বাবা?’

‘ছোট ছোট আধ আঙ্গুলের মানুষ, ঘরের উঠানে তেঁতুলের বিচি লাগাচ্ছে। এই স্বপ্নের মানে কি কাকীমা?’

‘দুরূহ স্বপ্ন! কিছু একটা ব্যাখ্যা না দেওয়া পর্যন্ত ছফা শান্ত হবে না, তাই আমার কিছু একটা ব্যাখ্যা দিতে হয়।’ (ফয়েজ ২০০৮: ৯৪)

হুমায়ূন আহমেদের বলপয়েন্ট আর আয়েশা ফয়েজের জীবন যে রকম একই বছরে—মানে ইংরেজি ২০০৮ সালে—প্রকাশিত হইয়াছিল। ভিতরের প্রমাণ—অর্থাৎ বেগম ফয়েজের লেখা ‘মুখবন্ধ’—অনুসারে অবশ্য আমরা জানিয়াছি বেগম ফয়েজের বইটি আদিতে লেখা হইয়াছিল ঢের আগে—সেই ১৯৯১ সালে। তখন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁহার ছেলের কাছে বেড়াইতে গিয়াছিলেন। তাঁহার জবানবন্দী অবিশ্বাস করিবার তো কোন কারণ নাই। বইটি তিনি মার্কিন মুলুকে বসিয়া লিখিয়াছিলেন ‘নেহায়েতই খেয়ালের বশে’। বলা বাহুল্য, আহমদ ছফা তখনও বাঁচিয়া আছেন। আয়েশা ফয়েজ লিখিয়াছেন, ‘ভাল মন্দ কিছু স্বপ্ন দেখলেই সে চলে আসে বাসায়, আমাকে বলে, কাকীমা, আজ একটা স্বপ্ন দেখেছি।’

আহমদ ছফার এই খোয়াবনামাটা মুহম্মদ জাফর ইকবালও কিছুটা বিবৃত করিয়াছেন। ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই নিজেও স্বনামধন্য অন্য পাঁচ কারণে। স্বপ্নের পূর্ব কাহিনীটাও বয়ান করিয়াছেন তিনি। লিখিয়াছেন, ‘বেঁচে থাকার দুঃসহ প্রচেষ্টার মধ্য থেকে ছফা ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটা ঘনিষ্টতা হল। তিনি তখন প্রায় নিয়মিতভাবে আমাদের খোঁজ নিতে আসতেন। আমাদের মা ভাইবোন সকলের সঙ্গে তাঁর খাতির। আমার মায়ের সঙ্গে তাঁর খাতির সবচেয়ে বেশি। কারণ কিভাবে জানি তাঁর ধারণা হয়েছে যে আমার মা স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারেন।’ (ইকবাল ২০০১: ৭ এবং ২০০৩: ১২৩)

জাফর ইকবাল লিখিয়াছেন, ‘তিনি তখন প্রায় নিয়মিতভাবে আমাদের খোঁজ নিতে আসতেন।’ বেগম ফয়েজও মনে করিতেছেন, ‘ভাল মন্দ কিছু স্বপ্ন দেখলেই সে চলে আসে বাসায়।’ আহমদ ছফার জীবনচরিত লেখকদের জন্য একখানা সমস্যা এখানে তৈয়ার হইল। কেননা হুমায়ূন আহমেদের বয়ানের সহিত এখানে দেখিতেছি একপ্রস্ত গোলযোগ।

আহমদ ছফা সম্বন্ধে অতি উঁচু ধারণা পোষণ করিতেন হুমায়ূন আহমেদ। তাই তিনি ধরিয়া লইয়াছেন এ সকল স্বপ্ন আহমদ ছফার অতিকথা মাত্র। আহমেদ মন্তব্য করিতেছেন, ‘আমার ধারণা, ছফা ভাই স্বপ্নগুলি বলতেন বানিয়ে বানিয়ে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে মাকে খুশি করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। আমার এ রকম ধারণা হওয়ার কারণ হলো, ছফা ভাইয়ের স্বপ্নগুলিতে ডিটেলের কাজ খুব বেশি থাকত। স্বপ্নে এত ডিটেল থাকে না।’ (আহমেদ ২০০৯: ৩০)

সান্ত্বনাস্বরূপ হুমায়ূন আহমেদ একটা ছফাবিয়া স্বপ্নের বয়ান স্মরণ করিয়াছেন। যেমন: ‘একটা স্বপ্ন বললেই পাঠক বুঝতে পারবেন—কাকিমা, কাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম দুটা কাক। একটা বড় একটা ছোট। ছোট কাকটার একটা নখ নেই। তার স্বভাব চড়ুই পাখির মতো। তিড়িং-বিড়িং করে সে শুধু লাফায়। বড়টা শান্ত স্বভাবের। সে একটু পর পর হাই তোলার মতো করে। তাদেরকে ধান দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ ধান খাচ্ছে না। ধানগুলি ঠোঁটে করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিচ্ছে। এখন, কাকিমা, বলুন, স্বপ্নটার অর্থ কী? আমি বিরাট চিন্তায় আছি।’ (আহমেদ ২০০৯: ৩০-৩১)

আহমদ ছফার স্বপ্নগুলি সত্য ছিল না, তিনি স্বপ্নগুলি বলিতেন বানাইয়া বানাইয়া, স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানিতে চাহিয়া চাচিমাকে খুশি করাই ছিল তাঁহার উদ্দেশ্য—হুমায়ূন আহমেদের এই ধারণাটা মাত্র তাঁহার নিজের নহে। মুহম্মদ জাফর ইকবালও এই এজমালি ব্যাখ্যার শরিক। ইকবাল লিখিতেছেন, ‘প্রথম প্রথম সহজ সহজ স্বপ্ন দেখে চলে আসতেন। ধীরে ধীরে তাঁর স্বপ্ন জটিল হতে শুরু করল।’ (ইকবাল ২০০১: ৭ এবং ২০০৩: ১২৩)

আয়েশা ফয়েজ লিখিয়াছেন, ‘ছোট ছোট আধ আঙ্গুলের মানুষ, ঘরের উঠানে তেঁতুলের বিচি লাগাচ্ছে।’ আমরা এই গল্পটা একটু আগেই উদ্ধার করিয়াছিলাম। আর জাফর ইকবাল জানাইতেছেন, ‘গ্রামের বাসিন্দারা ছোট ছোট মানুষ। তাদের গায়ের রঙ কাল। সেই গ্রামে বড় বড় তেঁতুল গাছ। গ্রামের মানুষের সবার হাতে তেঁতুল বিচি। তারা তেঁতুল বিচি নিয়ে বাজারে বিক্রি করে।’ ইতি আদি। ইতি আদি। ইকবাল লিখিয়াছেন, ‘ছফা ভাইয়ের স্বপ্নের বর্ণনা শুনে শুনে আমরা হেসে গড়াগড়ি যেতাম এবং তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমার মা হিমশিম খেয়ে যেতেন।’ (ইকবাল ২০০১: ৭ এবং ২০০৩: ১২৩)

