বইয়ের কথা

রূপকথার আদলে তীক্ষ্ণ সমালোচনা

Looks like you've blocked notifications!

কৃষণ চন্দর, উর্দু এই সাহিত্যিক তাঁর প্রতিটি লেখায় মানুষের প্রতি শোষণ-নির্যাতন, অন্যায়, সমাজের অসংগতি, শ্রেণিবৈষম্য ইত্যাদি তুলে এনেছেন অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত ভঙ্গিমায়। এমনই একটি উপন্যাস ‘আমি গাধা বলছি’ পড়ছিলাম মোস্তফা হারুণের অনুবাদে।

এটা একটা শিক্ষিত গাধার আত্মজীবনী বলতে পারেন। এই গাধা ছোটবেলা থেকে বই আর পত্রিকা পড়ে শিক্ষিত হয়েছে এবং সে মানুষের ভাষায় কথাও বলতে পারে। লেখক এই শিক্ষিত গাধার নানা ঘটনা ও কথোপকথনের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজের অসংখ্য দিক আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন সুনিপুণ দক্ষতায়।

উপন্যাসটা বেশ হাস্যরসাত্মক। কিন্তু হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে ভাববার মতো অনেক কিছু। অনেকটা চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমার মতো। চ্যাপলিনের কর্মকাণ্ড দেখে আমরা হাসি, কিন্তু চ্যাপলিন আমাদের মনকে কাঁদিয়ে যায়, নাড়িয়ে যায়। এক জায়গায় চ্যাপলিনের উল্লেখও করেছেন লেখক।

শিক্ষিত গাধাটির জীবন দুর্গতিময়। গাধা তার জন্মস্থান বারাবাংকি ছেড়ে ডাংকি হয়ে দিল্লিতে আসে এবং ঘটনাক্রমে বোম্বেসহ আরো নানা জায়গাতেই তাকে যেতে হয়। প্রথমে সে এক ধোপার বাড়িতে কাজ করে। ধোপাকে কুমির খেয়ে ফেললে সে অসহায় ধোপার পরিবারের দায়িত্ব নেয়। ঘটনাক্রমে সে পণ্ডিত নেহরুর বাসভবনে যায় এবং তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার গাধার ভাগ্য খুলে দিল। পর্যায়ক্রমে সে এক শেঠজি, ডাক্তার রামঅবতার, তানসেনের মাজারে ডাণ্ডাবাজ শিষ্য, ঘিসু বেপারী, মাদক ব্যবসায়ী জোসেফ, রেসের বাজিকর রুস্তম শেঠ, ডাক্তার ও বৈজ্ঞানিক এইচ বি মাস্টার, শেঠ ভুসুরীমলসহ অনেকের পাল্লায় পড়ে বারবার প্রতারিত হয়।

গাধার জীবনের পরতে পরতে ঘটতে থাকা নানা ঘটনায় উঠে এসেছে মাজারের নামে ভণ্ডামি; চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী ও জুয়ারিদের নোংরা জীবনের প্রতিচ্ছবি; শিক্ষাদীক্ষা-প্রতিভা, সচ্চরিত্রের বদলে অর্থ আর বংশ গৌরবের অহমিকায় প্রেমের মূল্য নির্ধারণের মতো ক্ষুদ্রতা; জাত-পাত-ধর্ম দিয়ে করা বিচারের নামে অবিচার; ধনী-গরিব বৈষম্য; অর্থ ও যশের কাছে দাসত্বের দাসখতনামা; নিজের স্বকীয়তা, মেধা, নীতি-নৈতিকতা, চরিত্র অর্থের কাছে বিকিয়ে দিয়ে আয়েশি জীবনের প্রতি মোহ, গাধাকে ঘোড়া বানাবার গল্প, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নোংরামির চিত্রসহ আরো অনেক নষ্টামির গল্প।

