উৎপল বসু আমার প্রিয় কবি নন, কিন্তু...
কবি উৎপল কুমার বসু চলে গেলেন, গত ৩ অক্টোবর। হাংরি গোষ্ঠীর সদস্য উৎপল বাংলা কবিতার অন্যতম মৌলিক কবি। আশির দশক থেকে বাংলাদেশের কবিকূলকে কলকাতার যে দুই কবি সবচে প্রভাবিত করেছেন তার মধ্যে আছেন তিনি এবং বিনয় মজুমদার।
উৎপলকে নিয়ে এই হ্রস্ব-গদ্যটি লিখেছিলাম এক যুগ আগে, ২০০৩ সালে। এটি পড়ে স্বয়ং কবি লেখককে ‘দুষ্টু’ বলে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। লেখাটির কানাকড়ি দাম এখনো ফুরিয়ে যায়নি বলে পাঠক-পাঠিকার জন্য পুনঃনিবেদন।
১
আমাদের জানা বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন চর্যাপদের ভাষ্য অনুসারে, বাংলা কবিতা, যাত্রা শুরু করেছিল শ্রমজীবী ও নিপীড়িত মানুষের বেদনার সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে। তাদের কান্না-ঘাম-ক্ষুধা- শোক-বঞ্চনার গভীর বয়ান ছিল তাতে। তারপর কবিতায় বহুকাল আর সেই সব মানুষের দেখা পাই না। বরং পরের দীর্ঘ ইতিহাস শোষক ও রাজন্যবর্গ নির্মিত দেবস্তুতির। মানুষ সেখানে ছিল রাজা, ধর্ম ও দৈবের দাস। যদিও এর ভেতরেও কখনো-সখনো সে নিজের মাহাত্ম্য উচ্চারণ করেছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ ধরনের, কিন্তু আমাদের কবিতায় মানুষকে মানবিক পূর্ণাবয়ব পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে উনিশ শতক পর্যন্ত। কিন্তু পূর্ণ কি হয়েছে আর? কারণ মানুষ ঈশ্বরত্ব পেয়েছে বলে মনে করলেও, এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, যোগাযোগের সুফল তার ঘরের বিছানা পর্যন্ত পৌঁছে গেলেও, মানুষ পরিণত হয়েছে নতুন দৈবের দাসে।
সেই দৈব পুঁজি, যা মানুষের ভেতরটাকে চুরমার করে দিয়েছে, যে বিশ শতকে ঘোষণা দিয়েছে স্বর্গীয় ঈশ্বরের মৃত্যু ঘটেছে পার্থিব পুঁজির হাতে; কেননা পুঁজিই বর্তমান পৃথিবীর ঈশ্বর। এই পুঁজি-ঈশ্বর বাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের ভোগপিপাসা, লোভ ও রিরংসা; কারো জন্য এনেছে অপরিমেয় ভোগ- বৈভব-বিলাস; আর অনেকের জন্য এনেছে হতাশা, অর্থহীনতা, জান্তবতা। কেমন সেই ঈশ্বর আর কেমন তার রূপ, খুব সহজ করে বোঝার জন্য রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর শরণ নেওয়া যেতে পারে।
২
উৎপল কুমার বসু আমাদের সেই সময়ের কবি, যখন জীবন আর মাহাত্ম্যবান নয়, বরং প্রায়শ সে অর্থহীন, নিরানন্দ, হাস্যকর। মানুষ এখন পুঁজির উৎপাদন-কীট। বিশ্বব্যাপী পুঁজির যে বিশাল গভীর ঘূর্ণি চলছে মানুষ তাতে কেবল পাক খেয়ে চলছে। একসময় মানুষ ছিল ধর্মের ক্রীড়নক, এখন পুঁজির। আর এই ক্রীড়া উৎপল দেখছেন পৃথিবীর এক দরিদ্র জগতের বাসিন্দা হিসেবে। তার কবিতায় সেই সব মানুষের পুঁজির হাতে, মানুষরচিত নিয়তির হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার এবং তাদের জীবনের অর্থ-অনর্থকতা, মাহাত্ম্য-অক্ষমতা, তাদের আনন্দ- বেদনা-যাতনা, হাস্য-ব্যঙ্গ-লাঞ্ছনার কথা তিনি সম্পূর্ণ নিজের তৈরি ভাষায় প্রকাশ করে চলেছেন। তার কবিতা আবেগ থরোথরো নয়। কোনো মায়াকান্না নেই তার কবিতায় তথাকথিত মানুষের জন্য শিল্পের দোহাই নিয়ে। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, এই পুঁজি ও পণ্য-আধিপত্যের যুগে মানুষও আসলে যন্ত্রসদৃশ, সেও অদৃশ্য চাকার মতো নিয়মের হাতে বন্দি হয়ে ঘুরছে এবং তার আবেগ-অনুভূতিও অনেকাংশে হয়ে পড়েছে যান্ত্রিক। ফলে, তার কবিতা আপাত অর্থে কাঠখোট্টা, এবং এক ধরনের স্বেচ্ছা-আচারী। এমনকি প্রেমের ক্ষেত্রেও তিনি কেমন যেন আবেগশূন্য। এই বস্তুভোগ-আক্রান্ত পার্থিবতায় যে আবেগ এখন অনেকটাই অনর্থক ও মূল্যশূন্য- এ কথা তার মতো করে খুব কম কবিই বুঝেছেন। তাই তার কবিতা এই সময়ের নির্মমতারই প্রতিনিধিত্ব করে।
