বইয়ের কথা

নটর ডেমের মানবিক কুঁজোর গল্প

Looks like you've blocked notifications!

ফরাসি সাহিত্যিক ভিক্টর হুগোর সবচেয়ে বিখ্যাত দুটো বইয়ের নাম বললে ‘লে মিজারেবল’-এর পরেই আসবে ‘হাঞ্চব্যাক অব নটর ডেম’ উপন্যাসের নাম। নর-নারীর প্রেমের এতটা মানবিক উপস্থাপন খুব কম উপন্যাসেই পাওয়া যায়। নিয়াজ মোর্শেদের অনুবাদে বইটি প্রকাশ করেছে সেবা প্রকাশনী।

উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায় ভবঘুরে এক কবি, নাট্যকার ও দার্শনিক পিয়েরে গ্রিঁগোয়ারকে। ব্যর্থতা ও হতাশা নিয়ে এক রাতে প্যারিসের রাস্তায় ঘুরছিল সে। ঘটনাক্রমে সুন্দরী জিপসি তরুণী এসমেরালদাকে অনুসরণ করতে গিয়ে জিপসিদের আস্তানায় পৌঁছায় সে। এসমেরালদা প্যারিসের পথে পথে তার ছাগল জালিকে নিয়ে নেচেগেয়ে, খেলা দেখিয়ে দিন কাটাত। গ্রিঁগোয়ারকে জিপসিদের ক্রোধ থেকে বাঁচিয়ে সেদিন আশ্রয় দেয় জিপসি মেয়েটি। এ জন্য অবশ্য চার বছরের জন্য মৌখিকভাবে স্বামী বানাতে হয় গ্রিঁগোয়ারকে। তবে এই সম্পর্ক নিতান্তই বাহ্যিক, তাদের মধ্যে অন্য কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। এসমেরালদার অন্ধ বিশ্বাস, সে নিজেকে কুমারী রাখলে একদিন তার হারানো মা-বাবার দেখা পাবে।

উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ  চরিত্রে আছেন নটর ডেম গির্জার আর্চডিকন ক্লদ ফ্রোলো, জ্ঞানী-সংযমী মানুষ তিনি। এই মানুষটি একসময় সমাজের মানুষের আপত্তি উপেক্ষা করে আশ্রয় দিয়েছিল শারীরিক প্রতিবন্ধী কোয়াসিমোদোকে। সে বধির এবং বোবা, গির্জার ঘণ্টা বাজানোর কাজ করে। কুৎসিত ও দানবীয় চেহারার কারণে সবাই তাকে ঘৃণা করে, কিন্তু তাকে আগলে রাখে পালক-পিতা ফ্রোলো। ফ্রোলোর মতো এমন মানবিক মানুষই পরে এসমেরালদাকে পাওয়ার তীব্র কামনায় অন্ধ আর অমানবিক হয়ে ওঠে। হিংসা, ক্রোধ, যৌন লালসা একটা মানুষকে মানুষ থেকে কীভাবে জানোয়ার বানিয়ে দিতে পারে—মানবিক চরিত্রের রূপান্তরের উদাহরণ এই চরিত্রটি।

এদিকে সরল এসমেরালদা প্রেমে পড়ে তরুণ ক্যাপ্টেন ফিবাসের। কিন্তু দুশ্চরিত্র ফিবাস বাগদত্তা থাকা সত্ত্বেও এসমেরালদার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে এবং মেয়েটাকে ভোগ করতে চায়। এ ঘটনা বুঝতে পেরে ক্লদ ফ্রোলো চেষ্টা করে ফিবাসকে মেরে ফেলতে। আহত হলেও বেঁচে যায় ফিবাস। কিন্তু এই খুনের দায়ে উল্টো এসমেরালদাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই সাজা থেকে ক্লদ ফ্রোলো তাকে বাঁচাবে, যদি এসমেরালদা ফ্রোলোর প্রেমকে স্বীকার করে। কিন্তু প্রেমিক ফিবাসের খুনিকে কিছুতেই মেনে নেয় না মেয়েটি। এমন অবস্থায় উন্মাদ জনতার হাত থেকে এসমেরালদাকে উদ্ধার করে এবং পালক-পিতা ক্লদ ফ্রোলোর কুনজর থেকে নটর ডেম গির্জায় তাকে লুকিয়ে রাখে কোয়াসিমোদো।

ক্লদ ফ্রোলো তার কামনা পূরণের জন্য এসমেরালদার কথিত স্বামী গ্রিঁগোয়ারের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে জিপসি ও রাজার সৈন্যদের মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে ছিনিয়ে আনে এসমেরালদাকে। তারপর তাকে সিস্টার গুঁদুলে নামে এক পাগলির হাতে সঁপে দেয়। ঘটনাক্রমে এসমেরালদা জানতে পারে, ওই পাগলিটি তার হারিয়ে যাওয়া জননী। সৈন্যরা এসমেরালদাকে মৃত্যুদণ্ডের জন্য নিয়ে যেতে এলে মা রক্ষা করতে চায় এতদিন পর ফিরে পাওয়া মেয়েকে, কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। এসমেরালদা আরো জানতে পারে, যে প্রেমিককে খুনের মিথ্যা দায়ে তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, সে বহাল তবিয়তে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসমেরালদাকে যেদিন ফাঁসিমঞ্চে তোলা হলো, সেদিনই ক্ষুব্ধ কোয়াসিমোদো তার পালকপিতাকে ক্যাথেড্রালের ওপর থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। এর পর থেকে কোয়াসিমোদোকে আর দেখা যায়নি।

দুই বছর পরে নটর ডেমের পাতালে খননকাজ চলাকালে দুটি কঙ্কাল পাওয়া যায়। এর মধ্যে একজন নারী, আর তাকে জড়িয়ে ধরে আছে শিরদাঁড়া বাঁকানো খর্বাকৃতির একটি কঙ্কাল। তাদের আলাদা করতে গেলে ধুলো হয়ে গিয়েছিল কঙ্কাল দুটো। এসমেরালদার দুঃখে সব সময় পাশে থেকেও তার কাছে কখনো প্রেম দাবি করেনি কিয়েসিমোদো, বরং অবহেলাই পেয়েছে। এই হলো উপন্যাসের গল্প।

ভিক্টর হুগোর অন্য উপন্যাসের মতো এ উপন্যাসেও চরিত্রগুলোর দ্বন্দ্বকে উপস্থাপন করেছেন দারুণ দক্ষতায়। লেখক এই উপন্যাসেও আর্চডিকন ক্লদ ফ্রোলোর মনের ভেতরে ভালো ও মন্দের প্রবল দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন, দেখিয়েছেন কবি-দার্শনিকের দোদুল্যমানতা। দেখিয়েছেন বাহ্যিকভাবে যাকে দানব মনে হয়, সেই কিয়েসিমোদোর ভেতরকার অপূর্ব মানবিক সত্ত্বা। সেইসঙ্গে মধ্যযুগের ইউরোপে রাষ্ট্র ও ধর্ম কীভাবে একত্রিত হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করত, তার বর্ণনা উঠে এসেছে। সে যুগের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ, গরিবদের প্রতি উচ্চবিত্তদের মনোভাব, শাসকদের শোষণ-নিপীড়নসহ অনেক বাস্তবতাই তুলে এনেছেন ঔপন্যাসিক। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠে এসেছে এক মানবিক প্রেমের গল্প।