বইয়ের কথা

বিপ্লবের আঁচে ভলতেয়ারের ‘কাঁদিদ’ পাঠ

Looks like you've blocked notifications!

ভলত্যার বা ভলতেয়ার, এই নামেই তিনি এত পরিচিত যে তাঁর আসল বা পিতৃদত্ত নাম কেউ জানতেও চায় না। ফরাসি বিপ্লব ও ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রাণপুরুষ ভলতেয়ারের আসল নাম ঝাঁ-মারি আরুয়ে। ফরাসি এই লেখকের বিখ্যাত উপন্যাস 'কাঁদিদ' নিয়ে কিছু বলব আজ। অনুবাদ করেছে কবি অরুণ মিত্র। প্রকাশ করেছে ভারতের সাহিত্য আকাদেমি। কবির স্পর্শে অনুবাদ মনোহর হয়েছে।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কাঁদিদ। ওয়েস্টফালিয়ায় এক ভূস্বামীর দুর্গে তার বাস। সে ভালোবাসত ওই অঞ্চলের ভূস্বামীর মেয়ে ক্যুনেগঁদকে। নানা ঘটনাচক্রে এই প্রেমিক যুগল বারবার আলাদা হতে থাকে এবং সবশেষে মিলিত হয়। আর এই ঘটনাচক্রগুলোই আসলে গুরুত্বপূর্ণ।

উপন্যাসে কাঁদিদের প্রিয় শিক্ষাগুরু পাঁগ্লস একজন দার্শনিক। তার সঙ্গে নানা তর্ক-বিতর্ক ও ঘটনার মধ্য দিয়ে অনেকগুলো দার্শনিক চিন্তা আনা হয়েছে উপন্যাসে। পাঁগ্লস আধ্যাত্মবাদী ও ধর্ম বিশ্বাস থেকে যুক্তি করতেন। এগুলোর অনেকগুলোই উপন্যাসেই নানাভাবে খণ্ডন করা হয়েছে যুক্তি দিয়ে। কিছুটা বাস্তববাদী আরেক দার্শনিকের আবির্ভাব হয় উপন্যাসের শেষাংশে, চরিত্রটির নাম মারত্যাঁ। প্লাঁগসের মতো সে অদৃষ্টবাদী নয়, বরং সে কিছুটা বস্তুবাদী। তবে পুরো মাত্রায় নয়। পাঠককে পড়তে হবে বুঝতে চাইলে।

উপন্যাসজুড়ে শাসকদের ক্ষমতায় টিকে থাকা, সাম্রাজ্য দখলের লড়াইয়ে কাঁদিদের মতো প্রজাদের দুর্গতি, নারী-শিশুদের ওপর অমানবিকতা, ধর্মযাজকদের ভণ্ডামো, সম্পদের লোভ, ঈর্ষা, বংশ গৌরবের বিরোধিতা করে মানুষকে সমান ভাবা, দাসপ্রথার কুফল ও তা থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করার চিন্তাসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। রূপকের আড়ালে উঠে এসেছে ওই সময়কার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। লেখকের স্যাটেয়ার করার ক্ষমতাও অসাধারণ। ওই সময়কার ফ্রান্সসহ ইউরোপের রাজনৈতিক দুরবস্থা, ভিন্ন চিন্তার মানুষদের ওপর শাসকদের নিপীড়ন ও শোষণমুক্ত বিশ্ব গড়ার কামনা ফুটে উঠেছে উপন্যাসে।

উপন্যাসে কাঁদিদ ও তার ভৃত্য কাকাঁবো 'এলদোরাদো' নামে একটি গ্রামে যায়। গ্রামটির মানুষ সরল, লোভ ও নেতিবাচক চিন্তামুক্ত। কারো অভাব-অভিযোগ নেই, বৈষম্য নেই, সবাই সুখী। এই গ্রামের মানুষেরা ধর্মীয় পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে, গ্রহণ করছে বিজ্ঞানকে। সম্ভবত লেখকের আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের বর্ণনাই দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা যে সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজমের পথে হাঁটার কথা বলি, তারই একটা খণ্ডিত রূপ যেন। বাস্তব জীবনেও ভলতেয়ার 'ফ্যার্নে' নামে একটা জায়গা কিনেছিলেন শেষ বয়সে। সেখানে তিনি তাঁর মনের মতো করে স্বাধীন চিন্তার মানুষের বসতি বানিয়েছিলেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই ফ্যার্নে হয়ে উঠেছিল ইউরোপের মননকেন্দ্র।