আহমদ ছফার স্বপ্নের বয়ান হুমায়ূন আহমেদ আর তাঁর পরিবারের অন্য দুই লেখকের মুখে শুনিতে শুনিতে আমার জার্মান মহাত্মা ফ্রয়েডের নাম মনে পড়িল না। কি কারণে জানি না মনে পড়িল ফরাশি কবি শার্ল বোদলেয়রের কথা। হুমায়ূন আহমেদ বলিয়াছেন ‘স্বপ্নে ডিটেল থাকে না।’ মহাত্মা ফ্রয়েড এই মন্তব্যের পরিপোষন করিবেন বলিয়া মনে হয় না। স্বপ্ন মানে কিন্তু দ্রষ্টা যাহা দেখিয়াছেন তাহা নহে! স্বপ্ন মানে দ্রষ্টা যাহা বয়ান করিতেছেন তাহা বৈ নহে। তাই বলিতে শরম নাই, স্বপ্নদ্রষ্টা যতখানি জাগিয়াও স্মরণ করিতে পারিতেছেন তাহা হইতেই আমরা শ্রোতা বা পাঠিকার দল স্বপ্নের ব্যাখ্যা করিতেছি। ঘটনাটি কিছু পরিমাণে স্মৃতিকথার সহিত তুলনার যোগ্য।

যাহাকে সচরাচর ‘শৈশবস্মৃতি’ বলা হইয়া থাকে তাহা শৈশবে প্রকৃত প্রস্তাবে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল হুবহু তাহার প্রতিচ্ছবি হয় না। হয় যখন স্মরণ করিতে বসিয়াছি তখন মাত্র যাহা যাহা মনে পড়িতেছে তাহারই প্রতিবিম্ব। মহাত্মা ফ্রয়েড ইহার নাম রাখিয়াছিলেন ‘পর্দার উপরের স্মৃতি’ কিংবা ভাসাভাসা স্মৃতি। আহমদ ছফার অবিশ্বাস্য খোয়াবগুলি খানিক এই ‘পর্দাস্মৃতি’ জাতীয় জিনিশটারই নিকটতম তুলনা বলিয়া মনে হইতেছে।

স্বপ্নে আমরা যাহাই দেখি না কেন তাহাতে কদাচ ভবিষ্যত থাকে না, থাকে অতীত। তাই স্বপ্ন মানেই পুনরাবৃত্তির অর্থাৎ বর্তমান সত্যের চাপ। তাহাতেই পড়ে ভবিষ্যতের ছায়া। একই স্মৃতিকথায় মাত্র একপাতা আগে  হুমায়ূন আহমেদ যাহা লিখিয়াছেন তাহার সহিত অভিযুক্ত সডিটেল স্বপ্নের একটা সংযোগ আছে বলিয়াই আমার সংশয় হইতেছে। হুমায়ূন আহমেদ হইতে উদ্ধার করিতেছি:

আমি আমার যৌবনে হন্টন পীরের মতো একজনকে পেয়েছিলাম। আমরা দল বেঁধে তাঁর পেছনে হাঁটতাম। তিনি যদি কিছু বলতেন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। গভীর রাতে নীলক্ষেত এলাকায় তিনি হাঁটতে হাঁটতে আবেগে অধীর হয়ে দুই হাত তুলে চিৎকার করতেন “আমার বাংলাদেশ। আমার বাংলাদেশ।” আমরা  গভীর মুগ্ধতায় তাঁর আবেগ এবং উচ্ছ্বাস দেখতাম। তাঁর নাম আহমদ ছফা। আমাদের সবার ছফা ভাই। (আহমেদ ২০০৯: ২৯)

মোহাম্মদপুরের যে বাসায় হুমায়ূন আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে সিট না পাওয়া পর্যন্ত আহমদ ছফাকে থাকিবার উদার আমন্ত্রণ জানাইয়াছিলেন সেই বাসারও তো একটা কাহিনী আছে। হুমায়ূন আহমেদ তাহাও যদি দুদণ্ড স্মরণ করিতেন নগদ জানিতেন স্বপ্নে ডিটেলও থাকে। সত্য বলিতে, ডিটেলের অধিক থাকে। বাকি থাকে। ডিটেল এক অর্থে স্বপ্নেরই অপর নাম। এই ডিটেলের থাকে দুই প্রান্ত—একটাকে যদি বলি রূপক, অন্যটার নাম লক্ষণা। ডিটেল ভুলিয়া থাকেন কেবল তাঁহারাই যাঁহাদিগকে স্বয়ং আল্লাহপাক লেখক বানাইয়া এই দুনিয়ায় পাঠাইয়া দেন।

আমি এই জায়গায় মুহম্মদ জাফর ইকবাল হইতে কিঞ্চিৎ সাহায্য-সহায়তা গ্রহণ করিব। আশা করি ইহাতে আহমদ ছফার খোয়াবনামা কিছুটা প্রকটিত হইবে। তিনি স্মরণ করিতেছেন:

তখন সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধের সময় আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। পুরা পরিবারের খুব দুঃসময়। শহিদ পরিবার হিসেবে সরকার থেকে আমাদের একটা বাসা দিয়েছিল। একদিন [জাতীয়] রক্ষীবাহিনী এসে আমাদের বাড়ি থেকে উৎখাত করে দিল। দিয়ে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই পথে নামিয়ে দিল। আমরা তখন জগৎ সংসারের জটিলতায় একেবারে অনভিজ্ঞ। সারা বাংলাদেশে আমাদের পক্ষে কথা বলবার মতন কেউ নাই। তখন আহমদ ছফা তাঁর শুকনা পাতলা দেহ (কিন্তু বিশাল একটা হৃদয় আর সিংহের হৃদয়) দিয়ে আমাদের পাশে এলেন। সেই ভয়ংকর দুঃসময়ে আমাদের পাশে কেহ একজন আছেন সেই ভরসাটুকুন যে কত বড় সেটা শুধু আমরাই জানি। বেঁচে থাকবার দুঃসহ প্রচেষ্টার মধ্যখানে থেকে ছফা ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটা ঘনিষ্ঠতা হলো। তিনি তখন প্রায় নিয়মিতভাবে আমাদের খোঁজ নিতে আসতেন। (ইকবাল ২০০১: ৭ এবং ২০০৩: ১২২-১২৩)

এই ঘটনা হইতে জাফর ইকবাল কিন্তু কোন বিশেষ বা ডিটেল স্মরণ করিলেন না। শুদ্ধ বিবরণটা পেশ করিয়াই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করিলেন তিনি। একই বৎসরে প্রকাশিত স্মৃতিকথায় হুমায়ূন আহমেদ অবশ্য কিছুটা ডিটেলেও গিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছিলেন এক মধ্যরাত্রে রক্ষীবাহিনী তাহাদিগকে বাড়ি হইতে আক্ষরিক অর্থেই বাহির করিয়া দিয়াছিল। বাসার লোটা-কম্বল আর হাড়িপাতিল লইয়া হুমায়ূন আহমেদ আর তাঁহার ভাইবোন—মা আর এক টুকরা ‘আট বছর বয়েসী’ কাজের ছেলে—লইয়া রাস্তায় বসিয়া রহিলেন।

