মুণ্ডা বিদ্রোহ
বিরসা মুণ্ডার জাগরণ
নৃতাত্ত্বিকদের মতে, মুণ্ডারা অস্ট্র্যালয়েড গোষ্ঠীভুক্ত। কিন্তু আকৃতি, প্রকৃতি, আচার, রীতি প্রভৃতি অনুযায়ী এদের নিজস্ব কিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আছে, যা আজও অপরির্তিত। এই মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো তারা যুগ যুগ ধরে বহন করে আসছে। আর্য সভ্যতারও বহু আগে থেকেই ভারতীয় ভূখণ্ডের বেশ কিছু অঞ্চলে অস্ট্র্যালয়েড গোষ্ঠীর আদিবাসীরা বসবাস করত। এদের মূল জীবিকা ছিল চাষবাস ও পশুপালন। একটি নির্দিষ্ট রুচি ও সংস্কৃতিও ছিল তাদের। কিন্তু আর্যরা আসার পরই পাল্টে যেতে থাকে সবকিছু। নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আর্যরা লড়াই শুরু করে ওই অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের সঙ্গে। ফলে তারা সেখান থেকে সরে ছোটনাগপুর, মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যার পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
অস্ট্র্যালয়েড জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোল আদিবাসীরাই বনাঞ্চল কেটে প্রথম জনবসতি তৈরি করে বিহারের ছোটনাগপুর এবং রাঁচিতে। কোলদের সমাজে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বা সর্দারগণকে ডাকা হতো মুণ্ডা। সেখান থেকেই মুণ্ডা নামের উৎপত্তি।
ইংরেজরা আসার আগে কোলদের রাজা ও জমিদাররা সকলেই ছিল কোলজাতির লোক। আদি নিয়মানুসারে যে জমি কোলেরা সকলে মিলে বনজঙ্গল পরিষ্কর করে চাষবাসের উপযোগী করে তুলত সে জমির মালিক রাজা ও জমিদাররা হতো না। জমির মালিক হতো কাট্টিদার কোল। জমিদারের কাজ ছিল জমিতে উৎপাদিত শস্যের একটি সামান্য অংশ খাজনা হিসেবে আদায় করা। তা থেকে আবার একটি অংশ নিজের ভরণপোষণের জন্য রেখে দিয়ে বাকি অংশ রাজার ভাণ্ডারে জমা রাখা হতো। এ ছাড়া বনের ফলমূল, কাঠ, বেত প্রভৃতি সম্পদের অধিকার ছিল কোল আদিবাসীদের।
কিন্তু ইংরেজরা আসার পরপরই ভূমি ব্যবস্থার এ মৌলিক নিয়মটির পরিবর্তন ঘটে। ফলে দেখা দেয় ব্যাপক গণবিদ্রোহ। ছোটনাগপুরের মুণ্ডারাও তখন ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে।
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগে সমগ্র রাঁচি জেলায় আবারও বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। দলবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহীরা তখন ওই অঞ্চলের জমিদারদের কাছারিগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং বহু কর্মচারীকেও হত্যা করে। সে সময় জমিদারগোষ্ঠীর আহ্বানে ইংরেজ সরকারের কয়েকটি বড় সৈন্যদল এগিয়ে আসে বিদ্রোহ দমনে। তবে এ সময় বিদ্রোহ দমনে ইংরেজরা ভিন্ন পথ অবলম্বন করে।
ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর সেনাপতিরা বিদ্রোহের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে আপসের ইচ্ছার কথা জানায়। বিদ্রোহীরাও তাতে রাজি হয়। ফলে আদিবাসী সর্দার ও সেনাপতিদের মধ্যে বৈঠক বসে। উভয় পক্ষের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়—নতুনভাবে খাজনা বৃদ্ধি করা হবে না, পূর্বের খাজনাই বহাল থাকবে এবং বনের নানা সম্পদ আদিবাসীরা ব্যবহার করতে পারবে। আলোচনার মাধ্যমে এভাবেই ওই বিদ্রোহের অবসান ঘটে তখন।
ইংরেজ সরকারকে বিশ্বাস করে মুণ্ডা সর্দারগণ ফিরে গেলেও, অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। ফলে মুণ্ডা অঞ্চলে ধীরে ধীরে আবারও বিদ্রোহের ঝড় ওঠে।
১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগের কথা। মুণ্ডা অঞ্চলে আবির্ভাব হয় একুশ বছর বয়সী হাস্যজ্জোল ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার এক যুবকের। নাম তাঁর বিরসা মুণ্ডার। ছোটনাগপুরের রাঁচি জেলার তামার থানার চালকাদ গ্রামের কাছেই উলিহাতির বাম্বা পল্লী। ওখানেই ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে বিরসা মুণ্ডার জন্ম। বাবা মুণ্ডা সর্দার সুগণা মুণ্ডা আর মায়ের নাম কারমী। তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বিরসা ছিলেন চতুর্থ। তাঁর জন্মের পর সুগণা মুণ্ডা বাম্বা পল্লী ছেড়ে চলে আসেন চালকাদ গ্রামে। চরম দারিদ্রে দিন কাটছিল তাদের। সে সময় গ্রামে গ্রামে আদিবাসীদের দারিদ্র্যের সুযোগে তাদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের কাজ করতো খ্রিস্টান মিশনগুলো। নানা প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভনে বহু আদিবাসী তখন খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়।
সুগণা মুণ্ডাও তখন মিশনারিদের দ্বারা প্রভাবিত হন। খ্রিস্টান পাদ্রিদের দয়ায় তার দারিদ্র্য ঘুচবে—এমন আশায় তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষা নেন। এভাবে বিরসাও খ্রিস্টান হন মাত্র ১২ বছর বয়সে। তখন তাঁর নাম দেওয়া হয় দাউদ মুণ্ডা।
মাত্র চার বছর বয়সে তিনি ভর্তি হন চাইবাসার জার্মান মিশনারিদের স্কুলে, ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। পরে জার্মান মিশনারিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ফলে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে বিরসা ওই স্কুল ত্যাগ করে রোমান ক্যাথলিক মিশনে চলে যান। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন টিকতে পারেন না।
কিন্তু কারণ কী?
