মৃণাল সেন : ঘটতে থাকা ইতিহাসের অংশই ছিলেন
সদ্যপ্রয়াত বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন ফরিদপুরের সন্তান ছিলেন । জন্মেছিলেন ১৪ মে ১৯২৩ সালে। চলে গেলেন ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে ৯৫ বছর বয়সে। কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে পোস্টগ্র্যাজুয়েট করেছিলেন পদার্থবিদ্যায়। দেশভাগের আগেই কলকাতায় গিয়েছিলেন—দেশভাগের পর আর ফিরে আসেননি। ওখানে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বন্ধু হিসেবে পান ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, তাপস সেন, হৃষিকেশ মুখার্জি, বংশীচন্দ্র গুপ্ত প্রমুখের মতো গুণী মানুষের। চলচ্চিত্রের ভাষা ও নান্দনিকতার ওপর লিখিত বই পড়ে; ১৯৫২ সালে কলকাতায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র দেখে চলচ্চিত্র মাধ্যমের প্রতি তাঁর উৎসাহ তৈরি হয়। জীবিকার কারণে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি নিয়েও ছেড়ে দেন এই উৎসাহের কারণে।
কলকাতা ফিল্ম স্টুডিওতে অডিও টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগ দেন। সব ছেড়ে ১৯৫৫ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। ২০০২ সালে আশি বছর বয়সে নির্মাণ করেন সর্বশেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আমার ভুবন’। ২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্যৈর পাশাপাশি নির্মাণ করেছেন বেশকটি তথ্যচিত্র, দূরদর্শনচিত্র, দূরদর্শন ধারাবাহিক। অন্য পরিচালকদের জন্য রচনা করেছেন চারটি চিত্রনাটক। অনুবাদ করেছেন ক্যারল চ্যাপেকের ‘চীট’; চার্লস চ্যাপলিনের ওপর বাংলা ভাষায় প্রথম গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ছয়টি চলচ্চিত্রবিষয়ক মৌলিক গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর চলচ্চিত্র বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে; তিনি নিজেও বহু জাতীয় ও আন্তর্জাজিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাগ্মী, একরোখা-জেদী, বেনিয়মের কারবারি মৃণাল সেন বস্তুত চেতনার চৌকিদার। চলচ্চিত্রাঙ্গিকের মাধ্যমে তিনি বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির চেতনাকে পাহারা দিয়ে গেছেন, তাদের করণীয় সম্পর্কে সজাগ করে দিয়েছেন একের পর এক প্রতিবাদী-রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। ব্যষ্টি ও সমষ্টির জীবন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হলে তাদের জীবনে নেমে আসে সংকট, সেই সংকটকালীন মহূর্তেই তারা সবচেয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম—ঠিক এ রকমই একটি দার্শনিক মতবাদ তার প্রায় সব চলচ্চিত্রে ব্যক্ত করে গেছেন মৃণাল সেন। এ সূত্রে বলা যায় যে, তার মানস কিছুটা অস্তিত্ববাদ দ্বারা সজ্জিত ছিল।