হুমায়ূন আহমেদ লিখিতেছেন, ‘তিন বোনের মধ্যে দুই জন ফিচফিচ করে কাঁদছে। মা কাঁদছেন। আমাদের কাজের ছেলে জিতু মিয়া কাঁদছে চিৎকার করে। আমি অধিক শোকে পাথর। একসময় রাত্রি কাটবে, সকাল হবে। এদের নিয়ে কোথায় যাব? জলে ভেসে যাওয়া একটি শহীদ পরিবারকে কে আশ্রয় দান করবে?’ এমন সময় আবির্ভাব আহমদ ছফার। হুমায়ূন আহমেদের বাকি জবানিটাও কম শুনিবার মতন নয়:

আমরা সারারাত পথে বসে রইলাম। সকাল হলো। হঠাৎ দেখি রিকশা করে ছফা ভাই এসে উপস্থিত। তাঁর সঙ্গে একটি কেরোসিনের টিন। মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। আমাকে বললেন, ‘হুমায়ূন রিকশায় উঠুন।’

আমি বললাম, ‘কোথায় যাব?’

ছফা ভাই বললেন, ‘গণভবনে যাব। নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেব। একটি শহীদ পরিবারের প্রতি যে অপমান করা হয়েছে—তার প্রতিবাদে এই কাজটা করব। আত্মাহুতি দেব।’

আমি বললাম, ‘কী বলছেন, ছফা ভাই?’

ছফা বললেন, ‘কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না। উঠে আসুন। সঙ্গে ভারী চাদর নিয়ে এসেছি। আপনি আমার গায়ে ভালমতো চাদরটা জড়িয়ে দেবেন। যেন আগুনটা ঠিকমতো লাগে।’

ছফা ভাই কেরোসিন ঢেলে জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছেন, এই খবর চারদিকে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। কবি সিকান্দার আবু জাফর ব্যস্ত হয়ে ছফা ভাইয়ের কাছে এলেন। ধমক দিয়ে বললেন, ‘আমি ব্যবস্থা করছি। কথা দিচ্ছি এই শহীদ পরিবারের জন্যে থাকার একটা ব্যবস্থা করব। তুমি কেরোসিনের টিন আমার বাসায় দিয়ে আসো।’ হুমায়ূন আহমেদ ডিটেলে গেলেন না। তবে যোগ করিতে ভুলিলেনও না: ‘আমি ভাইবোন-মাকে নিয়ে আগের বাড়িতেই ওঠার সুযোগ পেলাম।’ (আহমেদ ২০০৩: ৬১-৬২)

হুমায়ূন আহমেদের মা বেগম আয়েশা ফয়েজ তাঁহার স্মৃতিকথায় ঘটনার আরো বিস্তারিত বিবরণ দিয়াছেন। এই বিবরণটা বরং অনেক ডিটেলে পূর্ণ। আমি এখানে যতদূর পারি পুরা বিবরণটাই তুলিয়া ধরিব: ‘বাবর রোডের বাসায় ওঠার তিন দিন পর হঠাৎ একদিন রক্ষীবাহিনী এসে হাজির হলো। একজন সুবেদার মেজর এসে জিজ্ঞেস করল, এ বাড়ি আপনি কোথা থেকে পেলেন?’

উত্তরে বেগম আয়েশা ফয়েজ কি বলিয়াছিলেন তাহা তিনি এইভাবে জানাইয়াছেন: ‘আমি বললাম, সরকার আমাকে দিয়েছে। আমার স্বামী যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তাই।’ তারপর কি ঘটিল সে বিবরণটা আরেকটু পড়া যাইতে পারে।

সুবেদার মেজর কিছু না বলে চলে গেল। আমার মনের ভিতরে হঠাৎ করে একটা খটকা লেগে গেল, হঠাৎ করে রক্ষীবাহিনী আসছে কেন?

খানিকক্ষণ পর হঠাৎ করে আরেকজন সুবেদার মেজর এসে হাজির। সে একা নয়, তার সঙ্গে এক ট্রাকবোঝাই রক্ষীবাহিনী। সবার হাতে অস্ত্র। সুবেদার মেজরের নাম হাফিজ, ভিতরে ঢুকে বলল, ‘এ বাড়ি আমার। শেখ সাহেব আমাকে দিয়েছেন।’

আমি বললাম, ‘সে কী করে হয়? আমার কাছে বাসার অ্যালটমেন্ট রয়েছে—’

সে কোনো কথা না বলে টান দিয়ে ঘরের একটা পর্দা ছিঁড়ে ফেলল। সাথে আসা রক্ষীবাহিনীর দলকে বলল, ‘ছেলেমেয়েদের ঘাড় ধরে বের কর।’

আমি এতদিনে পোড় খাওয়া পাথর হয়ে গিয়েছি। রুখে দাঁড়িয়ে বলেছি, ‘দেখি তোমার কত বড় সাহস।’

সুবেদার মেজর একটু থমকে গিয়ে। কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

দেখতে দেখতে আক্ষরিক অর্থে শত শত রক্ষীবাহিনী দিয়ে পুরো এলাকা বোঝাই হয়ে গেল। বাসা চারদিকে ঘেরাও হয়ে আছে, কাউকে ঢুকতে দেয় না, কাউকে বেরও হতে দেয় না। কাজল মুহসীন হলে ছিল, খোঁজ পেয়ে এসেছে, তাকেও ঢুকতে দিল না। সারা রাত এভাবে কেটেছে। (ফয়েজ ২০০৮: ৯২-৯৩)

তাহার পরের ডিটেল হুমায়ূন আহমেদ বা মুহম্মদ জাফর ইকবাল কেহই আর বিশেষ লিখিলেন না। কিন্তু আয়েশা ফয়েজ আর একটু না লিখিয়া পারেন নাই।

ভোর হতেই আমি বের হলাম। পুলিশের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলাম। তারা বলল, ‘আমরা গোলামির পোশাক পরে বসে আছি! রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা কি করব?’

বঙ্গভবন, গণভবন এমন কোনো জায়গা নেই যা আমি বাকি রাখলাম না সাহায্যের জন্যে কিন্তু লাভ হলো না। আমি তুচ্ছ মানুষ। আমার জন্যে কার মাথাব্যথা?

রাতে ফিরে এসেছি। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না, অনেক বলে ভিতরে ঢুকেছি। রাত আটটার সময় রক্ষীবাহিনীর দল হঠাৎ করে লাথি মেরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল। ইকবাল আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে, একজন বেয়োনেট উঁচিয়ে লাফিয়ে এল। রাইফেল তুলে ট্রিগারে হাত দিয়েছে, চিৎকার করে কিছু একটা বলছে, গুলি করে মেরে ফেলবে আমাদের?

