মুণ্ডা বিদ্রোহ
মানুষ হিসেবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে ছিলেন বিরসা
অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে বিরসা একদিন চুতিয়ায় মন্দিরের উপর আক্রমণ করেন এবং তা দখল করে সমস্ত দেবমূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন। মন্দির উদ্ধারে স্থায়ী জমিদার, মহাজন ও পুরোহিতগণ তখন সাহায্য চান ছোটনাগপুরের মহারাজের কাছে।
জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহের কথা। গভীর রাত্রে বিরসা মুণ্ডা তার অনুচরদের নিয়ে মন্দিরে সভা করছিলেন। ঠিক তখনই মহারাজের পাইক বরকন্দাজরা মন্দির আক্রমণ করে। এই আকস্মিক আক্রমণের ফলে বিরসার দল পরাজিত হয় এবং মন্দির ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এই ঘটনার পরপরই রাঁচি থেকে একদল সৈন্য ও পুলিশ এসে মুণ্ডা অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে ঘাঁটি বসায়। তারা ঘরে ঘরে হানা দিয়ে বিরসা ও তার অনুচরগণকে খুঁজতে থাকে। ফলে বিরসা মুণ্ডা প্রথমে আত্মগোপন করেন। অতঃপর গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি মুণ্ডা চাষীদের মধ্যে নতুন সংগ্রামের প্রচার চালাতে থাকেন।
একদিকে পুলিশ ও সৈন্যরা মুণ্ডাদের ভয় দেখিয়ে বিরসা মুণ্ডাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাতে থাকে। অপরদিকে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে একটি আইন পাস করে জমি ও বনভূমির উপর মুণ্ডাদের আদি অধিকার নামমাত্র স্বীকার করা নেওয়া হয়। কিন্তু তখনও জমিদারগণ ওই আইন মানতে সচেষ্ট ছিল না।
ওই বছরই লে. গভর্নর উডর্বান এসে মুণ্ডাদের প্রাচীন অধিকার রক্ষার ঘোষণা দেন। কিন্তু জমিদারগণ সে অনুযায়ী কোন ব্যবস্থা নেয় না। ফলে আদিবাসীদের আর্থিক দুর্দশা আরও শোচনীয় হয়ে উঠে।
অন্যদিকে একটি দুর্ভিক্ষের আঘাত কাটিয়ে উঠার আগেই মুণ্ডা অঞ্চলের উপর আরও একটি দুর্ভিক্ষের মেঘ ঘনিয়ে আসে। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কথা। ওই অঞ্চলে ওই বছর শীতের ফসল হয় না। ফলে কারও ঘরে এক মুঠো শস্যও উঠে না। সমগ্র মুণ্ডা অঞ্চলে তখন হাহাকার পড়ে যায়। সবকিছু জেনেও জমিদারগণ তাদের খাজনার এক পয়সাও মওকুফ করে না। তারা খাজনার দায়ে চাষীর সর্বস্ব কেড়ে নিতে থাকে।
মুণ্ডাদের এই দুর্দশা দেখে বিরসা স্থির থাকতে পারেন না। ইতিমধ্যে গ্রামাঞ্চল থেকে সৈন্য ও পুলিশ বাহিনী সরিয়ে নেওয়া হয়। বিরসা তখন প্রকাশ্যে মুণ্ডা অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে সবাইকে অভয় দিতে থাকলেন। তাঁর অনুরচগণও গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার করতে থাকে যেÑ মুণ্ডারাই জমির একমাত্র মালিক, কেউ যেন জমিদার ডিকুদের খাজনা না দেয়।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে শেষের তিন মাস বড় বড় সভা হয় মুণ্ডা অঞ্চলে। এইসব সভায় বিরসা স্বয়ং জ্বালাময়ী ভাষায় জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা এবং তাদের উপর জমিদার ও মহাজনগোষ্ঠীর উৎপীড়নের বিরুদ্ধে মুণ্ডাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। মুণ্ডারা বুঝে যায় অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করে ডিকু দস্যুদের তাড়াতে না পারলে তাদের বাঁচার কোন আশা নেই। তারা তাই বিরসার নেতৃত্বে বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
