গল্প

সাহেবুলের চলাচল

Looks like you've blocked notifications!

নিচু হয়ে জিনিসটা গোটাতে গিয়েই কোমরের ব্যথাটা আবার নিশান দেখাল। সাহেবুল জানে বয়েস বাড়ার চিহ্ন এসব। বৃষ্টিটা বাড়ছে। আকাশ মেঘে ভরপুর। পায়ের তলায় জল। প্যান্ট গুটিয়ে আবার হাঁটতে লাগল সে। সামনে খেলার মাঠটা। সবুজ ঘাসটা কার্পেটের মতো নরম লাগছে। বৃষ্টির জলে এই মেঘলা দিনেও চকচক করছে মাঠের ঘাসগুলো। গোটা মাঠটা ভোঁ ভাঁ। কিছুদিন আগে দেওয়া ফেন্সিংয়ের তারগুলো জলে ধুয়ে ঝকঝকাচ্ছে। পুরোনো কথা মনে পড়ছিল। ছুটির দিনে বৃষ্টি হলেই বল নিয়ে মাঠটা দাপাত ওরা। কোণের বটগাছটার বেদিতে গিয়ে বসল সাহেবুল। মাঠের নিঃসঙ্গতা ওর মনের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে গেল। বৃষ্টিভেজা কতগুলো চড়ুই ফেন্সিংয়ের মাথায় বসে হাঁপাচ্ছিল। মোবাইলটা বেজে উঠল। নূপুর। 

-কখন থেকে ফোন করছি! ধরছো না কেন?

-খেয়াল করিনি। বৃষ্টির শব্দ। তুমি কোথায়?

-কোথায় মানে! আমার এখন কোথায় থাকার কথা?

 সাহেবুলের মনে পড়ে গেল, ও তো বাড়ি থেকে বেরিয়েছেই নূপুরের সঙ্গে দেখা করতে। রোজই যায়। বৃষ্টিতে সব কেমন ঘেঁটে গেল। এমন ওর মাঝে মাঝেই হয়। এটাও কি বয়েস বাড়ার লক্ষণ? কে জানে! বটগাছের তলা থেকে ও তাড়াতাড়ি পা চালাল...

-কী হয়েছিল তোমার? বউ বেরোতে দিচ্ছিল না? 

নূপুর জেরার সুরে জানতে চায়। চোখে সন্দেহ।

-আরে না না। বৃষ্টিটা এত জোরে এলো তখন যে শেডের নিচে দাঁড়াতে বাধ্য হলাম।

সাহেবুল পরিস্থিতি হালকা করতে নূপুরের হাত ধরল। নূপুর কিন্তু এখনো খেপে আছে। স্বাভাবিক। ঝাড়া এক ঘণ্টা দাঁড়াতে হয়েছে ওকে। সাহেবুল বোঝে। কী যে হয় মাঝে মাঝে ওর! নূপুরের খোলা পিঠে হাত রাখে ও।

-ছাড়ো, আর আদিখ্যেতা করতে হবে না।

সাহেবুল ছাড়ে না। বরং ওর আঙুলটা নূপুরের তৈলাক্ত পিঠে স্লিপ খেয়ে ওর ঘাড়ের কাছে চলে যায়। ঘাড়ের ওই ভাঁজটা ঠোঁটের মতোই নরম। এবং সেনসিটিভও। নূপুর আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়তে থাকে...

এমনই হয় ওদের। তবে এভাবে কতদিন চলবে তার জবাব নেই ওদের কারো কাছে। সাহেবুলের স্ত্রী আছে। একটা ছেলেও আছে। ক্লাস নাইন। ছোটবেলার বিয়ে। আর বনে না। সামনে এলেই খিটিরমিটির। সাহেবুলের ভালো লাগে না।