উপন্যাসের একাংশে ঔপন্যাসিক লিখেছেন, ‘...ব্যবসা নীতির দ্বিতীয় ধারা হল, ভেজাল সংমিশ্রণের পরিমাণ এবং উপাদান। যেমন, আপনি যদি দুধে মধু মিশালেন, তাহলে হয়েছে আপনার ব্যবসা। একটা দামী জিনিসের সঙ্গে একটা দামী জিনিস মেশানো চলে না। দামী জিনিসের সঙ্গে কম দামী জিনিস মেশাতে হবে (যদি ক্ষতিকর হয় তাতেও ক্ষতি নেই)। আজকাল ব্যবসার সব রকম রহস্য এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পানির কিইবা দাম আছে। আমার মত গাধাও বিনে পয়সায় পানি পান করে থাকে। কিন্তু এ পানি যখন দুধে মেশানো হয়, চার গুণ দামে বিক্রি হয়। কাঠের ভুঁষির কিইবা দাম? অথচ আটার সঙ্গে মিশিয়ে দিলে দিব্যি চলে যায়, কারো খেতে অসুবিধা হয় না। ঘৃণা এবং বিসংবাদ এমনিতে কত নিচ কাজ, অথচ তাতে যদি ধর্মের সংমিশ্রণ করা যায়, তাহলে লাখো নিষ্পাপীদের প্রাণ তাতে বিলীন হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। ব্যবসা-নীতির এসব গুরুত্ব দুধের গোয়ালারা শুধু জানে না, ধর্মের ধ্বজাধারী থেকে আরম্ভ করে রাজনীতির জনহিতৈষীদেরও বিলক্ষণ জানা আছে।’

 চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’-এর মতো লেখক এক জায়গায় পুঁজিবাদের স্বরূপ বোঝাতে লিখেছেন, “তোমাকে নিয়ে নতুন গবেষণা হবে আমার, তোমাকে ভুখা রাখব এবার। ‘আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,

‘আমাকে ভুখা রাখবে কেন আবার?’

‘নূতন ইনজেকশন আবিষ্কার করব। ক্ষুধার ইনজেকশন।’

‘ক্ষুধার ইনজেকশন আবার কিসের? মাস্টার ক্ষুধার ইনজেকশন সম্পর্কে আমাকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝাল। তার মর্মার্থ হল,

বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার হাহাকার বড় বিপজ্জনক। এ বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধাকে নিবারণ করার জন্য লোকেদেরকে দু-দুবেলা খাবার সংস্থান করতে হয়। সাধ্যাতীত পয়সা খরচ করতে হয় তাতে। সুতরাং এমন একটা ইনজেকশন সে তৈরি করবে, যা দিলে নিমেষে মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্তি হয়ে যাবে। অবশ্য ক্ষুধাকে একেবারে সমূলে বিনাশ করা সম্ভব হবে না তাতে। এক ইনজেকশন দিলে আট-দশ দিন আর ক্ষুধা লাগবে না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, ইনজেকশন খাদ্যের কাজ দেবে। ইনজেকশন শুধু ক্ষুধাটা দাবিয়ে রাখবে। এ আট-দশ দিনে মানুষ অবশ্য দুর্বল হয়ে যাবে, কিন্তু ক্ষুধা লাগবে না। চিন্তা করে দেখ তো আমি যদি ইনজেকশন তৈরিতে সফলকাম হই, বিশেষ করে কারখানার মালিকদের কত উপকার হবে। কারখানায় হাজার হাজার মজুরকে শুধু একটি করে ইনজেকশন দিয়ে দশ দিন পর্যন্ত দিব্যি খাটিয়ে নিতে পারবে। তোমার রক্ত দিয়ে ক্ষুধার অ্যান্টিসিরাম তৈরি হবে আর তা সারা বিশ্বে পেটেন্ট হয়ে বিক্রি হবে, তখন আমার নাগাল আর পায় কে?”

