অমৃতা শের-গিল : একটি মোহনার নাম

Looks like you've blocked notifications!

চিত্র ১ : আলোকচিত্রে শিল্পী অমৃতা শের-গিল

 

শিল্পী অমৃতা শের-গিল ( ৩০ জানুয়ারি ১৯১৩ - ৫ ডিসেম্বর ১৯৪১) শিল্পকলার জগতে একটি বিতর্কিত অণুগল্পের নাম। মাত্র ২৮ বছরের যাপিত জীবনের সেই অণুগল্পটির যদি একটি কাল্পনিক নাম দিতে বলা হয়, তবে সেটা হতে পারে -‘মোহনা’। সমুদ্রে পড়বার পূর্বমুহূর্তে, যে মোহনাতে এসে থমকে গেছে দুটো ভিন্নধর্মী স্রোতধারা। অমৃতার শিল্পশৈলীও ব্যতিক্রম নয়, সেই মোহনার মতোই সেটি, যেখানে মিলিত হয়েছে পাশ্চাত্যের শিল্পশৈলী ও প্রাচ্যের শিল্পশৈলী। তবে এই দুই শিল্পশৈলীর শৈল্পিক সঙ্গমে নতুন কোনো চিত্রশৈলী সৃষ্টির পূর্বেই শের-গিলকে প্রস্থান করতে হয়েছে জীবনের মঞ্চ থেকে। অমৃতার শিল্পসৃষ্টির শৈলী এবং অমৃতার জীবন যাপনের ধরন, দুটোই ছিল এই উপমহাদেশীয় ঐতিহ্যের ও প্রথাগত শিল্পচর্চায় একটি প্ররূঢ় প্রতিবাদ সরূপ। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে যা ছিল বেশ বিশৃঙ্খল আর সমালোচকের ভাষায় তিনি ছিলেন, ‘অতি আত্ম-সচেতন আত্মাম্ভরিতাপূর্ণভাবেই শৈল্পিক’।

অমৃতা তাঁর যাপিত জীবনে, কেতাদুরস্তিতে, সর্বোপরি সৃজনশীলতায় পরস্পর বিরোধী এক বৈপ্যরিত্যের চর্চা করে গেছেন।   ভারতের ইতিহাসের অমাবস্যার মতো গভীর এক অন্ধকার সময়ে অমৃতা তাঁর নাক্ষত্রিক উজ্জ্বলতা নিয়ে আসেন সেই অন্ধকারকে কিছুটা বিশ্রাম দিতে। কিন্তু সমসাময়িক সময়ে  শের-গিল ছিলেন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, তিনি উপমহাদেশের শিল্পী মহলে ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও প্ররোচনাদায়ী শিল্পী, হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যদিও ভারতীয় শিল্পজগতে  অমৃতার জীবন ও শিল্পকর্ম  আজও গভীর আরাধ্যের বিষয়।

