উপন্যাস (কিস্তি ৮)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন

Looks like you've blocked notifications!

‘কেমনে শুনিলো কন্যা নিজঝুম জলের ডাক!’

মায়ে ছন্দে-বন্ধে চুকা রাঁধতে থাকে পুরাটা দুপুর। তবে তার নজর কেবল চুলার জ্বাল কি সালুনের দিকেই আটকা দিয়ে থাকে না। মেয়ে তার একলা খেলাখেলি করে উঠানে। হোক নিজের বাড়ি, কিন্তু পোলাপাইন মানুষ। তার মতি কোনদিক থেকে কোনদিকে যাবে- কে বলতে পারে! সেই জন্য মায়ে কাজকাম করে, আর ক্ষণে ক্ষণে নজর দেয় উঠানের দিকে। চুলার বাম পাশেই রান্ধনঘরের একদিকের বেড়া। বেড়ার গায়ে জালি কাটা এট্টুখানি জানালা। চুলার পাতা-লাকড়ির জ্বাল ছাইদাড়া দিয়া নাড়াচাড়া দিতে দিতে মায়ে যখন তখন দেখে নিতে পারে, মেয়ে তার কী করে। সেয় খেলে, না, কোনোদিগে যাওয়ার জন্য পাও বাড়াইতাছে চুপেচাপে!

সেদিনকার রান্ধারান্ধি তখন প্রায় শেষ। চুলায় খালি চাপিলা মাছের চুকা তরকারিটা। সেইটা নামতে আর কতোক্ষণ! মেয়ে এখন তার গোসল করে আসলেই হয়। তাইলে গরম গরম ভাত তরকারিটা মেয়ের পাতে দিতে পারে মায়ে। ঠাণ্ডা হলে এই তেঁতুল-চাপিলার চুকা কি আর তেমন মজা লাগে, গরমটা যেমন?

‘ও জুলি, গুছুল কইরা আয়’ – মা হাঁক দেয়।

জুলেখা এক্কা-দোক্কা খেলার নড়ানড়ি বন্ধ করে আসমানের দিকে চায়। মাগ্গো মা! রইদ কি গমগমাইতাছে! এমুন সোমে পানিত ডুবাইতে কি আরামের আরাম যে লাগব! এই কথা পলকে মনে আসে জুলেখার। আবার সঙ্গে সঙ্গে এও মনে আসে যে, তাগো পুষ্কুনির পানি আর পানি নাই এই চৈত মাইস্যা দিনে। ডুব দেওয়ার মতন পানিও আর এই সময়ে নাই তাদের পুকুরে। ডুব দিয়া গোসল করার দিন বহুত দিন আগেই ফুরাইছে। এখন কেবল কয় লোটা পানি আলগোছে তুলে শরীরে ঢালা।

তবে, পুষ্কুনি ভরা যখন থই থই পানি; তখনো কি জুলেখায় একলা পানিতে নেমে ডুব-গোসল করতে পারে!  মায়ে সঙ্গে থাকলে এট্টু সময়ের জন্য পারে। নাইলে না। তার মায়ের  কড়া নিষেধ দেওয়া আছে। একলা পুকুরে কোনোদিনও তুমি নামতে যাইবা না মাইয়া! খবরদার কইলাম! তোমার আশপাশে থাকবো না একখান জনমনিষ্যি, ওদিগে মায়ে থাকব নে চুলার পাড়ে। তোমার ভালাবুরার খেয়াল রাখব কে? কে না জানে যে, খোদার দুনিয়ায় বান-বাতাসের কোনো অভাব নাই। একলা পাইয়া মাইয়ারে চুবাইয়া মাইরা থুইয়া গেলে মায়ে খোঁজও পাইব না!

মায়ের সামনে মায়ের কথার অবাধ্যতা দেখানোর সাহস জীবনেও পাবে না জুলেখায়। যা করার সে মায়ের অগোচরে করে। যত ইচ্ছা তত ডুবায়। ডুব সাঁতার, ওপর সাঁতার- যা খুশি দেয়। দেয় পরান ভইরা। কিন্তু মায়ের সামনে লক্ষ্মীর মতোন -পানি তোলার লোটাখান হাতে নিয়া যায় সে রোজ, পুকুর-ঘাটে। সেদিনও গোসলের হুকুম পেয়ে সে ধুছমুছ লোটা হাতে নেয়, গামছাখান কান্ধে নিতেও ভোলে না। পেছন থেকে মায়ে ডাকে, ‘দ্যাখ কি বেবুঝ মাইয়া। মাথার বেণি মাথায় রইছে, সে যাইতাছে গোছল করতে। আয়, আগে বেণি খুইল্লা দেই।’

