অগ্রন্থিত ছফা

ঝড়টা কখন আসে

Looks like you've blocked notifications!

সংস্কৃতির দাবি- চলুন হয়ে উঠি। নদী যেভাবে প্রবাহিত হয়, ফুল যেভাবে ফুটে ওঠে, সকালে আকাশের পূর্বদিক রাঙ্গিয়ে অংশুমান যেমন ঝলক দেয় তেমনি চলুন হয়ে উঠি। সংস্কৃতি মানুষের দ্বিতীয় নিসর্গ। নিসর্গের সঙ্গে ঘষায়-মাজায় সংশ্লেষেবিশ্লেষে নিসর্গের অন্তর থেকে ননীর মতো যে জিনিশটি ঝলক দিয়ে জেগে ওঠে সেটাকে সংস্কৃতির মর্মশাঁস হিশেবে গ্রহণ করতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। ভাওয়াইয়া গানে উত্তরবঙ্গের নিধুয়া পাথার ডেকে আনে। ভাটিয়ালিতে নদীর দীঘল বাঁক মূর্তিমান হয়। এগুলো তো কেউ বানায়নি। ভেতর থেকে হয়ে উঠেছে। সংস্কৃতি সবসময় ভেতর থেকে হয়ে ওঠে। সংস্কৃতিতে ওপর থেকে চাপানোর কোন ব্যাপার থাকতে পারে না। ওপর থেকে জোরজবর করে কোন কিছু চাপালে সংস্কৃতির শরীর চিকিৎসাবিজ্ঞানের এন্টিবডির মত সেটা পরিহার করে। অস্বাভাবিক অপরিমিত জীবনের সঙ্গে খাপ খায় না এমন কোন উপাদান সংস্কৃতি সচরাচর গ্রহণ করে না।

 রাজনীতির ব্যাপারটি একটু ভিন্ন। রাজনীতির উৎসও সংস্কৃতির মতই- একই রকমের মানুষ। কিন্তু রাজনীতির দাবিটা একটু ভিন্নরকম। রাজনীতি সমাজের মানুষকে দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু কাজ করিয়ে নিতে চায় এবং সেজন্যে রাজনীতিকে নির্দেশ দিতে হয়- এটা কর ওটা কর। তুমি যদি রাজি না হও রাজনীতি তোমাকে শাস্তি দিতে পারে, দেশদ্রোহী আখ্যা দিতে পারে। তুমি মনে মনে রাজি না হতে পার, বলতে পার কাজটা ঠিক ন্যায়সঙ্গত হচ্ছে না-এতে করে রাজনীতির কিছু যায় আসে না। যতকাল রাজনীতির লোকদের হাতে ক্ষমতা থাকবে কিংবা ক্ষমতায় চড়ার জন্যে একটা বদ্ধমতের চর্চা নিরন্তরভাবে করে যাবে ততক্ষণ তোমার নিস্তার নেই।

 রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যে জিনিশটার সম্পর্ক সেটা জোর। এ জোরটা রাজনীতির লোকরা সচরাচর সম্পূর্ণ নিষ্ঠুরতা সহকারে প্রদর্শন করতে চান না। জোরটা জোর হিশাবে প্রয়োগ করলে বর্বরতায় পর্যবসিত হয়। রাজনীতির লোকদের সে জ্ঞানটা টনটনে। ক্ষমতা দখল করার জোরকে মিষ্টি জিনিশ হিশাবে দেখাবার জন্যে নানারকম ফন্দিফিকির করতে তাদের আটকায় না। কখনো দল, কখনো দেশ, কখনো কখনো জাতি- এ সমস্ত ঢোলা ঢোলা প্রতীতি সামনে টেনে নিয়ে এসে তারা ঘোষণা দিয়ে বসেন, আমরা এই পবিত্র প্রতীতিপুঞ্জের সতীত্ব রক্ষা করার জন্যে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছি। কিছু উগ্র মানুষের সমর্থন যখন তাদের ভাগ্যে জুটে যায় তারা নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সবান্ধবে সংস্কৃতিধর্ষণের কর্মটা প্রচণ্ড উল্লাসে করতে থাকে। নাৎসি যুগ, ফ্যাসি যুগ, কমুনিস্ট যুগ থেকে শুরু করে পাকিস্তান যুগ পর্যন্ত আমরা নানাভাবে, নানাদেশে সংস্কৃতি [ধর্ষণের] প্রক্রিয়াটি প্রত্যক্ষ করেছি।

এমন একটা সময় ছিল যখন মনে করা হত টলস্তয়ের চাইতে গোর্কি বড় লেখক, দস্তয়েভস্কি কোন লেখকই না, সেবাস্টিয়ান বাখের চাইতে রিচার্ড বাহগনার বড় শিল্পী- কেননা হিটলার তাঁকে পছন্দ করেন। নাৎসী কুলটুরের সঙ্গে বাহগনারের শিল্পচিন্তার মিল আছে। এই ভারত উপমহাদেশে কি তার ঢেউ লাগেনি? এমন একটা সময় ছিল প্রগতিশীল বলে কথিত সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষকে চিন্তা করতে হয়েছে কার লেখা পড়ব- রবীন্দ্রনাথ না সুকান্ত? আজকে এগুলো হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু সে সময়ে এগুলোর প্রাসঙ্গিকতা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। সংস্কৃতিকে যদি নদী মনে করি [তার] দুই পাড়ে মরা জন্তুর অস্থি এবং দাঁতের মত এ রকম বিস্তর সাংস্কৃতিক অপচেষ্টার প্রমাণ আমরা কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারি না।