পশ্চিমবাংলার চলচ্চিত্র স্রষ্টাদের মধ্যে এক নিশ্বাসে যে-তিনজন চলচ্চিত্রকারের নাম উচ্চারণ করা হয় তাঁদের মধ্যে মৃণাল সেন একজন। অন্য দুজন হলেন সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটক। মৃণাল সেন ভারতীয় প্যারালাল সিনেমার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি, অতর পরিচালক। গত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে শুরু করে নয়ের দশক এবং শূন্য দশকের পশ্চিমবাংলার উত্তর ঔপনিবেশিক সমাজকাঠামোর নানা সংকট থেকেই মৃণাল সেন তাঁর অধিকাংশ চলচ্চিত্রের বিষয় বেছে নিয়েছেন। বলা যায় ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর যেসব সংকট, তা ব্যক্তিক-পারিবারিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক—যাই হোক না কেন, সেসব সংকটই মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রগুচ্ছের কাহিনী তথা বিষয়মুখ নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাঁর চলচ্চিত্রসমুদয় প্রকৃত অর্থেই ঘটতে থাকা সমাজ-ইতিহাসের অংশবিশেষ। কিছু আবার সমকালীনতা থেকে বেশ দূরের বাস্তবতানির্ভর। যেমন ‘আকালের সন্ধানে’ (১৯৮০) বা ‘জেনেসিস’ (১৯৮৬)।
তবে সত্য এই যে, বাস্তবতা থেকে বিষয় বেছে নিলেও বাস্তবতার প্রবল বন্ধন ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা তাঁর চলচ্চিত্র-পরিসরে বিদ্যমান। এই ভাংচুরের কাজে তিনি পরাবাস্তববাদ ও জার্মান অভিব্যক্তিবাদী শিল্পদর্শনকে ব্যবহার করেছেন। বক্তব্যের কাঠামোকে শান দিয়েছেন মার্ক্সবাদ, অস্তিত্ববাদের সারাৎসার দিয়ে। এইসব দার্শনিক মতবাদ তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির বিন্যাসে জেঁকে বসেছিল। বস্তুত বাস্তবকে তিনি মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করেই চলচ্চিত্রের কাহিনী-কাঠামোতে স্থান করে দিতেন। বহুবিচিত্র বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। তাঁর চলচ্চিত্রে সমকালীন সমাজবাস্তবতায় স্থিত দারিদ্র্য, বেকারত্ব, রাজনীতির দীনতা, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তশ্রেণির সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, সমাজ-সংসারে নারীর অধস্তন অবস্থান, নারীর মনোলোক, ব্যষ্টির নৈঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নগরায়ণের অসম্পূর্ণতাজাত নানা সমস্যা, মানবসভ্যতার নানামুখী সংকট, শ্রমিক-কৃষক-আমলা-প্রান্তজন—সব তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয়-চরিত্র হয়ে এসেছে।
ওকা উরি কথা (১৯৭৭)
মধ্যবিত্তশ্রেণির মধ্যে লুক্কায়িত শ্রেণিশত্রুর চেহারাও উন্মোচিত হয়েছে তাঁর চলচ্চিত্রে। মৃণাল সেন মনে করতেন, মধ্যবিত্তশ্রেণিই রাজনৈতিক আন্দোলনের নিয়ন্ত্রক ও নেতৃত্বদানকারী। যদিও পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেখা যায় যে শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণিও গত চার দশকে বিরাট ভূমিকা রেখেছে, এখনো রেখে চলেছে।
এতসব বিষয়মণ্ডিত কাহিনী-কাঠামোর কারণেই মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের আঙ্গিক-শৈলী-ভাষা সতত নিরীক্ষাপ্রবণ। ভারতবর্ষের নানা আঞ্চলিক ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করার কারণেও তাঁর চলচ্চিত্রের আঙ্গিক বাঁক নিয়েছে বারবার। তাঁর চলচ্চিত্র নির্মিতির ধাঁচে ফরাসি নবতরঙ্গের প্রণেতা গদার, ত্রুফো প্রমুখের কাজের প্রভাব পড়েছে বলে অনুমিত হয়; ইতালীয় নব্যবাস্তববাদের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার কাছেও তিনি কিছুটা জিম্মি ছিলেন। চেখভ্-ব্রেখট্-চ্যাপলিনের গল্প-নাটক-চলচ্চিত্র উপস্থাপনের রীতির আছরের উপস্থিতিও টের পাওয়া যায় তাঁর কাজে। মৃণাল সেন তাঁর সমগ্র সৃষ্টিতেই সমষ্টির মঙ্গল চেয়েছেন। তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয়-কাহিনী ব্যষ্টিকে দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে তা সমাজস্থ সমষ্টির অন্যান্য প্রসঙ্গকেও জড়িয়ে ধরে। বস্তুত ব্যষ্টিসত্তার দ্বন্দ্বকে এক বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষিতে স্থাপন করেই সমাজসত্তার সার্বিক মুক্তির পথ ও উপায়ের সন্ধান মৃণাল সেন করে গেছেন তাঁর চলচ্চিত্র সমগ্রে। এই প্রবণতাই তাঁকে বাংলা চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক-প্রতিবাদী চলচ্চিত্রের প্রবক্তা হিসেবে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার খোরাক জুগিয়েছে।
প্রকৃত প্রস্তাবে উত্তর ঔপনিবেশিক সমাজবাস্তবতায় একজন মানবদরদী শিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তিনি নিজের অজান্তেই স্ব-সময় ও সমাজের কথক হয়ে উঠেছেন। সাধারণ কথক নন—জাঁদরেল কথক; এক ডাকসাইটে সমালোচক। তাঁর চলচ্চিত্রের শেষে কোনো একক সমাধানের শোলক পাওয়া যায় না। দর্শকের ওপর ছেড়ে দেন সমাধান খুঁজে নেওয়ার ভার। এক বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি দর্শককে যুক্ত করেন নির্মিত চলচ্চিত্রের সঙ্গে; দর্শক পরিণত হন চলচ্চিত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। এই প্রক্রিয়ায় দর্শক তাঁদের ভাবনাবলয়ের আদলে নানামূখী সমাধানের পিছে ছোটেন।
কয়েকটি পর্বে ভাগ করে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রযজ্ঞকে একদা মূল্যায়ন করেছিলেন সোমেশ্বর ভৌমিক। ভৌমিকের বিবেচনায় প্রথম পর্বে মৃণাল তাঁর চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা অন্বেষণ করেছেন এবং তা তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর নবম চলচ্চিত্র ‘ভুবন সোম’ (১৯৬৯)-এ এসে। যদিও তাঁর তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০)-এ তিনি সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের পর্যায়ভুক্ত হয়ে যান, ওই চলচ্চিত্রের বিষয় ও নির্মাণশৈলীর কারণে। দ্বিতীয় পর্বের শুরু রাজনৈতিক ও প্রতিবাদী চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে । এই পর্বে তিনি ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭০), ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২), ‘পদাতিক’ (১৯৭৩), ‘কোরাস’ (১৯৭৪) ইত্যাদি নির্মাণ করেন। প্রথমোক্ত তিনটিকে একত্রে ‘কলকাতাত্রয়ী’ বলা হয়–এগুলোতে নির্মাণকালীন সময়ে কলকাতাস্থ সমাজসংকটের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