চিত্র ২ : বাবা-মায়ের সাথে শিশু অমৃতা,  বুদাপেস্ট, হাঙ্গেরি, ১৯১৩

অমৃতা জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাঙ্গেরির  বুদাপেস্ট শহরে।  মা, মারি আন্তোয়ানেত গটেসমান-এরডোবাকট ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভুত, ইহুদী এবং  একজন অপেরা শিল্পী। বাবা সরদার উমরাও সিং শের-গিল ছিলেন ভারতীয় শিখ, অভিজাত পরিবারের সন্তান। তিনি  ছিলেন  সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষার পণ্ডিত এবং আলোকচিত্রী। শুধু অমৃতাই তাঁর আলোকচিত্রের বিষয়বস্তু ছিল না, স্ত্রী এবং কনিষ্ঠ কন্যা সন্তানকেও তিনি তাঁর আলোচিত্রের মাঝে অমর করে রেখেছেন।  যদিও অমৃতার জীবনে তাঁর মায়ের প্রভাব ছিল প্রবল, কিন্তু বাবাও ছিলেন অমৃতার সৃজনশীলতার যাত্রার সহযাত্রী এবং গুরু। মায়ের তত্ত্বাবধানে অমৃতার শৈশব কাটে হাঙ্গেরিতে । সুতরাং  তাঁর শিক্ষা ও মননের ভিত্তি ছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতি। পরবর্তী সময়ে অমৃতা সুদূর ইউরোপ থেকে নানা ধরনের শিল্প-সংস্কার বয়ে এনেছিলেন ভারতের মাটিতে। বর্তমান সময়ে অমৃতা আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি সম্পন্ন শিল্পী হলেও তাঁর মায়ের দেশ হাঙ্গেরির অনেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম জানলেও অমৃতার সম্পর্কে অবগত নন তেমনভাবে। অমৃতা যেমন তাঁর পিতার মতো ভিজুয়াল মাধ্যমে পারদর্শী হয়ে উঠছিলেন তেমনি মায়ের মতো অপেরার অতি নাটকীয়তাও ছিল তাঁর স্বভাবজাত।  

চিত্র ৩ : বিভিন্ন সময়ে  আঁকা অমৃতার আত্মপ্রতিকৃতি

অমৃতার জীবনটি সংক্ষিপ্ত হলেও বহু ঘটনায় পরিপূর্ণ, জীবনের একদিকে ছিল বেশ উন্নাসিক ও কিছুটা মানসিক ভারসম্যহীন মা আর অন্যদিকে শীতল,  রক্ষণশীল বাবা। এমন দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী শক্তির টানাপড়েনের মাঝে, দোদুল্যমান এক পরিস্থিতিতে অমৃতা নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন শিল্পকলার আশ্রয়ে। আত্মপরিচয়ের সংকটের মুখে আত্মগ্লানিতে ভুগেছেন এবং কাটিয়েছেন এক বোহেমিয়ান জীবন। হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, ইতালি, তুরষ্ক এবং  ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি  ‍ছুটে বেড়িয়েছেন শান্তির খোঁজে। তাঁর সেই অব্যক্ত চিন্তাভাবনাগুলো শৈশব থেকেই ডায়েরিতে লিখে রাখতেন, চিঠিপত্রতেও লিখতেন। অমৃতার চিঠি ও ডায়েরি থেকে তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। তাঁর সৃষ্টিশীল প্রকৃতির বাইরে ঠিক বিপরীত একটি প্রকৃতি ছিল। তিনি বাচনে ছিলেন ধারালো, অন্তরে নিষ্ঠুর, এবং প্রকটমাত্রায় বিশ্লেষণী । তাঁর পারিপাশ্বির্কতা নিয়ে ক্রমাগতভাবে কটাক্ষ করে গেছেন তাঁর লেখনিতে। শের-গিল পিতামাতার কাছ থেকে শৈল্পিক সংবেদনশীলতা ছাড়াও প্রথাগত মানুষদের নিশেষাধাজ্ঞামূলক প্রতিক্রিয়ার প্রতি একটি প্রকৃতিগত উদ্বেগশূন্যতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন।

চিত্র ৫ : অমৃতার ভারতীয় শৈলীতে আঁকা ভারতীয় নারীরা ও ইউরোপীয় শৈলীতে আঁকা নগ্ন আত্মপ্রতিকৃতি

