বইয়ের কথা

শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার কথা বলে কামুর ‘প্লেগ’

Looks like you've blocked notifications!

প্লেগ ভয়ংকর এক রোগ। আর এই রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লে গ্রামকে গ্রাম, শহর উজাড় করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। প্লেগ আক্রান্ত একটি শহরে অবরুদ্ধ মানুষদের দুঃসহ সময়কে উপজীব্য করে লেখা আলবেয়ার কামুর একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি প্লেগ’। কাজী মুজাম্মিল হকের অনুবাদে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হয়েছে বইটি।

ফরাসি উপনিবেশ আলজেরিয়ার একটি শহর ওরাও। খুবই সাদামাটা-নিস্তরঙ্গ এই শহর আর শহরের মানুষগুলো। লেখক খুব দারুণভাবে শহরের একটা চিত্র উপস্থাপন করেছেন। এখানে মানুষ শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য ছুটতে থাকে, স্থূল তাদের চিন্তার জগৎ। ঋতুবৈচিত্র্য বোঝা যায় বাজারে নতুন ফলমূল দেখে। এমন একটা একঘেয়ে শহরে ধীরে ধীরে ইঁদুর মরার হার বাড়তে থাকল। রাস্তাঘাটে, অফিসে, বাসায়—সবখানে মরা ইঁদুরের উৎপাতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। তারপর একদিন মরা ইঁদুর আর দেখা গেল না। কিন্তু প্রতিদিনই অজানা এক রোগে মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকল। শুরুতে কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটাকে চেপে রাখার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পরে প্রকাশ করতে বাধ্য হয় যে শহরে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে, প্রতিরোধের সময় নেই আর।

প্লেগের সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে লাগল শহরের মানুষের জীবনযাত্রা। শহরের সব গেট বন্ধ করে দিল কর্তৃপক্ষ। কেউ এ শহরের বাইরে যেতে পারবে না, বাইরে থেকে কেউ আসতেও পারবে না। নিজ গৃহে, নিজের শহরে থেকেও এমন ভয়াবহ বন্দি জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে লাগল যেন মানুষের। যাদের কাছের মানুষরা ভিন্ন শহরে ছিলেন, তাদের জন্য প্রাণ কেঁদে উঠতে থাকল শহরবন্দি মানুষদের। একটা বদ্ধ শহরে যেন মৃত্যুর জন্য রাতদিন বসে থাকা। অপরাধী না হয়েও এই সাজা ভোগের ফলে এই শহরের মানুষ অস্থির সময় কাটাতে লাগল। মৃতরা মুক্তি পাচ্ছে, কিন্তু জীবিতদের অবস্থাটা অসম্ভব কষ্টের। এই বদলে যেতে থাকা শহর আর মানুষের সংকট উঠে এসেছে উপন্যাসের পরতে পরতে। একসময় প্লেগ চলে যায়। অনেক অপ্রত্যাশিত কষ্ট আর দুঃসহ স্মৃতি রেখে গেলেও শহরের মানুষ প্লেগের তিরোধানে উল্লাসে মেতে ওঠে। নতুন করে জীবন সাজাতে শুরু করে।

প্লেগ উপদ্রুত কঠিন এক পরিস্থিতিতেও কিছু মানুষ সংগ্রাম করে গেছেন মানুষের জন্য। এমনই একটি চরিত্র ডাক্তার রিও। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মানুষের জীবন বাঁচাতে। আরেক শহরে নিজের অসুস্থ স্ত্রী’র চিন্তাকে তুচ্ছজ্ঞান করে তিনি উদয়াস্ত লড়াই করে যাচ্ছেন প্লেগের বিরুদ্ধে। একসময় তার স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদও আসে। কিন্তু এত মৃত্যুর কাছে ফিকে মনে হয় তার। এতো মানুষের জীবন রক্ষার দায়িত্ব যে নিয়েছে, তাকে তো শোক চাপা দিয়ে হলেও যুদ্ধে যেতে হবে। ডাক্তার রিও যেন প্লেগ-বিধ্বস্ত শহরে একজন মহামানব। আর এই অনন্যসাধারণ চরিত্রের ডাক্তারটির সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হয় আরও কিছু চরিত্র---গ্রাদ, তারিউ, ফাদার প্যানালু ও র‌্যাঁবেয়ার। তারা ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে প্লেগের বিরুদ্ধে লড়তে থাকে।

অন্য শহর থেকে আসা তারিউ একজন পর্যবেক্ষক, যে শহরের সবকিছুর বিবরণ লিখে রাখে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া মানুষকে উদ্ধার করতে চাওয়া তারিউ প্লেগের বিরুদ্ধে ডাক্তার রিওর সঙ্গে কাজ করতে করতে একসময় নিজেই সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তারিউ তার জীবনের শেষ অবধি বাঁচার জন্য বীরের মতো প্লেগের সঙ্গে যুদ্ধ করে গেছেন।