আমি ছেলেমেয়েদের হাত ধরে বের হয়ে এলাম। (ফয়েজ ২০০৮: ৯৩)

বেগম আয়েশা ফয়েজের রচনাশক্তির ঝাঁজ বড়ই তীক্ষ্ণ। আগুনের হলকার মতন তার স্পর্শ এখনও ঠাহর করিতে পারি। গল্পের শেষ কিন্তু এখানেই নহে। তিনি আরো এক অধ্যায় লিখিয়াছেন। ঐ অধ্যায়ের নাম ‘আহমদ ছফা’। এদিকে ‘রক্ষীবাহিনী’ নামা বর্তমান অধ্যায়টির তামাম তিনি শোধ করিলেন তিনটি আশ্চর্য—কাটা কাটা—ডিটেলমুক্ত বাক্যে। একটা আমরা আগেই উদ্ধার করিয়াছি। বাকি দুইটা এখনই তুলিয়া দিতেছি। তিনি জানিলেন এ জগত স্বপ্ন নয়, সত্য নিঃসন্দেহে। বেগম আয়েশা ফয়েজ উবাচ:

পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাকে প্রথমবার গৃহহারা করেছিল।

বাংলাদেশ সরকারের রক্ষীবাহিনী আমাকে দ্বিতীয়বার গৃহহারা করল। (ফয়েজ ২০১১: ৯৩)

জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে ‘এই গোলমালের মাঝে’ সাহায্যের জন্য যাঁহারা ছুটিয়া আসিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে—আয়েশা ফয়েজ স্মরণ করিতেছেন—ছিলেন বিশেষ একজন। তাঁহার নাম আহমদ ছফা। আহমদ ছফা প্রসঙ্গে বেগম আয়েশা ফয়েজের বয়ানটা খানিক উদ্ধার করিতেই হয়। তিনি লিখিতেছেন, ‘এই খেয়ালি মানুষটি রক্ষীবাহিনীর আচরণে একেবারে ক্ষেপে গেল। চেনাজানা সমস্ত মানুষকে সে টেনে নিয়ে এল বাবর রোডে।’

শুদ্ধ কি তাহাই? আহমদ ছফার কল্যাণে অচেনা অজানা সমস্ত মানুষও জানিয়া গেল বাবার রোডে কি ঘটিয়াছে। আয়েশা ফয়েজ লিখিতেছেন:

প্রাণ নিয়ে বাসা থেকে বের হবার পর রক্ষীবাহিনীর বীর জওয়ানেরা আমাদের সব জিনিসপত্র রাস্তায় টেনে ফেলে দিয়েছে। তার মাঝে চেয়ার-টেবিলও আছে—রাত্রিবেলা সেখানেই সবাই বসেছে, খোলা আকাশের নিচে এক রাউন্ড চাও খেয়ে ফেলল সবাই। সরকারি যে দলিলটির জন্য আমার এত বড় লজ্জা ছফা যাওয়ার সময় সেটি হাতে করে নিয়ে গেল। (ফয়েজ ২০১১: ৯৪; বানান খানিক সংশোধিত)

বেগম আয়েশা ফয়েজের স্মৃতিকথা অনুসারে আরো জানা গেল, ‘পরদিন গণকণ্ঠ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ পরিবারের নির্যাতন বিষয়ক এই খবরটি ছাপা হলো। সাথে সরকারি অ্যালটমেন্টের কপিটি।’

আয়েশা ফয়েজ সাহসী মানুষ। সঙ্গে একটি মন্তব্য যোগ করিতে তিনি কসুর করিলেন না তিনি: ‘আওয়ামী লীগ সরকার তখন প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছে। তাদের কিংবা রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলে সে রকম সাহস কারো নেই। গণকণ্ঠ একমাত্র কাগজ যারা সাহস করে কিছু বলত।’ (ফয়েজ ২০১১: ৯৫)

আমরা আগেই দেখিয়াছি শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াইয়াছিল এই ঘটনার ফলাফল। আহমদ ছফা, সিকান্দার আবু জাফর আর দৈনিক গণকণ্ঠ—এই তিনে মিলিয়া অবশেষে কি উপায়ে একটি অন্যায়ের প্রতিকারে সফল হইলেন তাহার কথাই বলিতেছি। দুর্ভাগ্যের মধ্যে, নিজস্ব ধারণার অন্তর্গত স্বপ্নের মতন সকল ডিটেল বর্জন করিয়া হুমায়ূন আহমেদ একটি মাত্র বাক্যে এই কাহিনীর সমাপ্তি টানিয়াছিলেন: ‘আমি ভাইবোন-মাকে নিয়ে আগের বাড়িতেই ওঠার সুযোগ পেলাম।’ (আহমেদ ২০০৩: ৬২)

তাঁহার মা সত্যই বলিয়াছেন, হুমায়ূন আহমেদ ঝামেলা মোটেও সহ্য করিতে পারিতেন না। কৃতজ্ঞতার কথা আলাদা। ডিটেলে ঢের ঝামেলা। মা জননী কিন্তু একটুখানি আলাদা, তিনি এদিকে ডিটেল যোগাইয়াছেন অল্পবিস্তর। যে রাত্রে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর বীর জওয়ানেরা পরিবারটিকে পথে নামাইয়া দিয়াছিল সে রাতটা তাঁহারা কাটাইয়াছিলেন কোথায়? উত্তর: ঠিক পথে নহে, পাশের বাসায়। ঐ বাসার মহাশয় মালিকের নাম ডাক্তার মনোয়ার। নামটা—দুঃখের মধ্যে—এই পর্যন্তই। সদাশয় ভদ্রমহোদয়ের বৃত্তান্ত অধিক জানিতে দেন নাই আয়েশা ফয়েজ।

বেগম ফয়েজ বলিয়াছেন, ডাক্তার সাহেব মুহম্মদ জাফর ইকবালকে লইয়া টানাটানি করিয়া মধ্যরাত্রে উদ্বাস্তু পরিবারটির জিনিশপত্র নিজের বাসায় তুলিয়া ফেলিলেন। পরের দুয়েকদিনের মধ্যে বেগম ফয়েজ পাশেই একটি ছোট্ট বাসা ভাড়া করিয়া উঠিয়া গেলেন।

বাসাটা ফেরত পাওয়ারও একটা অংক ছিল। সেই অংকটাও কম আদরের জিনিশ নহে। এই বিষয়ে নীরব থাকাই হুমায়ূন আহমেদ সমীচীন মনে করিয়াছেন। কিন্তু বেগম ফয়েজ দমিবার পাত্রী নহেন। ইহার মধ্যে কি ভূমিকা আহমদ ছফা কিংবা তাঁহার দেওয়া সংবাদ শিরোনামের তাহা পাঠিকা যে যাহার মত ভাবিয়া লইবেন।

কয়েকদিন পার হইল। আরেকদিন সেই চরম বিপদের রাতে আশ্রয়দাতা প্রতিবেশী ডাক্তার মনোয়ার হঠাৎ বেগম আয়েশা ফয়েজের বাসায় আসিয়া হাজির। পর্বটা বেগম ফয়েজ এভাবে স্মরণ করিতেছেন। ডাক্তার সাহেব একটা সুখবর লইয়া আসিয়াছেন। খবরটা ঘোড়ার মুখে শুনিয়া লওয়াই বেহতর। আয়েশা ফয়েজ লিখিতেছেন:

[ডাক্তার মনোয়ার] বললেন, ‘রক্ষীবাহিনীর প্রধান নূরুজ্জামান আপনার সাথে ফোনে কথা বলতে চান।’

‘কেন?’