কলকাতা নিজেই একটি চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তাঁর চলচ্চিত্রে। কলকাতার মানুষ, তাঁদের মূল্যবোধ, শ্রেণিবৈষম্য প্রভৃতি উপস্থাপিত-ব্যাখ্যাত হয়েছে মৃণাল সেনের নিজস্ব মনোভঙ্গির আলোকে। এই পর্বের চলচ্চিত্রে এক অভিনব উপস্থাপনারীতি লক্ষ করা যায়। তৃতীয় পর্বের চলচ্চিত্রে গল্প বলার ঢং প্রবল। চতুর্থ পর্বের চলচ্চিত্রে চরিত্রের অভিজ্ঞতার আলোকে গল্প বলেছেন এবং পঞ্চম পর্বের চলচ্চিত্রে দেখা যায় যে মৃণাল গল্পের মায়াবী বন্ধন ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন—এই পর্বের কাজে ফেবল্, ফ্যান্টাসি, প্যারাবল্, অ্যালিগরি প্রাধান্য পেয়েছে। ‘খণ্ডহর’ (১৯৮৩), ‘জেনেসিস’(১৯৮৬), ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯), ‘অন্তরীণ’(১৯৯৩) প্রভৃতির মধ্যে এ-সবের ব্যবহার লক্ষণীয়।
মৃণাল সেনের মানস ও চলচ্চিত্র নাগরিক ধ্যান-ধারণা দ্বারা পরিপুষ্ট। নাগরিক চিন্তা সামন্ততন্ত্রের বাইরের একটি চিন্তা-কাঠামো এবং ‘নাগরিক চিন্তারই নির্ণিমেষ প্রভাবই আমরা দেখব মৃণাল সেনের সৃষ্টিকর্মের ভিতরে।’ তাঁর বেশিরভাগ চলচ্চিত্রকর্মই নাগরিক জীবনের টানাপড়েনের ফসল। মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রে চিহ্ন-প্রতীকের উপস্থিতি প্রবল ও একই সঙ্গে প্রসঙ্গ ও অনুসঙ্গ ক্রিয়াশীল থাকে। তাঁর চিত্রপ্রকরণের সঙ্গে জীবনাভূতির সম্পর্কের ধরনটিও বিবেচ্য বিষয়। তাঁর চলচ্চিত্রকর্ম হতাশ প্রাত্যহিকতার মধ্যে ‘বাঁচার মন্ত্র’। নিরেট বাস্তব তাঁর চলচ্চিত্রের আধার হলেও ‘মৃণাল সেন বাস্তব বলতে তাঁর ছবিতে একাধিক জগৎকে বুঝেছেন।’ মধ্যবিত্তশ্রেণির মানুষেরা তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয় হলেও তিনি নিম্নবর্গীয় সর্বহারাদের চেতনালোককেও ধরতে চেয়েছেন। কারো বিবেচনায় মৃণাল সেন ‘সময়ের কণ্ঠস্বর’। সময়ের দাবি মেনে তিনি চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেছেন। মৃণালের কাজে ‘সমাজবাস্তবতার শর্তপূরণের দাবিটাই ছিল অগ্রগণ্য।’ মৃণাল সেন বাস্তবকে বিচার করেছেন তাঁর জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যে ভাবনা, তার নিরেখেই। সেই নিরেখেই তাঁর সৃষ্ট চলচ্চিত্রে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। চলচ্চিত্রের ‘বাস্তব’ বস্তুত নির্মিত বাস্তব। কখনোই সমাজবাস্তবতার টানা প্রতিরূপায়ণ নয়। সত্য ও বানানো বাস্তবের দোলাচলে নির্মিত হয়েছে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রবর্গ—‘অবাস্তবতার ইল্যুশন ভেঙ্গে তিনি বাস্তবতার ইল্যুশন তৈরি করতে চেয়েছেন।...বাস্তবকে আপন দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ঝাড়াই-বাছাই ও পরে তার পুনর্বিন্যাস ঘটিয়েছেন।’
‘একদিন আচানক’-এর সেটে মৃণাল সেন (১৯৮৯)
শুরুর দিকের ভারতীয় চলচ্চিত্র সাজানো বাস্তবতার গল্প বলেছে শুধু। সেই প্রমথেশ বড়ুয়ার যুগ থেকে সহনীয় বাস্তবতার চলচ্চিত্রই বানানো হয়েছে সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণালদের আগ পর্যন্ত—দুঃসহনীয় বাস্তবতার কথা বলা বা দেখানো হয়নি। এই বিবেচনা সম্পূর্ণ সত্য নয়, কারণ তাঁদের চলচ্চিত্রকর্মের আগেই তৈরি হয়েছিল ‘নয়া সংসার’ (১৯৪১), ‘উদয়ের পথে’ (১৯৪৪), ‘ধরতি কা লাল’ (১৯৪৬), ‘নীচানগর’ (১৯৫০), ‘তথাপি’ (১৯৫০) ও ‘ছিন্নমূল’ (১৯৫০)। এ-সব চলচ্চিত্রে দুঃসহনীয় বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছিল বৈকি। মৃণালের দায় শুধু সমাজের প্রতিই নয়, শিল্পের প্রতিও— তাই তিনি নিজস্ব শিল্পভাবনার