মুণ্ডা সর্দারগণের পরামর্শে বিদ্রোহের দিন ঠিক হয় ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের খ্রিস্টমাস পর্বের ঠিক আগের দিন। ওই দিন মুণ্ডাগণ তাদের তীর, ধনুক, বল্লম প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুণ্ডা অঞ্চলের রাজা, হাকিম, জমিদার, জাগীরদার, ঠিকাদার, ব্রাহ্মণ-পুরোহিত, খ্রিস্টান পাদ্রী প্রভৃতি সকল শোষক এবং উৎপীড়কদের আক্রমণ করবে, তাদের হত্যা করা হবে। বিরসা মুণ্ডা বললেন, এই সব শয়তানকে হত্যা করলেই এই দেশ হবে আমাদের। জমির মালিক হব আমরা।
খ্রিস্টমাস পর্বের কয়েকদিন আগেই বিরসার বিশ্বস্ত অনুচরগণের একেক জনকে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। খ্রিস্টমাসের আগের দিন তাদের নেতৃত্বেই তানা, কুটি, তামা, বাসিয়া, রাঁচি প্রভৃতি অঞ্চলে জমিদারদের কুঠি মন্দির, গীর্জা, খামার, থানা, আদালত প্রভৃতির উপর আক্রমণ শুরু হয়। ফলে বহু জমিদারী কর্মচারী, পুরোহিত, পাদ্রী ও চৌকিদার নিহত হয়। সমগ্র অঞ্চলে এই বিদ্রোহের ফলে খ্রিস্টানদের বড়দিনের উৎসব ও আনন্দ পণ্ড হয়ে যায়। জমিদার-মহাজন, পুরোহিত পাদ্রীরা তখন পালিয়ে রাঁচি শহরে আশ্রয় নেয়। এক সময় সামরিক ঘাঁটি রাঁচি শহরের উপরেও বিদ্রোহীদের আক্রমণের আশঙ্ক দেখা দেয়।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি। ৩০০ মুণ্ডা যুবক তীর-ধনুক, বল্লম, টাঙ্গি, খড়গ প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে খুন্তির থানার উপর আক্রমণ করে। ফলে থানার কনস্টেবলরা সবাই নিহত ও গুরুতর আহত হয়। বিদ্রোহীরা তখন থানায় আগুন ধরিয়ে দেয়।
এই সংবাদ পাওয়ামাত্র তৎকালীন পুলিশ কমিশনার ও ডেপুটি পুলিশ কমিশনার দারেন্দার সামরিক ঘাঁটি থেকে ১৫০ জন ইংরেজ সৈন্য ও ১০০ জন সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে বিদ্রোহ দমাতে খুন্তি ছুটে আসে। খবর পেয়ে খুন্তির নিকটবর্তী দুমারী পাহাড়, জানুমপিড়ি, ঘুটুহাটু, কুরপুর্তি প্রভৃতি অঞ্চল থেকে শত শত সশস্ত্র মুণ্ডা খুন্তির কাছেই জঙ্গল অঞ্চলে একত্রিত হয়। তারা আত্নরক্ষার জন্য গাছ ও বাঁশ কেটে বেড়া দেয় এবং বেড়ার পেছনে থেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়। এ সময় বিরসা মুণ্ডা নিজেই হন বিদ্রোহী বাহিনীর সেনাপতি।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ৯ জানুয়ারি। খুব সকালে পুলিশ কমিশনার সৈন্য ও সশস্ত্র পুলিশের বিশাল বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহীদের কাছাকাছি অবস্থান নেয়। তিনি বিদ্রোহীদের আত্নসমর্পণ করার আদেশ দেওয়া মাত্রই বিদ্রোহীরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে শত শত বিষাক্ত তীর সৈন্যবাহিনীর দিকে ছুড়তে থাকে। ফলে বহু সৈন্য ও পুলিশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