সে সময় মুণ্ডারা জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। ওই বিদ্রোহে ইংরেজদের পক্ষে ছিল মিশনারিরা। তারা বিদ্রোহী মুণ্ডা সরদারদের প্রতারক বলায় এর প্রতিবাদ করে বিরসা মুণ্ডা। ফলে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই খ্রিস্টান মিশনারিদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ তৈরি হয়।
মিশনারি স্কুলে শিক্ষা লাভ করায় বিরাস মুণ্ডা আরো সচেতন হন এবং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। একদিকে আদিবাসী সংস্কৃতির প্রভাব, অন্যদিকে খ্রিস্টান মিশনারির শিক্ষা—এ দুইয়ের মধ্যকার বিষয়গুলো তাঁর মনে দ্বন্দের সৃষ্টি করে। ফলে একসময় শিকড়ের টানে বিরসা মুণ্ডা খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে আবারও মুণ্ডাদের প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাসে ফিরে আসেন। ওই সময়ের পর তিনি বাদগাঁও নামক জায়গায় প্রায় তিনবছর ছিলেন একজন বৈষ্ণবের কাছে। ফলে হিন্দু ধর্মের নানা আচার ও বিশ্বাসের প্রতিও তিনি আসক্ত হন।
বিরসা যতটুকু শিক্ষা পেয়েছেন, তাতেই বুঝেছেন যে, রোমান পুরোহিত ও খ্রিস্টান পাদ্রি—এই উভয় ধর্মযাজকগণই মুণ্ডা সমাজের শত্রু। তাদের প্রচারে ও অনুশাসনে মুণ্ডারা বিভ্রান্ত। সুতরাং এদের প্রভাব দূর করতে না পারলে মুণ্ডাদের জাগরণের কোনো আশা নেই। তা ছাড়াও মুণ্ডা সমাজে বহু দেবতার পূজা প্রচলন করেছিল ব্রাহ্মণরা। তাই সেটারও অবসান ঘটাতে হবে।
১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২১ বছর বয়সী বিরসা মুণ্ডা প্রচার করতে থাকেন যে, তিনি এক নতুন ধর্ম মুণ্ডাদের প্রধান দেবতা শিং বোঙ্গার কাছ থেকে লাভ করেছেন। শিং বোঙ্গা নিজে তার মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছেন যে, মুণ্ডাদের এখন থেকে বহু দেবতার (বোঙ্গার) পরিবর্তে কেবল একটি দেবতাকেই পূজা করতে হবে, তাদের জীবজন্তুর মাংস খাওয়া ত্যাগ করতে হবে, সৎভাবে জীবনযাপন করতে হবে, সর্বপ্রকার কুসংস্কার পরিত্যাগ করে সুন্দর নির্মল ও পবিত্র চরিত্র গঠন করতে হবে, আর হিন্দুদের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মতো গলায় জানে, অর্থাৎ পবিত্র সূত্র ধারণ করতে হবে—এসবই হলো প্রধান দেবতা শিং বোঙ্গার নির্দেশ। শিং বোঙ্গার পূজা মুণ্ডারা নিজেরাই করবে, এর জন্য কোনো পুরোহিত ডাকারও প্রয়োজন নেই। এভাবে বিরসা নতুন ধর্মমতের প্রচার শুরু করেন।
বিরসা মুণ্ডা। ছবি : সংগৃহীত
বিরসা মুণ্ডার মুখে শিং বোঙ্গার নির্দেশনা শুনে মুণ্ডা জনসাধারণের মধ্যে এক নতুন প্রাণ-চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সুত্রধারী ব্রাহ্মণের দল এতকাল তাদের মধ্যে বহু দেবতা ও সুত্রের মহিমা প্রচার করে তাদের যেমন বোকা বানিয়ে রেখেছিল, তেমনি ধর্মের ভয় দেখিয়ে জমিদার-মহাজনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধাও দিয়েছিল তারা। ফলে বিরসা এই নতুন ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে মুণ্ডাদের মধ্য থেকে ব্রাহ্মণ ও খ্রিস্টান পুরোহিত শ্রেণির দুষ্ট প্রভাবও দূর করেছিলেন।
মূলত বিরসা মুণ্ডা চেয়েছিলেন জমিদার মহাজন, তথা ইংরেজদের থেকে শোষণমুক্ত আধুনিক শিক্ষায় আলোকিত এক মুণ্ডা সমাজ। তাই তিনি অত্যাচারীদের প্রতিরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে মুণ্ডাদের মধ্যে কিছু সংস্কারমূলক কাজও করেছিলেন।
(চলবে)