স্ত্রীকে এড়িয়ে চলে। অথচ বিয়ের প্রথম দিকে এমনটা ছিল না। গল্প করতে করতে রাত ভোর হয়ে যেত। এখন ঘর-বিছানা আলাদা। সাহেবুল দু-একবার যে ট্রাই নেয় না এমনটা নয়। কিন্তু ব্লাউজের বেশি আর নামতে পারে না। একটা আঁশটে গন্ধ সাহেবুলকে নিষ্কাম করে দেয়। পরের দিন সাহেবুলের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে, ওর বাপ চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে। সাহেবুল কিছু বলে না। ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঝিলের ধারে চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। এখানেই বাপজানের কাছে সাঁতরাতে শিখেছিল। বাপের স্মৃতি হালকা। ওর সাত বছরে বাপজান মারা গিয়েছিল পুলিশ এনকাউন্টারে। সাহেবুল খুব ন্যাওটা ছিল বাপজানের। তখন থেকেই ওর একাকিত্ব শুরু। ঝিলটা বিশাল। পুরোটা পাক মারতে এক ঘণ্টা প্রায়। ঝিলের ওপারে নূপুর থাকে। বিধবা মায়ের সঙ্গে। বিয়ে থা হয়নি। কে দেবে? সাহেবুল ঝিলধার বেয়ে চলে নূপুরের বাসায়। চাঁদের আলো ঝিলের বুকে। সেখান থেকে নূপুরের টিনের চালে। নূপুরের মা আফিম খায়।

জানালা দিয়ে চাদের আলো নূপুরের বুকে। সাহেবুলের মাথা এসে ঢেকে দেয় ওর বুক। আলো আবার হারিয়ে যায়। নূপুর দরদরিয়ে ঘেমে চলে। সেই ঘামে সাহেবুল কমলালেবুর গন্ধ পায়... 

সাহেবুলের আম্মি আলাদা থাকে। ওদের ঘরের পেছন উঠোনে আম্মির কুঁড়ে। বুড়ি নিজের খেয়ালে থাকে। সাহেবুলদের সাতেপাঁচে থাকে না। আম্মি এখনো ব্যাগ সেলাই করে নিজের খরচা চালায়। সাহেবুল কখনো জোর করে এটা ওটা কিনে দেয়। বৌ যাতে জানতে না পারে। 

     সাহেবুল আসলে এখনো একা। শুধু নূপুরের সঙ্গে কিছু মুহূর্ত ছাড়া। তাই ও আনমনা হয়ে যায় কখনো। কখনো ঝিলের জল, কখনো মাঠের ঘাস, কখনো নূপুরের ঘাম-এসবের মধ্যে হারিয়ে যায় ও।

      নূপুরের কথা সবাই জানে। সাহেবুলের আম্মি, স্ত্রীও জানে। স্ত্রী ছেলেকে জানিয়েছে। ছেলে ওকে ঘেন্না করতে শিখেছে মায়ের কাছ থেকে। সাহেবুল ওকে ঘুড়ি কিনে দেয়। ছেলে তা ছিঁড়ে ফেলে আড়াল হলেই। সাহেবুল ওকে লজেন্স কিনে দেয়। ছেলে তা ঝিলের জলে ফেলে দেয়। সাহেবুল সব বোঝে। কিছু বলে না। ও হাঁটতে হাঁটতে ঝিলের পারে চলে যায়। ঝিলের জলে দুটো ছেলে সাঁতার কাটছে। ওর মনে হয় ও আর বাপজান। ও দূর থেকে আম্মিকে আসতে দেখে।

-কোথায় গিয়েছিলে আম্মি?

-মহাজনের ঘরে। তুই ভরদুপুরে এহানে কী করস?

-কিছু না, এমনি।

-মন খারাপ লাগে?

আম্মিরা সব টের পেয়ে যায়!
-ঘরে যা। বিবিরে সময় দে।

-এত বছর তো দিলাম।

আম্মি হাসে। 

-আরো দে।

-বাপজান তোমায় দিত?

-না।

-তাহলে?

-সব ছানাই কি দশ মাসে বিয়োয়? আট মাস, সাত মাসেও তো বিয়োয়, না কি? 

আম্মি হাঁটতে থাকে। সাহেবুলও সঙ্গে চলে।

-কিছু কইবি?

-আমি তোমার সঙ্গে থাকব।

আম্মি হাসে।

-তোর বৌ তবে আমায় মাইরাই ফালাইবো। যা, ঘরে যা।

সাহেবুল ঘরে যায় না। ঝিলের ধার বেয়ে ও নূপুরের বাসার দিকে চলে। 

    আজ সকাল থেকেই দোকানে ভিড়। বাজারে ব্যাগ তৈরির মেটেরিয়ালের দোকান সাহেবুলের। ব্যাগের চেন, হ্যান্ডেল, বোতাম, স্পাইক এসব আর কি। কিন্তু দোকান করতে ভালো লাগছে না ওর। দোকানের ছেলেটাকে বলে বেরিয়ে গেল সে। নূপুরের বাসায়। নূপুর বাড়িতে ব্যাগ সেলাইয়ের কাজ করে। 

নূপুরের দমবন্ধ হয়ে ওঠে। সাহেবুলের ঠোঁট ওর ঠোঁটে, সাহেবুলের জিভ ওর মুখের আনাচে কানাচে। নূপুরের দুই হাত সাহেবুল শক্ত করে চেপে রাখে। নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে নূপুর আরো জড়িয়ে পড়ে সাহেবুলের নাগপাশে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে নূপুর...