‘মনে হয় বাসাটা নিয়ে গোলমাল মিটিয়ে ফেলতে চান।’

‘তার আর দরকার নেই। সরকারি বাসার শখ আমার মিটে গেছে। পাকিস্তান আর্মির হাতে যারা মরেনি, এখন রক্ষীবাহিনীর হাতে তারা শেষ হবে?’

ডাক্তার সাহেব আমাকে বোঝালেন, ‘আপনার এখন মাথা গরম করলে হবে না। আপনাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আপনি যদি বাসাটা পেয়ে যান খুব ভাল হয়। ঢাকায় বাচ্চাদের নিয়ে থাকতে, ওদের পড়াশোনা শেষ করতে পারবেন। আমার বাবা যখন মারা যায় আমার বয়স তিন। কত ঝামেলা গেছে আমার উপর দিয়ে, সে তুলনায় আপনার তো কিছুই হয়নি। আমি এখন দাঁড়িয়ে গেছি। আপনিও একদিন দাঁড়িয়ে যাবেন।’

ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে আমি শেষ পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীর প্রধান নূরুজ্জামানের সাথে কথা বলতে রাজি হলাম। ভদ্রলোক বেশ ভালো ভালো কথা বলে বাসার ওপর তলাটি আমাকে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। আমার ওপর যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে তার বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। (ফয়েজ ২০০৮: ৯৫)

এতদিন পরও আপনকার স্বভাবজাত রসবোধ হারাইয়া বসেন নাই বেগম আয়েশা ফয়েজ। তিনি মন্তব্য করিলেন, ‘বিচারটি খারাপ হলো না। নীচের তলাটি দেয়া হলো সুবেদার মেজর হাফিজকে।

বেগম ফয়েজের রসগোল্লা হইতে তাঁহার প্রথিতযশা পুত্র, ঐশ্বর্যবান ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমদও কেন বঞ্চিত হইবেন? পুত্রের স্বভাবটি তিনি লক্ষণার আকারে বেশ দেখাইতে পারিয়াছেন। মা লিখিয়াছেন, ‘কাজল ঝামেলা মোটেও সহ্য করতে পারে না। এসব যন্ত্রণা দেখিয়া (সে) মহসীন হলে পাকাপাকি আশ্রয় নিল। প্রতিদিন সকালে উঠে কাগজে খুঁজে দেখে শহীদ পরিবারকে রক্ষীবাহিনী উচ্ছেদ করেছে এরকম খবর আছে কি না! যদি না থাকে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে।’ (ফয়েজ ২০০৮: ৯৫)

বলা হয়তো বাহুল্যই, এই সেই বাসা যাহার ছাদের তলায় আহমদ ছফা কিছুদিনের জন্য আশ্রয়ধন্য হইয়াছিলেন। তাঁহার আশ্চর্য স্বপ্নের সূচনা কি এই বাড়িতেই হইয়াছিল? এতদিনে এ জিজ্ঞাসার সদুত্তর পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে।

কোন কোন স্বপ্নে হয়ত ডিটেলই থাকে না। হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নেও সম্ভবত থাকিত না। মহাত্মা ফ্রয়েড প্রণীত ‘ডি ট্রাউমডয়টুংগ’ বা ‘খাবনামা’ নামক যুগান্তকারী গ্রন্থের ব্যবস্থা কিন্তু অন্য কথা বলিতেছে।

ফ্রয়েডের মতে স্বপ্নে কেবল ডিটেলের রাজত্ব। সেই ডিটেলের গঠন আবার ভাষার মতন—রূপকে আর লক্ষণায় ভরপুর। ফ্রয়েড বলিয়াছিলেন ডিটেল কোথাও হয় ঘন, কোথাও যায় হেলে। রূপক আর লক্ষণা কথা দুইটি চিরায়ত অলংকারশাস্ত্র হইতে উদ্ধার করিয়াছেন ফ্রয়েডের শাবক ফরাশি মহর্ষি জাক লাকাঁ।

হুমায়ূন আহমেদ মহাত্মা ফ্রয়েডের সহিত পরিচয়ের দৌঁড়ে কতখানি কাছাকাছি পৌঁছিলেন জানিবার সাধ আমার হয় নাই। তবে অনুমান করিতে দোষ নাই তিনি হয়তো শার্ল বোদলেয়ারের সহিত অপরিচয়ের বাধাটা অতিক্রম করিয়া থাকিবেন। কবিতার দৈবগুণ যে একদা জীবনপ্রভাতে তাঁহাকেও পাইয়া বসিয়াছিল সে সত্য তো তিনিও অস্বীকার করিতে পারেন নাই। তাঁহারও একটা বৃত্ত ছিল। তিনি সে বৃত্তের ভিতরে কি বাহিরে বসবাস করিতেন সে বড় কথা নয়। (আহমেদ ২০০৯: ৯-১৩)

‘পারিসিয়া স্বপ্ন’ নামে বোদলেয়রের একটি কবিতা আছে। মাত্র ষাট পংক্তির এই নাতিদীর্ঘ কবিতায় বোদলেয়রের নায়ক বলিতেছেন, ‘লো সোমেয় এ প্লাঁ দো মিরাক্ল’ অর্থাৎ নিদ্রাদেবের ভাঁড়ার অলৌকিক সব কাণ্ডকারখানায় ভরপুর: ‘চোখে সকলই পড়িতেছে, মগর কানে কিছুই পশিতেছে না।’

একদিন প্রাতবেলা এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিয়াছেন বোদলেয়রের নায়ক। সেই স্বপ্নে এমন এক দেশ দেখা দিয়াছে অন্য কোন মরণশীল প্রাণী যে দেশ কোনদিন দেখিতে পায় নাই। সেই স্বপ্নের দেশে কোন প্রাণের ছোঁয়া নাই, এলোমেলো সবুজের বা প্রাণের দেখা নাই। ঘাসবিচালি পর্যন্ত দেখা যায় না সেখানে। ঐদেশে কেবল একঘেয়ে ধাতু, মর্মর পাথর আর পানির রাজত্ব। সে দেশের প্রাসাদরাজি অনন্তবিস্তৃত, চারিপাশে কেবল সিঁড়ি আর দালানকোঠার সারি।