শহরের প্রধান গির্জার পুরোহিত ফাদার প্যানালু প্লেগকে ঘিরে তার ধর্মীয় চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে থাকেন, আর এর ফলে শীতল যুদ্ধে জড়ান ডাক্তার রিওর সঙ্গে। ফাদারের মতে, প্লেগ ঈশ্বরের অভিশাপ। বিজ্ঞান আর ধর্মের এই দ্বন্দ্ব পড়তে থাকা পাঠক চিকিৎসা নিতে অস্বীকৃতি জানানো ফাদার প্যানালুর প্লেগের কবলে পড়ে নীরব প্রস্থান দেখবেন একসময়।

ভীন্ন শহর থেকে আসা সাংবাদিক র‌্যাঁবেয়ার একটু অন্যরকম চরিত্র। দুর্বিপাকে পরে সে ভিন্ন দেশে বন্দি জীবন কাটাচ্ছে আর পালানোর উপায় খুঁজছে যেন সে নিজের প্রেমিকার সঙ্গে মিলিত হতে পারে। ব্যক্তিস্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখা র‌্যাঁবেয়ার একসময় পালানোর ব্যবস্থা করেও ফেলে, কিন্তু তার মন বদলে যায়। সে পালিয়ে না গিয়ে প্লেগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ডাক্তার রিওর সঙ্গে।

গ্রাদ খুব সাধারণ একজন মানুষ। কর্মজীবনের ফাঁকে যে একটা উপন্যাস লেখার জন্য দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছে, সেও প্লেগের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামে ডাক্তার রিওর সঙ্গে। আর পাঠকের কাছে গ্রাদ তখন আর সাধারণ থাকে না।

অনেকে এই উপন্যাসে প্লেগকে একটা প্রতীক হিসেবে দেখেছেন, দেখার মতো যথেষ্ট কারণ পাঠক খুঁজেও পাবেন। উপন্যাসটি কামু প্রকাশ করেছিলেন ১৯৪৭ সালে। প্লেগ নাৎসি বাহিনীর প্রতীক হতে পারে বলে তাই অনেকের বিশ্বাস। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি দেশে জার্মান আগ্রাসন ঔপন্যাসিককে আলোড়িত করেছিল। আবার কামুর অস্তিত্ববাদী দর্শনে বিশ্বাস এই উপন্যাসকে আরেক দার্শনিক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। একটা শহরের সমস্ত মানুষের সামগ্রিক হতাশার এমন নিখুঁত চিত্র কামু তুলে এনেছেন যে নাড়া দিয়ে যাবে পাঠককে।

কামুর উদ্ভাবিত অ্যাবসার্ডিটি বা অনিঃশেষ আশাবাদ এই উপন্যাসের একটি বৈশিষ্ট্য। অ্যাবসার্ডিটি সম্পর্কে কামু বলেছেন, ‘মানুষের সঙ্গে তার জীবনের আর জীবনের সঙ্গে তার পরিপার্শ্বের বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিই অ্যাবসার্ডিটি। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-ভালোবাসা, চেষ্টা-চরিত্র এবং অর্থহীন পৃথিবী—যে অর্থহীনতার মধ্যে তাকে ঠেলে দেওয়া হয়—এ দুয়ের ব্যবধান থেকেই অ্যাবসার্ডিটি জন্ম নেয়।’ প্লেগ উপন্যাসে প্লেগ রোগটিই হয়তো অ্যাবসার্ডিটির জীবাণু বহন করছে। হয়তো অনিঃশেষ আশাবাদের লালন করে চলছেন ডাক্তার রিও।

উপন্যাসের শেষের দিকে বলা এই কথাগুলোর দার্শনিক গভীরতা বোঝার জন্য পাঠককে অনুরোধ করছি, “দূর শহর থেকে ভেসে আসা তুমুল হর্ষধ্বনি শুনতে শুনতে রিও-র মনে হল, মানুষের এই উল্লাস হয়তো আবার একদিন বিপন্ন হবে, কারণ প্লেগের জীবাণু কখনোই পুরোপুরি ধ্বংস হয় না, হারিয়েও যায় না চিরতরে। বছরের-পর-বছর এই জীবাণু লুকিয়ে থাকে আসবাবপত্র আর কাপড়চোপড়ের মধ্যে, অপেক্ষা করে শোবার ঘরে, ভাঁড়ারে, বুকশেলফে। তারপর সেই দিনটি আসে যেদিন এই জীবাণু মানুষের সর্বনাশের জন্য আবার ইঁদুরগুলোকে জাগিয়ে উত্তেজিত করে মরবার জন্য, এবং ঝাঁকে ঝাঁকে ওদেরকে পাঠিয়ে দেয় আনন্দমুখর কোনো শহরে।”