মাথা-ভর্তি মেয়ের য্যান চুল না! বাইরা মাইস্যা ঢল! কোমর ছুঁই ছুঁই চুল ভিজলে শুকান দায়! সেই চুল সারা দুপুর মায়ে নাড়ে চাড়ে শুকায়। তারপর বিকালভরে নানা ছন্দে বেণি বান্ধে। কোনোদিন কলা বেণি, কোনোদিন বেড়া বেণি, কোনো দিন নকশী-পাটি। আজকে মেয়ের চুলে আছে বেড়া বেণি। সেই বেণি মায়ে হুড়াহুড়ি করে কোনো মতে খুলে দেয়। চুলায় না চুকা বসানো! সেইটা না আবার পোড়ে! এই ভাবনায় মায়ে চুলার দিকে ছোটে দ্রুত পায়ে। তারপর তরকারি নাড়ানাড়িতে মন দিতে হয় বলে, মায়ের আর খেয়াল করার ফাঁকটা থাকে না যে, মেয়ে তার লোটা গামছাখানা ঠিকমতো সঙ্গে নিল কি না!

নিজেদের পুষ্কুনিখান বাড়ির পশ্চিমে। সেটা নামেই পুষ্কুনি, আসলে এত্তোটুক একটু ডোবা। চৈত মাসে তার পানি শুকাইতে শুকাইতে একদম তলায়। বাবায় ঘাটলা নামাতে নামাতে একেবারে পেরেশান। এমন চলবে জষ্টি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তারপর আঁতকা একদিন পানি জাগনা দেওয়া শুরু করবে। ধীরে-সুস্থিরে ফোলা দিতে থাকবে। শেষে আচমকা একদিন ধুছমুছ বেড়ে গিয়ে সেই পানি পুষ্কুনিরে করে দেবে ভর-ভরন্ত, ছলবলা। এখনকার ঘোলা ঘোলা, প্যাঁক মেশা পানি তখন হয়ে উঠবে ঝকঝকা কালো, টলটলা শীতল। তবে সেইদিন আসতে এখনো অনেক দিন বাকি।

ঘাটলার তক্তায় খাড়া দিয়ে মেয়ের মন  অভক্তিতে খাবিজাবি খেতে থাকে। চক্ষের সামনে এই যে  প্যাঁক-গোলা, ঘোলা, তপ্ত জিনিস- এরে নি শইল্লে দিতে মন সরে! মন লড়ে না।

নিজেদের পুষ্কুনির উঁচা পাড়ের পরে, অই যে মস্ত ক্ষেত। ঠাকুরবাড়ির ক্ষেত। বহুকাল তাতে আবাদ নাই, বহুকাল এই ক্ষেত পতিত পড়ে থাকা। এখন ক্ষেত বোঝাই কেবল জংলা খেজুর গাছ, আকন্দ ঝোপ আর শিয়ালকাঁটার ঝাড়। অই সকল ঝোপঝাড়ের ফাঁকফোঁকড় দিয়াই গেছে সরু, পায়ে হাঁটার রাস্তাখানা। গেছে ঠাকুরবাড়ির দিকে। এই রাস্তা দিয়েই পাড়ার সকল মাতারি ঝাঁক বেঁধে সকালের কালে যায় খাওয়ার পানি আনতে, নিত্যি। আর প্রায় প্রায় বহুজনে মিলে যায় ঠাকুরবাড়ির পুকুরে গোসল সারতে।

ঘাটলার তক্তায় খাড়া দিয়া থাকা জুলেখার চোখ আঁতকা যায় জংলা খেজুর গাছের দিকে। আর কী আচানকের কথা! খেজুর গাছ দেখতে দেখতে কি না তার চোখের সামনে ঝাপট দিয়া ওঠে ঠাকুরবাড়ির উত্তরের পুকুরখানা! ঠাণ্ডা শীতল ধীর গম্ভীর পানি- নজরের সামনে- ঢেউ খেলাইতে থাকে, ঢেউ খেলাইতে থাকে। আহারে! কি বাহারের সেই পানি! কত ঠাণ্ডার ঠাণ্ডা! খালি একবার  একটা ডুবও যদি দেওয়া যায় সেই পানিতে, পুরা দিনের জন্য শরীর শীতল হয়ে যায়।

মায়েরে গোপন করে জুলেখায় প্রায় প্রায়ই যায় তো সেই পুষ্কুনিতে। যায় একা একা। গোসল করে। ঝাপ্পুর-ঝুপ্পুর ডুবায়, ঝুম-ঝাম সাঁতরায়। নিত্যি নিত্যি পারে না, তবে বেশির ভাগ দিনই যায়। এক ছুটে ক্ষেত পার হয়, পলকা পায়ে হুমধুম ঘাটলার সিঁড়ি বায়, পানিতে নামে।