অতঃপর শুরু হয় সৈন্য ও পুলিশবাহিনীর রাইফেলের গুলিবর্ষণ। সমান তালে চলে মুণ্ডাদের তীরবৃষ্টিও। সৈন্যদের গুলির আঘাতে বহু মুণ্ডা যুবক নিহত ও আহত হয়। রাইফেলের সামনে তীর-ধনুক নিয়ে টিকে থাকা যায় না। তাই বিদ্রোহীরা বিরসা মুণ্ডার নির্দেশে বেড়ার পেছন থেকে সরে আশ্রয় নেয় নিকটবর্তী জঙ্গলে। পরে বেড়ার পেছনে পাওয়া যায় সাতজন মুণ্ডার মৃতদেহ। যার মধ্যে তিনজনই ছিল বীরবেশে থাকা মুণ্ডা যুবতী।
ইংরেজ সৈন্য ও সশস্ত্র পুলিশের সংখ্যা তখন ছিল তিনশজনের মতো। খবর পেয়ে বিভিন্ন ঘাঁটি থেকেও আসে আরও তিনশর মতো সৈন্য ও সশস্ত্র পুলিশ। এরা একত্রিত হয়ে বিদ্রোহীদের পেছন পেছন জঙ্গলে প্রবেশ করে। বিদ্রোহীরা তখন চারদিকে ছড়িয়ে যায়। তারা সমগ্র রাঁচি জেলা ও সিংভূম অঞ্চলে সশস্ত্র মুণ্ডাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে থাকে। যুদ্ধ চলে প্রায় দুই মাস। এদিকে বিভিন্ন স্থান থেকে সশস্ত্র পুলিশের দল এসে মুণ্ডা অঞ্চলে ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে। ফলে শত শত মুণ্ডা আদিবাসী মৃত্যুবরণ করে। এভাবেই ধীরে ধীরে বিদ্রোহের আগুন নিভে যেতে থাকে।
মুণ্ডা বিদ্রোহের নায়ক বিরসা মুণ্ডা ও তাঁর শতাধিক অনুচরকে এক সময় গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর শুরু হয় তাদের বিচারের পালা। কিন্তু তার পূর্বেই, ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ভাগে রাঁচি জেলে কলেরা রোগে আক্রান্ত হন ঐতিহাসিক মুণ্ডা বিদ্রোহের প্রধান নায়ক বিরসা ভগবান। অতঃপর মাত্র আঠাশ বৎসর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন পর মুণ্ডা বিদ্রোহে বিরসার অনুচরদের বিচার শেষ হয়। বিচারে দুইজনের ফাঁসি, বারোজনের দ্বীপান্তর এবং তিয়াত্তর জনের পাঁচ থেকে দশ বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়।
ইংরেজ সরকার এতোদিন মুণ্ডা আদিবাসীদের দাবিগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এই বিদ্রোহের ফলে তাদের টনক নড়ে। তারা মুণ্ডা অঞ্চলের সমস্ত জমি জরিপ করে এবং জমি ও বনভূমির ওপর আদিবাসীদের অধিকার আংশিকভাবে স্বীকার করে নেয়। তাছাড়া জমিদারের জমিতে আদিবাসীদের বল প্রয়োগ ও বেগার খাটানো রীতিও সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কেউ কেউ বিরসা মুণ্ডার ধর্মসংস্কার, রাজনৈতিক মত ও আন্দোলনকে ভিন্ন চোখে দেখেন। কিন্তু মুক্তমন্ত্রে দীক্ষিত এই মুণ্ডা যুবক মুণ্ডাদের বহুদিনের দুঃখ-দুর্দশার অবসানের জন্য, মুণ্ডা জাতির উপর হিন্দু-খ্রিস্টান পুরোহিত-সম্প্রদায় ও জমিদার-মহাজনদের অবর্ণনীয় শোষণ-উৎপীড়নের শেকড় উপরে ফেলতে এবং মুণ্ডা জাতির আদি মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে যেভাবে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, তা যেকোনো জাতির, যেকোনো মানুষের জন্য অনুকরণীয়। নিজ জাতির মুক্তিতে নিবেদিতপ্রাণ এই তরুণ মুণ্ডা নায়ক তাঁর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে নুতন চেতনার সঞ্চার করেছিলেন, মুণ্ডাদের মানুষ হিসেবে বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছিলেন। আর এ কারণেই বিরসা মুণ্ডাকে আজও মুণ্ডা জাতি ভগবান হিসেবেই স্মরণ করে।