ঐ দেশেই ঘরে ঘরে থরে থরে সাজান সোনাদানার বাহার, ফোয়ারার ছটা ঝরিয়া পড়িতেছে সোনার নানান পাত্রের উপর। সেখানে ধাতুর দেওয়াল হইতে ফটিকের পর্দার মতন ঝুলিছে ভারি ভারি জলপ্রপাত। গাছগাছালির চিহ্ন পর্যন্ত নাই সেখানে, আছে কেবল বড় বড় কতকগুলি থাম অর্থাৎ খাম্বা। সেখানে সরোবরে সামান্য নারীজাতির সন্তানের মতন আপনকার মুখের বিম্ব দেখিতেছে বিশাল বিশাল দানবীর দল।

বোদলেয়রের নায়কটি বলিতেছেন, তাঁহার স্বপ্নের দেশে গোলাপি আর হরিতবর্ণা দুই জেটির মাঝখানে কোটি কোটি ক্রোশ জুড়িয়া—নিখিলের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত—কেবল নীল পানির সমুদ্র। সেখানে অলীক পাথর আর অলৌকিক তরঙ্গভঙ্গ। ফাটিয়া পড়িতেছে তীরে। আর বিশাল সব আয়নায় ঘটিতেছে এইসব দৃশ্যের প্রতিফলন। অস্থির আর নির্বাক নতুন আকাশগঙ্গা সেখানে তাহার হীরকখচিত গর্তে ধনরত্ন ঢালিয়া দিতেছে। এই ঘুমপাড়ানো মহাসমুদ্র পাথরের একটা সুড়ঙ্গ দিয়া বহিয়া যাইতেছে।

এই স্বপ্নলোকে দুনিয়ার তাবৎ বর্ণ—মায় ঘোর মসীকৃষ্ণ বর্ণ পর্যন্ত—চকচকে মসৃণ আর উজ্জ্বল দেখাইতেছে। স্ফটিকে বিম্বিত আলোর ধারায় বহমান তরলের দীপ্তি প্রকাশ পাইতেছে। আকাশের কোথাও একটা তারা নাই, সূর্যের আভাস পর্যন্ত পাইতেছি না, তাহার চিহ্নও নাই আকাশের দশ দিগন্তে। আশ্চর্য সব আজব চিজ জ্বলিতেছে—এ কথা সত্য কিন্তু তাহাও আপন আপন প্রাণের আগুনে মাত্র।

আর সবচেয়ে বড় কথা, কি ভয়ানক কাণ্ড! চোখে সকলই পড়িতেছে, মগর কানে কিছুই পশিতেছে না! এই সকল চলন্ত বিস্ময়ের উপর বিরাজ করিতেছে এক অনন্ত নৈঃশব্দ্য।

এতখানি স্বপ্ন দেখিবার পর নায়ক মহাশয় জাগিয়া উঠিলেন। ততক্ষণে নির্দয় বেলার প্রগতি হইয়াছে—প্রায় বারটা বাজিয়া গিয়াছে। তাহার ঘরখানি নোংরা, ভাঙ্গাচোরা। হয়তো এখনি পাওনাদার আসিবে। মাথায় শত দুঃশ্চিন্তার ভার চাপিয়া যাইতেছে আরেকবার। বেলা বারটার শোকসন্তপ্ত ঘণ্টা বাজিতেছে আর আকাশের অন্ধকার গড়াইয়া গড়াইয়া পড়িতেছে দুঃখের বোঝায় ভারাতুর থমকিয়া থাকা পৃথিবীর পিঠে। ( বোদলেয়র ১৯৭৫: ১০১-১০৩ এবং ২০০৪: ১০৪-১০৬)

শার্ল বোদলেয়র এই পদ্যটি উৎসর্গ করিয়াছিলেন তাঁহার পরম বন্ধু শিল্পী কস্তাঁতাঁ গীকে। নগরীর চিত্রকর খ্যাতিতে ইনি তখন দেদীপ্যমান। যতদূর জানা গিয়াছে পদ্যটির রচনা ১৮৬০ সালের আগে নয়। এই কবিতায় বর্ণিত স্বপ্নের কি কোন অর্থ হয়? বোদলেয়র নিজেই ইহার একটা অর্থ প্রস্তাব করিয়াছিলেন—কবিতার ‘পারিসিয়া স্বপ্ন’ নামেই তাহার প্রকাশ। এমন স্বপ্ন বুঝি শুদ্ধ পারি নগরেই সম্ভব।

এক্ষণে প্রশ্ন জাগিতেছে আহমদ ছফার আশ্চর্য স্বপ্নটির আদৌ কোন ব্যাখ্যা কি দাঁড় করান যায়? যদি যায় তো প্রথমেই স্বীকার করিতে হইবে এমন স্বপ্ন তাঁহাকেই সাজে—যিনি ‘গভীর রাতে নীলক্ষেত এলাকায় ... হাঁটতে হাঁটতে আবেগে অধীর হয়ে দুই হাত তুলে চিৎকার’ করিয়া বলিতে পারেন ‘আমার বাংলাদেশ! আমার বাংলাদেশ!’ হুমায়ূন আহমেদ নিজেই সাক্ষ্য দিয়াছেন এই আবেগের অথচ তিনি ঠাহরই করিতে পারেন নাই আহমদ ছফার স্বপ্নের সহিত ‘বাংলাদেশ’ নামক আবেগের একটা সম্পর্ক আছে। কোথায় সে সম্পর্ক? তাহার আগে হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষ্যটা দেখা যাইতে পারে।

দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। শিশু রাষ্ট্র জন্মের যন্ত্রণায় তখনো ছটফট করছে। আর ছফা ভাই ছটফট করছেন আবেগে এবং উত্তেজনায়। কত অদ্ভুত অদ্ভুত পরিকল্পনা তাঁর মাথায়। দেশকে শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতে এভারেস্ট শিখরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। দেশ মেধা এবং মননে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। ইত্যাদি। (আহমেদ ২০০৯: ২৯)

মহর্ষি ফ্রয়েড একদা লিখিয়াছিলেন, ‘আপনি চাহেন তো  তত্ত্বজ্ঞানী আর মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সহিত একমত পোষণ করিতে পারেন, উঁহারা যেমন স্বপ্নের অর্থানুসন্ধান জিনিশটাকে একান্তই কল্পনাবিলাস বলিয়া উড়াইয়া দেন তেমন উড়াইয়াও দিতে পারেন। কিন্তু আমার অন্যরকম একটা শিক্ষা হইয়াছে।’ (ফ্রয়েড ১৯৫৩: ৪/১০০; ফ্রয়েড ২০০৬: ১১২)

ফ্রয়েডের এই শিক্ষাটা কাঁহার দান? কে দিয়াছিল এই শিক্ষাটা? তিনি দেখাইয়াছেন, তিনি শিখিয়াছিলেন তাঁহার নিজের দেখা স্বপ্নের ভাঁড়ার আর তাঁহার কাছে চিকিৎসাপ্রার্থী রোগীসাধারণের স্বপ্নের বিবরণ হইতে আর—সবার উপরে—সাহিত্য পড়ার অভিজ্ঞতা হইতে।