শৈশবে অমৃতার প্রতীভা নজরকাড়ে মামা, বিখ্যাত ইন্ডোলজিস্ট এরভিন বাকটাইয়ের। তিনি অমৃতার মাকে পরামর্শ দেন মেয়ের প্রতিভাকে পরিচর্যা করতে। ভারতে সাধারণত যেমন হয়ে থাকে,  প্রতিভা বাস্তবায়নে তাকে সক্ষম করেছিল  সুবিধাজনক সামাজিক অবস্থান। মাত্র এগারো বছর বয়সে, একটি চিত্রকর্মের জন্য, অমৃতা ৫০ রুপি অর্জন করেছিলেন জীবনের প্রথম পুরস্কার হিসেবে।  খুব অল্প বয়সেই অমৃতা নিজেকে একজন  মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে পরিচিত করে তোলেন এবং শিল্পী হিসেবে তিনি বেড়ে উঠতে চেয়েছিলেন প্রথা ভাঙ্গার দলে। সেই প্রক্রিয়ায় অমৃতাকে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। অমৃতাকে ইউরোপীয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রদানের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হন তাঁর মা। অবশেষে ১৯২৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে অমৃতাকে প্যারিসের ইকোল দে বোজার্টে ভর্তি করানো হয় শিল্পকলার প্রশিক্ষণের জন্য । প্যারিস তাঁর জন্য ছিল স্বর্গতুল্য; শিল্পকলা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি স্টুডিও সময় এবং  ক্লাসের পরে গ্যালারি বা মিউজিয়ামে সময় কাটানো এবং সেখান থেকে বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকর্ম থেকে শিক্ষা নেওয়া। সব কিছুই ছিল অমৃতার জন্য আনন্দের এবং উপভোগ্যের। অমৃতা সেখান থেকে ইমপ্রেজনিজম, পল গগ্যাঁ, পল সেজান, ব্রুগেল থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন গভীরভাবে। পরবর্তী সময়ে তাঁর কাজে আমরা তাদেরই প্রভাব দেখতে পাই।  হাঙ্গেরীয় চিত্রীশৈলীরও  মৃদু প্রভাব দেখা যায় তাঁর কাজে।

প্যারিসে আসার তিন বছর পর শের-গিল প্রথম একটি বড় ক্যানভাস শেষ করেন, ব্যক্তিগত কক্ষে দুজন তরুণী ( ইয়ং গার্লস, ১৯৩২)। যদিও শের-গিলের কাজে দুই তরুণীর মধ্যে পরিচিত অন্তরঙ্গতা, একজন নগ্ন, খোলা ঢেউ খেলানো সোনালি চুল, অন্যজনের কালো চুল চমৎকার করে বাঁধা এবং সুন্দর করে কাপড় পরা, যার কোলে চেরি ফল ভর্তি একটি বাটি, দেখলে খুব স্বাভাবিক মনে হয়, গোপন কোনো স্থান থেকে লুকিয়ে দেখে তৃপ্তি পাবার মতোদৃশ্য  মনে হয় না। এই কাজটির জন্য পাওয়া প্রশংসা শের-গিলকে সবচেয়ে অল্পবয়সী, এবং কেউ বলতে পারেন প্রথম এশিয়, চিত্রশিল্পী হিসাবে গ্রাণ্ড সালোনের একজন অ্যাসোসিয়েট হিসাবে নির্বাচিত করেছিল। ইউরোপীয় জীবন ধারার প্রতিটি বিষয়ের প্রতি শের-গিলের গভীর অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও, তাঁর ২০ বছর বয়সে ইউরোপ এবং এর সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আগ্রহ ম্লান হতে শুরু করেছিল যেন। শিকড়ের প্রতি তীব্র টান অনুভব করছিলেন এবং অবশেষে ভারতের মাটিতে পা রাখেন ১৯৩৪ সালে।