উপন্যাসের শেষ দিকটায় লেখক মানবজাতির করণীয় সম্পর্কে তাঁর মত দিয়েছেন, যদি পাঠক মনোযোগ দিয়ে পড়লে বুঝবেন। মানুষ প্রকৃত অর্থে সুখী হতে চাইলে তাকে কাজ করে যেতে হবে। অলস বসে থেকে অন্যেরটা মেরে দেওয়ার চিন্তায় চলতে থাকলে সুখ আসবে না। ঔপন্যাসিক মারত্যাঁ চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, ‘আমরা যেন তর্ক না করে কাজ করি। জীবনকে সহনীয় করার এই একমাত্র উপায়।’ তার মানে এই নয় যে উনি তর্ক করতে নিষেধ করেছেন। তিনি এখানে আধ্যাত্মবাদী চিন্তা, নৈরাশ্যবাদ, পিছিয়ে থাকার সমস্ত আয়োজনকে ফেলে দিয়ে সুন্দর পৃথিবী গড়তে নিজের অবস্থান থেকে কাজ করে যাওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। উপন্যাসের শেষ লাইনে কাঁদিদের ভাষ্য, ‘আমাদের কর্তব্য আমাদের বাগান চাষ করা।’

ভলতেয়ার ফরাসি বিপ্লব দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু এমন একটা বিপ্লবের ব্যাপারে তিনি আঁচ করেছিলেন বোধ হয়। তার লেখনী শোষকদের জন্য যেন রক্তচক্ষু। লেখার মধ্য দিয়ে মতপ্রকাশের সাজা হিসেবে বারবার তিনি নির্বাসিত হয়েছেন, কারাগারে গিয়েছেন। নাবালক রাজা পঞ্চদশ লুই-এর রিজেন্ট সম্বন্ধে দুটি ব্যঙ্গ-নাটক তাঁরই রচনা সন্দেহ করে তাঁকে ফ্রান্সের এক জায়গায় নির্বাসন দেওয়া হয় ১৭১৬ সালে। চতুর্দশ লুই-এর রাজনীতিকে বিদ্রুপ করে লেখা এক কবিতার জন্য বাস্তিল কারাগারেও বন্দি হন তিনি। ১১ মাস কারাজীবনে লিখলেন ফরাসি ভাষার প্রথম মহাকাব্য - 'La Henriade'।

নাৎসিবাদী মনোবৃত্তির প্রতিবাদ জানিয়ে ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘বিধাতা-নির্বাচিত কোনো মানবগোষ্ঠী নেই, কোনো শ্রেষ্ঠ জাতি নেই।’ মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে বলেছিলেন, ‘আমি চাই সমস্ত অবিচারের কাহিনী সমস্ত মানুষের কানে সমস্তক্ষণ প্রতিধ্বনিত হোক।’ বলেছিলেন, ‘সমস্ত মানুষ যেন স্মরণ করে তারা সকলে ভাই, তাদের আত্মার ওপর যে স্বৈরাচার চলে তাকে যেন তারা ঘৃণা করে।’

পাঠক হিসেবে আমি মনে করি, ভলতেয়ারের লেখা আমাদের পড়া উচিত। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই আধুনিক যুগেও শাসকরা আমাদের কীভাবে বলীর পাঠা বানায়, কীভাবে ক্ষমতার দম্ভে আমাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়—তা ভলতেয়ার সেই যুগের প্রেক্ষাপটে বলে গেছেন। শাসকদের রূপ বদলালেও এখনো শোষণ থেকে গেছে। এ থেকে মুক্ত হতে হলে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে।