মুণ্ডা বিদ্রোহ
কারামুক্ত বিরসার প্রতিশোধ
ক্রমে শত শত মুণ্ডা যুবক বিরসা মুণ্ডার নতুন ধর্মমন্ত্রে দীক্ষা লাভ করে এক নতুন চেতনায় অনুপ্রাণিত হতে থাকে। তারা দলে দলে বিরসার গ্রামে সমবেত হয় এবং তাঁকে ভগবানের আসনে বসিয়ে জাতির ত্রাণকর্তারূপে পূজা করা শুরু করে। এভাবে বিরসা হয়ে ওঠেন বিরসা ভগবান, মুণ্ডা ভাষায় -ধাতৃ আবা অর্থাৎ বিশ্বের পিতা।
বিরসা তাঁর শিষ্যদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে গ্রামে গ্রামে তাঁর নতুন বাণী প্রচারসহ কিছু নির্দেশনা পাঠালেন। তারাও ঘুরে ঘুরে মুণ্ডাদের অবিলম্বে জমিদারদের খাজনা, বেগার খাটা প্রভৃতি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। বিরসার নির্দেশ অনুযায়ী তারা মুণ্ডাদের কাছে বিদ্রোহের তারিখটিও জানিয়ে দেয়।
তারিখটি ছিল ২৭ আগস্ট। ওই দিনটিকে তারা বলেনÑ প্রলয়ের দিন। ওইদিন ইংরেজ সরকার ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। তাই এই প্রলয়ের দিনে সকল মুণ্ডাকে নতুন কাপড় পরে নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ চালকাদ গ্রামে সমবেত হতে বলা হয়। বিরসার ডাকে প্রলয়ের আগেই হাজারে হাজারে মুণ্ডা চালকাদ গ্রামে সমবেত হতে থাকে। চালকাদ গ্রাম জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মুণ্ডাদের মধ্যে চাঞ্চল্য জেগে উঠে। কিন্তু ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও জমিদার মহাজনগণ তখন ভয়ে মুণ্ডা অঞ্চল থেকে পালিয়ে যেতে থাকে।
তারা বিদ্রোহের সংবাদ থানায় থানায় জানিয়ে দেয়। ফলে বিদ্রোহের আগেই কয়েকশ পুলিশ চালকাদ গ্রামের কাছে ঘাঁটি গাড়ে। বিরসা মুণ্ডার পরিকল্পনা ছিল ওইদিন মুণ্ডা অঞ্চলের ডিকু শয়তান অর্থাৎ জমিদার-মহাজনদের হত্যা করা। কিন্তু তার আগেই তারা পালিয়ে যায়। ফলে বিরসার অনুচরগণ অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে পুলিশ বাহিনীর ওপর। প্রস্তুত হওয়ার আগেই বিদ্রোহীরা পুলিশকে আহত করে, তাদের জিনিসপত্র তছনছ এবং বিছানাগুলি নিকটবর্তী নদীতে ফেলে পালিয়ে যায়।
এরপরই সশস্ত্র পুলিশ গ্রামে গ্রামে হানা দিতে থাকে এবং মুণ্ডাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায়। মুণ্ডারাও পুলিশের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। তখন এক খণ্ডযুদ্ধে পরাজিত হলে কয়েকজন অনুচরসহ বিরসা মুণ্ডা আত্মগোপন করেন। পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের সংবাদ পেয়ে একদল সৈন্য ও কয়েকটি হাতি নিয়ে মুণ্ডা অঞ্চলে আসেন। তিনি কয়েকশ পুলিশ ও সৈন্য একত্রিত করে বিরসা মুণ্ডা ও তার প্রধান অনুচরদের খোঁজে গোটা মুণ্ডা অঞ্চল চষে বেড়ান। হাতির সাহায্যে বিদ্রোহী মুণ্ডাদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে পিষে দেওয়া হয়। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয় তারা। অতঃপর বিরসার এক বিশ্বাসঘাতক অনুচরের সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ ও সৈন্যরা বিরসা মুণ্ডাকে তাঁর গোপন আশ্রয় স্থান থেকে গ্রেপ্তার করে। তারা তাঁকে গোপনে দূরবর্তী রাঁচি জেলে পাঠিয়ে দেয়।
বিরসার গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই মুণ্ডাদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। প্রায় সাত হাজার মুণ্ডা তখন চালকাদ গ্রামে সমবেত হয়। তারা জেল ভেঙ্গে তাদের ভগবান বিরসাকে ছাড়িয়ে আনতে চায়। কিন্তু বিরসার অনুচরগণ তাদের বুঝিয়ে ফিরিয়ে দেয়। অতঃপর আটজন অনুচর গোপনে রাঁচি জেলে প্রবেশ করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তারাও ব্যর্থ হয় এবং পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।
বিরসাকে প্রকাশ্যে বিচার করে কঠিন শাস্তি দিলে মুণ্ডারা ভয় পাবে এবং বিদ্রোহ থেকে ফিরে আসবে এই ধারণা নিয়ে বিরসা ও তাঁর অনুচরগণকে মুণ্ডা অঞ্চলের মধ্যবর্তী খুন্তিয়া জেলে আনা হয়। এই সংবাদ পাওয়া মাত্রই ১০ হাজার মুণ্ডা আদিবাসী খুন্তিয়া জেল দুদিন পর্যন্ত ঘিরে রাখে। ফলে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ভয় পেয়ে যায়। তারা অতি গোপনে বিরসাদের আবারও রাঁচি জেলে স্থানান্তর করে। অতঃপর ইংরেজরা ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বিরসা মুণ্ডাকে আড়াই বছর ও তাঁর অনুচরদের বিভিন্ন সময়ে সশ্রম কারদণ্ডে দণ্ডিত করে।