চিত্র ৪ : অমৃতার এই চিত্রটির জন্য গোল্ড মেডেল অর্জন করেছিলেন, প্যারিস, ১৯৩২

অমৃতা  প্রাণোচ্ছল একজন শিল্পী, বৌদ্ধিক চক্রে যার উপস্থিতি, তারপরেও এই সালেই একটি উসকানিমূলক মন্তব্যে বলেছিলেন, ‌‘ইউরোপ হচ্ছে পিকাসো, মাতিস, ব্রাক এবং অন্য বহু শিল্পীদের, কিন্তু ভারত শুধু আমার।’ তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে, তিনি বেঙ্গল স্কুলের ( ১৯২০) সমালোচনার উত্তর দিচ্ছিলেন, তাঁর কাজের মাধ্যমে। লোকজ শিল্পকলা এবং মোগল মিনিয়েচার চিত্রকর্ম, এবং সেই সাথে পারস্য থেকে জাপান অবধি শিল্পকলার ঐতিহ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত বেঙ্গল স্কুলের নেতৃত্বে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১- ১৯৫১) এবং নন্দলাল বসু (১৮২২-১৯৬৬)। বহু দশক ধরেই বেঙ্গল স্কুল ভারতীয় শিল্পকলার জগতে প্রাধান্য বিস্তার করে এসেছিল, এবং স্বাধীনতার পর এটি নতুন এই জাতির নিজস্ব ঘরানার শৈলীতে রুপান্তরিত হয়েছিল । শের-গিলের মনে করতেন তাদের বহু চিত্রকর্মের রোমান্টিকতা এবং অতি-জটিলতা বিষয়টির শিল্পীর সৃজনশীল সত্তার উপর ‘সংকীর্ণতায় রুদ্ধ এবং ‘পঙ্গু’ করে দেওয়ার মতো একটি প্রভাব আছে। অনেক কিছু যা আঁকা হয়েছে তা প্রয়োজনীয় নয়, এই কাজগুলো মূলত শূন্য খোলসের মত, যদি অজন্তা চিত্রকর্মের মতো প্রাচীন কাজ কিংবা তাঁর ১৯৩৭ সালে দক্ষিণ ভারতে অধ্যয়ন করা দেয়ালচিত্রগুলোর মতো ‘শস্যদানা বা ফলের ভিতরকার শাঁসের’ সাথে সেগুলো তুলনা করা হয়।

অমৃতার শিল্পকলায় যৌনতা এবং বিষণ্ণতার প্রাধান্য ছিল। নিজের  দুর্বলতা এবং  অনাক্রম্যতাকে আচ্ছাদিত করেননি তিনি এমনকি নিজের শরীরকেও উন্মুক্ত করতে দ্বিধা করেননি;  সমসাময়িক ভারতীয় নারীদের থেকে অবশ্যই সেটি ছিল ব্যতিক্রম। তাঁর শিল্পচর্চার বিষয়বস্তু মূলত মানবশরীর বা প্রতিকৃতি হলেও কিছু ভূদৃশ্যও নির্মাণ করেছিলেন। তবে প্রতিকৃতি রচনায় তিনি ছিলেন পারদর্শী। আত্মপ্রতিকৃতি ছাড়াও তিনি আরো অনেকেরই প্রতিকৃতি এঁকেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে।  সামনে বসা মানুষটির মুখের অভিব্যক্তিকে তিনি তুলির আঁচড়ে  ফুঁটিয়ে তুলেছেন দক্ষতার সাথে। অমৃতার প্রতিকৃতিগুলো বাস্তববাদীতার নমুনা। অল্প সময়ের মধ্যে সমাপ্ত করা চিত্রগুলিতে তুলির আঁচড়গুলো অমসৃণ, কিন্তু তিনি অল্প আচড় ও সীমিত সংখ্যক রঙের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হতেন তাঁর সামনে বসা মডেলদের অবয়ব বা শরীর। তবে ভূদৃশ্য নির্মাণে তাঁর বেশ অলসতা দেখা যায়। সেক্ষেত্রে কাজগুলোতে বেশ জড়তার আভাস মেলে। এবং প্রকৃতি ছাড়াও অসংখ্য মানুষ ও পশু-প্রাণীতে ঠাসা তাঁর ভূদৃশ্যগুলো।  রঙের ক্ষেত্রে মলিন ও গাঢ় রঙের ব্যবহার লক্ষ্যনীয়। অমৃতার কালার-প্যালেটে ছিল ধূসর, বাদামি, সবুজ, বাদামি লাল ও বাদামি কমলা এই ধরনের প্রাকৃতিক রঙের প্রাধান্য।
 

নারীশরীর ও জীবন তাঁর ক্যানভাসের সাথে একাত্মা হয়ে আছে। অমৃতার ইউরোপীয় ভাগের কাজগুলোতে ইউরোপীয় বাস্তববাদিতার প্রভাব সুস্পষ্ট। এবং সামনে বসা মডেলকে তিনি এঁকেছেন সত্যিকার রক্ত-মাংসের মানুষ রূপে, কিন্তু ভারতীয় পর্বের চিত্রগুলোর মডেলগুলোকে তিনি এঁকেছেন বেশ জড়তা নিয়ে, যেন ভারতীয় শৈলীকে তুষ্ট করতে এমনটি করা। তিনি অজন্তার গুহাচিত্রগুলো পরিদর্শন করার সুযোগ পান এবং গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন। ভারতের মিনিয়েচার ঘরানার চিত্রকর্ম, বিশেষ করে পাহাড়ি শৈলী থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তিনি এমন কিছু করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা ভারতে ছিল দ্বিগুণ পরিমাণে বৈপ্লবিক। শিল্পী এম এফ হুসেইন (১৯১৫-২০১১) পরবর্তী সময়ে অমৃতার অবস্থানকে চিহ্নিত করেছিলেন ‌‌‘ভারতীয় শিল্পকলার রাণী’ হিসেবে। ১৯৩৭ সালে লাহোরে তাঁর প্রথম ও শেষ একক চিত্র প্রদশর্নী অনুষ্ঠিত  হয় ।

চিত্র ৬ : অমৃতার ভারতীয় শৈলীতে আঁকা কিছু চিত্রকলার উদাহরণ

 

অমৃতা তাঁর নাতিদীর্ঘ জীবনে সৃষ্টি করে গেছেন অসংখ্য অসাধারণ শিল্পকর্ম। যাদের অনেকগুলোই অনেক ক্ষেত্রে উপমহাদেশের জন্যছিল সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রার এবং নতুনত্বের প্রয়াস। অমৃতার শিল্পযাত্রাকে অনুসরণ করবার পূর্বে আমাদের একটু ফিরে দেখতে হবে অতীত-ইতিহাসের দিকে, সেই অতীতে নয়, সে অতীত থেকে অমৃতা এসেছেন, সেই অতীতে যেখান থেকে অমৃতা নিয়েছেন অনুপ্রেরণা। অমৃতাকে শিল্পী রাজা রবি বর্মার (১৮৪৮-১৯০৬) যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় সহজেই। যিনি ইউরোপীয় প্রাতিষ্ঠানিক শৈলীতে, বাস্তবাদীতার আলোকে শিল্প সৃষ্টি করতেন । যখন বেঙ্গল স্কুলের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের যে জোয়ার আসে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭৬-১৯৪১) নিজ কাঁধে দায়িত্ব তুলে নেন উপমাহদেশের শিল্পকলাকে আধুনিকতার আলোতে আনতে। শিল্পকলার ইতিহাসবিদ পার্থ মিত্রের মতে রবীন্দ্রনাথের পরই অমৃতার অবস্থান ভারতে আধুনিক শিল্পকলার পরিচিতি ঘটানোর জন্য। তবে একথা ভুললে চলবে না,  শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন (১৯১৪-১৯৭৬) ৪৩-এর দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে আধুনিক শিল্পধারার জন্ম দিয়েছিলেন কলকাতার রাস্তায়। যদিও আজও অমৃতাকে অনেকেই ভারতীয় আধুনিক শিল্পকলার প্রধান মানবী বলে মনে করেন। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী  অমৃতা শুধুমাত্র হাঙ্গেরি থেকে ভারতে বয়ে এনেছিলেন এক পশলা ইউরোপীয় সতেজ হাওয়া। তিনি ভারতীয় সমাজের হৃদস্পদন সঠিকভাবে অনুধাবন করবার পূর্বেই অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু বরণ করেন, শিল্প সৃষ্টিই শেষ বছরগুলোয় তাঁর মানসিক স্থৈর্যের উৎস ছিল। ভগ্নীপুত্র শিল্পী ভিভান সুন্দারাম অমৃতার অসমাপ্ত অভিযানের যোগ্য উত্তরসূরি আজ।