আলোকে চলচ্চিত্রাঙ্গিকের সন্ধানে সর্বদাই নীরিক্ষামূখর। নান্দনিক সৌকর্যের প্রলেপ দিয়েই মৃণাল সেন সমাজসত্যের স্বরূপ প্রকাশ করেছেন তাঁর চলচ্চিত্রসমূহে। তিনি সর্বদাই কাহিনীর কৃত্রিম কাঠামো ভেঙে দেবার চেষ্টা করেছেন। বিষয়ের ভিন্নতার কারণে আঙ্গিকচেতনাও ক্রমশ বদলেছে তাঁর কাজে। তাঁর কাজে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তাঁর ‘সমাজমনস্ক সংবেদনশীলতা’। তিনি ‘ব্যক্তিসত্তার দ্বন্দ্বকে সর্বদা এক বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষিতে স্থাপন করেছেন।’
মৃণালের চলচ্চিত্রের আদল তাঁর সমসাময়িক কিংবা উত্তরসূরি নির্মাতাদের থেকে আলাদা। তাঁর কাজে কাহিনীর চেয়ে বক্তব্য ও চরিত্রের মনোজগৎ প্রাধান্য পেয়েছে বেশি—‘কাহিনীর প্রান্তিক ভূমিকার জন্যেই মৃণাল সেনের ছবিতে গুরুত্ব পায় বিশেষ বিশেষ মূহুর্ত।’ বস্তুত টুকরো টুকরো বাস্তবের দৃশ্য ও শব্দ জোগার করেই তিনি বক্তব্যকে প্রকাশ করেছেন। বক্তব্য প্রকাশের জন্যই বারবার আঙ্গিক বদল করেছেন এবং ‘আপাত আখ্যান-বর্জিত সংগঠনের মধ্যে মাঝেমধ্যে টুকরো টুকরো আখ্যানের সন্নিবেশ’ ঘটিয়েছেন।
শেষের দিকে এসে তিনি চেয়েছেন ‘তাঁর ছবিতে আসুক কবিতার স্পর্শ।’ এবং ‘সময়ের সঙ্গে তাল রেখে—ইম্পাল্সিভ হয়েও যে তিনি সময়কে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন, শিল্পী হিসেবে এখানেই মৃণাল সেনের সার্থকতা।’ প্রকৃতপ্রস্তাবে ‘সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা, সময়ের প্রতি বিশ্বস্ততা তাঁকে বাধ্য করেছে তাঁর শ্রেণির প্রতি নির্মোহ হতে।’ জ্বলন্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তব থেকে বিষয় বেছে নেওয়ার কারণে বারবার তাঁর চলচ্চিত্র-নির্মাণভঙ্গি ও প্রকরণের পরিবর্তন হয়েছে বলে।
মৃণাল সেন সময়ের তাড়া খেয়ে নিজেকে বদলে বদলে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে করতে এগিয়ে গেছেন। মৃণাল সেন প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্রকার। প্রথা ভেঙ্গেছেন। নিজেকেও ভেঙেছেন, আবার গড়েছেন নতুনভাবে। শত্রু বানিয়ে বানিয়ে এগিয়ে গেছেন সামনের দিকে। তাঁর নিজের ভাষায় ‘আপনাকে নতুনভাবে চিরকালীন প্রথার বিরুদ্ধে যেতে হবে। শত্রু বানাবেন অনেক। আমার জীবনেও শত্রু অনেক হয়েছে। যে লোকটার শত্রু নেই তার জন্য আমার কষ্ট হয়। শত্রু বানাতেই হবে। নিয়মকানুনের বাইরে যেতে হবে, বেনিয়মের কারবার করতে হবে।’
আশা করি, চলচ্চিত্র-মাধ্যমে উৎসাহী নতুন প্রজন্মের তরুণরা মৃণাল সেনের কথা থেকে শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যাবেন; তাঁর কথাগুলো নিজের কথা বানিয়ে নিবেন। তবে তা করতে হবে চলচ্চিত্রসৃষ্টি করতে করতে এগিয়ে যাওয়ার ভেতর দিয়ে। ‘নিউ মিডিয়া’র যুগেও চলচ্চিত্র যে একটি শিল্প ও প্রকাশমাধ্যম হিসেবে টিকে থাকবে এ-বিষয়ে মৃণাল সেন নিশ্চিত। তাঁর মতে ‘সিনেমার বিকল্প সিনেমাই’।
সবশেষে, মৃণালকান্তি সেন ওরফে মিনা, আপনার সৃষ্টি ও স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ আপনার শিরে ৯৫ বার কুমার নদের জল সিঞ্চন করছি, যে-নদের তীরে একদা আপনি জন্মেছিলেন।
[রচনাটি পূর্বে প্রকাশিত লেখা অবলম্বনে রচিত]