স্বাস্থ্যের কথা মানলে রোগের কথাও মানতে হবে। সংস্কৃতির সঙ্গে অসংস্কৃতি তো থাকবেই। আমি স্বতস্ফূর্ততার বদলে আত্মগোপনকারী ছদ্মবেশী শক্তি-প্রয়োগকে অসংস্কৃতি বলতে চাচ্ছি। রাজনীতি যখন শুদ্ধ, সৎ এবং মানবিক হতে চায় তখন সংস্কৃতির কাছে নতিস্বীকার করে। সে রাজনীতি উৎকৃষ্ট যা সংস্কৃতির দূষণ পরিহার করে এবং সংস্কৃতিকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করে। আমি বলব সে রাজনীতি পরিত্যাজ্য যা সংস্কৃতির ভেতরে পশু-আবেগ চারিয়ে সংস্কৃতির চেহারায় পরিবর্তন ঘটায়, প্রাণস্পন্দনে জড়তার সৃষ্টি করে এবং কিছু জরদ্‌গব ব্যক্তিকে সেই সংস্কৃতির মুখ্য প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করার কাপালিক প্রয়াসে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। এটা স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, এটা রোগ- জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন, ‘কতিপয় গলগণ্ড ফলিয়াছে ...’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

যদি কেউ মনে করে আমার দলের লোকদের দিয়ে আমি আলোকিত আকাশের সমস্ত অঞ্চলটাই দখল করে ফেলব, আমার বলার কিছুই থাকবে না। অন্যেরা যখন মনে করছে, নিশ্চয়ই তার মধ্যে কোন সত্য খুঁজে পেয়েছে। আবার কেউ যদি বিনীতভাবে বলে আমার জীবনের সমস্ত কর্মের মধ্যে সৃষ্টির একটা গহন সুর বেজে উঠেছে সে কারণে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আমাকে আদর করে বুকের কাছে ধরে রাখবে- সেটাও এক ধরনের উপলব্ধি। কিন্তু সবসময়ের নয়। কারণের মনুষ্য সমাজে সবসময় মনুষ্যচেতনা সোনার ধান হয়ে ওঠে না। পোকামাকড় সাপবিচ্ছু হয়ে উড়তেও বা বাধা কোথায়? আজকে আমাদের দেশে শিল্প-সাহিত্যের নামে পত্রিকার মাধ্যমে নামফাটা লোকেরা যে সব জিনিশ লিখছেন ওগুলো পোকামাকড়, উকুন, ছারপোকার চাইতে উৎকৃষ্ট কিছু একথা আমি কবুল করতে পারব না।

হ্যাঁ, কথা উঠতে পারে- তুমি কি করছ? আমার বিনীত জবাব- পোকামাকড়েরা যখন শতাব্দীর ওপর তাদের ছোট শরীরের ছায়াটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘকায় করে প্রসারিত করছে আমি সেই প্রক্রিয়াটির একটা মানসিক প্রতিবাদ প্রাণের ভিতর নির্মাণ করছি। মানুষ প্রাণবান জীব, প্রাণের সত্যসন্ধ প্রেরণা প্রাণের উপর আপনি প্রভাব বিস্তার করে, তর্কে যেতে মন চায় না। তর্কের মাধ্যমে যদি সত্য, সৎ এবং যুক্তিপূর্ণ কোন কিছু প্রতিষ্ঠা করা যায় তর্কের একটা সার্থকতা থাকে। যে তর্ক করে কোন ফল হবে না, তা করে লাভ কি! আমি চুপ করলাম, আমাদের বুড়ো, আধবুড়ো, মোড়ল, সর্দারদের হাতে লাঠিঠ্যাঙ্গা, অপরিপক্ক বালক এবং হিজড়া গুণীজনদের তুলে দিলাম। তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে আমাদের এই শ্লেষ্মাক্রান্ত কবিকুলের কণ্ঠে কোন প্রাণবান বাক্যশিশু জন্মাবে কি না সেই দূরাশায় বসে আছি।

আমার খুব ভয় হয়। কেন বলি। ১৯৯১ সালের উপকূলীয় প্লাবনে দলে দলে মরে যাওয়া গরুমোষ আমি দেখেছি। আমাদের আস্ফালনশীল বাক্যনবাবদের কথাবার্তা শুনলে ঝড়ের হাতে পাইকারীভাবে নিহত অসহায় গোমোষদের কথা স্মরণে আসে। এদের ভাগ্যও একইরকম। অপেক্ষা ঝড়টা কখন আসে।

(রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৪ এপ্রিল ১৯৯৪ সালে, বাংলাবাজার পত্রিকায়। রচনার মাঝে বন্ধনীর মাঝে শব্দগুলো যোগ করেছেন ‘অগ্রন্থিত ছফা’র সম্পাদক সলিমুল্লাহ খান। তাঁকে সহযোগিতা করেছেন প্রিয়ম পাল।)