চিত্র ৭ : অমৃতার শেষ ও অসমাপ্ত চিত্রকলা, লাহোর, ১৯৪১

 

যদিও অমৃতার অকাল মৃত্যুর কারণ বলে মনে করা হয়, তাঁর একের অধিক গর্ভপাত এবং  শারীরিক জটিলতা । সমসাময়িক শিল্পী মারিনা আব্রাহমভিচ (১৯৪৬-) এবং ট্রেসি এমিন (১৯৬৩- ) বা আরো পেছনে ফিরে দেখলে  ভাস্কর কামিল ক্লদেল (১৮৬৪ - ১৯৪৩) এবং শিল্পী ফ্রিদা কাহলো (১৯০৭ - ১৯৫৪), আরো অনেক  শিল্পীর জীবনে গর্ভপাতের ঘটনা ঘটেছে; স্ব-ইচ্ছায় বা শারীরিক ত্রুটির কারণে। তবুও তার প্রভাব সবাই ভিন্ন ভিন্নভাবে মোকাবিলা করেছেন একজন নারী হিসেবে। তারপরও তারা সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছেন। এই অপ্রতিরোধ্য শিল্পীকে প্রতিরোধের দেয়াল তুলে দেয় পরিবার বা সমাজ এমনকি শেষ পর্যন্ত নিয়তিও তাঁর পথের সামনে মৃত্যুর পর্বত গড়ে দেয়, সেই পর্বতকে পার করবার আর কোনো শক্তি তাঁর অবশিষ্ট ছিল না তখন।

চিত্র ৮ : রেখাচিত্রে আঁকা অমৃতার আত্মপ্রতিকৃতি

একজন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন না, যতক্ষণ না তিনি নিজেই নিজের গন্তব্য হন। মানুষ মৃত্যু অবধি ক্রমাগতভাবে হাঁটতে থাকে সেই গন্তব্যের দিকে। অমৃতা শৈশব থেকেই নিজের গন্তব্যটা খুঁজে পেয়েছিলেন এবং সেটাই ছিল তাঁর জীবনের সার্থকতা।এভাবে তিনি পরবর্তী ভারতীয় প্রজন্মকে আশীর্বাদপুষ্ট করেছিলেন সেই সংস্কৃতির দূর্লভ একটি উত্তরাধিকারে : স্বাধীন সৃজনশীল একজন নারীর উদাহরণ। অমৃতার  যৌনস্বাধীনতা, অতিআধুনিক জীবন যাপন, দাম্ভিকতাপূর্ণ আচরণ, ক্রমাগত আত্মপ্রতিকৃতির চিত্রায়ন,  অমৃতাকে ‘ভারতীয় ফ্রিদা কাহলো’র খেতারবটি নিতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু মূলত অমৃতা তুলনাহীনা এবং উপমহাদেশের আধুনিক শিল্পধারার আলোকবর্তিকা বহনকারিণী হিসেবে তাঁর নামটি শ্রদ্ধাভরে স্মরণের যোগ্য। তাঁর মৃত্যুর প্রায় আশি বছর পর বর্তমান সময়ে, অমৃতার শিল্পকর্ম ভারতের জন্য জাতীয় সম্পদ সরূপ।  তাঁর শিল্পকর্মগুলোকে রক্ষা করবার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, এবং তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে কোনো ধরনের বাণিজ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।  এটাই প্রমাণ করে অমৃতা যে মোহনার সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন, তার  মহাসমুদ্রে আজকে নির্ভয়ে সাঁতরে বেড়াচ্ছেন নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা, নিশ্চিতভাবে স্রোতের বিপরীতে তাঁদের অবস্থান।