সেকালের বড় বড় তত্ত্বজ্ঞানী আর মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলিতেন ‘স্বপ্নের কোন অর্থ হয় না’।

ফ্রয়েড তাঁহাদিগের মোকাবেলা করিবার লক্ষ্যে একটি ইতিহাসবিখ্যাত সাহিত্যকর্মের আশ্রয় লইয়াছিলেন। নিজের দেখা একটি স্বপ্নের ব্যাখ্যা করিতে বসিয়া ফ্রয়েড বলিয়াছিলেন, গ্রিক পুরাণের এদিপাস কাহিনী কানে পশিলে একালের সকল শ্রোতাই কমবেশি কান খাড়া করিয়া থাকেন। এই বাড়তি উদ্বেগের, বাড়তি কান খাড়া করিবার কারণটা কি? একটা কারণ হইতে পারে এই যে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটি একটি করিয়া ছোট ছোট এদিপাস বাস করে। ফ্রয়েড লিখিতেছেন:

কবি একদিকে এদিপাসের অপরাধটি ধরাইয়া দিয়াছেন, আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাদেরও আমাদের আপন আপন মনের ভিতরের খবরটা লইতে বাধ্য করিতেছেন: এদিপাসের মতন আমরাও যে যাহার জীবনটা চালাইয়া যাইতেছি ... আর খবর যখন রাষ্ট্র হইয়া গেল, হইতে পারে তখন আমরা সকলেই স্ব স্ব বাল্যদশার যত দৃশ্য পাছে তাহা দেখিতে পাই এই ভয়ে চক্ষু মুদিয়া থাকি। (ফ্রয়েড ১৯৫৩: ৬/২৬১-২৬৩)

ফ্রয়েডের এই বক্তব্যের মধ্যে বিজ্ঞানে বিপ্লবের একটি বিবরণ আছে। সেকালের প্রচলিত বিজ্ঞানকেও তিনি উচিত শিক্ষা দিয়াছিলেন। গ্রিক মহর্ষি আরস্তু বলিয়াছিলেন, মানুষ স্বভাবের বশে জানিতে চাহে। আর ফ্রয়েডের টিপ্পনী অনুসারে, মানুষ ভয়ে জানিতেই চাহে না, চোখ বন্ধ করিয়া রাখে।

ফ্রয়েডের এই প্রণালীর সহিত এয়ুনানি মহাত্মা সক্রাতেসের পদ্ধতির একটা মিল দেখা যায়। আফলাতুন লিখিত সুসমাচার অনুসারে কবিরা কবিতা লেখেন বটে কিন্তু কবিতার অর্থ কি তাহা বলিতে পারেন না। সক্রাতেসের ধারণা, কবিরা কবিতা লেখেন একধরণের প্রেরণা বা ঘোরের বশে অর্থাৎ জ্ঞান অথবা বিজ্ঞতাই কবিতার জননী নহে। তাই জ্যোতিষশাস্ত্র কিংবা হস্তরেখাবিদদের মতন মজার মজার অনেক কথা তাঁহারা বলিয়া যাইতে পারেন কিন্তু তাঁহাদের কথার অর্থটা কি তাঁহারা বলিতে অক্ষম।

এই দুনিয়ায় কিছু মানুষ আছেন যাঁহারা মনে করেন জগতের সকল রহস্য তাঁহাদের কাছে ধরা দিয়েছে কিংবা একদিন অন্তত দিতে পারে। ইঁহারাই যাহাকে বলে পরম জ্ঞানী। তত্ত্বজ্ঞানের ইতিহাস এই ধরনের পরম জ্ঞানীতে পরিপূর্ণ। ইঁহাদের এক নেতার নাম—জার্মান মহাত্মা গেওর্গ হেগেল। ইঁহার মতে পরম জ্ঞানের লক্ষণ হইল এই যে, সে যে জানে সে কথাটিও তাহার অজানা থাকে না। আমাদের পৃথিবীতে যখন একটা নতুন যুগের সূচনা হইয়াছিল—যে যুগের বর্তমান নাম দাঁড়াইয়াছে বুর্জোয়া যুগ—সেই যুগে এই অহমিকাই ছিল মনুষ্যজাতির পক্ষে পরম জ্ঞান।

বুর্জোয়া যুগে দুর্যোগ দেখা দিবার পর হইতে একধরণের সংশয়ভাব মাথাচাড়া দিয়াছে। যাঁহাকে এ যুগের তত্ত্বজ্ঞানীদের গুরু বলা যাইতে পারে তাঁহার নাম—আহা, আবারও এক জার্মান মহাত্মা—ফ্রিডরিখ নিৎশে। ইঁহার শিষ্য-শাবকেরা এখন পশ্চিমা দুনিয়ায় বলা যায় রাজত্বই করিতেছেন। উঁহারা কহিতেছেন (সক্রাতেসের আদলে) আমরা মাত্র একটা জিনিশই জানি—তাহা এই যে ‘আমরা জানি না’।

পরিশেষে আমরা তৃতীয় একটা দলের নাম লইতে প্রস্তুত। ইঁহাদের নেতার নাম জিগমুন্ট ফ্রয়েড—ঘটনাচক্রে ইনিও জার্মান মহাত্মাদের সারিতে। ফ্রয়েডের দল হইতে আমরা শিখিতেছি আমাদের অজানা জ্ঞানের গঠন অনেকটা স্বপ্নের মতন। ইহার মানে কি দাঁড়াইল? ফ্রয়েডের শিষ্য—ফরাশি দেশীয় মহর্ষি—জাক লাকাঁ জিনিশটা বানান করিয়া বলিয়াছেন: আমাদের স্বপ্ন ও সাহিত্যকর্ম একই গোত্রের জিনিশ। সাহিত্য একটা কথা জানে যে সে জানে, কিন্তু সে যাহা জানে তাহার অর্থ কি তাহা আর জানে না। (ফেলম্যান ১৯৮২)

স্বপ্নের ব্যাখ্যা হইতেই ফ্রয়েড বিজ্ঞানে একটা রীতিমত বিপ্লবের সূচনা করিয়াছিলেন। এই ব্যাখ্যার তাৎপর্য এইখানে যে স্বপ্নের গড়ন আছে এবং এই গড়ন ভাষার আদলে চলে। ফ্রয়েডের আবিষ্কার হইতে মানুষ ইচ্ছা করিলে শিখিতে পারিত যে ভাষাই মানুষের প্রকৃত জননী।

ভাষার উপর মানুষের অধিকার জন্মাইয়াছে—এই সত্যের একটা উল্টা পিঠও আছে। সেই পিঠে লেখা—মানুষের উপর ভাষার অধিকার ষোল আনা। যেখানে ভাষা নাই সেখানে মানুষই নাই। মানুষ ভাষার ক্রীড়নক বিশেষ—এই সত্যে যাঁহাদের সন্দেহ  তাঁহারা আজও মানুষ হইয়াছেন একথা বলা যাইবে কিনা সন্দেহ।

