সাক্ষাৎকার

প্রেম নিয়ে প্রেমের কবি হেলাল হাফিজ

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : রফিকুর রহমান

১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন কবি হেলাল হাফিজ। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে এই সাক্ষাৎকার।

প্রশ্ন: শুরুতেই জানতে চাইব আপনার প্রথম প্রেম বিষয়ে-আপনার জীবনে প্রথম প্রেম কে?

হেলাল হাফিজ : প্রথম প্রেম বিষয়ে বলতে হলে বলতে হয়, সেটি ছিল অসামঞ্জস্য বা অসম বয়সী প্রেম। আবার অন্যদিক বিচারে হয়তো এটাকে প্রেম বলাও যায় না।

প্রশ্ন : প্রেম বললে দোষ কোথায়?

হেলাল হাফিজ : প্রেম বলতে চাই না এ জন্য যে, আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম সে ছিল আমার চেয়ে প্রায় ১০ থেকে ১১ বছরের বড়। সম্পর্কে সে আমার মামাতো বোন। আর তা ছাড়া, আমি তাকে আমার ভালোলাগার কথা কখনোই জানাতে পারিনি। কিন্তু এটা সত্যি, তাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। কৈশোরোত্তীর্ণ সময়ে আমি তার প্রেমে পড়েছি, এটা তাকে বলাও যায়নি। অথচ তার প্রতি আমার টান ছিল দুর্বার। একধরনের প্রেমানুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল আমার ভেতরে। তবে সেই প্রেমটি ছিল সম্পূর্ণ কামহীন প্রেম।

প্রশ্ন : তাহলে বলা যায়, প্রথম প্রেমেই ছ্যাকা!

হেলাল হাফিজ : তা বলতে পারো। হা! হা! হা!

প্রশ্ন : ফের আবার কবে প্রেমে পড়লেন?

হেলাল হাফিজ : আমি মনে করি প্রথম প্রেম কিংবা শেষ প্রেম বলে কিছু নেই। যখন কেউ প্রেমে পড়ে তখন তার কাছে সেটিই মুখ্য হয়ে ওঠে। তখন আগের প্রেমটি তার কাছে তেমন গুরুত্ব পায় না। তাই মানুষ নতুন নতুন প্রেমে পড়ে। আর তেমনি, কোন প্রেমটিকে আমরা শেষ প্রেম বলব? কারণ, যে কোনো সময় যে কেউ যে কারো প্রেমে পড়তে পারে।

প্রশ্ন : সেটা মানলাম। তবুও জানতে ইচ্ছে করছে, আপনার প্রথম প্রেম থেকে দ্বিতীয় প্রেমে পড়তে কতদিন সময় লেগেছিল?

হেলাল হাফিজ : আমি আবারও বলছি, আপনি যাকে আমার প্রথম প্রেম বলছেন, সেটি ছিল যৌবনে পদার্পণের ঠিক আগ মুহূর্তে। তাই তখনকার প্রেমটি ছিল সরল ও নিষ্পাপ। তাই, ওই প্রেমটি থেকে আর একটা প্রেমে পড়তে খানিক সময় তো লাগবেই! বলতে পারেন, একধরনের ভয় বা দ্বিধা আমাকে পেয়ে বসেছিল। তাই পরবর্তীকালে প্রেমে পড়তে গিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কখনো মনে হয়েছে এসব অকারণ ভাবনা। আবার কখনো মনে হয়েছে যা হওয়ার তাই হবে! যখন মাধ্যমিক পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম, তার পরেই আমি আবার প্রেমে পড়লাম। এবারের প্রেমটিকে সত্যিকারের প্রেম বলতে পারেন আপনি। এখানে সত্যিকারের প্রেম বলতে চাচ্ছি এই জন্য যে, যে মেয়েটিকে আমার ভালো লেগেছিল তাকে আমি আমার মনের কথা জানাতে পেরেছিলাম।

প্রশ্ন : আপনার ওই প্রেমটি কতদূর গড়িয়েছিল?

হেলাল হাফিজ : এ বিষয়ে বেশি কিছু বলব না। তবে এটুকু বলছি, আমার কোনো প্রেমই শেষ পরিণতি পায়নি। এটিও পায়নি।

প্রশ্ন : এবার আপনার কবিতায় আসা যাক। আপনার এখন পর্যন্ত প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থ যে জলে আগুন জ্বলে; মোট কবিতা সংখ্যা ৫৬। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি কবিতা তুমুল জনপ্রিয়তা বা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। আপনার কবিতায় প্রেম এসেছে এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। এ বিষয়ে কিছু বলুন...