৩
খুব স্পষ্ট করেই, উৎপল কুমার বসুর কবিতার স্বাদ নতুন। তার কবিতা বুঝতে হয় আবেগ নয়, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে; আমাদের সময়-সমাজ-রাজনীতি-বাস্তবতা ও বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার নিরিখে। কেবল কাব্যরস তার কবিতায় মুখ্য নয়, অন্বিষ্টও নয়। বরং তার রসের আকর নিহিত তার অভিজ্ঞতার জগতের সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতার সংশ্লেষের মধ্যে, তার চিন্তার সঙ্গে আমাদের চিন্তার বিরোধ বা নৈকট্যের মধ্যে। আর তার দাবি সেই সচেতন পাঠকের, যিনি কেবল কাব্যভোক্তাই নন, বরং সমাজ-সমকাল-বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতির দিকেও যার আছে সংবেদনমগ্ন নজর। তার মানে এই নয়, উৎপল কবিতা-মাধ্যম দিয়ে তত্ত্ব করতে লেগেছেন। তত্ত্ব তিনি করেন বটে, তবে তা কবিতাকে অবজ্ঞা করে নয়। তার কবিতা সর্ব অর্থেই কবিতা, উৎকৃষ্ট কবিতা। কারণ কবিতার মৌলিক শর্ত পূরণেও তিনি নিষ্ঠ।
৪
এত সব গুণপনা, অভিনবত্ব ও মৌলিকত্বের কারণে উৎপল আমার শ্রদ্ধাভাজন। এবং এ কথা সঙ্গতভাবেই মনে হয়, উৎপল বাংলা কবিতার নতুন দ্রষ্টা। আর পাঠকের চেয়ে পরবর্তী কবিদের ওপর তার প্রভাব বারবার এ কথা মনে করায়, তিনি যতটা সাধারণ পাঠকের, তারচে বেশি কবিদের কবি।
তবু আমার একটা ‘কিন্তু’ আছে।
আমি উৎপলে তৃপ্তি পাই না। কেননা যে ধরনের কবিতা আমাকে দোলায়, তাঁর কবিতা উল্লেখযোগ্যভাবেই এর ব্যতিক্রম। আর এখানেই তার বিশিষ্টতা। তার বোধ ও ভাষাভঙ্গির কারণেই তিনি আমাদের কাছ থেকে সুপ্রচুর সমীহ আদায় করে নিয়েছেন। লক্ষ করেছি, আশির দশকের নতুন-স্বপ্ন-দেখা কবিরা উৎপলকে খুব নিজের লোক বলে ভাবতেন। তাদের পথ ধরে আমাদের সময়ের কবিদেরও উৎপল ঘোরমুগ্ধ হতে দেখেছি। অনেকের কবিতায়ও উৎপল ছিলেন ঘোরতরভাবে উপস্থিত। তবে আগের মতো ঘোর এখন আর না থাকলেও এবং কেউ কেউ তাদের কবিতায় উৎপল-ঘোর কাটিয়ে উঠলেও, তিনি তার শ্রদ্ধার আসনটুকু অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, উৎপল বাংলা কবিতায় নিজের আসনটি নির্দিষ্ট করে ফেলেছেন এবং তিনি যে ‘কবিদের কবি’ এর প্রমাণ উত্তর-কবিদের ওপর তার প্রভাব।
প্রভাবের কারণ খুব পরিষ্কার। তাঁর কবিতায় যে এই সময়ের কূটরাজনীতি, মধ্যবিত্তের জীবন, তাদের ভোগবাসনা, মানুষের মনের গহন আর যাপিত জীবনের বহুরূপী অভিজ্ঞতা, তার সঙ্গে আমাদের আছে গভীর আত্মীয়তা। এমনকি তার ভাষাও অনেক সময় আমাদের চিন্তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়।
৫
উৎপল স্যাটায়ার ভালোবাসেন। কিন্তু সেসব কেবল স্যাটায়ারের জন্য স্যাটায়ার নয়। এগুলো উঠে আসে জীবনের গভীর থেকে; জীবনের হল-কোলাহল, অপ্রাপ্তি-বঞ্চনা, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, কাম-যৌনতা আর আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অনুষঙ্গের ভেতর থেকে। তবে বিষয় যতই সিরিয়াস হোক, উৎপল ঠিক ঠিক বের করে নেন তার আরাধ্য ভাষা। কান্নার ভেতর থেকেও তিনি খুঁজে নেন হাস্য ও রঙ্গ।
জীবনও তো আসলে এ রকমেরই। তাবৎ যাতনা-লাঞ্ছনার পরও জীবনকে ভালোবাসতে হয় আমাদের। অতএব, জীবনের প্রতি নিবিষ্ট উৎপল, জীবনকে আরো ঘন-বেদনার্ত করে দিতে চান না। এর ভেতর থেকেও বের করে নেন জীবনের গোপন রস।
এসব কারণেই প্রিয় কবি না হয়েও উৎপল কুমার বসু আমার শ্রদ্ধাভাজন কবি। বাংলা কবিতা তাঁকে তাঁর ঠিক আসনে বসিয়ে দিয়েছে বহু আগেই। নিঃসন্দেহে আরো বহুকাল তিনি এই আসনে অধিষ্ঠিত থাকবেন।