বিরসার কারাদণ্ডের পরও শান্ত থাকে না মুণ্ডারা। তারা আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিরসা মুণ্ডার কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে বড় ধরনের বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই অবস্থা দেখে ইংরেজ শাসকগণ ভরকে যায়। তারা গ্রামে গ্রামে পুলিশ ও সৈন্য বসায়। ফলে মুণ্ডারাও বুঝতে পারে এ অবস্থায় বিদ্রোহ করা সম্ভব নয়। তাই তারা ওই সময় শান্ত থাকে।
মুণ্ডাদের নীরবতার সুযোগে পুলিশ ও সৈন্যবাহিনীর সহযোগিতায় পুরোহিত ও জমিদার-মহাজনগণ আবার ফিরে আসে এবং মুণ্ডাদের ওপর আগের মতোই শোষণ-উৎপীড়ন চালাতে থাকে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তৎকালীন সরকারি বিবরণীগুলোতে। ১৮৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দের ভূমি রাজস্বের বাৎসরিক বিবরণে উল্লেখ করা হয় লোহারদুগা জেলায় (মুণ্ডা অঞ্চলে) শোনা যায় যে, জমিদারদের খাজনা ও বেগার শ্রমের নামে চাষিদের যথা-সর্বত্র কেড়ে নিয়েছে। জমিদার আদিবাসী চাষিদের জমি থেকে উচ্ছেদের ভয় দেখিয়ে সর্বদা তাদের শঙ্কিত অবস্থায় রাখছে। এই অবস্থায় চাষিরা তাদের দেওয়া খাজনাও দিতে অস্বীকার করে।
এরপরের বছর অর্থাৎ ১৮৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দের ভূমি রাজস্ব বিবরণে এ প্রসঙ্গে লেখা হয় ঠিক এভাবে লোহারদুগা জেলার জমিদার ও রায়তের সম্পর্ক অতিশয় উদ্বেগজনক। জমিদারগণ আইনের সাহায্যে অথবা বে-আইনিভাবেই রায়তের যথাসর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার জন্য সর্বদা সচেষ্টা। রায়তেরা তাদের যথাসম্ভব বাধা দিচ্ছে। জঙ্গলের অধিকার নিয়ে সংঘর্ষ লেগেই আছে। এ সম্পর্কে অবিলম্বে কিছু করা না হলে জেলার এক বৃহৎ অংশের জঙ্গলে আদিবাসীদের সব অধিকার অথবা জঙ্গরের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে।
সে সময় জমিদার-মহাজনদের উৎপীড়ন ও শোষণ ছাড়াও দুর্ভিক্ষ এবং মহামারীতে আদিবাসীরা ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ায়। জমিদারদের ভয়ঙ্কর উৎপীড়ন ও অনাবৃষ্টির ফলে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র মুণ্ডা অঞ্চলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে অনাহারে অসংখ্য কৃষকের মৃত্যু হয়। এর পরের বছর গ্রীষ্মকালে সমগ্র অঞ্চলে কলেরা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শত শত আদিবাসী বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারায়।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে বিরসা মুণ্ডা ও তার অনুচরগণ জেল থেকে মুক্তি পান। তারা মুণ্ডা অঞ্চলে এসেই মুণ্ডাদের দুর্দশা দেখে স্থির থাকতে পারে না। মুণ্ডাদের এই চরম দুর্দশার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে বিরসা মুণ্ডা অস্থির হয়ে উঠেন। ফলে গ্রামে গ্রামে তিনি তার অভয় বাণী প্রচার ও বিদ্রোহের ডাক দিতে থাকেন।
এতে মুমূর্ষ মুণ্ডা জাতি আবারও মনোবল ফিরে পায় এবং তাদের প্রিয়তম নায়ক বিরসা মুণ্ডার নির্দেশ শুনতে চালকাদ গ্রামে উপস্থিত হয়। এবার বিরসা ঘোষণা করলেন, মুণ্ডারাই মুণ্ডা অঞ্চলের সমগ্র জমির একমাত্র মালিক, তারা ইংরেজ সরকারকে ভূমিকর দিতে প্রস্তুত, কিন্তু ডিকু অর্থাৎ জমিদারকে কোন খাজনা দেবে না, ডিকুদের কোনো অধিকার তারা স্বীকার করে না।
এ সময় চুতিয়া নামক স্থানে প্রাচীন হিন্দু মন্দিরকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের সহায়তায় জমিদার-মহাজনগণ বহুদিন থেকে চাষিদের উপর উৎপীড়ন চালিয়ে আসছিল। তারা তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এ খবর পেয়ে বিরসা অনুচরদের সঙ্গে পরামর্শ করে হিন্দু মন্দিরের ওপরেই প্রথম আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। চলবে……..