হেলাল হাফিজ : নিজের কবিতার বিষয়ে নিজে কীভাবে বলি! তবে আমার যেটি মনে হয়েছে, কবিতার পাঠকরা আমার কবিতায় এমন কিছু পেয়েছে, যা তাদের প্রেমে পড়তে গিয়ে, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কিংবা প্রেমে মজে আমার কবিতার কাছে নিয়ে এসেছে। এমনও হয়েছে, লোকজন এসে আমাকে জানিয়েছে, আমার কবিতাটি সে তার প্রিয়তমাকে লিখে দিয়ে প্রেম নিবেদন করেছে। আবার কেউ কেউ এও বলেছে, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে আমার কবিতায় আশ্রয় নিয়েছে। তাই হয়তো বিভিন্ন শ্রেণির পাঠকরা তাদের নিজেদের মতো করে আমার কবিতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

প্রশ্ন : আপনার কবিতায় যে নারী চরিত্রগুলো এসেছে সে বিষয়ে কিছু বলুন....

হেলাল হাফিজ : এ বিষয়ে বিস্তারিত বলাটা সঙ্গত কারণেই নিরাপদ নয় বলে আমি মনে করি। কেননা, আমার কবিতা আমার জীবনের বাইরে তো কিছু নয়! যেসব নারী আমার জীবনে নানাভাবে রেখাপাত এঁকে গিয়েছে, সেসব নারীই নানা আঙ্গিকে আমার কবিতায় স্থান করে নিয়েছে। তাদের কেউ কেউ এখনো বিদ্যমান। তাই তাদের কথা বলে তাদের অস্বস্তিতে ফেলতে চাই না। তাদের কথা বলাটা আমার জন্যও যেমন সমীচীন হবে না, তেমনি তাদের জন্যও সুখকর হবে না। যেটি আড়ালে আছে, সেটি আড়ালেই থাকুক।

প্রশ্ন : আপনার প্রেমের কবিতায় প্রেয়সী বা প্রেমাস্পদের প্রতি একধরনের জেদ এবং পাশাপাশি নির্ভরশীলতা বা আশ্রয়ও লক্ষ করা যায়। কবিতায় এই বিষয়গুলো কি ব্যক্তিগত প্রেমের অভিজ্ঞতার কারণেই?

হেলাল হাফিজ : দেখো, প্রেয়সীর প্রতি একটা কোমল ও অনুরাগের জেদ হয়তো প্রত্যেক প্রেমিকমাত্রই পোষণ করেন। অন্যদিকে প্রেমের কাছে বা প্রেমিকার মাঝে একটা আশ্রয় তো আশা করাই যায়!

প্রশ্ন : নিশ্চয়। আপনার কবিতায় ওই বিষয়গুলো নিয়েই শুনতে চাচ্ছিলাম।

হেলাল হাফিজ : আমার কবিতায় এগুলো হয়তো এসেছে। তবে মূল কথা হচ্ছে, কবিতা সম্পর্কে বলা একটু কঠিন। কবিতা লেখা হয় বিশেষ মুহূর্তে। আবার কখনো মনে হয় কবিতা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে বলেই আমি লিখতে পেরেছি। তবে ব্যক্তিজীবনের বাইরে গিয়ে কোনো লেখাই আমি লিখিনি। আমার সময়, দেশ, দেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রেয়সী-সবাই কোনো না কোনোভাবে আমার লেখায় জায়গা করে নিয়েছে।

প্রশ্ন : আপনার ‘ফেরীঅলা’ শীর্ষক কবিতায় আপনি কষ্ট ফেরি করার কথা বলেছেন। এই কবিতাটি সম্ভবত আমাদের দেশে বহুল প্রচারিত কবিতা, আবৃত্তির ক্যাসেটেও অনেক বাজানো কবিতার মধ্যে এটি একটি। আপনি নিজেকে কষ্টের ‘ফেরীঅলা’ হিসেবে কবে থেকে ভাবা শুরু করলেন?

হেলাল হাফিজ : তোমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে খানিক বলে নিচ্ছি- আমি তো গত প্রায় ২৫ বছরেরও বেরি সময় একধরনের স্বেচ্ছানির্বাসনের মতো ছিলাম। তখন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মানুষের কাছে এই কবিতাটির কথা শুনেছি। বিভিন্ন জায়গায় মাইকে বা অডিও প্লেয়ারে আবৃত্তি শুনেছি। তখন আমার মনে হয়েছে, লোকজন যেভাবে এ কবিতাটি তাদের ভেতর থেকে উচ্চারণ করে চলেছে, তাতে করে আমার মনে হয়েছে প্রত্যেকেই যেন একেকজন কষ্টের ‘ফেরীঅলা’! এই যে, আমার একক কষ্টানুভূতিটুকু সবার কাছে পৌঁছে যাওয়া এটাই প্রাপ্তি। আর আপনার কথার জবাবে বলছি, আসলে শৈশব থেকেই আমি ভেতরে ভেতরে দুঃখী মানুষ। আমার আম্মার মৃত্যু হয়েছে আমার তিন বছর বয়সে। যেহেতু তখনকার কোনো স্মৃতি ছাড়াই আমি বেড়ে উঠেছি, তাই আসলে তখন থেকেই একটা দুঃখানুভূতি আমার ভেতরে ছিল। আর কবিতায় সেটিই নানা মাত্রায় হাজির হয়েছে।