রাজনীতি-সচেতন লেখক সূক্ষ্মভাবে নিয়ে এসেছেন ইংরেজদের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা, ও তাদের এদেশীয় চাটুকার গাধাদের কথা। উঠে এসেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের ফুসে ওঠার গল্প, আবার আন্দোলনের নামে ফায়দা লোটার গল্পও। আছে কুসংস্কারের প্রতি মানুষের অদম্য বিশ্বাসের গল্প আর আছে সেই কুসংস্কার ভেঙে পরিশ্রম করে উপার্জনের পথের গল্প।

উপন্যাসে গাধার মুখ দিয়ে লেখক বলিয়েছেন, ‘কি রকম আহাম্মক আর মূর্খ এ লোকগুলো। পয়সার জন্যে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। এদের কাছে ধর্ম, রাজনীতি, কৃষ্টি, সভ্যতা এবং মানব জাতির ভবিষ্যৎ চিন্তার কোনো মানেই নেই। অর্থের সীমিত গণ্ডির মধ্যেই এদের আনাগোনা। আত্মার ওপর অন্ধত্বের পট্টি বেঁধে বর্তমান, ভবিষ্যৎ আর অতীতকে ভুলে লোভী কুকুরের মতো অর্থের বেদিতে আত্মাহুতি দিচ্ছে।’

এমন অসাধারণ একটা উপন্যাস পড়ে মুহূর্তেই সমাজের নোংরামিগুলো ছুড়ে ফেলার ইচ্ছা জাগে, নিপীড়িত মানুষের জন্য মনটা কাঁদে। আমাদের সমাজে কৃষণ চন্দরের মতো লেখক দরকার, চ্যাপলিনের মতো চলচ্চিত্র নির্মাতা দরকার—যারা আমাদের সত্য-মিথ্যা আর ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদ বুঝিয়ে পথ চলার রাস্তা দেখিয়ে দেবে।

উপন্যাসটি সম্পর্কে কৃষণ চন্দর তার আত্মকথায় লিখেছেন, তাঁর প্রতি পণ্ডিত নেহরুর বিরক্তি ছিল আর গাধাকে নিয়ে লেখা এ বইয়ে গাধার সঙ্গে পণ্ডিতজির বিদ্রুপাত্মক কথার কারণে সেটা আরো বেড়ে যায়। মস্কো যাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন তিনি পাসপোর্ট পাচ্ছিলেন না। মেজাজ গরম করে ১১ দিনেই লিখে ফেললেন এই গাধার গল্পটা। বইটা যথারীতি পণ্ডিতজিকে দেওয়া হয়। ওই সময় দিল্লির রুশ দূতাবাসে অক্টোবর দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নেহরু উপস্থিত ছিলেন। কৃষণ চন্দরের স্ত্রী, লেখক সালমা সিদ্দিকীর ইচ্ছা, তিনি নেহরুর সঙ্গে কথা বলবেন। কৃষণ চন্দর না গিয়ে অরুণা আসফ আলীকে অনুরোধ করলেন তাঁর স্ত্রীকে নেহরুর কাছে নিয়ে যেতে। অরুণা দুজনকেই টেনে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন। নেহরু সালমা সিদ্দিকীকে জড়িয়ে ধরতেই সবাই ছবি তুলতে শুরু করল, কিন্তু কৃষণ চন্দরের দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না। অরুণা আসফ আলী বেকায়দায় পড়ে বললেন, ‘পণ্ডিতজি, ইনি কৃষণ চন্দর।’ পেছনে ফিরে পণ্ডিতজি কৃষণ চন্দরকে দেখে বললেন, ‘জানি, গাধাওয়ালা।’ তারপর অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। কৃষণ চন্দর বুঝতে পারলেন যে পণ্ডিতজি বইটা পড়েছেন। এটাই ছিল পণ্ডিতজির সঙ্গে কৃষণ চন্দরের শেষ দেখা।