-এই সম্পর্ক তোমায় এত যন্ত্রণা দিলে থেকো না।

সাহেবুল উত্তর না দিয়ে জানালা দিয়ে চেয়ে থাকে দূরের ঝিলের দিকে। ঝিলের মাথায় ঘুড়ি উড়ছে। চাঁদিয়াল। হয়তো সাহেবুলের ছেলে ঝিলের ওপার থেকে ওড়াচ্ছে। ওর মা কিনে দিতে পারে। সাহেবুল দিলে ছেলে নেয় না। এমন সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। জানালা দিয়ে জলের ছাঁট এসে সাহেবুলের মুখ ভিজিয়ে দিল। নূপুর বুকে শায়া জড়িয়ে উঠে এসে জানালা আটকে দিল। সাহেবুলের বৃষ্টির ছাঁট ভালোই লাগছিল। নূপুর ওর পিঠে ভর দিয়ে বসল। ওর ভারী স্তনের ভারে সাহেবুলের খোয়াব খানিক চটকালো।

-আমি তোমায় ভালোবাসি নূপুর।

নূপুর ওর স্তনের ভার আরো খানিকটা বাড়াল ওর পিঠে...

বৃষ্টি মাথায় করেই সাহেবুল বেরিয়ে পড়ল। নূপুর মানা করেছিল।

হাঁটতে হাঁটতে ও পৌঁছে গেল বটগাছটার তলায়। ও আর বাপজান এখানেই পোশাক ছেড়ে জলে নামত। 

        প্রচণ্ড বৃষ্টিতে দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। রাস্তাঘাট ভোঁ ভাঁ। একজোড়া শালিক বটের প্রান্তিক ডালটায় চুপ করে বসে ভিজছে। খানিক সরে বসলেই ওরা ভিজবে না। ওরা ভিজতেই চায় আসলে। সাহেবুল পোশাক ছেড়ে বটের ঝুড়িতে রেখে ঝিলে নেমে পড়ল। ছেলেবেলার মতো। আস্তে আস্তে সাঁতরাতে লাগল ও। নিজেকে হালকা লাগছে খুব। সাঁতরাতে সাঁতরাতে ঝিলের মধ্যিখানে চলে গেল ও। এখান থেকে নূপুরদের বাসাটা আবছা দেখা যাচ্ছে। সাহেবুল অনুভব করল ওর নিচে আরো কেউ সাঁতরাচ্ছে ওর সঙ্গে। জলে মুখ ডোবাল ও। একটা বিরাট কালো মাছ! মাছ না মৎস্যপুরুষ ওটা? ভালো করে দেখার জন্য সাহেবুল ডুব সাঁতারে আরো খানিকটা ভেতরে গেল। মাছ বা মৎস্যপুরুষটা যেন হাসছে ওর দিকে চেয়ে! সাহেবুলের মনে হলো ওটা ওর বাপজান!

-বাপজান, বাপজান
সাহেবুল চিৎকার করে ডাকতে চাইল। বাপজান ওকে ইঙ্গিত করে নিজের দিকে ডাকছে।

-দাঁড়াও বাপজান, গাছতলা থেকে প্যান্টশার্টটা নিয়ে আসি
-এহানে ওসব লাগে না, আয়
বাপজান দুই হাত বাড়িয়ে ওকে ডাকে। সাহেবুল পিছু পিছু চলে। ঝিলের ওপরের মানুষদের কথা ভুলে যায় সে। আম্মি, স্ত্রী, ছেলে, নূপুর... সাহেবুল স্বার্থপর হয়ে যায়, শুধু নিজের কথা ভাবে সাহেবুল। জলের গভীরে তলিয়ে যেতে যেতে অনুভব করে, ক্রমশ ছেলেবেলার মতো আকৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে সে...