হুমায়ূন আহমেদ এবং মুহম্মদ জাফর ইকবাল দুইজনেই বাংলা একাডেমি পুরস্কার জয় করিয়াছেন। আহমদ ছফা বাংলা একাডেমির মন জয় করিতে ব্যর্থ হইয়াছিলেন কেন? তাঁহারা দুইজনে মিলিয়াও এই প্রশ্নের জবাবটা খুঁজিয়া বাহির করিতে সমর্থ হন নাই। এই দুঃখ তাঁহারা রাষ্ট্রও করিয়াছেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল আহমদ ছফা বিষয়ে আপনকার স্মৃতিকথার নাম রাখিয়াছিলেন সেই দুঃখের অক্ষরেই—‘আহমদ ছফা এবং বাংলা একাডেমী পুরস্কার’। একটি আবেদনে—মাত্র একটি আবেদনে—তিনি স্মৃতির নির্বন্ধ শেষ করিয়াছিলেন:

বাংলা একাডেমীর প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, আহমদ ছফার সাহিত্যকর্মকে যথাযথ মূল্যায়ন করে তাঁকে মরণোত্তর পুরস্কার দিয়ে হলেও আমাদেরকে একটি লজ্জা এবং অপমান থেকে মুক্তি দেয়া হোক। তা না হলে ভবিষ্যতে যাঁরা এই পুরস্কার পাবেন তাঁরা দশজনের সামনে কেমন করে মুখ দেখাবেন? (ইকবাল ২০০১: ৭ এবং ২০০৩: ১২৬)

আমি সামান্য মানুষ। এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নাই। তবুও বলিতে পারি যাঁহাদের দেখাইবার মতন মুখ নাই তাহারা অন্য কোন অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ দেখাইলেই পারেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা লিখিবার সামর্থ্যই বা আমার কোথায়! কেন জানি মনে হইতেছে ১৯৭২ সালে আহমদ ছফা যে স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন তাহার মধ্যে রক্ষীবাহিনী হইতে বাংলা একাডেমি—এমনকি আজিকার রাতের হেফাজতে ইসলাম—সকলের ইতিহাস স্বপ্নাক্ষরে লেখা ছিল। বলি কি হুমায়ূন আহমেদ আর মুহম্মদ জাফর ইকবাল যে একদিন বাংলা একাডেমি বিজয় করিবেন তাহার বাণী পর্যন্ত খোদাই করা ছিল ঐ স্বপ্নে। নতুবা এই স্বপ্নের অন্য অর্থ কি আর হইতে পারিত: ‘ছোট ছোট আধ আঙুলের মানুষ, ঘরের উঠানে তেঁতুলের বিচি লাগাচ্ছে’?

এই নিবন্ধের গোড়ার দিকে ওয়াদা করিয়াছিলাম আনিস সাবেত নামটি জড়াইয়া যে একটা গল্প আমারও জানা আছে তাহা পরে বলিব। এক্ষণে গল্পটি বলিতে চাহি। ইংরেজি ২০০১ সালের জানুয়ারি  কি ফেব্রুয়ারির কথা। আহমদ ছফা একদিন আমাকে টেলিফোনযোগে বলিলেন, ‘সলিমুল্লাহ খান, তোমাকে একটা বহি উৎসর্গ করিতে চাই।’ আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলাম। সপ্তাহখানিক পরে আহমদ ছফা আবার টেলিফোন করিলেন। জানাইলেন, ‘আমি দুঃখিত, বইটা তোমাকে উৎসর্গ করিতে পারিতেছি না। অনেকদিন হয় আমার বন্ধু আনিস সাবেত মারা গিয়াছেন, তাঁহার নামে কোন বই উৎসর্গ করা হয় নাই। তাঁহাকে এই বইটা উৎসর্গ করিতে হইবে।’

আমি আবারও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলাম। সঙ্গে যোগ করিলাম, ‘আল্লাহ যাহা করেন ভালোর জন্যই করেন।’ এক সপ্তাহ পর আহমদ ছফার বইটা ছাপা হইল। বইটির নাম ‘উপলক্ষের লেখা’। একদিন দেখা হইতে আহমদ ছফা বলিলেন, ‘একটা ভুল হইয়া গিয়াছে। আনিস সাবেতকে আমি আগেও একটা বই উৎসর্গ করিয়াছিলাম।’ পরের বইটা তোমাকে দিব। আবার বলিলাম, ‘আল্লাহ যাহা করেন ভালোর জন্যই করেন।’

আহমদ ছফা ইহলোক ত্যাগ করিয়াছিলেন ঐ বছরের জুলাই মাসের ২৮ তারিখ। ইহার মধ্যে তাঁহার লেখা কোন বই আর প্রকাশ  পায় নাই।

দোহাই

১. আয়েশা ফয়েজ, জীবন যে রকম, ১০ম মুদ্রণ (ঢাকা: সময় প্রকাশন, ২০১১)।

২. হুমায়ূন আহমেদ, ‘পড়বে না তাঁর পায়ের চিহ্ন’, আহমদ ছফা স্মারকগ্রন্থ, মোরশেদ শফিউল হাসান ও সোহরাব হাসান সম্পাদিত (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৩), পৃ. ৬১-৬৩।

৩. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ‘আহমদ ছফা এবং বাংলা একাডেমী পুরস্কার’, প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট ২০০১, পৃ. ৭; পুনর্মুদ্রণ, আহমদ ছফা স্মারক গ্রন্থ, ঐ, পৃ. ১২১-১২৬।

৪. হুমায়ূন আহমেদ, বলপয়েন্ট, ৫ম মুদ্রণ (ঢাকা: অন্য প্রকাশ, ২০০৯)।

৫. হুমায়ূন আহমেদ, ‘নিজের কিছু কথা’, পুনর্মুদ্রণ, সমকাল, ঈদ আনন্দ ২০১২ সংখ্যা, ১৭ আগস্ট ২০১২।

৬. হুমায়ূন আহমেদ, ‘নিজের কিছু কথা’, উপন্যাস সমগ্র: প্রথম খণ্ড, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা: প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ২০১৬), পৃ. [সাত]-[আট]।

৭. আহমদ ছফা, সেইসব লেখা, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত (ঢাকা: খান ব্রাদ্রার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০০৮)।

৮. Charles Baudelaire, ‘Rêve parisien,’ Oeuvres complètes, tome I, par Claude Pichois (Paris: Gallimard, 1975), pp. 101-103.

৯. Charles Baudleaire, ‘Paris Dream,‘ Selected Poems, Carol Clark, trans. (London: Penguin Books, 2004), pp. 104-107

১০. Sigmund Freud, The Complete Psychological Works of Sigmund Freud, James Strachey, ed., vols. 4 and 6 (London: Hogarth Press, 1953—).

১১. Sigmund Freud, Interpreting Dreams, J. A. Underwood, trans. (London: Penguin Books, 2006).

১২. Shoshana Felman, ‘Psychoanalysis and Education: Teaching Terminable and Interminable,’ Yale French Studies, no. 63 (1982), pp. 21-44.