আহারে পানি কি তিরতিরা শীতল! কইলজা ইস্তক ঠাণ্ডা কইরা দেয়! তয়, পানিতে তো আর বেশিক্ষণ থাকার উপায়টা নাই জুলেখার। সে পানিতে নেমে ঝপাঝপ ডুব দেয়। কয় ঝটকা হাত-পাও ছোঁড়ে, তারপর য্যান উড়াল দিয়া ফিরা আসে নিজেগো বাড়ির ঘাটলায়। মায় একদিনও তো ধরতে পারে নাই জুলেখায় গোসলটা করতাছে কই! আর এই যে সে একলা একলা এতবার গেল-আইল- অই ছাড়া-বাড়ির ঘাটলায়, একদিনও তো ডরের কিছু হইতে দেখল না সে! মাইনষে তবে ডরায় ক্যান! ডরের কী আছে! ডরের তো কিচ্ছু নাই।

আজকা যুদি যায় সে, মায়ে বুঝব? ধইর ফালাইব? না মোনে হয়! কবে পারছে? একদিনও না। আজকাও মায়ে ধরতেই পারব না তার গোসলের আসল বিষয়খান। যাইব সে আজকাও ঠাকুরবাড়ির পুষ্কুনিতে ডুব দিতে? নাকি যাইব না আজকা সেয়! নিজেদের ঘাটলায় খাড়া দিয়ে জুলেখা এই নিয়া কতক্ষণ দোনোমোনো করে। শেষে তার মনে হতে থাকে যে; এই তপ্ত, প্যাঁকের মতন পানি সে কোনোমতেই শইল্লে দিতে পারব না। পারব না-ই।

বরং একদৌড়ে যাওয়াই যাক! আজকা নাইলে ডুব দিতে না নামল। খালি কয় লোটা মাত্র পয়-পরিষ্কার পানি ঢালবে সে মাথায়, ছপর ছপ। তারপর দিব সেয় এক দৌড়। নিজেগো ঘাটলায় আইতে আর কতখোন!

অমন যদি করা যায়, তাইলেই তো আর আজকা দেরী হবে না তার। মায়ে খোঁজ করার আগেই সে এসে হাজির হয়ে যাবে নিজেগো ঘাটলায়। যাইবই সে। জুলেখা পড়িমরি পায়ে ধুম ছুট দেয় ঠাকুরবাড়ির পুষ্কুনির দিকে। ঝোপ-ঝাড়ের সরু রাস্তাখান দিয়া মাইয়া এমন ছুট দেয়,য্যান উতলা পঙ্খী!  

এদিকে, মায়ে রান্না শেষ করে চুলায় পানির ছিটা দেয়, রান্ধন ঘরের ঝাট-পাট সারে, হাবিজাবি কোটাকুটি, সরা-পাতিলা ধোওয়া পানি– ছিটালে নিয়া ফালায়। হাত পয়-পরিষ্কার করে। তারপর পিঁড়ি পেতে মেয়ের খাওয়ার জায়গা করে। কাঁসার গেলাসে পানি ভরে। দুইটা লেবুপাতা ছিঁড়ে দেয় গেলাসের পানিতে। তাতে পানি খালি খাইতেই সোয়াদ লাগবো না, গন্ধেও মাইয়ার মনটা ফুরফুরা থাকব। কাঁসার থালখানের এক কিনারে নুন দেয়। এই করে সেই করে, আর বেড়ার জালি-জানালা দিয়া ক্ষণে ক্ষণে চায়। আসল নি মাইয়ায় উঠানে? গোসল শেষ হইলো তার!

না, আসে নাই। মায়ে আবার গিমা শাকের কড়াইটা চুলায় তোলে। কাঠের হাতাখানা দিয়া থ্যাতা হওয়া শাকেরে আরো থ্যাতা-ন্যাতা করে।  আধা নিভানো আগুনের আসল আবস্থাটা পরখ করে। যেইটুক ভাঁপ উঠছে আধা-নিভানো ছাই থেকে, তাতে কড়াইয়ের শাক সুন্দর গরম থাকবে, কিন্তু পুড়বে না। জুলির অমন গরমটাই খাইতে চায়!

‘আইলো মাইয়ায়?’ মায়ের চোখ দেখে যে, এখনো মেয়ে গোসল শেষ করে ফিরে নাই! ‘আরে! নিত্যির গোছলখান করতে কতখোন লাগে একটা মাইনষের!’ মায়ের এট্টু বিরক্তি লাগতে থাকে; ‘আজকা য্যান একটু বেশি করতাছে জুলিয়ে! এমুন ঢিলা হইলে পরের ঘর কেমনে করবো, এই মাইয়ায়!’

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)​
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)